শিমুলের কাছে ফেরা

4.9
(55)

সায়েরা আপাকে এখানে দেখতে পাবো ভাবি নি । শেষ কবে দেখেছিলাম মনেও নেই ঠিক । শুনেছিলাম সে লন্ডন চলে গিয়েছিলো । কবে ফিরে এল কে জানে !
আমাকে দেখেই সায়েরা আপা বলল, আরে ফয়সাল যে । এখানে ?
তার চোখে কৌতুহল ! আমি নিনার দিকে তাকালাম । নিনা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে । ও আসলে বুঝতে পারে নি যে এই ক্লিনিকের ডাক্তার আমার পরিচিত হবে । আমিও যে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যাই নি সেটা না । আমি খুব ভাল করেই জানি যে আমি যখন এখানে আসার কারণটা সায়েরা আপাকে বলব তখন সে আমার দিকে ভুরু কুচকে তাকাবে । আর ভাববে আমার ভেতরে সমস্যা আছে ! আর এমনটা ভাবলে তাকে খুব একটা দোষও দেওয়া যায় না !

নিনা সম্পর্কে আমার বন্ধু হয় । অনেক দিন ধরে ওকে চিনি । আজকে সকালে ফোন দিয়ে জানালো যে সে প্রেগনেন্ট । কিন্তু এই বাচ্চা সে মোটেই রাখবে না । এখন সে কোন ভাবেই মা হতে প্রস্তুত না । নিনার জামাই এই কথা জানে না । এবং সে তাকে জানাতেও চায় না । একা একা ক্লিনিকে যেতে তার কেমন যেন লাগছে । তাই বন্ধু হিসাবে আমাকে যেতে হবে !

আমি খুব ভাল করে জানি যে ও আসলে আমাকে স্বামী সাজিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে । প্রথমে একটু গাইগুই করছিলাম । কিন্তু শেষে রাজি হতে হল । আমার পুরো জীবনে নিনা আমাকে অনেক বার বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে । ওর এই উপকার টুকু আমি করতেই পারি । নিনা আমাকে বলল যে আমাকে কিছু করতে হবে না । কেবল আমি সাথে গেলেই চলবে । বাকি সব ব্যবস্থা সে করেই রেখেছে । আমি তাই আজকে সাথে এসেছি । এসেই পড়লাম বিপদে । সায়েরা আপাকে এখানে দেখতে পেলাম ।

সায়েরা আপা অবশ্য আমাকে আর নিনাকে খুব বেশি বিব্রত করলেন না । অহেতুক প্রশ্ন করলেন না । নিনাকে নিয়ে গেলেন ভেতরে ।

সকল কাজ শেষ করে নিনাকে নিয়ে যখন বের হয়ে যাবো তখন সায়েরা আপা বললেন, ফয়সাল, তোমার সাথে আমার একটু কথা ছিল । এখন না হলে কাল পরশু একটু এসো তো আমার কাছে । কেমন !
আমি মাথা কাঁত করে জি আচ্ছা বলে বের হয়ে এলাম ।

পরের সপ্তাহে আবার গিয়ে হাজির হলাম সায়েরা আপার ক্লিনিকে । নানান কথা বার্তা হল । আগে যখন আমরা যশোর ছিলাম, সায়েরা আমাদের পাশের বাসায় থাকতো । আমার থেকে চার বছরের সিনিয়র ছিল । ভাল ছাত্রী হিসাবে তখন থেকেই তার নাম ডাক ছিল বেশ । তাই মা বলতো তার কাছে গিয়ে যেন পড়া দেখে নিই । সেখান থেকেই আপার সাথে ভাল পরিচয় হয়েছিলো । আমাকে ছোট ভাইয়ের মত আদর করতো । পরে আপার বাবা বদলি হয়ে গেলে যোগাযোগ টা কমে যায়। ঢাকাতে এসে আবার যোগাযোগ হলেও দুরত্ব আর কমে নি ।

এক সময় সায়েরা আপা বললেন, শিমুলের সাথে যোগাযোগ আছে কি?
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম । আসলে শেষবার যখন আপার কাছে এসেছিলাম তখন শিমুল আমার সাথে ছিল । ওর জন্যই আসা । শিমুল তখন আমার প্রেমিকা ছিল । একই সাথে কাজ করতাম আমরা । দুজনের ভেতরে সম্পর্কটা বেশ গাঢ় ছিল । ওকে বিয়ে করার একটা পরিকল্পনা ছিল আরও একটু গুছিয়ে নিয়ে । একদিন হঠাৎ শিমুল এসে বলল যে সে প্রেগনেন্ট । আমি সত্যি বলতে কি তখন বাচ্চার নেওয়া কিংবা বিয়ের কথা ভাবছিলাম না । ওকে বোঝালাম যে চাকরিটা সবে মাত্র শুরু হয়েছে । এখনই বিয়ে কিংবা বাচ্চার দিকে আমি যেতে চাই না । দুতিন বছর পার করে বিয়ে করবো । শিমুলকেই বিয়ে করবো তবে এখন না । ও চুপচাপ শুনলো । এবং সব কথা মেনে নিল । ঠিক হল আমরা বাচ্চা এবোর্ট করে ফেলবো । তখন এই সায়েরা আপার কাছেই এলাম । সব কিছু উনিই সামাল দিলেন ।
আমি বললাম, আসলে আপা, ঐ ঘটনার পরে শিমুল কেমন জানি হয়ে গিয়েছিলো । আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে দিতে একেবারে বন্ধ করে দিল । তারপর চাকরিটাও ছেড়ে দিলো ।
-এখন আর যোগাযোগ নেই?
-না । আমি তখন অনেক চেষ্টা করেছিলাম যোগাযোগ করতে । ও রাজি হয় নি ।

সায়েরা আপা কিছু সময় কি যেন ভাবলেন । তারপর বললেন, তোমার কাছ থেকে একটা কথা আসলে আমি লুকিয়েছি ।
-কি কথা ?
একটা জোরে দম নিলেন আপা । তারপর বললেন, ঐদিন শিমুল বাচ্চাটা নষ্ট করতে দেয় নি । এমন ভাবে কাঁদছিলো যে আমি পারি নি । ও…
-মানে !

আমার পুরো মাথার ভেতরে যেন শক খেল । আমি ঠিক শুনলাম তো ! বাচ্চা এবোর্শন করে নি । তার মানে বাচ্চাটা রয়ে গেছে । আমি অনুভব করলাম আমি ঠিকঠাক মত ভাবতে পারছি না । কোন মতে বললাম, তার মানে….।
-হ্যা বাচ্চাটা রয়ে গেছে । চেকাপের জন্য শিমুল আরেকবার আমার কাছে এসেছিলো । তখনও বাচ্চা আর শিমুল ভালই ছিল । তারপরই তো আমি চলে গেলাম বাইরে !

আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না । সায়েরা আপা বললেন, শিমুল আমাকে অনুরোধ করেছিলো আমি যেন ব্যাপারটা তোমাকে না বলি ! কিন্তু একটা সময়ে আমার মনে হল তোমার ব্যাপারটা জানা দরকার !

আমি উঠে দাড়ালাম । আমার মাথায় তখন আর কিছু কাজ করছে না । বারবার মনে হচ্ছে কি করেছি আমি ! শিমুল কী তীব্র ভাবে চেয়েছিল । আমি তো ওকে ভালোবাসতাম তাহলে কেন বুঝতে পারি নি । কি হত দুজন মিলে যদি বাচ্চাটা রাখার সিদ্ধান্ত নিতাম । আমি নিতে পারি নি কিন্তু শিমুল নিয়েছে । আজকে প্রায় চার বছর শিমুলের দেখা নেই । তার মানে বাচ্চাটার বয়স নিশ্চয়ই তিন সাড়ে তিন বছর । আমার কেবল মনে হল যে যেকোন ভাবেই শিমুলকে খুজে বের করতে হবে ।

অফিসে গিয়ে ঠিকানা জোগার করলাম । আমি জানতাম ওর বাসা মাগুরা সদর থানাতে । কিন্তু বাড়ির ঠিকানা জানতাম না । এখন ওর হোম টাউনে শিমুলকে পেলেই হয় ! অবশ্য না পেলে ওর বাবার কাছ থেকে তো নেওয়া যাবে । ওর বাবা স্থানীয় একটা স্কুলের হেড মাস্টার ছিল, এই টুকু আমার মনে আছে !

পরদিন খুব ভোরে রওয়ানা দিলাম । বাড়ির যে ঠিকানা ছিল সেখানে গিয়ে দেখি সেখানে ওরা নেই । আমি হতাশায় এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । যখন মনে হল যে আর খোজ পাবো না তখনই ভাগ্য মুখ ফিরে তাকালো । একটা মুদির দোকানদারের কাছ থেকে জনাতে পারলাম যে মাস্টার সাহেব ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে উঠেছে । তিনি যদিও বাড়ির ঠিকানা দিতে পারলেন না । তবে স্কুলের ঠিকানা দিয়ে দিলেন । স্কুল তখনও ছুটি হয় নি । সেখানে গেলে মাস্টার সাহেব কে পাওয়া যাবে আশা করি ।

স্কুল খুজে পেতে সমস্যা হল না । গেট ভেতরে প্রবেশ করলাম । সবে মাত্র টিফিন শেষ হয়েছে । নতুন ভাবে ক্লাস শুরু হয়েছে । দারোয়ানকে হেড মাস্টারের রুমটা কথা জিজ্ঞেস করতেই সে দেখিয়ে দিল। আমার পরনের পোশাকের কারণে আর কোন কথা জানতে চাইলো না । আমি স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাটতে শুরু করলাম । একেবারে শেষ মাথায় হেড স্যারের রুম । আমি এখনও জানি না যে তাকে আমি কি বলবো ! কিভাবে বলব!
একেকটা ক্লাস পার হচ্ছি আর ভেতরে চোখ যাচ্ছে । বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন স্যার কিংবা ম্যাডাম । একটা ক্লাস রুম পার হতেই আমি থমকে দাড়ালাম ! তারপর আবারও দরজার সামনে এসে দাড়ালাম । ভেতরে চশমা আর শাড়ি পরে একজন শিক্ষিকা পড়াচ্ছেন বই হাতে নিয়ে । আমাকে দেখে সেই থমকে গেল !

শিমুল ! প্রায় চার বছর পরে দেখছি ।
আগে শিমুলের চেহারার ভেতরে একটা কিশোরী কিশোরী ভাব ছিল । এখন সেটা নেই । বরং তার বদলে একটা নারীত্ব ভাব ফুটে উঠেছে । আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর বাচ্চাদের উদ্দেশ্য বলল, তোমরা এই গল্পটা পড় আমি আসছি ।

আমার সামনে এসে দাড়ালো ও । তারপর বলল, তুমি এখানে?
আমি বলল, তুমি আমাকে কেন বল নি ? কেন বল নি ?

শিমুল কিছু সময় যেন বিভ্রান্ত হল । কিন্তু পরমুহুর্তেই বুঝে গেল আমি কি বুঝাতে চাইছি । বলল, এসব কথা পরে হবে ।
-না এখনই হবে । আমি জানি আমি গাধা ছিলাম । কিন্তু তুমি তো মনের কথাটা আমাকে একবার বলতে পারতে ! একবার ! তুমি তো আমাকে চিনতে নাকি ! আমি কতখানি ইম্ম্যাচিউর ছিলাম তখন !
শিমুল বলল, এসব কথা এখন না বলি ! ক্লাসের পরে বলি !
-বাবু ছেলে না মেয়ে ?

শিমুল বলল, তুমি নিজেই দেখে নাও । এসো আমার সাথে !
এই বলে আমাকে নিয়ে ও হাটতে শুরু করলো । ক্লাস রুম পার করে একটা স্টাফ রুম । তার পরেই দেখলাম একটা ছোট রুম । বাচ্চাদের খেলার জন্য । সেখানে চারটা বাচ্চা আপন মনে দেলছে । একজন মহিলা বসে আছে একটু দুরে । আমারা দরজার কাছে আসতেই দেখলাম একটা বাচ্চা মুখ তুলে তাকালো । তারপর খেলা ছেড়ে দৌড়ে এল আমাদের দিকে । আমাকে বলে দিতে হল না যে এটাই আমার মেয়ে ! আমি কেবল অপলক চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । কখন যে আপনা আপনি চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এল সেটা আমি নিজেও জানি না ।

স্কুল ছুটি হলে আমি শিমুলের সাথেই ওদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম । শিমুলের বাবা আমাকে দেখে মোটেও খুশি হন নি সেটা তার চেহারা দেখেই আমি পরিস্কার বুঝলাম । তবে তিনি কিছু বললেন না আমাকে ।

সন্ধ্যার সময় শিমুল আমাকে সব কিছু খুলে বলল। এই এলাকায় সবাই জানে শিমুলের জামাই বিদেশ থাকে । মেয়ে তাই এখন এখানে থাকে । যখন ঢাকাতে ছিল শিমুল তখন বিয়ে করেছিলো । জামাই বাইরে গিয়েছে পড়তে । আসল সত্যটা কেবল শিমুলের বাবা মা জানতেন । সত্য জানার পরেও সে মেয়েকে দুরে ঠেলে দেন নি । তাহলে হয়তো শিমুলের জন্য বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে যেত ।
শিমুল বলল, তোমার উপর আমি রাগ করি নি ফয়সাল । সত্যি বলছি । কারণ যা করেছি দুজনের ইচ্ছেতেই হয়েছে । আর তুমি সব সময়ই বলতে যে আর কয়েক টা বছর পরেই সব গুছিয়ে নিয়ে বিয়ে করবে । আমিও সেই রকম ভেবেছিলাম কিন্তু মাঝ খান দিয়ে সব অলট পালট হয়ে গেল । আমিও হয়তো পারতাম কিন্তু কোন ভাবেই বাবুকে মেরে ফেলতে পারি নি । আর চাই ও নি তোমার উপর আমি বোঝা হয়ে যাই ।
-একটা বার আমাকে বলতে ! মাত্র একটা বার ! তোমাকে তো ভালোবাসতাম । এখনও বাসি । তুমি চলে যাওয়ার পরে আমমি কোন ভাবেই আর কাউকে নতুন ভাবে নিজের জীবনের সাথে যুক্ত করতে পারি নি ।

ঐ রাতেই আমাদের বিয়ে হল । শিমুলের বাবা তবুও গম্ভীর হয়েই রইলো । আমার মনে হল যে কাজ আমরা মানে আমি করেছি তিনি কোন দিন আমার সাথে স্বাভাবিক হতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে তবে আমার শাশুড়ি দেখলাম আমাকে পেয়ে বেজায় খুশি । আসলে এই সময়ে একটা বড় চিন্তার পাথর তার বুকের উপর থেকে চলে গিয়েছে । মেয়ের জামাই ফিরে এসেছে ।

আমি কোন দিন ভাবি নি আমার জীবনের মোড়টা এভাবে ঘুরে যাবে । যদি ঐদিন নিনার সাথে না যেতাম, তাহলে সায়েরা আপার সাথে দেখা হত না, তিনিও হয়তো বলতেন না । আমার কোন দিন জানাই হত না যে আমার একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে।

রাতে শশী আমাদের মাঝে ঘুমালো । আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম একভাবে । কখন যে আমার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়তে শুরু করলো আমি নিজেই টের পেলাম না । শিমুল আমাকে দেখছিলো । বলল, তুমি এখনও সেই ছেলেমানুষই আছো দেখছি ! মেয়ে বড় করতে পারবে তো?
বললাম, চিন্তা নেই । মেয়ের মা তো আছে । সে সাহায্য করবে !
আমি শিমুলের হাত ধরলাম । তারপর বলল, এই জীবনে আমি আর কোন দিন তোমাকে অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না । আই প্রমিজ !

এটা কেবল আমি শিমুলের সাথেই না, নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করলাম । একটা বড় ভুল আমি করেছিলাম । বাকিটা জীবনে আর দ্বিতীয়বার সেই ভুল আমি আর করবো না ।

গল্পের সময় কাল ২০০৫ ধরা হোক । তাহলে হয়তো আরও বেশি এপ্রোপ্রিয়েট হবে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 55

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →