ভারত বিভক্তির সময়ে..

oputanvir future
4.3
(6)

কিছু বাংলাদেশী এবং প্রায় সব পাকিস্তানীদের মনে একটা দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে ভারত বিভক্ত হয়েছিল তাদের কায়েদে আজম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর বিচক্ষণার কারণে। তিনি না থাকলে হয়তো ভারত বিভক্ত হত না। অথচ জিন্নাহ কিন্তু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে আপোস করতে রাজি ছিলেন। ১৯৪৬ সালে যখন ক্যাবিনেট মিশন ঘোষিত হল, সেই সময়ে ঠিক হয়েছিল যে ব্রিটিশ সরকার প্রথমে অবিভক্ত ভারতকে স্বাধীনতা দেবে। তবে মুসলিমদের শাসন রক্ষার জন্য তিনটি শাসনতান্ত্রিক অঞ্চল গঠিত হত। প্রথম অঞ্চলে থাকবে পাকিস্তান বর্তমান সময়ে যে প্রদেশগুলো আছে সেই অঞ্চল । দ্বিতীয় অঞ্চলে থাকবে বাংলা ও আসাম এবং বাকি অঞ্চলে থাকবে বর্তমান ভারতের অঞ্চলগুলো। কিছু ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্র সরকারের হাতে এবং কিছু ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের রাজ্য সরকারের হাতে। প্রতি দশ বছর পরপর প্রদেশ তিনটির সামনে এই সুযোগ আসবে যে তারা স্বাধীনতা চায় কিনা !
ভারত বিভক্তির ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সম্মতির দরকার ছিল। আর কংগ্রেসের সম্মতি বলতে মহাত্মা গান্ধীর সম্মতি। গান্ধীর সম্মতির জন্য কংগ্রেসের বড় দুই নেতার সম্মতির প্রয়োজন ছিল। একজন হচ্ছেন, জওহরলাল নেহেরু এবং অন্য জন হচ্ছেন বল্লভভাই প্যাটেল। এই দুইজন রাজি না হলে গান্ধীও রাজি হতেন না ভারত বিভক্তিতে। জহরলাল নেহেরু ভারত বিভক্তির তীব্র বিরোধী ছিলেন। তবে নেহেরু এক সময়ে রাজি হয়েছিলেন এবং এর পেছনে একজন মায়াবী সুন্দরী বিদেশিনীর হাত ছিল। তিনি ছিলেন লেডি এডউইনা মাউন্টব্যাটেন। নেহেরুর সাথে তার প্রনয়ের সম্পর্ক ছিল। এডউইনাই নেহেরুকে ভারত বিভক্তির ব্যাপারে রাজি করিয়েছিলেন।
এডউইনার জন্ম ১৯০১ সালে এক বনেদী লর্ড পরিবারে । বিশ বছর বয়সে এডউইনা তার নানার রেখে যাওয়া ২০ লক্ষ পাউন্ডের মালিক হন। সেই সময়ের ২০ লক্ষ পাউন্ড এই সময়ে কত হতে পারে একবার কল্পনা করে দেখুন। এদিকে লুই মাউন্টব্যাটেন ছিলেন রানী ভিক্টরিয়ার নাতনি। তাদের বিয়ে হয় ১৯২২ সালে। এবং বিয়ের কয়েক বছর পরেই তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে ওঠে। লোক দেখানো সম্পর্ক ঠিক রেখে তারা দুজনে ব্যক্তিগত জীবনী নিজেদের মত থাকতে শুরু করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে মাউন্টব্যাটেন দম্পতির সাথে নেহেরুর পরিচয় হয় সিঙ্গাপুরে। শোনা যায় সেই প্রথম দেখা থেকেই তাদের প্রেম শুরু হয় । এই কথাই মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছিলেন তার ভারত স্বাধীন হল বইতে। এবং বইটি যখন প্রকাশ পায় তখন নেহেরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাউন্টব্যাটেন এবং তার স্ত্রী এডইউনা আসেন ভারতে। মাউন্টম্যাটেনকে ব্রিটিস ভাইসরয় হিসাবে পাঠানো হয় ভারতে। মাউন্টব্যাটেনকে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় যেন যত দ্রুত সম্ভবত ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন প্রত্যাহার করা হয়, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করা । মাউন্টব্যাটেন বিশ্বাস করতেন যে ভারত বিভক্তি ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর কোন ভাবেই সম্ভব না। কিন্তু এদিকে কংগ্রেস কোন ভাবেই এই ভারত বিভক্তির পক্ষে ছিল না। বিশেষ করে নেহেরুর সমর্থণ ছাড়া গান্ধীকে কোন ভাবেই রাজি করানো যাবে না, এই কথা মাউন্টব্যাটেন খুব ভাল করেই জানতেন।
২০১২ সালে এডইউনার ছোট মেয়ে পামেলা তার স্মৃতিকথায় এই কথা অকপটে স্বীকার করেন যে তার মায়ের সাথে নেহেরুর গভীর প্রেম ছিল এবং তার বাবাসহ সকলেই এই কথা জানত। এবং এডউইনা ছাড়া নেহেরুর মত পরিবর্তন সম্ভব ছিল না।
তবে কেবল এডউইনার একক কৃতিত্ব অবশ্যই ছিল না কংগ্রেসের মত পরিবর্তনে। সেই সময়ে কংগ্রেসের আরেক শক্তিমান নেতা ছিলেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। নেহরু রাজি হলেও প্যাটেল রাজি ছিল না। আর সে যদি রাজি না হয় তাহলে কংগ্রেসও ভারত বিভক্তির পক্ষে যাবে না। ভারত বিভাগ মেনে নেওয়া সম্ভব হতো না। তবে এক সময়ে প্যাটেল রাজি হলেন। এবং বলা যায় যে অনেকটা নিজের ভুলের কারণেই তাকে রাজি হতে হয়।
ভারতে সব বড় দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হল। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া নেওয়ার হয়েছিল। প্রথমে ঠিক হয় যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবে মুসলিম লীগ। কিন্তু মুসলিম লীগ প্রথম পর্যায়ে মন্ত্রিসভায় যোগ দিল না। ফলে প্যাটেলকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরে যখন মুসলিমলীগ মন্ত্রীসভার যোগ দিল তখন ঠিক হল যে লিয়াকত আলীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্তে প্যাটেল বেঁকে বস্লেন । তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেছেন। এটা হাত ছাড়া করতে চাইলেন না। তার পরামর্শ মতেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হল মুসলিম লীগকে। তার ধারণা ছিল যে মুসলীগের ভেতরে এই মন্ত্রণালয় চালানোর মত জ্ঞান নেই। মন্ত্রনালয় চালাবে মূলত আমলারাই। লিয়াকত আলী এই প্রস্তাবে রাজী ছিলেন না। তবে প্যাটেল যে খবর জানতেন না সেটা হচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ বিভাগে দুজন সুদক্ষ মুসলিম কর্মকর্তা ছিলেন। একজনের নাম গোলাম মোহাম্মদ অন্যজন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। এই দুইজন জিন্নাহর মাধ্যমে লিয়াকত আলীকে রাজি করালেন। লিয়াকত আলী অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেন। বাজেটে ব্যবসায়ের ওপর কর বাড়ানো হল। ধনী হিন্দু ব্যবসায়ীরা পড়ল বিপাকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে ব্যয়ের প্রস্তাব আসতো তা অর্থমন্ত্রনালয় থেকে মানা করে দেওয়া হত। প্যাটেল বড় ঝামেলায় পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে মুসলীগের সাথে কাজ করা সম্ভব না । ভারত বিভক্তি ছাড়া পথ নেই। এই দুইজনের সম্মতিতে গান্ধী নিজেও মৌন সম্মতি প্রদান করেন।
তবে এখানে আরেকটা দুর্ঘটনার ভূমিকা একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডোমেনিক ও লা পিয়েরের মতে, জিন্নাহ যখন পাকিস্তানের জন্য চূড়ান্ত দর-কষাকষি করছেন, তখন তিনি ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। এই খবর জিন্নাহর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও জিন্নাহ নিজে জানতেন। কিন্তু কংগ্রেসের কেউ জানত না। জিন্নাহর চিকিৎসক এ খবরের গোপনীয়তা রক্ষা করেছেন। অন্যথায় কংগ্রেস আপসে হয়তো রাজি হতো না। যত সময় যেত, জিন্নাহ আপসের জন্য অস্থির হয়ে পড়তেন। এটাও একটি অনুঘটক হিসাবেই কাজ করে ভারত বিভক্তির ক্ষেত্রে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.3 / 5. Vote count: 6

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →