রুয়ান্ডার গণহত্যা

0
(0)

গত শতাব্দীর কয়েকটি ভয়াবহ গণহত্যার মধ্যে রুয়ান্ডার গণহত্যা অন্যতম। ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা এবং বুরুন্ডির প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান কিগালি বিমানবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হয়। কে বা কারা এই বিমান হামলার পেছনে ছিল তা জানা যায়নি, তবে মূলত এই ঘটনা থেকেই গণহত্যার সূত্রপাত হয় এবং প্রায় একশো দিন ধরে এই গণহত্যা চলে। প্রায় আট লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। এটি (১৯৯৪) বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি। এই গণহত্যা চালায় দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হুতুরা এবং তাদের প্রধান শিকার ছিল সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের মানুষ। এছাড়া কিছু মধ্যপন্থী হুতুকেও হত্যা করা হয়। এই গণহত্যার পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের জাতিগত বিভেদ, ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, রেডিও টেলিভিশন লিব্রে দে মিল কলিন নামক একটি রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে চালানো উস্কানি ও ঘৃণার প্রচার।
রুয়ান্ডার সামাজিক গঠন বোঝার জন্য হুতু এবং তুতসি সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক পটভূমি জানা জরুরি। রুয়ান্ডা মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকার মাঝামাঝি অবস্থিত একটি দেশ। দেশটির আয়তন ছাব্বিশ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা চট্টগ্রাম বিভাগের চেয়ে ছোট। এই দেশে মূলত তিনটি বড় সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে: হুতু (৮৫%), তুতসি (১৪%) এবং তাওয়া (১%)।
হুতুরা মূলত কৃষক, অন্যদিকে তুতসিরা ছিল জমির মালিক ও পশুপালক। তাওয়ারাও পশুপালক ছিল, তবে তারা শূকর পালত। জাতিগত ভেদাভেদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে রুয়ান্ডায় তারা পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করে আসছিল। ১৯শ শতাব্দীর শেষের দিকে জার্মানরা এবং পরে বেলজিয়ানরা রুয়ান্ডায় উপনিবেশ স্থাপন করে। জার্মান শাসনকালে রুয়ান্ডায় জাতিগত সমস্যা দেখা দেয়নি। তবে বেলজিয়ান শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ঝামেলা শুরু হয়। তারা “হ্যামিটিক হাইপোথেসিস” তত্ত্ব প্রয়োগ করে। এই তত্ত্বে বলা হয় যে তুতসিরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত একটি “উচ্চতর” জাতি, কারণ তাদের ত্বক তুলনামূলকভাবে হালকা এবং নাক খাড়া। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে বেলজিয়ানরা তুতসিদের বিশেষ সুবিধা দিতে শুরু করে এবং পরবর্তী বিশ বছরে তুতসিরা শিক্ষা, চাকরি, প্রশাসনিক ক্ষমতা—সব ক্ষেত্রে হুতুদের থেকে অনেক এগিয়ে যায়। তুতসিদের মাধ্যমে বেলজিয়ানরা হুতুদের উপর শাসন চালাতে থাকে। এদিকে এই “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতির কারণে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ বাড়তে থাকে।
১৯৫৯ সালে এই বিদ্বেষের বিস্ফোরণ ঘটে। শুরু হয় জাতিগত দাঙ্গা। এই দাঙ্গায় প্রায় ২০ হাজার তুতসিকে হত্যা করা হয় এবং সাড়ে তিন লাখের বেশি তুতসি দেশ ছেড়ে পাশের দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বেলজিয়ানরা এই দাঙ্গা থামাতে ব্যর্থ হয়ে দেশের ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। ফলে রুয়ান্ডা স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬২ সালে রুয়ান্ডা স্বাধীন হওয়ার পর ক্ষমতা হুতুদের হাতে চলে আসে। তবে সংঘাত অব্যাহত থাকে। ১৯৭৩ সালে রুয়ান্ডার সামরিক বাহিনীর একটি দল সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জুভেনাল হাবিয়ারিমানাকে ক্ষমতায় বসায়। এরপর তিনি ন্যাশনাল রেভল্যুশনারি মুভমেন্ট ফর ডেভেলপমেন্ট (এনআরএমডি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, তবে শেষ পর্যন্ত তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে, বিশেষ করে যখন অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। এই সময়ে উগান্ডায় আশ্রয় নেওয়া তুতসিরা রুয়ান্ডা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ) নামে একটি দল গড়ে তোলে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন তুতসি সম্প্রদায়ের পল কাগামে। অনেক মধ্যপন্থী হুতু এই দলটিকে সমর্থন দিয়েছিল। আরপিএফের মূল লক্ষ্য ছিল জুভেনাল হাবিয়ারিমানাকে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং পালিয়ে যাওয়া তুতসিদের দেশে ফিরিয়ে আনা।
১৯৯০ সালে, যখন জুভেনাল হাবিয়ারিমানার জনপ্রিয়তা একেবারে তলানিতে, তখন আরপিএফ উগান্ডা থেকে রুয়ান্ডায় আক্রমণ শুরু করে। ফলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এই সময়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে, যা এই গণহত্যাকে আরও ত্বরান্বিত করে। উগ্র হুতুরা তুতসিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে আরটিএলএম রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা করে।
আরটিএলএমের জন্য দুটি ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। একটি ১০০ ওয়াটের কিগালিতে, এবং আরেকটি ১০০০ ওয়াটের মাউন্ট মুহেতে। এই মাউন্ট মুহে রুয়ান্ডার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়গুলোর একটি। এই শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের কারণে রেডিও সংকেত প্রায় পুরো দেশে পৌঁছে যেত। রুয়ান্ডায় তখন মাত্র দুটি রেডিও চ্যানেল ছিল। গান, কৌতুক, ফুটবল ম্যাচের ধারাভাষ্য ইত্যাদির কারণে খুব দ্রুতই এই রেডিও চ্যানেল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ পত্রিকা পড়ত না। তাদের কাছে বিনোদন এবং তথ্যের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে এই রেডিও। এখানে একটি বিষয় আমাদের বর্তমান সময়ের সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে। তথ্যের প্রধান উৎস হচ্ছে রেডিও।
তবে এই রেডিওর আসল উদ্দেশ্য ছিল তুতসিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও উস্কানি ছড়ানো। রেডিওতে বারবার বলা হতো যে তুতসিরা হুতুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাদের গোলাম বানাতে চায়, এবং বাঁচতে হলে তুতসিদের শেষ করতে হবে। তুতসিদের “ইনয়েনজি” (তেলাপোকা) বলে অপমান করা হতো। মধ্যপন্থী হুতুদের “দালাল” হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উস্কানি দেওয়া হতো। আগেই বলেছি, সাধারণ মানুষ পত্রিকা পড়তে পারত না, তাদের কাছে তথ্যের একমাত্র উৎস ছিল এই রেডিও এবং এখান থেকে তারা প্রতিনিয়ত এই উস্কানি শুনত। ফলে এই প্রচারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুবই প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা এবং বুরুন্ডির প্রেসিডেন্টের বিমান কিগালি বিমানবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনা গণহত্যার সূত্রপাত করে। হুতু চরমপন্থীরা এই দুর্ঘটনার জন্য তুতসিদের দায়ী করে, যদিও এর পেছনে কারা ছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। রেডিও তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘটনাকে কাজে লাগায় এবং সহিংসতার ডাক দেয়। ৭ এপ্রিল থেকে গণহত্যা শুরু হয়। প্রথমে মধ্যপন্থী হুতুদের লক্ষ্য করা হয়। এর মধ্যে ছিলেন হুতু প্রধানমন্ত্রী আগাথে উইলিংগিয়িমানা। গণহত্যার প্রথম রাতেই তাকে হত্যা করা হয়। এরপর হুতু মিলিশিয়া, যেমন ইন্টারাহামওয়ে, এবং সাধারণ হুতু জনগণ লাঠি, চাপাতি, বটি এবং সাধারণ বন্দুক নিয়ে তুতসিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আরটিএলএমের ভূমিকা এখানে ছিল অত্যন্ত ভয়ানক। রেডিওতে নিয়মিতভাবে ঘৃণা ও উস্কানি ছড়ানো হতো এবং একই সঙ্গে গণহত্যাকে সংগঠিত করতে সরাসরি নির্দেশনা দেওয়া হতো। রেডিওতে নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করে বলা হতো: “অমুক এলাকায় তুতসি ষড়যন্ত্রকারী এবং তাদের দালাল হুতুরা জড়ো হয়েছে।” এই আহ্বানে সাধারণ মানুষ, এমনকি প্রতিবেশী, বন্ধু বা আত্মীয়রা একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়।
গণহত্যার পরিমাণ ছিল অকল্পনীয়। মাত্র ১০০ দিনে প্রায় ৮ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে প্রায় এক লাখ ছিল শিশু। এই হত্যা ঠেকাতে জাতিসংঘ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। সেই সময়ে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যদি একটু চেষ্টা করত, তবে এই হত্যার সংখ্যা কিছুটা কমে আসত। জাতিসংঘ সেখানে শান্তিরক্ষার জন্য সৈন্য পাঠায়নি, বরং সৈন্য অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
সাধারণ মানুষ কোথা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রুয়ান্ডার সাধারণ মানুষের তথ্য সংগ্রহের একমাত্র উৎস ছিল এই আরটিএলএম। যদি এমনটা না হতো, তাহলে রুয়ান্ডায় গণহত্যার তীব্রতা এতটা হতো না। সংখ্যাটা আরও কম হতো।
বিগত সরকার তথ্যের ওপর কী ভয়ানক নিয়ন্ত্রণ চালিয়েছে, সেটা আমাদের কারো অজানা নয়। রেডিও, টেলিভিশন আর পত্রিকা—সব কিছুর ওপর ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণ। ফলে সাধারণ মানুষের এই প্রচলিত তথ্যের উৎসের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়। এসবের স্থান দখল করে নেয় ইন্টারনেট, আরও ভালোভাবে বললে ফেসবুক, ইউটিউব আর টিকটক। আমাদের দেশের তরুণ ভোটারের সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এই চার কোটির প্রায় সবাই ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। এখানে তারা যা দেখবে, তাই বিশ্বাস করবে। এছাড়া গ্রামে-গঞ্জে, যেখানে সাধারণ মানুষ বেশি শিক্ষিত নয়, তারাও তথ্যের জন্য পত্রিকা বা টেলিভিশনের চেয়ে ইন্টারনেট (ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক) এর ওপর বেশি নির্ভর করে। এটা খুব ভয়ানক একটা বিষয়। সত্যি কথা বলতে, এখানে নীতিকথা কপচিয়ে কোনো লাভ নেই। আমরা এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছি দীর্ঘ সময় ধরে। এর পেছনে কারা দায়ী, সেটাও আমরা ভালোভাবে জানি। এখন এর ফল আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হবে।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

অপু তানভীরের নতুন অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে

বইটি সংগ্রহ করতে পারেন ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে থেকে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *