এদেশী সব ছেলেদের মাঝে একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে । তারা সব সময়ই তার প্রিয় মানুষটাক শাড়িতে দেখতে পছন্দ করে । নানান মানুষের নানা রকম পছন্দ থাকতে পারে কিন্তু এই দিক দিয়ে সবার পছন্দ একদম একই রকম । শাড়ি মানেই মেয়েদের অপূর্ব সুন্দরী ! তবে আমার কাছে শাড়ির সব থেকে ভালো দিক হচ্ছে শাড়ি খুব সহজে খোলা যায় ! এই দিক অবশ্য শাড়ি আমার বেশ পছন্দ !
তৃষা যদি আমার এই মনভাব শোনে তাহলে আমার খবরই আছে । যাই হোক আজকে বসন্তের প্রথম দিন । সেই সাথে আজকে আবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ! কাপলদের জন্য বলতে গেলে একেবারে সোনায় সোহাগা দিবস । অবশ্য আমার জন্য প্রতিটি দিনই ভালোবাসা দিবস যদি তৃষার সাথে দেখা হয় । সেই হিসাবে আজকে আমার ভালোবাসা দিবস হওয়ার কথা ছিল না । আজকে যদিও রবিবার, তৃষার অফিস আজকে বন্ধ থাকে কিন্তু দুইদিন আগেই সে আমাকে জানিয়েছিলো যে এই রবিবার সে মোটই ফ্রি থাকবে না । সুতরাং দেখা হবে না । আমার মন খানিকটা খারাপই হয়েছিলো । একটা ফাল্গুন ওর সাথে কাটানোর আমার কত দিনের ইচ্ছে । শাড়ি পরবে ও, আমি পরবো পাঞ্জাবী ! ঘুরে বেড়াবো রিক্সাতে করে ! এই শখটা কিছুতেই পূরন হয় না ! অবশ্য এই দিন আমার কাছে বরাবরই কুফা একটা দিন । কোন সময়ই ভাল যায় না । সেই ছোট বেলা থেকেই এমন হয় ! সুতরাং এমন কিছু যে হতে পারে সেটা আগেই ভাবা উচিৎ ছিল আমার !
রাতে কথা হয়েছিলো তৃষার সাথে । প্রতি রাতেই যেমন হয় । এমন কি সকালের গুড মর্নিং মেসেজ পর্যন্তও আমি জানতাম যে আমাদের আজকে দেখা হবে না । তাই সারাদিন আমার ঘুমানোর প্লানই ছিল । কিন্তু নয়টার দিকে হঠাৎ তৃষার ফোন এসে হাজির । এগারোটার ভেতরে যেন ওর বাসার সামনে এসে হাজির হই । এক মিনিটও যেন দেরি না হয় ! বুঝতে পারলাম যে আজকে দেখা হতে যাচ্ছে ।
তৃষা ঠিক ঠিক এগারোটার সময়ে গেট দিয়ে বের হয়ে এল । তৃষার দিকে তাকিয়ে আমি একটা হার্টবিট মিস করলাম । সত্যি বলতে কি হলুদ শাড়িতে ওকে আমি এই প্রথম দেখলাম । তৃষা সব সময়ই ওর চুল গুলো খোলা রাখে । এমন ভাবেই আমি ওকে দেখে অভ্যস্ত । তবে আজকে খানিকটা খোপার মত করে বেঁধেছে । সেই সাথে চুলে ফুল গুজে দিয়েছে । ঠোটে একেবারে হালকা লিপস্টিক ! মুখেও তেমন ভাবে হালকা মেক আপ দেওয়া । শাড়িটা সামলাতে সামলাতে সে আমার সামনে এসে দাড়ালো । আমি তখনও ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছি । তৃষা বলল, এই যে জনাব ! কি হল ?
-না মানে তোমাকে দেখছি !
-আমাকে দেখার কী হল শুনি ! আজকে তো নতুন দেখছো না ।
-আমি তোমাকে প্রতিদিনই নতুন ভাবে দেখি ।
আমি ওর হাতে গোলাপের তোড়াটা তুলে দিলাম । যদিও তৃষা এই ফুল খুব একটা পছন্দ না । ওর কাছে ফুল মানে হচ্ছে অপচয় । অবশ্য তৃষাকে খুশি করতে দরকার হচ্ছে চকলেট ! সেটাও নিয়ে এসেছিলাম । সেটা পেয়ে ও বেশ খুশি হল ! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-হয়েছে ! এতো তেল দিতে হবে না । রিক্সা ডাক দাও !
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ! ওকে একা বের হয়ে আসতে দেখে ভেবেছিলাম যে আজকে হয়তো ড্রাইভার গাড়ি চালাবে । একটু পরেই বের হয়ে আসবে । কিন্তু তৃষা দেখি রিক্সা ডাকতে বলছে ! আমি বললাম, রিক্সা !! তোমার শরীর ঠিক আছে তো !
-হা হা ! ভেরি ফানি । শুনি ঢং করবা না ! যা করতে বলেছি তাই কর !
আমি মোটেই দেরি না করে রিক্সা ডাক দিলাম । জানতে চাইলাম কোন দিকে যাবে । তৃষা বলল,আপাতত কোন দিকে না । দুপুরে যেতে হবে সোহাদের বাসায় ! কিন্তু তার আগে আমরা কিছু সময় রিক্সা নিয়ে ঘুরবো !
ঘন্টা অনুযায়ী রিক্সা ঠিক করলাম । তারপর রিক্সাতে উঠে বসলাম । তৃষার সাথে আমি শেষ কবে রিক্সাতে উঠেছি আমার ঠিক মনেও পড়ে না । তৃষা নিজের গাড়ি ছাড়া কোথাও এক পাও নড়ে না । এমনি ওর বাসা থেকে মিনিট দশেক হাটার দুরুত্বে ডেইলি সুপার সপে যাওয়ার জন্যও আধা ঘন্টার জ্যাম সহ্য করে গাড়ি নিয়ে বের হয় । সেই তৃষা আজকে আমার সাথে রিক্সা নিয়ে বের হয়েছে । ব্যাপারটা ভাবতেই ভালো লাগছে । আজকে যদিও উইক ডে, তার পরেও কেন জানি রাস্তা বেশ ফাঁকা । আমরা এদিক ওদিক দিয়ে ঘুরতে লাগলাম ।
মাঝে রাস্তা থেকে ওকে আরও বেশ কয়েকটা ফুল কিনে দিলাম । দুপুরের দিকে গিয়ে হাজির হলাম সোহাদের বাসায় । সোহা তৃষার সব থেকে কাছের বন্ধু । সেই হিসাবে আমারও কাছের বন্ধুতে পরিনত হয়েছে । আমাকে ড্রয়িং রুমে একা রেখে ওরা দুজন ভেতরে চলে গেল । দেখলাম একটু পরে সোহা হাজব্যান্ড এসে হাজির হল । আমার সাথে গল্প গুজব করতে লাগলাম । খাওয়া দাওয়া শেষ করে আরও অনেকটা সময়ই সোহাদের বাসাতে থাকলাম । বের হতে হতে বিকেল হল ।
ভেবেছিলাম যে হয়তো আমাকে এবার চলে যেতে হবে । ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে আমি নিজের বাসার দিকে রওয়ানা দিবো কিন্তু সোহাদের বাসায় নামতে গিয়ে দেখি তৃষার গাড়ি দাড়িয়ে রয়েছে সেখানে । তৃষা আমাকে গাড়িতে ওঠার ইংগিত দিয়ে নিজে বসলো ড্রাইভিং সিটে । তারপর গাড়ি স্টার্ট দিল ।
কেন জানি তৃষার মুখ আমি খানিকটা গম্ভীর দেখলাম । পুরোটা সময় তো তৃৃষা আমার সাথেই ছিল ! এর ভেতরে কি আবার কিছু হল ! আমি হঠাৎ বললাম, কিছু কি হয়েছে ?
তৃষা একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসলো । তারপর বলল, কই না তো ! কী হবে !
-তোমার মুখ এমন কেন দেখাচ্ছে !
গাড়ি ততক্ষণে বেড়িবাধের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে । জানাল খোলা । তৃষার চুল উড়ছে । তৃষা হঠাৎ বলল, হঠাৎ যদি আমি হারিয়ে যাই, তোমার কষ্ট হবে ?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন ?
-এমনি ! বল কষ্ট হবে ?
-তুমি খুব ভাল করেই জানো আমার কেমন অবস্থা হবে !
-হুম !
তৃষা আসলে আর কিছু বলল না । গাড়ি ছুটে চলল অনির্দিষ্ট ভাবে ! আমাকে যখন তৃষা আমার বাসার সামনে নামিয়ে দিলো তখন রাট প্রায় নয়টা বাজে । আমাকে নামিয়ে দিয়ে ও গাড়ি ঘোড়ালো ! আমার দিকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা তোমার ভ্যালেন্টাইনের গিফট ! বাসায় গিয়ে খুলো ! আর ভালো থেকো !
তৃষা গাড়ি নিয়ে চলে গেল । আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল । কেন জানি আমার হঠাৎ কষ্ট হতে লাগলো । তৃষার সাথে এমন একটা দিন কাটানোর জন্য আমি অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম । কোন এক ফাল্গুনে ও পরবে হলুদ আমি পরবো সাদা পাঞ্জাবি । দুজন এক সাথে ঘুরবো রিক্সাতে করে । ওর সাথে কতবার দেখা হয়েছে কিন্তু এই অবস্থা কোন দিন হয় নি ।বলতে গলে আজকে অনেক দিনের স্বপ্নটা পূরণ হল । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পূরণ না হলেই বুঝি ভাল হত !
বাসায় এসে খামটা খুলতে আমার মোটেই ইচ্ছে হল না । কাছেই এক বন্ধুর কাছে গিয়ে হাজির হলাম । আড্ডা চলল বেশ কিছু সময় ধরে ! রাতে খাবার খেয়ে যখন বাসায় উঠলাম তখন প্রায় এগারোটা বেজে গেছে । বাসায় এসে আমি তৃষাকে ফোন দিতে গেলাম । ফোনটা ঢুকলো না । বন্ধ । অন্য সব গুলো নাম্বারে ট্রাই করলাম সব গুলো বন্ধ !
কয়েকবার চেষ্টা করেও কাজ হল না । তখনই মনের ভেতরে কু কেরে উঠলো ! তৃষা আজকে হঠাৎ করেই এরকম ভাবে শাড়ি পরে আমার সাথে রিক্সায় ঘুরলো কেন ! এই আচরন তো ওর সাথে যায় না ! তাহলে ! এমন কেন করলোও ! আমি কেবল অনুভব করলাম যে আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে !
আমি এবার সোহাকে ফোন দিলাম । ওর ধরলো একটু পরেই। আমার কেন জানি মনে হল তৃষা আমার ইচ্ছেটা পূরণ করে চলে গেছে । আমি সোহাকে বললাম, তৃষার ফ্লাইট কখন?
সোহা কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, তোমাকে কিছু বলেছে ও ?
-না কিছু বলে নি । কেবল একটা চিঠি দিয়েছে । আমি এখনও খুলি নি ! ফ্লাইট কখন ওর !
-এই তো সাড়ে বারোটায় !
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম ! প্রায় বারোটার কাছাকাছি চলে গেছে সময় । এখন কোন ভাবেই এয়ারপোর্ট পৌছানো সম্ভব না । সোহা বলল, ওর পক্ষে তোমাকে বিদায় জানানো সম্ভব ছিল না । ও তোমার সাথে দেখাই করতে চাইছিলো না । আমি অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছি !
-আর কি আসবে না !
-না মনে হয় !
আমি ফোন রেখে দিলাম কেবল । আমার মনে হল যে আমি আর কোন কিছু অনুভব করছি না । আমার আর যেন কিছু নেই । তৃষার দেওয়া শেষ খামটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । ভেতরে কি লেখা আছে আমি জানি না । খুব ইচ্ছে হল খামটা এখনই খুলে পড়ে ফেলি, ভেতরে কী লেখা ! কিন্তু তখনই মনে হল পড়ে ফেললেই তো শেস হয়ে যাবে ! তৃষার শেষ কথা গুলো কেন জানি পড়তে ইচ্ছে হল না । ওটা থাকুক ওভাবে ! ওটা যতদিন পরবো না ততদিন ওটা খোলার একটা আশা থাকবে ! ওটা পড়ার জন্য বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে ! অন্য কোন ফাল্গুনে তৃষা নিশ্চয়ই আসবে আবার ! আরেক ফাল্গুনে আমরা আবারও রিক্সাতে করে ঘুরে বেড়াবো এক সাথে । আরেকটা ফাল্গুন আসবে অবশ্যই !