তৃষাকে দেখে আরনিন যেন একেবারে চিনতেই পারলো না । একেবার অন্য রকম হয়ে গেছে মেয়েটা । ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, তৃষা তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না ।
তৃষা একটু হাসলো কেবল । কোন উত্তর দিলো না । কারণ প্রায় সবাই তার ব্যাপারে এই একই কথা বলে । তাকে নাকি একদম চেনাই যাচ্ছে না । সময়ের সাথে মানুষ বদলায় । কিন্তু তৃষা যেন একটু বেশিই বদলেছে । অবশ্য এটা নিয়ে তৃষার কোন আক্ষেপ নেই বরং তৃপ্তি আছে । আরনিনের দিকে তাকিয়ে তৃষা দেখলো মেয়েটা এখনও অনেকটা আগের মতই আছে । আগের থেকে মনে হল চেহারাতে আরও একটু তীক্ষতা বেড়েছে । আগে তো কাটাকাটা সুন্দরী ছিল এখন সেটা আরও বেড়েছে ।
স্কুল আর কলেজে থাকতে তৃষা আর আরনিনের সুনাম সবার কাছে পৌছে গিয়েছিলো । চেহারা স্টাইল পোশাক চাল চলন সব কিছুতেই দুজনকে এক নামে চিনতো সবাই । পোশাক থেকে শুরু করে নখের কালার পর্যন্ত দুজনেরই একদম টিপটপ হওয়া চাই। যদিও এই প্রতিযোগিতাতে তৃষা সব সময়ই এগিয়ে ছিল । তৃষার ভেতরে যা ছিল সবই ছিল ন্যাচারাল । ওর পরিবার ওকে এই ভাবেই বড় করেছে অন্য দিকে আরনিনকে সব কিছু শিখতে হয়েছে । তৃষা এই ব্যাপারটা সব সময়ই খেয়াল করতো যে আরনিন ওকে একটু ঈর্ষা করতোই । যদিও আরনিন মুখে সেটা কোন স্বীকার করে নি আর তৃষাও এসব ব্যাপার নিয়ে খুব একটা গা করে নি কোন দিন ।
আরনিন পড়তে বাইরে চলে গিয়েছিলো । এর ফাঁকে একবার বিয়েও করেছিলো এক বিদেশীকে তবে সে সংসার টিকে নি । আরনিন আবার দেশে ফিরে এসেছে। পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা করতে তার অফিসে এসে হাজির হয়েছে । অফিসের ক্যাফেটরিয়াতে বসতে বসতে আরনিন বলল, কী অবস্থা হয়েছে তো ? তুই হাতে নেইম পালিশ দেওয়ার বদলে মেহেদী দিয়েছিস? চোখে কাজল? রিয়ালি? আর নখ এতো ছোট করে ফেলেছিস ? কী সুন্দর নখ ছিল তোর !
তৃষা হাসলো । তারপর বলল, অপুর এসব পছন্দ না । তাই নখ রাখি নি । তখন টিনএজার ছিল সেই সময়কার স্টাইল কি আর এখন ভালো লাগে !
-তোর জামাই এতো পজেসিভ ? আমার বাবা এসব চলবে না । এই জন্য জামাইকে ছেড়ে দিয়েছি । আমার উপর কোন খবরদারী চলবে !
তৃষা হাসলো । তারপর বলল, পজেসিভ আর অপু ! বরং উল্টো ।
-তাহলে?
-আসলে জীবনের সব স্থানে আমি কারো কথা শুনবো না, এমনটা চলে না । অপুর কথাই যদি ধরি, সে কোন দিন আমাকে বলবে না তৃষা তুমি এই কাজটা কর না । আমি যদি আমার পছন্দমত পোশাক পরি, সাজি তার কোন সে নেই । কিন্তু আমি জানি অপু কী পছন্দ করে । এই যেমন হাতে মেহেদী দেওয়ার ব্যাপারটা । আমি যেদিন হাতে মেহেদী দেই ও যখন প্রথম হাতটা দেখে ওর চোখে সে তীব্র আনন্দটা আমি দেখতে পাই এটার কোন তুলনা নেই । এই আনন্দ দেখার জন্য আমি সব কিছু ছেড়ে দিতে পারি !
আরনিন বলল, বাহ ! তুমি মামা সেই প্রেমে পড়েছো !
তৃষা এবার খানিকটা গর্বের সুরেই বলল, অপুর মত কেউ হলে পরাই যায় ! দাড়া লাঞ্চ আওয়ার শুরু হবে এখনই । ওর অফিস কাছেই চল যাই এক সাথে লাঞ্চ করা যাবে । তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে ।
আরনিন নিজ চোখেই ব্যাপারটা দেখলো । সম্ভবত সকালে তৃষা যখন বের হয়েছিলো তখন তৃষার হাতে মেহেদী ছিল না । অফিসের কোন ফাঁকে দিয়েছে । তৃষার হাসব্যান্ড যখন তৃষার হাতের দিকে তাকালো তখন আনন্দে যেন ওর চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো । তৃষা এই আনন্দটা বেশ উপভোগ করলো । আরনিনকে এক প্রকার উপেক্ষা করেই তৃষার দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেটা ।
এই ব্যাপারটা সব থেকে ধাক্কা দিল আরনিনের চোখ । এমনটা কোন দিন হয় না । পুরুষকে খুব ভাল করে চেনে । তারা কী চায় সেটাও তার অজানা নেই । কোন ছেলে ওকে উপেক্ষা করবে সেটা হতেই পারে না । এমন কত বিবাহিত পুরুষ ওকে একবার দেখার পরে ওর পেছনে কুকুরের মত ঘুরে বেড়িয়েছে আর এই ছেলে কিনা একবার ওর দিকে ফিরে তাকাচ্ছেও না । প্রথমে কেবল একবার হ্যালো বলে ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিলো । ব্যাস আর না । চোখ তৃষার দিকেই নিবব্ধ। বুকের মাঝে একটা সুক্ষ জ্বালাপোড়া সৃষ্টি হল ।
দুই
দুইদিন পরের ঘটনা । তৃষা নিজের কাজ ব্যস্ত । এমন সময়ে অপুর মেসেজ এসে হাজির ।
-তোমার ঐ বন্ধু আমাদের ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে এসেছে ।
তৃষা মেসেজটা দেখে কিছু সময় হাসলো খুব । তারপর লিখে পাঠালো । ভালো তো তোমার একজন গ্রাহক বাড়লো ।
অপু সাথে সাথে লিখে পাঠলো, আরে একাউন্ট তো আমি খুলি না । তবুও সে আমার সাহায্য নিয়েই খুলতে চায় ! কী এক ঝামেলা বল তো !
তৃষা লিখলো, আরে বাবা একটু হেল্প করই না । আমার বন্ধু তো !
-আচ্ছা ।
-আর শুনো !
-বল
-আরনিন সম্ভবত তোমার সাথে লাঞ্চ করতে চাইবে । মানা করো না কিন্তু !
-মানে কি? তার সাথে লাঞ্চ কেন করতে হবে ? আর সে যে আমার সাথে লাঞ্চ করতে চাইবে এটা তুমি কিভাবে জানো ? তোমাকে বলেছে?
তৃষা আরও কিছু সময়হাসলো মনে মনে । তারপর লিখে পাঠালো, অপু তুমি এখনও বাচ্চাই রয়ে গেলে । লাঞ্চ করো । রাতে কথা হবে ।
ফোনটা রেখে আরও কিছু সময় সে হাসলো মনে মনে । কিছু মানুষের স্বভাব কোন দিন বদলায় না । আরনিনের বেলাতেও তাই। কিন্তু আরনিন বারবার কেবল ভুল স্থানে প্রতিযোগীতা করতে আসে ।
একটু পরে অপু আবার মেসেজ । এই মেয়ে সত্যি আমার সাথে লাঞ্চ করতে চাচ্ছে । আমি বললাম যে একটু দেরি হবে হাতের কাজটা শেষ করে উঠবো সে বলে কিনা অপেক্ষা করতে তার সমস্যা নেই ।
তৃষা প্রথমে কেবল হাসির ইমো পাঠালো । তারপর বলল, বেচারীর একটু লাঞ্চ করই না ! আর ওকে বলবে না যে আমাকে তুমি জানিয়েছো !
-কেন?
-এতো কেন কেন কর না । যা বলছি কর । রাতে কথা হবে ! ইনজয় দ্য লাঞ্চ !
রাতে যখন ওদের দেখা হল দেখলো অপু কেমন গম্ভীর মুখে বসে রয়েছে । টিভি চালু রয়েছে তবে সেটা দেখছে বলে মনে হয় না । তৃষা ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো ওর পাশে । সামনে ফ্লাক্সে গরম পানি করেই রেখেছে অপু । রাতে ফিরে এসে প্রথমে দুজন মিলে কফি খায় । তারপর একটু রাত করে রাতের খাবার খায় !
-কী শোনা পাখি, মুখ কেন গম্ভীর ?
-তুমি কিভাবে জানো যে আরনিন আমার সাথে লাঞ্চ করতে চাইবে ? আর ঐ মেয়ে যাওয়ার সময় কী বলে জানো
-কী?
-বলে সে যে ওখানে গিয়েছে এটা নাকি তোমাকে বলার দরকার নেই । মানে কি এসবের?
-আরে বোকা জামাই ও তোমার সাথে একটু ইটিস পিটিস করতে চাইছে ।
-ইটিস পিটিস?
-হুম ! শুনো ওর সাথে আমি স্কুল কলেজে পড়েছি । ওকে খুব ভাল করে চিনি । আমার সাথে ওর একটা প্রতিযোগিতা ছিল সব সময় । সব সময় আমার মত আমার থেকে সেরা হতে চাইতো । আমি কেমন পোশাক পরি, কেমন স্টাইল নেই সব ! কিন্তু তুমি তো জানো আমার জীবন কেমন ছিল । আমি কেমন পরিবেশে বড় হয়েছি । তো আরনিন সব সময় আমার জীবন পেতে চাইতো । আমি একটা ড্রেস পরলাম তারও সেই রকম ড্রেস চাই । আমি এক ভাবে চুল বাঁধলাম তারও তেমন করে বাঁধা চাই আমার একরম জামাই আছে এখন তারও সেটা চাই …..।
অপু কফিতে চুমু দিয়েছিল সেটা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল । চিৎকার করে বলল, মানে?
-মানে মাই ডিয়ার হাসব্যান্ড ও এখন চেষ্টা করবে তোমাকে পটাতে !
-তুমি এটা জানো? আর জেনেও আমাকে তার কথা বলতে বলছো?
তৃষা হাসলো । তারপর বলল, আরনিন যতই আমার মত হতে চাক, কোন দিন সে আমার মত হতে পারে নি । আমি কিছু না করেও ওর থেকে এগিয়ে থেকেছি সব সময় । ও হাজার চেষ্টা করুক, আমার মত বর সে কোন দিন পাবে না । ইউ আর দ্য পার্ফেক্ট ওয়ান ফর মি !
তারপর কফির কাপটা নিচে রেখে একটা টিস্যুর হাতে নিল । কফির অপুর মুখেও একটু ছিটিয়ে পড়েছিলো । তৃষা দুই পা দুই দিকে দিয়ে অপুর ঠিক কোলের উপরে উঠে বসলো । দুজনের শরীরটা একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে । তৃষা এরপর যত্ন নিয়ে টিস্যু দিয়ে অপুর মুখের কফি টুকু মুছে দিল । তারপর নিজের মুখটা একেবারে ওর কাছে এনে বলল, শুনো মাই ডিয়ার হাসব্যান্ড ওকে চেষ্টা করতে দাও । আমি জানি যা আমার তা কোন দিন কেউ নিতে পারবে না ।
এই বলে অপুর ঠোঁটে একটা দীর্ঘ চুমু খেল । তারপর …. থাকুক তারপর কি হল সেটা জানার দরকার নেই ।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.