অচেনা সুরের ডাক

oputanvir
4.3
(27)

সকাল থেকেই আমার আজকে মনে হচ্ছিল যে খারাপ কিছু হয়তো হবে। এমনটা আমার সাথে অনেক আগে থেকেই হয়। যেদিন আমার কপালে শনির দশা থাকে সেদিন আমি আগে থেকেই বুঝতে পারি। আমি তাই মানসিক ভাবে একটা প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলাম যে খারাপ কিছু হবে। অবশ্য আমাকে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না। অফিসে গিয়েই টের পেলাম কী হতে চলেছে।
আমাদের অফিসে কর্মী ছাটাই করা হবে। পঞ্চাশ কর্মী থেকে ৩৫ জনে নামিয়ে আনা হল। ১৫ জন বাদ পড়ল। এবং আমি সেই পনের জনের দলে। আমাদের সাথে কোন আলোচনা বা কথা হল না। এমন কি আমাদেরকে কিছু বলাও হল না। কেবল জানিয়ে দেওয়া হল যে আমাদের চাকরি নেই। সামনের দিন থেকে আর আসতে হবে না। তবে একটা ভাল কাজ অবশ্য আমার অফিস করেছে। তিন মাসের বেতন এক সাথেই দিয়ে দিয়েছে। এটা নিয়ে একটু চিন্তা কম লাগছে। আগামী তিনমাস আসলে কোন চিন্তা করতে হবে না। এটাই বা কম কিসের!
তবে চাকরি যাওয়া ছাড়া বাদ দিয়েই মন খারাপ হওয়ার আরেকটা কারণ আছে। নওরিন রহমান। আমাদের অফিসের এইচআর টিমে আছে মেয়েটা। মেয়েটাকে আমি বেশ পছন্দ করতাম। টুকটাক কথাও বলতাম তার সাথে। যদিও এই কথা কখনই প্রেম বা ভাললাগার দিকে কখনই যেত না তবে আমার এই কথা বলাতেই ভাল লাগত। এই চাকরি চলে যাওয়ার ফলে মেয়েটার সাথে আমার আর কথা হবে না আর দেখাও হবে না। এটা মন খারাপের কারণ। চাকরি অবশ্য আবার পেয়ে যাবো আশা করি। এর থেকে ভাল হোক মন্দ হোক একটা কিছু জুটে যাবে তবে সেখানে তো নওরিন থাকবে না। এটাই মুলত মন খারাপের কারণ।
কয়েকটা দিন মন খারাপ নিয়েই বসে রইলাম। ঘরের বাইরে বের হলাম না। তবে শুয়ে বসে আর কয়দিন থাকতে ইচ্ছে করে। আবার নতুন করে চাকরি খোজা শুরু করতে হবে। মাস তিনের খরচ পকেটে রয়েছে। এরপরে টাকার টানাটানি শুরু হবে। তবে চাকরি খোজা শুরু আগে আমার মনে হল কয়েকটা দিন ঢাকার বাইরে গিয়ে ঘুরে আসি। সিদ্ধান্ত নিতে খুব বেশি সময় নিলাম না। ফেসবুকে বেশ কিছু ট্যুর গ্রুপ আছে। প্রতিনিয়ত তাদের নানান ট্যুরের ইভেন্ট চলমান। আলী কদম হয়ে আন্ধারমানিক যাওয়ার একটা ইভেন্ট পছন্দ কল। রিপোটিং টাইম আজকে সন্ধ্যায়। সেটাই কনফার্ম করে দিলাম। দরকারী জিনিসপত্র ব্যাগে নিয়ে সেদিন নির্দিষ্ট সময়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে হাজির হলাম।
একে একে ট্যুরের মেম্বাররা এসে যখন হাজির হল এবং তখনই আমার বিস্ময়কর ঘটনা দেখতে পেলাম। নওরিন রহমান! আমাদের গ্রুপের একজন। আমি যেমন অবাক হয়েছি তাকে দেখে সে নিজেও আমাকে দেখে অবাক হয়েছে। আমরা এখানে এভাবে একসাথে হয়ে যাবো সেটা সম্ভবত আমরা কেউ ভাবতে পারি নি।
বান্দরবান পর্যন্ত নওরিন আমার পাশেই বসে গেল বাসে। ওর সাথে টুকটাক কথা চলতে লাগল। রাতের এক পর্যায়ে সে আমার কাধে ঘুমিয়েও পড়ল। আমার তখনই মনে হল যে চাকরি চলে যাওয়াটা আমার জন্য আসলে আশির্বাদ ছিল। যদি সেদিন আমার চাকরি না যেত তাহলে আজকে আমি কোন ভাবেই এই বান্দরবানে ট্যুরে আসতাম না। আসার কোন কারণই ছিল না। আর এই ভাবে নওরিন আমার পাশে বসে এভাবে আমার কাধে ঘুমিয়ে পড়ত না। আমাদের ট্যুরটা মোটামুটি পাঁচ দিনের। এই পুরো সময়টা নওরিন আমার পাশে পাশে থাকবে এটা ভাববেই মনের ভেতরে একটা আলাদা আনন্দ কাজ করছে।
প্রথম দিনটা আমাদের বেশ ভাল পরিশ্রমেই গেল। আমি ভেবেছিলাম নওরিন হয়তো ট্যুরের ট্রেকিংয়ের কষ্টে কাহিল হয়ে পড়বে কিন্তু সে বেশ ছটফট করেই এগিয়ে যাচ্ছিল। আমিই বরং ওর সাথে তাল মেলাতে একটু হিমশিম খাচ্ছিলাম। তবে তৃতীয়দিন নওরিন আর সামনে যেতে চাইলো না। আমরা যে পাড়াতে ছিলাম আমাদের টিমটা সামনের আরেকটা পাড়াতে যাবে, কয়েকটা স্পট দেখবে তারপর রাতে থেকে এই পাড়া দিয়েই আবার ফিরে যাবে। তখন নওরিন আমাদের টিম লিডারকে বলল যে আর যাবে না। এই পাড়াতেই থাকবে। যাওয়ার পথে তাকে নিয়ে গেলেই চলবে। আমি তখন সাথে সাথেই বললাম যে নওরিনের সাথে আমিও থাকবে এখানে। আমাদের দুইজনকে এক সাথে নিয়ে গেলেই চলবে। যদিও নওরিন বারবার বলছিল যেন আমি যেন তার কারণে আমার ট্যুর মোটেই নষ্ট না করি কিন্তু নওরিন কি আর জানে আমার আসল ট্যুর আসলে কোনটা। সবার সাথে না থেকে একটা দিন পুরোটা কেবল নওরিনের সাথে থাকতে পারা আমার জন্য সব থেকে বেশি আকর্ষনীয়।
বান্দবান ট্যুরগুলোতে এই ধরণের ঘটনা স্বাভাবিক। প্রায়ই দেখা যায় যে কোন মেম্বার আর সামনে যেতে চায় না। অনেকেই সহ্যের সীমায় পৌছে যায়। তখন কেউ কেউ পাড়াতে থেকে যায়। তখন তাকে রেখেই বাকিরা ঘুরে আসে। যাওয়ার পথে আবার তাকে নিয়ে যায়। তবে নওরিন একাই এবার এই পাড়াতে থাকতে তাই আমাদের টিম লিডার একটু চিন্তিত ছিল তবে আমি যখন এক সাথে থাকতে চাইলাম তখন দেখলাম টিমলিডার একটু নিশ্চিন্ত হল। সে আমাদের রেখেই চলে গেল। তারা চলে যেতেই নওরিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি না থাকলেই পারতে। আমি একাই থাকতে পারতাম এখানে।
আমি হেসে বললাম, আরে আমার জন্য ভালই হল। আমিও আর যেতে চাইছিলাম না। একা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম তুমি যখন বললে তখন আমি যেন বাঁচলাম।
নওরিন হাসল একটু। আমরা পাড়ার চারিদিকে এক সাথে ঘুরে বেড়ালাম দিন ভর। টিমলিডার আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে গিয়ছিল। এছাড়া আমাদের নিজেদের কাছেও খাবার ছিল। তাই আমাদের খুব একটা চিন্তা ছিল না। সত্যি দিনটা খুবই চমৎকার গেল আমার। অন্যদের সাথে না যাওয়াটা আমার জন্য ভাল ছিল।
রাতের খাওয়ার পরে আমরা আরও অনেকটা সময় মাঁচার উপরে শুয়ে গল্প করছিলাম। আমার এতো চমৎকার লাগছিল যে আমি বলে বোঝাতে পারব না। নওরিন আমাকে ওর জীবনের নানান কথা বলছিল। আমি সেগুলো শুনছিলাম। আমিও নিজের কথা বলছিলাম তবে এক সময়ে আমার ঘুম আসতে লাগল। আর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
কত সময় আমি ঘুমিয়ে ছিলাম সেটা আমি বলতে পারব না। তবে আমার ঘুম এক সময়ে ভেঙ্গে গেল। আমি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না যে আমি কোথায় আছি। তবে সেটা অল্প সময়ের জন্যই। ঘুমানোর আগের কথা মনে পড়ে গেল। আমি মাঁচায় শুয়ে পড়েছিলাম। আমি উঠে বসতেই পুরো মাঁচার দিকে তাকালাম। মাঁচায় কেউ নেই। তাহলে কি নওরিন কি আমাকে রেখেই পাড়ার ঘরে ফিরে গেল?
আমিও পাড়ার দিকে যাওয়ার কথা ভাবছি তখনই আমার নজর গেল একটা টিশার্টের দিকে। মাঁচা থেকে একটু দুরে একটা পাথরের উপরে একটা টিশার্ট পরে আছে। এবং তার নিচে একটা প্যান্ট। ভাজ করে রাখা। আমার মোটেই চিনতে কষ্ট হল না যে এতা নওরিন পরে ছিল। আমি তীব্র ভাবে অবাক হয়ে গেলাম। নওরিন নিজের টিশার্ট আর প্যান্ট এখানে খুলে রেখে গেছে?
কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর আমার বোধগম্য হল না। তবে আমি এটা নিশ্চিত হলাম যে সে পাড়ার দিকে যায় নি। এই ভাবে পাড়ার দিকে যাওয়ার উপায় নেই। আমি পাড়ার উল্টো দিকের পথে পা বাড়ালাম। চাঁদের আলোতে সব রাস্তা একেবারে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আমার পথ চলতে মোটেই কষ্ট হল না। এবং কয়েক কদম যাওয়ার পরেই এবার তীব্র ভাবে অবাক হলাম। কারণ পথের ঠিক পাশে অন্তর্বাস পরে থাকতে দেখলাম। এগুলো যে নওরিনের অন্তর্বাস সেটা আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট না। আমার মাথায় মোটেই এটা ঢুকল না যে নওরিন নিজের জামা কাপড় খুলে এভাবে কেন এই পথে গেল? কী এমন কারণ থাকতে পারে?
আমি সত্যিই কারণ জানি না। আমার মনে তীব্র একটা কৌতুহল জন্মালো। নওরিন কী করছে? কেন কারছে? আমার পুরো ব্যাপারটাই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। একবার আমার মনে হচ্ছে যে আমার আর সামনে যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না কিন্তু অন্য দিকে আমার ইচ্ছে করছে নওরিন আসলে কোথায় গেছে আর কেনই বা গেছে!
আমি আস্তে আস্তে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলাম পথ ধরে। তবে আমাকে খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে হল না। আমি আরেকটু দুরে যেতেই একটা বিড়বিড় করে কোন মন্ত্র জাতীয় কিছু পড়ার আওয়াজ পেলাম। তবে সেটা সামনের পথ থেকে আসছে না। আসছে পথের পাশের খাদের দিক থেকে। যতই চাঁদের আলো থাকুক না কেন রাতের বেলা এই খাদ দিয়ে নেমে যাওয়ার ব্যাপারটা মোটেই সহজ কোন ব্যাপার না। তবে আমার কাছে আবারও কৌতুহলের জয় হল। আমি খুব ধীরে ধীরে সেই খাদের পথ ধরে নামতে লাগলাম। আমার কেন জানি মনে হল যে আমার আওয়াজ করা মোটেই ঠিক হবে না। এখানে সম্ভবত ভয়ংকর কিছু হচ্ছে। কিন্তু নিজের কৌতুহলের কাছে আবারও জয়ী হল। আমার মনে হল নওরিন কী করছে আর এই আওয়াজটা কিসের সেটা আমাকে জানতেই হবে।
আমি খুব সাবধানে নিচে নামতে শুরু করলাম। কতক নামার পরেই আমি একটা সরু পায়ে চলা পথ দেখতে পেলাম। পাহাড়ের কোল ঘেষে সেটা চলে গেছে বেশ খানিকটা অন্ধকারের দিকে। আমি ধীরে ধীরে সেই পথের দিকে পা বাড়ালাম। আমার মধ্যে এবার কোথা যেন একটা ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল। আমার মনের সচেতন অংশ বারবার আমাকে ফিরে যেতে বলছিল। বারবার বলছিল যে এই অচেনা পথে আমার যাওয়ার কোন দরকার নেই তবে আমি এগিয়েই চললাম। সেই মনে তখন নওরিনের চিন্তা। তবে এটা আমি নিশ্চিত যে নওরিনকে কেউ জোর করে নিচে নিয়ে যায় নি। জোর করলে সে ঠিক নিয়ে যাওয়ার সময়ে চিৎকার করত আর আমি ঠিকই শুনতে পেতাম। এছাড়া ওভাবে জামা কাপড় খুলেও সে যেত না। আমার কাছে এসবের ভেতরে যেন অন্য কিছু মনে হচ্ছে। কিন্তু কী যে মনে হচ্ছে সেটা আমি ঠিক মত বুঝতে পারছি না। কিংবা আমার যুক্তিবাদি মন সেটা বুঝতে চাচ্ছে না।
আরও কিছুদুর এগিয়ে যেতেই আমি দেখতে পেলাম জায়গাটা একটু যেন সমতল হয়ে এসেছে। এখানে বন জঙ্গল আর গাছ পালা বেশ বেশ ভালই আছে। ফলে এইখানে চাঁদের আলো আসছে কম। আমি আরও ধীরে ধীরে হাটতে লাগলাম। আমি সেই মন্ত্রের আওয়াজটা আরও ভাল করে শুনতে পাচ্ছি এখন। তবে এখন এই আওয়াজের ভেতরে একটা সুরও যেন আছে। কন্ঠটা যে নওরিনের সেটা আমি ভালই বুঝতে পারছি। মেয়েটা এক মনে এই মন্ত্রটা পড়েই যাচ্ছে। আমি এই সুরটা শুনতে শুনতে কেমন যেন একটু ঘোরের ভেতরে চলে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমাকে কেউ খুব কাছ থেকে ডাকছে। একটু আগের কৌতুহলের চেয়ে আমার কাছে এখন এই ডাকটা আরও বেশি আকর্ষনীয় মনে হল। আমি এগিয়েই গেলাম। তারপরই আমি নওরিনকে দেখতে পেলাম!
অন্ধকার বনভূমির মাঝে আগুন জ্বলছে। তার ঠিক সামনেই নওরিন বসে রয়েছে। মুখ দিয়ে এক ভাবে সে কিছু পড়েই যাচ্ছে। পুরো আকাশা বাতাসে সেই সুর ছড়িয়ে পড়েছে। আমি আর নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম না। আমি সোজা এগিয়ে গেলাম নওরিনের দিকে। নওরিনের মুখ থেকে সেই অপার্থিব সুর যেন আমাকে ওর দিকে টেনেই নিয়ে চলেছে। আমি কিছুতেই ওর থেকে দুরে থাকতে পারছি না। আমি দেখতে পেলাম নওরিন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। তার চোখ জোড়া যেন আগুনের আলোকে জ্বলছিল। আমি তার মুখ নড়তে দেখলাম না তবে সেই সুরটা ঠিক শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল যে আকাশ বাতাস বন জঙ্গল চারিদিক থেকে সেই সুর ভেসে আসছে। সেই সুর আমার মধ্যে এক অজানা মাদকতা জাগিয়ে তুলেছে।
এবার নওরিন উঠে দাড়ালো। আগুনের জ্বলতে থাকা শিখা ওর পুরো শরীরে একটা আলাদা আভার সৃষ্টি করেছে। আমি সেই শরীরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার আর কিছু মনে রইলো না। নওরিন ধীরে ধীরে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। আমি নিশ্চিত জানি যে নওরিন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সেটা আর যাই হোক আমার আগের অফিসের এইচআর নওরিন নয়। সে অন্য কেউ বা অন্য কিছু। আমার এখনই এখান থেকে দ্রুত চলে যাওয়া উচিত কিন্তু তার পরেও আমি এক পা নড়াতে পারছিলাম না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত নওরিনের দিকেই তাকিয়ে রইলাম কেবল।
নওরিন একেবারে আমার কাছে এগিয়ে এল। তারপর আমার চারিদিক একবার চক্কর দিল। শিকারী যেমন তার শিকারকে পর্যনবেক্ষণ করে ঠিক তেমন ভাবে সে আমাকে দেখতে লাগল। আমি নড়তে পারছি না একদম। তারপরই আমার মনে হল যেন নওরিন আমার আছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি তার দেহটা যেন আমার শরীরের সাথে মিশে গেল। এক অচেনা আবেশ আমার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক তখনই আমি আমার ঘারের কাছে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। মনে হল যেন পিপড়া কামড় দিল আমাকে। তবে সেই কামড়ের ভেতরেও যেন একটা আলাদা আবেশ রয়েছে। আমার যেন এই ব্যাথা ভাল লাগছিল।
আমার আর কিছু মনে নেই। আমার যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমি দেখলাম আমি সেই মাঁচার উপরেই শুয়ে আছি । আমার শরীরের ভেতরে কেমন একটা উদ্দম অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল যে একটা আলাদা শক্তি আমি অনুভব করছি ভেতর থেকেই। তারপরেও আমি আরো কিছু সময় শুয়ে রইলাম। তারপর উঠলাম। পুরো রাতের ঘটনাটা আমি মনে করার চেষ্টা করলাম তবে খুব বেশি কাজ হল না। আমার মনে হল যেন আমি এখানে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখেছি। বাস্তবে কিছুই হয় নি।
আমি যখন পাড়ায় ফিরে গেলাম তখন দেখতে পেলাম সেখানে আমাদের পুরো গ্রুপটা ফিরে এসেছে। আমাকে দেখে সবাই হইহই করে উঠল। আমি নওরিনকেও দেখতে পেলাম। ওদের সাথে বসে বসে গল্প করছে। আমাকে দেখে একটু হাসল। আমি খানিকটা দ্বিধা নিয়ে তার পাশে গিয়েই বসলাম। নওরিন বলল, তুমি এতো আরাম করে ঘুমাচ্ছিলে বলে আর ডাকি নি।
আমি হাসলাম একটু। দুপুরের আগেই আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম। তারপর ফেরার পথ ধরলাম। এবার নিজের চলার গতি দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। কারণ আসার সময়ে আমার বেশ খবর হয়ে গিয়েছিল পাহাড় চড়তে। তবে এখন আমার সাথে সব কিছু একেবারে পানিপানি মনে হচ্ছে। আমি তড়তড়িয়ে পাহাড়ে উঠে পড়ছিয়াম। আমাদের টিম লিডার বেশ অবাক হয়ে গেল আমার হাটার ধরণ দেখে। আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে ছিল না।
ঢাকার আসার দুদিন পরে একটা অবাক করা ঘটনা ঘটল। আমার আগের অফিস থেকে আমার বস ফোন দিল। আমাকে সরি বলে বলল যে আমি যেন আবারও এসে অফিসে জয়েন করি। কেবল তাই না আমাকে যে অগ্রিম তিন মাসের বেতন দিয়েছিল সেটা ফেরত দিতে হবে না। আমাকে নতুন ভাবে নতুন পোস্টে জয়েন করতে বলল এবং বেতনও আগের থেকে বেশি। আমার কেন জানি মনে হল এর ভেতরে নওরিনের হাত রয়েছে। কিন্তু সেটা সে আমাকে একদমই বলে না। এমন কি অফিসে জয়েন করার পরেও তার আচরণ ঠিক আগের মতই থাকে। আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
পরের মাসে আরেকটা ঘটনা ঘটল। সেদিন সকাল থেকে আমার মনের ভেতরে সেই অনুভূতিটা ফিরে এল। মনে হচ্ছিল যেন খারাপ কিছু হবে। সেদিন অফিসের কাজেই আমাকে গাজিপুর যেতে হয়েছিল। আমাদের সব ফ্যাক্টরি গাজিপুরেই। সেদিক বেশ রাত পর্যন্ত কাল চলল তবে কাজ শেষ হল না। আরও কিছু কাজ বাকি রয়ে গেল। ঢাকায় ফিরে না এসে তাই অফিসের গেস্ট হাউজে গিয়ে উঠলাম। এবং তখনই অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে নওরিন গেস্ট হাউজে এসেছে। আমার অবাক হওয়ার ভাব দেখে নওরিন হাসল। তবে কিছুই বলল না। কী কারণে সে এখানে এসেছে সেটা এড়িয়ে গেল। আমার কেন জানি মনে হল যে নওরিন এখানে এসেছে আমার জন্যই। সে যেন জানতোই যে আজকে ফ্যাক্টরি কাজ শেষ হবে না আর আমাকে এখানে থেকে যেতে হবে। আমার নওরিনের সঙ্গ ভাল লাগলেও সকালের সেই অনুভূতিটা আবারও ফিরে এল। মনে হল যেন খারাপ কিছু ঘটবে।
রাতে আরও কিছু সময় আমরা গল্প করে আমরা নিজেদের ঘরে চলে গেলাম। তবে বেশি সময় আমি ঘুমাতে পারলাম না। রাতের একটা পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি সেই সুর শুনতে পেলাম। বান্দরবানের পাহাড়ের সেই সুর। আমি কিছু সময় নিজের কানে বালিশ চেপে ধরে সেই সুর থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইলাম বটে তবে কাজ হল না। এক সময়ে আমি উঠে দাড়ালাম। তারপর সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগলাম। তারপর সেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। গেস্ট হাউজের পাশের ছিল বন জঙ্গল। আমি নওরিনকে সেই আগের অবস্থাতে পেলাম সেখানে। একই ভাবে সে আমার দিকে এগিয়ে এল আর আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপরই আমার ঘাড়ের কাছে একটা পিপড়া কামড়ের মত অনুভব করলাম। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। আবারও সেই একই ভাবে সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গল নিজের ঘরে। আমি কিভাবে এখানে এলাম সেটা আমি জানি না। আমি সেই পাহাড়ের মাচার মত করে শরীরে একটা আলাদা উদ্দমটাও অনুভব করলাম।
আমি জানি না আমার সাথে কী হচ্ছে। পরদিন আমি যখন অফিসে ফেরত গেলাম তখন একটা অবাক করার মত ঘটনা জানতে পারলাম। গত দুইদিন আমাদের অফিসের মেয়েরা গ্রুপ করে সাজেক বেড়াতে গিয়েছিল। আমি তীব্র অবাক ভাবে ওদের কথা শুনতে লাগলাম। ছবিও দেখলাম। নওরিন সত্যিই সাজেকেই গিয়েছিল। তাহলে আমি গাজিপুরে কাকে দেখলাম? কে ছিল আমার সাথে? তবে আমি কেন জানি মনে হল এই ঘটনা আমার সাথে আবারও ঘটবে!

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.3 / 5. Vote count: 27

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →