আরেক ফাল্গুন

4.7
(68)

এদেশী সব ছেলেদের মাঝে একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে । তারা সব সময়ই তার প্রিয় মানুষটাক শাড়িতে দেখতে পছন্দ করে । নানান মানুষের নানা রকম পছন্দ থাকতে পারে কিন্তু এই দিক দিয়ে সবার পছন্দ একদম একই রকম । শাড়ি মানেই মেয়েদের অপূর্ব সুন্দরী ! তবে আমার কাছে শাড়ির সব থেকে ভালো দিক হচ্ছে শাড়ি খুব সহজে খোলা যায় ! এই দিক অবশ্য শাড়ি আমার বেশ পছন্দ !
তৃষা যদি আমার এই মনভাব শোনে তাহলে আমার খবরই আছে । যাই হোক আজকে বসন্তের প্রথম দিন । সেই সাথে আজকে আবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ! কাপলদের জন্য বলতে গেলে একেবারে সোনায় সোহাগা দিবস । অবশ্য আমার জন্য প্রতিটি দিনই ভালোবাসা দিবস যদি তৃষার সাথে দেখা হয় । সেই হিসাবে আজকে আমার ভালোবাসা দিবস হওয়ার কথা ছিল না । আজকে যদিও রবিবার, তৃষার অফিস আজকে বন্ধ থাকে কিন্তু দুইদিন আগেই সে আমাকে জানিয়েছিলো যে এই রবিবার সে মোটই ফ্রি থাকবে না । সুতরাং দেখা হবে না । আমার মন খানিকটা খারাপই হয়েছিলো । একটা ফাল্গুন ওর সাথে কাটানোর আমার কত দিনের ইচ্ছে । শাড়ি পরবে ও, আমি পরবো পাঞ্জাবী ! ঘুরে বেড়াবো রিক্সাতে করে ! এই শখটা কিছুতেই পূরন হয় না ! অবশ্য এই দিন আমার কাছে বরাবরই কুফা একটা দিন । কোন সময়ই ভাল যায় না । সেই ছোট বেলা থেকেই এমন হয় ! সুতরাং এমন কিছু যে হতে পারে সেটা আগেই ভাবা উচিৎ ছিল আমার !
রাতে কথা হয়েছিলো তৃষার সাথে । প্রতি রাতেই যেমন হয় । এমন কি সকালের গুড মর্নিং মেসেজ পর্যন্তও আমি জানতাম যে আমাদের আজকে দেখা হবে না । তাই সারাদিন আমার ঘুমানোর প্লানই ছিল । কিন্তু নয়টার দিকে হঠাৎ তৃষার ফোন এসে হাজির । এগারোটার ভেতরে যেন ওর বাসার সামনে এসে হাজির হই । এক মিনিটও যেন দেরি না হয় ! বুঝতে পারলাম যে আজকে দেখা হতে যাচ্ছে ।

তৃষা ঠিক ঠিক এগারোটার সময়ে গেট দিয়ে বের হয়ে এল । তৃষার দিকে তাকিয়ে আমি একটা হার্টবিট মিস করলাম । সত্যি বলতে কি হলুদ শাড়িতে ওকে আমি এই প্রথম দেখলাম । তৃষা সব সময়ই ওর চুল গুলো খোলা রাখে । এমন ভাবেই আমি ওকে দেখে অভ্যস্ত । তবে আজকে খানিকটা খোপার মত করে বেঁধেছে । সেই সাথে চুলে ফুল গুজে দিয়েছে । ঠোটে একেবারে হালকা লিপস্টিক ! মুখেও তেমন ভাবে হালকা মেক আপ দেওয়া । শাড়িটা সামলাতে সামলাতে সে আমার সামনে এসে দাড়ালো । আমি তখনও ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছি । তৃষা বলল, এই যে জনাব ! কি হল ?
-না মানে তোমাকে দেখছি !
-আমাকে দেখার কী হল শুনি ! আজকে তো নতুন দেখছো না ।
-আমি তোমাকে প্রতিদিনই নতুন ভাবে দেখি ।
আমি ওর হাতে গোলাপের তোড়াটা তুলে দিলাম । যদিও তৃষা এই ফুল খুব একটা পছন্দ না । ওর কাছে ফুল মানে হচ্ছে অপচয় । অবশ্য তৃষাকে খুশি করতে দরকার হচ্ছে চকলেট ! সেটাও নিয়ে এসেছিলাম । সেটা পেয়ে ও বেশ খুশি হল ! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-হয়েছে ! এতো তেল দিতে হবে না । রিক্সা ডাক দাও !

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ! ওকে একা বের হয়ে আসতে দেখে ভেবেছিলাম যে আজকে হয়তো ড্রাইভার গাড়ি চালাবে । একটু পরেই বের হয়ে আসবে । কিন্তু তৃষা দেখি রিক্সা ডাকতে বলছে ! আমি বললাম, রিক্সা !! তোমার শরীর ঠিক আছে তো !
-হা হা ! ভেরি ফানি । শুনি ঢং করবা না ! যা করতে বলেছি তাই কর !

আমি মোটেই দেরি না করে রিক্সা ডাক দিলাম । জানতে চাইলাম কোন দিকে যাবে । তৃষা বলল,আপাতত কোন দিকে না । দুপুরে যেতে হবে সোহাদের বাসায় ! কিন্তু তার আগে আমরা কিছু সময় রিক্সা নিয়ে ঘুরবো !

ঘন্টা অনুযায়ী রিক্সা ঠিক করলাম । তারপর রিক্সাতে উঠে বসলাম । তৃষার সাথে আমি শেষ কবে রিক্সাতে উঠেছি আমার ঠিক মনেও পড়ে না । তৃষা নিজের গাড়ি ছাড়া কোথাও এক পাও নড়ে না । এমনি ওর বাসা থেকে মিনিট দশেক হাটার দুরুত্বে ডেইলি সুপার সপে যাওয়ার জন্যও আধা ঘন্টার জ্যাম সহ্য করে গাড়ি নিয়ে বের হয় । সেই তৃষা আজকে আমার সাথে রিক্সা নিয়ে বের হয়েছে । ব্যাপারটা ভাবতেই ভালো লাগছে । আজকে যদিও উইক ডে, তার পরেও কেন জানি রাস্তা বেশ ফাঁকা । আমরা এদিক ওদিক দিয়ে ঘুরতে লাগলাম ।

মাঝে রাস্তা থেকে ওকে আরও বেশ কয়েকটা ফুল কিনে দিলাম । দুপুরের দিকে গিয়ে হাজির হলাম সোহাদের বাসায় । সোহা তৃষার সব থেকে কাছের বন্ধু । সেই হিসাবে আমারও কাছের বন্ধুতে পরিনত হয়েছে । আমাকে ড্রয়িং রুমে একা রেখে ওরা দুজন ভেতরে চলে গেল । দেখলাম একটু পরে সোহা হাজব্যান্ড এসে হাজির হল । আমার সাথে গল্প গুজব করতে লাগলাম । খাওয়া দাওয়া শেষ করে আরও অনেকটা সময়ই সোহাদের বাসাতে থাকলাম । বের হতে হতে বিকেল হল ।

ভেবেছিলাম যে হয়তো আমাকে এবার চলে যেতে হবে । ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে আমি নিজের বাসার দিকে রওয়ানা দিবো কিন্তু সোহাদের বাসায় নামতে গিয়ে দেখি তৃষার গাড়ি দাড়িয়ে রয়েছে সেখানে । তৃষা আমাকে গাড়িতে ওঠার ইংগিত দিয়ে নিজে বসলো ড্রাইভিং সিটে । তারপর গাড়ি স্টার্ট দিল ।

কেন জানি তৃষার মুখ আমি খানিকটা গম্ভীর দেখলাম । পুরোটা সময় তো তৃৃষা আমার সাথেই ছিল ! এর ভেতরে কি আবার কিছু হল ! আমি হঠাৎ বললাম, কিছু কি হয়েছে ?
তৃষা একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসলো । তারপর বলল, কই না তো ! কী হবে !
-তোমার মুখ এমন কেন দেখাচ্ছে !

গাড়ি ততক্ষণে বেড়িবাধের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে । জানাল খোলা । তৃষার চুল উড়ছে । তৃষা হঠাৎ বলল, হঠাৎ যদি আমি হারিয়ে যাই, তোমার কষ্ট হবে ?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন ?
-এমনি ! বল কষ্ট হবে ?
-তুমি খুব ভাল করেই জানো আমার কেমন অবস্থা হবে !
-হুম !

তৃষা আসলে আর কিছু বলল না । গাড়ি ছুটে চলল অনির্দিষ্ট ভাবে ! আমাকে যখন তৃষা আমার বাসার সামনে নামিয়ে দিলো তখন রাট প্রায় নয়টা বাজে । আমাকে নামিয়ে দিয়ে ও গাড়ি ঘোড়ালো ! আমার দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা তোমার ভ্যালেন্টাইনের গিফট ! বাসায় গিয়ে খুলো ! আর ভালো থেকো !

তৃষা গাড়ি নিয়ে চলে গেল । আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল । কেন জানি আমার হঠাৎ কষ্ট হতে লাগলো । তৃষার সাথে এমন একটা দিন কাটানোর জন্য আমি অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম । কোন এক ফাল্গুনে ও পরবে হলুদ আমি পরবো সাদা পাঞ্জাবি । দুজন এক সাথে ঘুরবো রিক্সাতে করে । ওর সাথে কতবার দেখা হয়েছে কিন্তু এই অবস্থা কোন দিন হয় নি ।বলতে গলে আজকে অনেক দিনের স্বপ্নটা পূরণ হল । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পূরণ না হলেই বুঝি ভাল হত !

বাসায় এসে খামটা খুলতে আমার মোটেই ইচ্ছে হল না । কাছেই এক বন্ধুর কাছে গিয়ে হাজির হলাম । আড্ডা চলল বেশ কিছু সময় ধরে ! রাতে খাবার খেয়ে যখন বাসায় উঠলাম তখন প্রায় এগারোটা বেজে গেছে । বাসায় এসে আমি তৃষাকে ফোন দিতে গেলাম । ফোনটা ঢুকলো না । বন্ধ । অন্য সব গুলো নাম্বারে ট্রাই করলাম সব গুলো বন্ধ !
কয়েকবার চেষ্টা করেও কাজ হল না । তখনই মনের ভেতরে কু কেরে উঠলো ! তৃষা আজকে হঠাৎ করেই এরকম ভাবে শাড়ি পরে আমার সাথে রিক্সায় ঘুরলো কেন ! এই আচরন তো ওর সাথে যায় না ! তাহলে ! এমন কেন করলোও ! আমি কেবল অনুভব করলাম যে আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে !
আমি এবার সোহাকে ফোন দিলাম । ওর ধরলো একটু পরেই। আমার কেন জানি মনে হল তৃষা আমার ইচ্ছেটা পূরণ করে চলে গেছে । আমি সোহাকে বললাম, তৃষার ফ্লাইট কখন?
সোহা কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, তোমাকে কিছু বলেছে ও ?
-না কিছু বলে নি । কেবল একটা চিঠি দিয়েছে । আমি এখনও খুলি নি ! ফ্লাইট কখন ওর !
-এই তো সাড়ে বারোটায় !

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম ! প্রায় বারোটার কাছাকাছি চলে গেছে সময় । এখন কোন ভাবেই এয়ারপোর্ট পৌছানো সম্ভব না । সোহা বলল, ওর পক্ষে তোমাকে বিদায় জানানো সম্ভব ছিল না । ও তোমার সাথে দেখাই করতে চাইছিলো না । আমি অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছি !
-আর কি আসবে না !
-না মনে হয় !

আমি ফোন রেখে দিলাম কেবল । আমার মনে হল যে আমি আর কোন কিছু অনুভব করছি না । আমার আর যেন কিছু নেই । তৃষার দেওয়া শেষ খামটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । ভেতরে কি লেখা আছে আমি জানি না । খুব ইচ্ছে হল খামটা এখনই খুলে পড়ে ফেলি, ভেতরে কী লেখা ! কিন্তু তখনই মনে হল পড়ে ফেললেই তো শেস হয়ে যাবে ! তৃষার শেষ কথা গুলো কেন জানি পড়তে ইচ্ছে হল না । ওটা থাকুক ওভাবে ! ওটা যতদিন পরবো না ততদিন ওটা খোলার একটা আশা থাকবে ! ওটা পড়ার জন্য বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে ! অন্য কোন ফাল্গুনে তৃষা নিশ্চয়ই আসবে আবার ! আরেক ফাল্গুনে আমরা আবারও রিক্সাতে করে ঘুরে বেড়াবো এক সাথে । আরেকটা ফাল্গুন আসবে অবশ্যই !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 68

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →