দ্যা ডার্ক কুইন (the start)

4.9
(25)

আসফিমা আস্তে আস্তে হাটছিলো অফিসের করিডোর দিয়ে । ওর পা দুটো যেন একটু একটু কাঁপছিলো । এতো বড় অফিসে যে ও চাকরি পাবে সেটা ও ভাবতে পারে নি । কিন্তু পেয়ে গেছে । তাও আবার যেনতেন চাকরি না । ডাইরেক্ট পিএস টু দ্য সিইও । সায়ান আহমেদের পিএস । কি অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার !
ওর বান্ধবীরা যখন বাপারটা জানতে পারবে তখন কি হবে ?
ওর চাকরি পাওয়ার ব্যাপারটা এখন কাউকে জানায় নি । এমন কি ওর নিজের বাসায়ও জানে না এই চাকরির ব্যাপারে !

এই চাকরিটা পেয়ে যে কেউ খুশি হবে । কিন্তু আসফিমা খুশি হতে পারছে না । বরং ওর মনের ভেতরে একটা অজানা আশংকা কাজ করছে । একটা ভয়ংকর কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে । সেই কাজের জন্যই তাকে এখানে আনা হয়েছে । সায়ান আহমেদের বিরুদ্ধে এমন একটা ষড়যন্ত্র চলছে সেটা কি সায়ান আহমেদ জানে ?
এতো বড় একটা কোম্পানি চালায়, আশে পাশে কত মানুষ অথচ একেবারে কাছের মানুষ তার পেছনে লেগেছে ।

আসফিমা ঘড়ির দিকে তাকালো । ঘড়িতে দশটা বাজতে এখনও দশ মিনিট বাকি । অফিসে এরই মধ্য প্রায় সবাই চলে এসেছে । তবে সায়ান আহমেদ এখনও আসে নি । তার আসতে আসতে সাড়ে দশটা । এমনই সময় বলা হয়েছে তাকে । এর আগে অফিসে পৌছে সব কিছু ঠিক ঠাক করতে হবে ।

-আসফিমা?

দাড়িয়ে গেল সে। কন্ঠস্বরটা চেনে সে । সায়ান আহমেদের আগের পিএস । কালকে জয়েন করার সময় মেয়েটার সাথে তার পরিচয় হয়েছে । মেয়েটা মোটামুটি সব দায়িত্বই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে । আজ থেকে তাকেই রিপ্লেস করবে সে ।

মেয়েটার নামটা আসফিমা ভুলে গেছে । কাল কি যেন বলেছিলো । একটু মনে করার চেষ্টা করবো বটে । খুব একটা কাজ হল না । চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিল । এই মেয়ের নাম মনে রাখার খুব একটা দরকার নেই। এই মেয়ের সাথে তার আর দেখা হবে না । মেয়েটা আসফিমার সামনে এসে দাড়ালো । একটু হেসে বলল, সময় মত চলে এসেছো । গ্রেইট ! স্যার চলে আসবে সাড়ে দশটার ভেতরেই । স্যার কেবিনে বসেই প্রথমে এক কাপ ব্লাক টি খায় । একেবারে র ।

দুজন বড় কেবিনে ঢুকলো । বড় কেবিনের একেদম সামনেই একটা ডেস্ক । এটাতে আজ থেকে তাসফিমা বসবে । ডেস্কটার ঠিক সামনেই সায়ান আহমেদের কেবিনের দরজা । দুজন কেবিনের ভেতরে ঢুকলো । আসফিমা গত কাল একবার এসেছিলো । সব কিছু দেখে গিয়েছে ।

গতকালই আসফিমা একটু অবাক হল । অন্যান্য অফিসে যেমন করে একটা বড় অফিস টেবিল থাকে, এই কেবিনে তেমন কোন টেবিল নেই । রুমটা অনেকটা কোন বাড়ির বসার ঘরের মত । একটা দামী বসার চেয়ার আছে । সেই তার পাশেই রয়েছে একটু ছোট টেবিল ।ঘরের ঠিক মাঝে রয়েছে বড় গোল সোফা । একেবারে অন্য পাশে রয়েছে একটা কম্পিউটার টেবিল । সেটাও খুব বেশি বড় না । কম্পিউটার টেবিলের পাশে একটা দরজা । সম্ভবত ওয়াশ রুম। ব্যাস এই হচ্ছে সিইওর রুম । মেয়েটা ওকে আরেকবার সব কিছু দেখিয়ে দিল । তারপর আবারও ফিরে এল আসফিমার ডেস্কের কাছে । ওর ডেস্কের ঠিক পেছনে রয়েছে আরেকটা ছোট ঘর । এটা মূলত রান্নাঘর । মেয়েটা ওকে দেখিয়ে বলল, এই পানি গরম দিয়ে দিলাম ।
এই বলে মেয়েটা ইলেক্ট্রিক সুইচটা অন করে দিল । স্যার যখন ঢুকবে এখান থেকে পানি ঢালবে কাপে । তারপর ঠিক এই টিব্যাগ থেকে দুইটা টিব্যাগ দুবাবে । আর কিছু না । মনে থাকবে !
আসফিমা মাথা ঝাকালো । এ আবার মনে না থাকার কি আছে ।

মেয়েটা আর দাড়ালো না । চলে গেল ওকে রেখে ।

নিজের ডেস্কে কিছু সময় বসে রইলো সে । হাতে এখনও বেশ কিছুটা সময় রয়েছে । আসফিমা কি করবে বুঝতে পারলো না । পানিটা একটু কমিয়ে দিয়ে আসবে ?
দরকার নেই । গরম হতে থাকুক । আপন মনে বসে বসে ভাবতে লাগলো ওর দুর্ভাগ্যের কথা । তাহলে কি ওর জীবনের সাথে আরেকটা দূর্ভাগ্য লেখা হয়ে থাকবে । আরেকটা মানুষের জীবন বিপদে পড়তে যাচ্ছে ওর কারণে । বিপদে ঠিক না, শেষ হতে যাচ্ছে !
এই নিয়ে কত জন হল?
সাত জন?
নাহ ! আটজন হবে । সাতজনকে সে এরই মধ্যে মেরে ফেলেছে ।
সায়ান আহমেদ হতে চলেছে আট নম্বর !

তখনই একজন সুদর্শন যুবক কেবিনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো । এই প্রথম সায়ান আহমেদকে সে সামনা সামনি দেখলো । ওর দিকে এক ঝলক দেখলো সে। যেন ওকে চিনতে পারে নি । অবশ্য আসফিমাকে তার চেনার কথা না ।
-ইউ আর দ্য নিউ ওয়ান ?
কি তীব্র কন্ঠ !
-জ্বী স্যার ।
কিছু সময় দাড়িয়ে গভীর ভাবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে । তারপর বলল, চা নিয়ে এসো !
-জ্বী স্যার ।

সায়ান আহমেদ কেবিনের দরজা ঠেকে ঢুকে গেল । আসফিমা বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল । তারপর রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে গেল । এতো চমৎকার একজন মানুষকে সে মেরে ফেলতে যাচ্ছে ভাবতেই কেমন লাগলো ওর !

দুই

সকালের আকাশটা বেশ চমৎকার ছিল । একটু মেঘলা মেঘলা । আসফিমা ঘুম ভেঙ্গে যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো তখন একবারেই তার মন ভেঙ্গে গেল । সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে সে আজকে আর ক্লাসে যাবে না । মাস্টর্সে উঠে এখন আর আগের মত নিয়মিত ক্লাস করতে ইচ্ছে করে না ওর । হলের বিছানাতে আরও বেশ কিছু সময় গড়াগড়ি খেল । তারপর এক সময় মনে হল এই ভাবে শুয়ে বসে এতো চমৎকার একটা দিন কোন ভাবেই নষ্ট করার দরজার নেই । বরং একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা যাক । আজকের দুপুরের লাঞ্চটা বাইরে করবে সে । এমনই প্লান নিয়ে সে বাইরে বের হয়েছিলো । দিনটা চমৎকার ভাবে কেটেও যাচ্ছিলো । মাঝে মাঝে একটু একটু বৃষ্টি শুরু হলেই আসফিমা নিজের ছাতাটা বের কর নিচ্ছে । সময়টা বেশ কাটতে লাগলো ওর । কিন্তু এক সময় প্রবল বর্ষন শুরু হয়ে গেল । বাইরে ছাড়া নিয়ে হাটার উপায় রইলো না আর চট করে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লো ।

ভেবেছিলো যে হয়তো ভীড় থাকবে বেশ কিন্তু দেখা গেল একদমই ভীড় নেই । মেনু কার্ড দেখে মনে হল একটু প্রাইসী তবে আসফিমা লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দিল । তারপর আপন মনে নিজের মোবাইল বের করে ব্রাউজ করতে শুরু করলো । কত সময় পার হয়েছে ঠিক টের পেল না কিন্তু ওর মনে হল যে এতো সময়ে খাবার চলে আসা উচিৎ ছিল । কিন্তু আসে নি । মোবাইল থেকে মুখ তুলে সামনে তাকাতে দেখলো পুরো রেস্টুরেন্টে কেবল একজন মানুষ ছাড়া কেউ নেই । মানুষটা ওর দিকে পেছন ফিরে রয়েছে বলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না । এছাড়া পুরো রেস্টুরেন্টে আর কেউ নেই । এমন কি দরজা দিয়ে ঢুকতে যে কাউন্টার ছিল সেখানেও কেউ নেই । এবং আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করতেই আসফিমা চমকে উঠলো । দরজার সামনে ওপেন লেখা সাইনবোর্ডটা দেখা যাচ্ছে ।

প্রতিটি রেস্টুরেন্টেই এই রকম ওপেন/ক্লোজড লেখা সাইন থাকে । ভেতর থেকে ওপেন সাইণটা দেখা যাচ্ছে, তার মানে বাইরে যারা রয়েছে তারা দেখছে ক্লোজড ! আসফিমার মনের ভেতরে কু ডেকে উঠলো । এখন ও কি করবে ?
উঠে চলে যাবে?
খাবারের অর্ডার তো দেওয়া হয়ে গেছে !
যাক! ও চলেই যাবে!
ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠতেই সেই মানুষটা ওর দিকে ফিরে তাকালো ।

সুদর্শন একজন মানুষ । উঠে দাড়িয়ে আসফিমার দিকে হাটতে লাগলো ! আসফিমা সোজা হয়ে দাড়িয়ে রইলো কেবল । মানুষটার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করছে । ওর থেকে কয়েক বছরের বড় হবে কেবল । পোশাক দেখে বেশ বড় লোক মনে হচ্ছে । মানুষটা ওর একদম সামনের চেয়ারে এসে বসে বলল, বস মিমু ।

এবার সত্যিই চমকে উঠলো আসফিমা । ওর নিকনেম টা খুব কম মানুষ জানে । এই মানুষটা কিভাবে জানলো ?
সে বলল, তোমার ভয় পাওয়ার কি কারণ আছে সেটা আমি ঠিক বুঝি না । আই মিন তুমি নিশ্চয়ই জানো তুমি কি ? রাইট ?
এবার আসফিমা সত্যি সত্যিই অবাক হল । নিশ্চিত হয়ে গেল যে সামনের বসা এই মানুষটা তাকে খুব ভাল করে চেনে । অন্তত তার ব্যাপারে খুব ভাল করে খোজ খবর নিয়ে সে এসেছে । কিন্তু কেন?
আসফিমার মনে হল সে এখনই চলে যায় । কিন্তু এই মানুষটাকে তাকে চলে যেতে দিবে ?
সে বলল, বসুন মিস আসফিমা ! আপনার সাথে কিছু কথা আছে ।
এতো সময় পরে আসফিমা মুখ খুলল, বলল, আপনাকে আমি চিনি না । আপনার সাথে কেন কথা বলবো?
সে হাসলো । তারপর বলল, না বললে তোমারই ক্ষতি । তোমার শান্তির জীবনে আবারও অশান্তি নেমে আসবে !
একটা ঠান্ডা অনুভূতি বয়ে গেল আসফিমার শরীর দিয়ে । বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে সে বরাবরই খুব সাবধান ছিল । তাই মোটামুটি এই সময়টা ভাল ভাবেই কেটে গেছে । নিজের এলাকার মানুষজন সে এড়িয়ে যেত ক্যাম্পাসে । বেশি ভাগ সময়ই মুখে মাস্ক পরে থাকতো নয়তো ওড়ণা নিয়ে নিজের মুখটা পেঁচিয়ে যাতে হুট করেই এলাকার কেউ তাকে চিনে না ফেলে । তবে ওর নিজের এলাকা থেকে ঢাবিতে পড়তে আসা মানুষের সংখ্যা খুবই কম । আর যথাযত সাবধানতা অবলম্বন করার কারণে এলাকার মানুষজন ওকে চিনতে পারে নি । শান্তিতে ছিল বেশ কিছুটা সময় ।

আসফিমা বসে পড়লো । সামনে বসা মানুষটা বলল, শুনো, আমার একটা ছোট কাজ করে দিতে হবে । ব্যাস তোমার ঝামেলা শেষ ।
-ছোট কাজ বলতে ?
-তুমি সায়ান আহমেদের নাম শুনেছো নিশ্চয়ই । দেশের সব থেকে ইয়াগেস্ট সিইও! মোটামুটি সেলিব্রেরি সে ! বিশেষ করে উইনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েদের কাছে খুবই জনপ্রিয় সে ! নাম নিশ্চয়ই শুনেছো !
আসফিমা শুনেছে তার নাম । কেবল মাথা ঝাকালো ।
-তোমাকে তার মেরে ফেলতে হবে !
-কি !

আসফিমা কিছুটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । সামনে বসা মানুষটা খুবই শান্ত আর স্বাভাবিক কন্ঠেই কথাটা বলল। আসফিমা বলল, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে । তাকে মারতে চান খুনী ভাড়া করুন । আমি কি খুনী নাকি ?

আসফিমার কথা শুনে যেন খুব মজা পেল সে । একটু হেসে উঠলো । তারপর বলল, এখনও পর্যন্ত সাতজন মানুষ মানুষকে মেরেছো তুমি? তাই না ?

কথাটা শুনে ফ্রিজ হয়ে গেল আসফিমা ! কি বলবে বুঝতে পারলো ন। আসফিমার বুঝতে পারলো সামনের মানুষটা ওর ব্যাপারে সব কিছু জানে । সব কিছু । এবার খানিকটা ভীত হয়ে উঠলো সে ।
-আমি কাউকে ইচ্ছে করে মারি নি । কাউকে না !
-এটা মিথ্যা কথা । ছয়জনকে তুমি ইচ্ছে করে মারো না । ইভেন তোমার দোষও ছিল না । কিন্তু একজন কে তো ইচ্ছে করে মেরেছো, তাই না ?
-আপনি কিছু প্রমাণ করতে পারবেন না ।

আবারও মানষটা হেসে ফেলল । বলল, প্রমাণ করতে পারবো না সত্য । কিন্তু আমি এর থেকে ভয়ংকর কাজ করতে পারি । লাইক একবার চিন্তা কর তোমার এখন পরিচিত সব মানুষের কাছে যদি এই খবর চলে যায় যে তুমি একটা ভয়ংকর অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছো । যাকেই তুমি ভালবাসো সেই মারা যায় ।
-এটা মোটেই ঠিক না । আমি যাকে ভালোবাসি সে মোটেই মারা যায় না !
-ভালবাসা বলতে আমি আমি কি বলতে চাচ্ছি সেটা জানো । যাই হোক সেটা প্রশ্ন না । আমি যদি বলি তাহলে একবার দেখো কি রকম প্রতিক্রিয়া হবে । আমি প্রমাণ হাজির করবো। এখনও পর্যন্ত যে যে তোমার সাথে রিলেশন করেছে সবাই মারা গেছে । যাই নি ?

আসফিমা লক্ষ্য করলো তার চোখ দিয়ে পানি বের হতে শুরু করেছে । সে আবার বলল, এটা সত্য যে সম্পর্ক কিংবা ভালবাসলেই সে মারা যায় না কিন্তু এই কথা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে তোমার থেকে সবাই ছিটকে দুরে চলে যাবে । যাবে না ?
আসফিমা জানে ঠিক এমনটাই হবে । এর আগেও ওর সাথে ঠিক এমনটাই হয়েছে । আর এমনটাই হবে । কাছের সব বন্ধু গুলো একে একে দুরে চলে যাবে । নিজের পরিবারই যেখানে ওকে দুরে ঠেলে দিয়েছে সেখানে অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ কি !

আসফিমা বলল, আমাকে কি করতে হবে ? আমি সায়ান আহমেদকে কিভাবে মারবো ? সে কোন ভাবেই আমার প্রেমে পড়বে না । ইভেন আমি তো তার কাছে যেতেই পারবো না ।
-রিল্যাক্স । সেই ব্যাবস্থা আমি করবো । তোমার কাজ হবে কেবল তাকে তোমার ….
শব্দটা শেষ করলো না । আসফিমা নিজেকে বড় অসহায় মনে করলো । এমন একটা অসহায়ত্বের অনুভূতি তার আগে কখনও হয় নি । এর আগে ওর সাথে যত গুলো দূর্ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর ব্যাপারে ও কিছুই জানতে পারে নি । স্ব-ইচ্ছেতে কিছুই করে নি সে । তবে একজনের সাথে ইচ্ছে করেই সব কিছু করেছে । আবির নাম ছিল তার ।

আসফিমা বলল, আপনি কিভাবে জানলেন আবিবের ব্যাপারে ?
-আবির ! আবির আমার বন্ধু ছিল ! বন্ধু বলতে খুবই কাছের বন্ধু ।
-আপনার ঐ বন্ধু জানোয়ার ছিল । বোধকরি আপনিও তাই !

ছেলেটা রেগে গেল না । হা হা করে হেসে উঠলো । তারপর বলল, আবিরের মেয়েদের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষন ছিল আর বুঝতেই পারছো, তার বাবার টাকা ছিল তাই এসব করতে খুব একটা সমস্যা হত না ।
-এতোই যখন শখ তাহলে টাকা দিয়ে ভাড়া পাওয়া যায় সেখানে কেন যায় না । নীরিহ মেয়েদের কে টার্গেট করতো?
-এটা ওর চয়েজ ! কিন্তু তাই বলে তুমি তাকে মেরে ফেলতে পারো না নিশ্চয়ই !
-আমি তাকে মারি নি । সে তার নিজের লোভের কারণে মরেছে । এমন কি আগে যারা মরে সবাই এই লোভের কারণেই ।
-বুঝতে পারছি । যাই হোক তোমাকে কিভাবে খুজে পেলাম বলি ! আবির যখন মরলো আমার মনে কেমন যেন কৌতুহল হল । ও মারা গেছে একেবারে সুস্থ অবস্থায় । একেবারে নিরোগ । এভাবে একটা মানুষ মারা যেতে পারে না । পুলিশ ডাক্তার পর্যন্ত বুঝতে পারে নি । নিজের ঘরে দরজা বন্ধ অবস্থায় । আমি কেবল একটা জিনিস ভাবতে শুরু করলাম । আবির গত এক মাসে কি কি কাজ করেছে । খোজ নিয়ে জানতে পারলাম যে সব কিছুই স্বাভাবিক । মানে হচ্ছে সে সারা জীবন যা করে । জিম, মুভি শপিং আড্ডা ! কেবল একটা জিনিস ছিল নতুন । তুমি । তুমি ওর গার্লফ্রেন্ড ছিল গত এক মাস ধরে । পুলিশও তোমার ব্যাপারে খোজ নিয়েছিলো তবে আবিরের স্বভাব জেনে আর কিছু মনে করে নি । কিন্তু আমার কেন যেন সন্দেহ হল । আমি তোমার ব্যাপারে খোজ নিলাম । তোমার এলাকাতে খোজ গেলো । এবং সেখান থেকেই ইন্টারেস্টিং খবরটা পেলাম । স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত এমন ছয়জন মানুষ মরেছে যাদের সাথে তোমার কিছু যোগ ছিল । এর ভেতরে তোমার এক মামাতো ভাই আছে, স্কুল কলেজের দুজন শিক্ষক আছে । আর দুইজন প্রেমিক আছে । তাই না ! আর একজন সম্ভবত তোমার বাবা বন্ধু !

সামনের মানুষটা থামলো । আসফিমা চুপ করে শুনতে লাগলো । ওর মনে হল যেন ওর চোখের সামনে আস্তে আস্তে সবার চেহারা ফুটে উঠতে শুরু করেছে । একটা তীব্র অনুশোচনা বোধ তার ভেতরে চলে আসতে শুরু করেছে । সে আবার বলল, তোমার নামে রিউমারটা ভাল ভাবেই ছড়িয়েছে বুঝলে !
আসফিমা বলল, কোন নিশ্চয়তা নেই যে হবেই !
-দরকার নেই । আই উইল টেক মাই চান্সেস !
-কেন ? সায়ান আহমেদের সাথে আপনার কেন এতো শত্রুতা ! তাকে কেন মারতে চান ?

সামনে বসা মানুষটা এবার হাসলো । তারপর বলল, তুমি আমাকে এখনও চিনতে পারো নি ?
আসফিমা তার দিকে ভাল করে তাকালো । সে বলল, ওয়েল আমি আমার ভাইয়ের মত এতো বিখ্যাত নই ।
তীব্র একটা বিস্ময়বোধ আসফিমাকে পেয়ে বসলো । সায়ান আহমেদের আপন ভাই তাকে মেরে ফেলতে চাইছে ! এটা কেমন কথা !

সে পকেট থেকে একটা খাম বের করে দিল আসফিমার দিকে । তারপর বলল, এখানে তোমার এপয়েন্টমেন্ট লেটার রয়েছে । আগামী কাল বিকেলে তুমি অফিস গিয়ে হাজির হব । তোমার নাম রিসিপশনেই বলা থাকবে । সে তোমাকে নিয়ে যাবে । আর আপাতত পঁচিশ হাজার টাকা রয়েছে এখানে। তোমার হাত খরচের জন্য । কাজ শেষ হলে তোমাকে ২৫ লাখ টাকা দিবো আমি । এছাড়া চাকরি করা বাবদ বেতন তো পাবেই সেটা আলাদা । কাজ শেষ করে তুমি চাইলে চাকরি ছেড়েও দিতে পারো আবার সেখানে চাকরি করতেও পারো । তখন তুমি আমার হয়ে কাজ করবে ! আই গেস এতে দুজনেরই লাভ ! তাই নয় কি !

আসফিমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে উঠে গেল । সে আরও কিছু সময় বোকার মত বসে রইলো । একটু একজন মানুষ ওকে অন্য আরেকজন মানুষকে খুন করতে কন্ট্যাক্ট দিয়ে গেল । সে কি খুনী ?
হ্যা সে তো খুনী ! যে কালো অভিশাপটা তার ভেতরে রয়েছে সেতো খুনী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না !

তিন

আসফিমা প্রথমে যতটা ভয় পেয়েছিলো, চাকরি শুরু করার পরে সেই ভয়টা একদমই কেটে গেল । তাকে যে কাজের জন্য এখানে পাঠানো হয়েছে তার এখন মনে হচ্ছে যে সেটা তাকে করতেই হবে এমন কিছু না । তার নিয়োগ কর্তাকে সে বলে দিবে যে সায়ান আহমেদকে প্রেমে ফেলতে পারে নি । ব্যাস ঝামেলা শেষ । তার একটা ধারনা হয়েছে সায়ান আহমেদ তার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করবে না ।
এই ব্যাপারে সে আরও একটু নিশ্চিত হয়েছে গত দিন । সায়ান আহমেদের একটা প্রেমিকা রয়েছে । মেয়েটা কে এখনও নিশ্চিত করে বুঝতে পারে নি সে তবে আছে সেটা সে নিশ্চিত । সায়ান আহমেদকে সে ফোনে কথা বলতে শুনেছে। সম্ভবত মেয়েটা ফিল্ম কিংবা নাটকে অভিনয় করে । অন্তত যে কয়েকটা লাইন সে শুনেতে পেয়েছে তাতে তাই মনে হয়েছে । তাহলে মোটামুটি নিশ্চিত যে সায়ান তার প্রেমে পড়বে না । আর প্রেম না পড়লে ঐদিকে যেতেও হবে না ! অবশ্য একটা সমস্যাই রয়েই যায় । সেটা হচ্ছে সায়ান যদি পুরুষদের মত পার্ভাট হয়? ঘরে বউ থাকলেও অনেকে অফিসের পিএ কিংবা কলিগের সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে । কেউ কেউ আবার জোর জবরদস্তিও করে মেয়েদের একা পেয়ে । সায়ান যদি এমন কিছু করে ? তার সে সুযোগ রয়েছে বেশ ভাল ভাবেই ।

আসফিমা নিজের মনকে এবার শান্ত করলো । তারপর মনে মনে বলল, এই রকম পার্ভাটদের মরে যাওয়াই ভাল । যেমনটা মরেছিলো তার মামাতো ভাইটা । তার বয়স তখন কত ছিল? সবে মাত্র নাইনে উঠেছে সে । মামার বাসা ছিল ওদের বাসা থেকে একটু কাছেই । স্কুল শেষ করে ঐ বাসায় গিয়ে হাজির হয় । গিয়ে দেখে সেখানে মামা মামী কেউ নেই । চলে আসতে গেলে মামাতো ভাই তাকে অপেক্ষা করতে বলে । নিরীহ মনে সে বসে অপেক্ষা করতে শুরু করে ! এমনই সময় পেছন থেকে এসে ওকে জাপটে ধরে সে !
এই দেশে অধিকাংশ মেয়েদের সাথে এই রকম অপ্রীতিকর কাজ গুলো করে আত্মীয় স্বজনেরা । মেয়েরা যখন এই ঘটনা পারিবারকে বলতে চায় তখন তারাই চুপ করিয়ে দেয় লাজ লজ্জার ভয়ে । কোন কোন বাবা মা আবার সেই মেয়েটাকেই দোষারোপ করতে থাকে । যেন যা হয়েছে সব দোষ এই মেয়ের। ঐ ললুপ দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকা জানোয়ারটার যেন কোন দোষ নেই ।

প্রথমে আসফিমা কিছু বুঝতেই পারে নি । যখন বুঝতে পারলো তখন চোখ ফেঁটে কান্না চলে এল । চিৎকরে কাঁদতে চাইলো কিন্তু সেই শক্তি ওর শরীরে ছিল না । ওর মামাতো ভাই ওর মুখ চেপে ধরেছিলো । বাসায় এসে যখন মাকে এই কথা বলেছিলো ওর মা ওকে কষে এক চড় মেরেছিলো । তার মায়ের প্রথম কথাই ছিল কেন গিয়েছিস ঐ বাড়িতে একা একা ?
আসফিমা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো কেবল ! কোন কথা যেন বলতে পারছিলো না । নিজের মায়ের কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে ! রাতে নিজের ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে কেবল উপরওয়ালার কাছে প্রার্থণা করছিলো যেন সে মারা যায় । সকালের মুখ যেন তাকে আর দেখতে না হয় !

পরদিন সকালে আসফিমার ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করে । ঘুম থেকে জেগে দেখতে পেল বাসায় কেউ নেই । কাজের মেয়েটা ছিল । তার কাছেই শুনতে পেল তার বাবা মা আর ছোট ভাই গিয়েছে তার মামার বাসায় । তার মামাতো ভাই রাকিব মারা গেছে সকালে । প্রথমে কিছু বুঝতে পারে নি সে । সত্যিই সে এটা শুনেছে নাকি এখনও স্বপ্নই দেখছে । কিন্তু না সে স্বপ্ন দেখছে না । সত্যিই ঐ জানোয়ারটা মারা গেছে ।

দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে ঠিক তার ছয় মাসের মাথায় । সেদিন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিলো । রাস্তাঘাট ফাঁকাই ছিল একদম । সন্ধ্যায় সেদিন টিউশনী থেকে বাসায় আসার সময়ে তার বাবার বন্ধুর সাথে দেখা হয় । সে বাইক নিয়ে তার পাশে এসে দাড়ায় এবং আসফিমাকে লিফট দিতে চায় । আসফিমা খুশি হয়েই উঠে বসে বাইকে । কিন্তু ঘটনা যায় অন্য দিকে ।

সেদিনও কাঁদতে কাঁদতে সে বাসায় আসে । তবে বৃষ্টির পানির কারণে সেই কান্না কেউ দেখে নি । গতবারের মত মাকে সে বলেও নি । পরদিন সকালে উঠে ঠিক একই কথা শুনতে পেল সে । তার বাবার বন্ধু মারা গেছে । কেন মারা গেছে কেউ বুঝলো না কিন্তু আসফিমা বুঝে গেল । তার মনে একটা অদ্ভুত ভয় এসে জমা হল । সেই সাথে একটা শান্তির অনুভূতিও হতে লাগলো ।

-আসফিমা!
-জি স্যার?
-আসরাফ ব্রাদার্সদের ফাইলটা খুজে পাচ্ছি না । একটু দেখবে কি ?

ফোন রেখে আসফিমা তার বসের ঘরের দিকে ছুটলো । ফাইনটা আজকেই কম্পিউটার টেবিলের উপরে রেখেছিলো । সেখান থেকেই খুজে এনে দিল।
-আর কিছু লাগবে স্যার ?
-না । তবে আজকে তোমার একটু দেরি হবে বাসায় যেতে !
-দেরি !
-তুমি তো এখনও হলে থাকো, রাইট ?
-জি স্যার । হলের গেট কখন বন্ধ হয় ?
-মেয়েদের জন্য নয়টার ভেতরে !
-তাহলে আজকে হলে ফিরে লাভ নেই । আসরাফ ব্রাদার্সদের সাথে আমাদের ডিলটা হবে ফার্মহাউজে । কাজ শেষ হতে হতে নয়টা দশটা বাজবে । তুমি রাতে ওখানে থেকো । সকালে অফিস চলে এসো ! ঠিক আছে?

আসফিমা মনের ভেতরে কু ডেকে উঠলো । মাত্র সাত দিনের মত হয়েছে জয়েন করেছে সে এখানে । এই সাত দিনের ভেতরে ওকে থাকতে হবে বসের সাথে ! তাও আবার ফার্মহাউজে !
আসফিমার এখন কি করা উচিৎ ?
সায়ানকে বলবে যে ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব না । কিন্তু না গেলে কি চাকরি থাকবে ? তাহলে ? আজকেই সে সুযোগ চলে আসবে?

দুপুরের একটু পরেই সায়ান আহমেদের গাড়িতে করেই আসফিমা রওয়ানা দিল । ফার্মহাউজে পৌছাতে পৌছাতে ঘন্টা দুয়েক লেগে গেল । অফিস থেকে বের হতেই বেশ বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় । তাই রাস্তাঘাটে প্রচুর জ্যাম ছিল । তারপরেও কিছুটা সময় হাতে রেখেই ওরা ফার্মহাউজে পৌছালো । ডিলারদের আসতে আরও কিছুটা সময় বাকি আছে । এই সময়ে আসফিমা ফাইল পত্র রেডি করতে শুরু করলো । তখনই আসফিমা লক্ষ্য করলো সায়ান আহমেদ ফার্মহাউজের উঠানো দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে । স্যুটের ব্লেজার খুলে ফেলেছে । প্যান্ট আর শার্ট পরে রয়েছে । বৃষ্টিতে ভিজে শাদা শার্ট শরীরের সাথে লেপটে আছে । আসফিমা চাইলেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারলো না । কেবল যে সায়ান আহমেদের অনেক টাকা পয়সা রয়েছে এই জন্যই মেয়েরা তাকে পছন্দ করে না । দেখতে সায়ান আহমেদ খুবই সুদর্শন । সেই সাথে জিমে যাওয়া পেটা শরীর । যে কোন মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মত । আসফিমা কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো কেবল । একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর মনে ।

-আসফিমা !
-জি স্যার ।
বাস্তবে ফিরে এল সে ।
-কাজ শেষ ?
-জি স্যার মোটামুটি সাজানো শেষ ।
-ওরা ফোন দিয়েছিলো । বৃষ্টি কারণে হয়তো আর ঘন্টাখানেক দেরি হবে আসতে । তুমি চাইলে ফ্রেস হয়ে নাও । আর ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে পারো ।

আসফিমার খুব ইচ্ছে করছিলো বৃষ্টিতে ভিজতে । আগে একটা সময়ে বৃষ্টিতে ভিজতে সে খুব পছন্দ করতো । ওর মনের ভেতরে ইচ্ছে ছিল তার ভালবাসার মানুষটাকে নিয়ে সে বৃষ্টিতে ভিজবে । হয়তো খুব শক্ত করে চুমু খাবে । কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়ে ওঠে নি ।
আজকে ভিজতে চাইলেও উপায় নেই । ওর সাথে করে আর কোন পোশাক আনে নি । এটা ভিজে গেলে পরে কি পরবে !

সেটা বাদ দিয়ে সে সায়ানের বৃষ্টিতে ভেজা দেখতে লাগলো । একটা সময় সায়ান হঠাৎ করেই ফার্ম হাউজের বইরে চলে গেল । আসফিমা চাইলেও দেখতে পাচ্ছে না সে কোথায় গেল । তবে একটু পরে খানিকটা হইচইয়ের মত আওয়াজ শুনতে পেল সে । একটু পরেই বুঝতে পারলো যে গেটের বাইরে বেশ কিছু বাচ্চা ছেলে জড় হয়ে আছে । তারাই আনন্দধ্বনি করছে । মাঝে মধ্যে অল্প খুলে রাখা গেট দিয়ে কাউকে কাউকে দেখা যাচ্ছে । তারপরই আসফিমা বুঝতে পারলো ব্যাপার টা !
সায়ান আহমেদ ফুটবল খেলছে বাচ্ছা ছেলেদের সাথে !

আপন মনেই হেসে ফেলল আসফিমা !
কি আজিব একটা ব্যাপার!

ডিলার এসে পৌছলালো সন্ধ্যার পরে । মুল কাজ সায়ান করলেও আসফিমা পুরোটা সময় তার পাশেই ছিল । যে কোন দরকার সায়ান বারবার আসফিমার নাম বারবার নিচ্ছিলো আসফিমা সেটা আস্তে আস্তে এগিয়ে দিচ্ছিলো । এছাড়াও ডিলারদের রাতের ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো । সেটার দায়িত্বও আসফিমার উপরেই ছিল । সে সেটা বেশ ভাল ভাবেই সামলে নিল । নিজের কাজ করার ক্ষমতা দেকে নিজেই অবাক হয়ে গেল । যখন সব কাজ কর্ম শেষ হল তখন প্রায় এগারোটা বেজে গেছে । রাতের ডিনার শেষ করে ডিলাররা চলে গেল বারোটার ভেতরে । তখন পুরো ফার্ম হাউজে চারজন কাজের লোক আর ওরা দুইজন । কাজের লোক গুলো রাতে ফার্ম হাউজে থাকবে না । তাদের জন্য আলাদা কটেজ আছে পাশে ।

আসফিমা নিজের রুমে এসে কিছু সময় পায়চারি করতে থাকলো । ওর মনে এবার একটু একটা ভয় করতে শুরু করেছে । এখন যদি দরজাতে সায়ান আহমেদ টোকা দেয় এবং ঘরে ঢুকে পরে তখন আসফিমার কিছু করার থাকবে না । এবং …..

লাইনটা আর ভাবতে পারলো না । তখনই দরজাতে টোকা পড়লো । আসফিমা কেঁপে উঠলো কেবল । নিশ্চিত জানে দরজাতে কে টোকা দিয়েছে !
কি করবে এখন ও !!

চার

বাইরে আবারও বৃষ্টি শুরু হয়েছে । আসফিমা দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল । ফার্মহাউজটার এরিয়া বেশ বড়। সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে ফার্মহাউজটা উপরে ছাদ গোলপাতা দিয়ে তৈরি । ঢাকার এতো কাছে গোলপাতা দিয়ে তৈরি বাড়ি । বৃষ্টি গোলপাতার উপরে পড়ছে । অদ্ভুত চমৎকার একটা আওয়াজ হচ্ছে । সম্ভবত আজকে সারা রাত বৃষ্টি হবে ।

আসফিমা বাইরে বের হল । ওর পরনো সারা দিনের সেই শাড়িটা নেই । তার বদলে একটা লম্বা টিশার্ট আর একটা থ্রিকোয়াটার প্যান্ট রয়েছে । একটু আগে দরজাতে এসে এই পোশাক দুটোই দিয়ে গিয়েছিলো সায়ান । দরজায় আঘাত শুনেই খানিকটা কেঁপে উঠেছিলো আসফিমার মন । ভীত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল । একবার মনে হয়েছিলো দরজাটা খুলবে না সে । কিন্তু ওর নাম ধরে যখন সায়ান আহমেদ ডাক দিল তখন আর দরজা না খুলে উপায় ছিল না ।

দরজা খুলতেই সায়ান আহমেদকে দেখা গেল । হাতে দুটো প্যাকেট । সে দুটো ওর আসফিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই শাড়ি পরে রাতে ঘুম হবে না । এর থেকে এই টিশার্ট আর প্যান্ট পরে নাও । এগুলো একেবারে নতুন ।
আসফিমা কেবল মাথা নাড়ালো । যা ভেবেছিলো সেই রকম কিছু না হওয়াতে ও একটু শান্তি পেল যেন । সায়ান চলে যাবে তখনই আবার ঘুরে দাড়ালো । তারপর বলল, বাইরে চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে । আমি নিজের জন্য এক কাপ কফি বানাচ্ছি । তুমি খেতে চাইলে তোমার জন্য বানাতে পারি এক কাপ !
আসফিমা তাড়াতাড়ি বলল, স্যার আমি বানিয়েনিয়ে আনছি !
-না না ! তোমার বানাতে হবে না । তুমি ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় আসো !
-জি আচ্ছা স্যার !

বারান্দার উপরে বসানো হয়েছে একটা টি টেবিল । তার দুপাশে দুটো বেতের চেয়ার । তারই একটাতে সায়ান বসে আছে । ওর হাতে কফির কাঁপ । আরেকটা কাপ টেবিলের উপরে ঢেকে রাখা হয়েছে । আসফিমা ধীরে পায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ায়ে বসল । তারপর খানিকটা সংকোচের সাথেই কাপটা তুলে নিল । সম্ভবত কোন বস তার এপ্লোয়রীর জন্য এই প্রথম কফি বানিয়ে দিল ।
সায়ান এক ভাবে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে !
আসফিমা বলল, স্যার কফি ভাল হয়েছে !
সায়ান হাসলো । তারপর বলল, খুশি করার জন্য বলছো নাকি সত্যিই সত্যিই বলছো ?
-সত্যিই বলছি স্যার ।
-ধন্যবাদ !
-আপনার কি বৃষ্টি খুব পছন্দ ?
-বলতে পারো ! সময় সুযোগ পেলে আমি বৃষ্টিতে ভিজি ।

কিছু সময় দুজন চুপ করে কফির কাপে চুমুক দিয়ে গেল। কফি যেন শেষ হওয়ার পথে তখন সায়ান বলল, তো আমাকে মেরে ফেলার প্লান কি করলে !

আরেকটু হলেই আসফিমার হাত থেকে কফির কাপটা পরে যেত । খানিকটা চমকে উঠলো সে । সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো খুব শান্ত ভাবে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে । বৃষ্টি দেখছে । আসফিমা কি বলবে খুজে পেল না ।
সায়ান আবার বলল, আয়ান এর আগেও আমাকে দুইবার মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে । একবার যেদিন প্রথমে আমাদের বাবা সব কিছুর দায়িত্ব আমাকে দিবে বলে ঘোষণা দিল । বলা যার সরাসরি আমার দিকে গুলি চালিয়েছিলো ।
আসফিমার মুখ দিয়ে আপনা আপনি বের এল, তারপর ?
-ওটা একটা এয়ারগান ছিল । পাখি মারার বন্দুক । আমার শরীরে যদিও লেগেছিলো খুব একটা ক্ষতি হয় নি !
-তারপর ?
-দ্বিতীয়বার বাবা মারা যাওয়ার বছর খানেক পরে । আমার গাড়ির ব্রেক কেটে দিয়ে । সেইবারও দূর্ঘটনাতে পড়েছিলাম বটে তবে মাইনর এক্সিডেন্ট ছিল ।
-আপনি মেনে নিয়েছেন সব ?
-ছোট ভাই তো ! ওর রাগের কারণ আমি বুঝতে পারি । তবে ওকে একটা ব্যাপার পরিস্কার করেই বুঝিয়েছি যে আমার যদি অপঘাতে মৃত্যু হয়, কেউ যদি আমাকে খুন করে তাহলে সন্দেহ সবার আগে তার উপরে গিয়ে পড়বে । সো এমন কিছু পরিকল্পনা করতে যাতে মৃত্যুটা স্বাভবিক হয়! তোমাকে তো এই কারণেই চাকরি দিয়েছে । তাই নয় কি?

আসফিমার ভয় পাওয়া উচিৎ । কিন্তু যেন জানি তার মোটেই ভয় করলো না । সায়ান আবার বলল, তুমি যদি আমাকে যে কোন ভাবে মেরে ফেলো সেটার দোষও ওর উপরে গিয়েই পড়বে । তার হাত দিয়েই তুমি কোম্পানীতে ঢুকেছো । গাধাটা এটা কেন বুঝছে না ।
আসফিমা হঠাৎ বলল, আমার কারণে যদি আপনার মৃত্যু হয় তাহলে তার উপর দোষ পড়বে না । এমন কি আমার উপরেও না !
সায়ান এবার আসফিমার দিকে তাকালো । চোখে খানিকটা কৌতুক কিংবা কৌতুহল ! বলল, তোমার ব্যাপার আমি খোজ খবর নিয়েছি । কই আমি তো তেমন কিছু পাই নি । খুবই স্বাভাবিক একজন মেয়ে তুমি । এর আগে এমন কিছু করোও নি কিছু !
আসফিমা বলল, আমি ভাল করে খোজ নেন নি । নিলে জানতে পারতেন ।
-আচ্ছা ! ওকে যাও ! তোমাকে আমি এই সুযোগ দিলাম । টেইক ইয়োর টাইম । আমি তোমাকে বাঁধা দিব না । আয়ানকেও কিছু বলবো না । যদি আপন ভাই আমাকে মেরে ফেলতে চায় কেবল মাত্র টাকা পয়সার জন্য তাহলে আমার মনে হয় না বেঁচে থাকা উচিৎ !

ব্যাপারটা যে এই দিকে যাবে আসফিমা বুঝতে পারে নি । তবে মনে মনে সে খানিকটা খুশিই হল । অনেকটাই ভার মুক্ত মনে হল । ওর আসলে আগে থেকেই ভাবার দরকার ছিল । এতো বড় একটা কোম্পানি সামলায় যে মানুষ সে কোন প্রকার খোজ খবর না নিয়ে একজনকে তার সাথে সাথে রাখবে ! এখন সায়ান নিজ থেকে ঐ কুৎসিত কাজটা না করলেই হয় । আর তাহলে কারো কোন সমস্যা হবে না । ফাঁকতালে ও নিজে একটা ভাল চাকরি পেয়ে গেল । যদি সায়ান কোন দিন ওর দিকে এগিয়ে না আসে তাহলে ওর নিজেরও কিছু করার নেই ।

পরের কিছু দিন কেটে গেল বেশ ঝামেলা বিহীন ভাবে । আসফিমা নিয়মিত অফিস করা শুরু করেছে । নিজের কাজ মন দিয়ে করছে । ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া আপাতত বন্ধ করে দিতে হচ্ছে । ওর দ্বারা ক্লাস করা এখন কোন ভাবেই সম্ভব হবে না । মাস্টার্সটা বরং বাদ দিয়ে ইভিনিং এমবিএ করার একটা পরিকল্পনা করছে ও ।
মাঝে আয়ান আহমেদের সাথে দেখা হল। এতোদিনে আসফিমার মনের ভেতরে থেকে ভয়টা চলে গেছে একদম ! আয়ান সরাসরি বলল, তুমি তোমার কাজ ঠিক মত করছো তো?
আসফিমা বলল, ঠিক মত কি ! মন দিয়ে কাজ করছি !
-কত দিন লাগবে ?
-সেটা আমি কিভাবে বলব? আমার হাতে কি আছে এই টা ? যদি আপনার ভাই পার্ভাট না হয় তথলে তো আমার কিছু করার নেই । আমি নিশ্চয়ই কিছু করবো না ! এমনটা আমাদের মাঝে কথাও হয় নি । হয়েছে কি ?

আসফিমার একবার মনে হল যে সে বলে দেয় সায়ানের সাথে তার কি কথা হয়েছে । কিন্তু কি মনে করে আর সেটা বলল না । আয়ান অবশ্য আর কিছু বলল না । চলে গেল । তারপর দিনই নতুন ঘটনা ঘটলো ।

নিজের ডেস্কে বসেই কাজ করছিলো তখনই একজন দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো । মেয়েটাকে দেখেই সে চিনতে পারলো । খানিকটা অবাক হয়ে গেল সাথে সাথেই । অবশ্য পুরো ব্যাপারটা ধরতে আসফিমার সময় লাগব মাত্র কয়েক সেকেন্ড । তাহলে এই সেই মেয়ে যার সাথে সায়ান আহমেদের কিছু চলছে । মেয়েটার নাম অরনি চৌধুরী । নাটকে অভিনয় করে ।
মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, সায়ান ভেতরে আছে?
-জি আছে !

আর কিছু না বলে অরনি যখনই ভেতরের দিকে পা বাড়াতে যাবে তখন আসফিমার কি মনে হল সে বলল, একটু দাড়ান প্লিজ ! স্যারের সাথে আগে কথা বলে নি !
অরনি একটু থামলো । তারপর বলল, তোমার স্যার আমাকে চেনে !

তুমি !
এইবার আসফিমার একটু মেজাজ খারাপই হল । অরনির বয়স তার মতই হবে । চট করেই ওকে তুমি করে বলে দিল ! এটা আসফিমার মোটেও পছন্দ হল না। সে বলল, আমাকে কিছু তেমন কিছু বলে নি স্যার যে কেউ আসছে । আমি স্যারের কাছে জিজ্ঞেস করে নিই ।
-তুমি চেন আমি কে ?
-আমি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন কিন্তু আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে । একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ !

এই বলে আসফিমা ফোন দিল সায়ানকে । এবং অবাক করেই সায়ান বলল যেন অরনিকে ভেতরে ঢুকতে না দেওয়া হয় ! ঠিক এইটাই চাচ্ছিলো আসফিমা ! সে নিজের ডেস্ক থেকে উঠে গিয়ে দরজার সামনে দাড়ালো । তারপর বলল, স্যার আপনার সাথে দেখা করতে চান না !
-কি?
-জি ! আপনি দয়া করে চলে যান ম্যাম !
-আমি চলে যাবো?
-জি আপনি চলে যাবেন । নয়তো আমি গার্ড ডাকবো !
-তোমার সাহস তো কম না । তুমি জানো আমি কে ! তোমার চাকরি আমি ….
-ম্যাম আপনি কে সেটা আমার জানার কোন দরকার নেই । আমি যার চাকরি করি সে বলেছে আপনাকে যেন ভেতরে ঢুকতে না দেওয়া হয় । ব্যাস । আর কিছূ জানার দরকার নেই আমার । যদি আপনি ভাল ভাবে না যান তাহলে আমি গার্ড কে ডাকবো । তারা আমার কথা মত আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে । আমাদের এখানে মেয়ে গার্ডও আছে । সো বুঝতেই পারছেন ! এখন আপনি নিজ থেকে যাবেন না গার্ড ডাক দিবো?
অরনি কিছু সময় আগুন চোখে তাকিয়ে রইলো । তারপর বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে ।

কিছু সময় আসফিমা সায়ানের ঘরে ঢুকে দেখে সে গম্ভীর মুখে বসে আছে । আসফিমার মাথায় কিছু ঢুকছিলো না । সে একবার নয়, গত এক মাসে বেশ কয়েকবার একজনের সাথে সায়ানকে কথা বলতে শুনেছে । বেশ হাস্যরস সম্বলিত ছিল সেই কথোপথন । এবং কথা শুনে মনে হয়েছিলো মেয়েটা নাটক কিংবা মুভিতে অভিনয় করে । সেই হিসাবে মেয়েটা যে অরনি চৌধুরী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । কিন্তু সায়ান তাহলে তার সাথে কেন দেখা করতে চাইলো না । কারণ টা কি হতে পারে?
কথাটা তাকে জিজ্ঞেস করবে কি না সেটা আসফিমা ঠিক বুঝতে পারছে না । সায়ান হয়তো রেগে যেতে পারে ।

আসফিমা বলল, স্যার চা খাবেন কি ?
এক মনে কি যেন ভাবছিলো সে । তারপর বলল, হ্যা নিয়ে এসো । শুনো চায়ে একটু চিনি দিও ।
-চিনি ? ক চামচ দিবো স্যার !
-তোমার মাপ মত ! আর তুমিও নিয়ে এসো এক কাপ। তোমার সাথে এক কাপ চা খাওয়া যাক !

আসফিমা খানিকটা কৌতুহলী হয়েই চা বানাতে গেল । আজকে হঠাৎ ওর সাথে চা খেতে চাচ্ছে কেন সায়ান !

পরের পর্ব

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 25

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

Comments are closed.