বন্ধন

4.8
(64)

বাচ্চাটার মা মারা গেল সন্ধ্যা বেলা । হিমি তখন স্টাফ রুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো তখনই একজন নার্স ছুটে এল । কেবিন নম্বর চারের পেসেন্ট কোন কথা বলছে না । হিমি উঠে দাড়ালো । রোগীর অবস্থা ভাল ছিল না । বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মেয়েটার অবস্থা বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলো । শরীর ভেঙ্গে গিয়েছিলো অনেকটা । হিমি বুঝতে পারছিলো যে মেয়েটা বাঁচবে না । কিছু কিছু মানুষের চেহারাতে ফুটে ওঠে ব্যাপারটা । হিমি ব্যাপারটা আগেও খেয়াল করেছে । নীলিমা নাম মেয়েটার । বয়স হবে ওর মতই । ফুটফুটে একটা বাচ্চা জন্ম দিয়েছে মেয়েটা । কি চমৎকার দেখতে হয়েছে ।

কেবিনে গিয়ে দেখলো সব কিছু শেষ । মেয়েটা ঘুমের ভেতরেই মারা গেছে । বড় স্যার এসে দেখলো । কিছুই করার ছিল না কারো । পাশে বাচ্চাটা তীব্র চিৎকার করে কাঁদছে । সম্ভবত বুঝতে পেরেছে যে এই পৃথিবীর সব থেকে আপন মানুষটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে । কয়দিন হয়েছে বাচ্চাটার বয়স? মাত্র ছয়দিন । এর ভেতরেই গলায় আওয়াজ বেশ বেড়েছে । বাচ্চার দাদী বাচ্চাটাকে সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না । সবার চোখে পানি । তারপরেও চোখে একটা ব্যতীব্যস্ততা । বাচ্চাটা এতো চেচাচ্ছে কেন? ওকে কেউ থামাও !

হিমি দেখতে পেল বাচ্চার দাদী বাচ্চাটাকে নিয়ে রুমের বাইরে চলে গেল । কিন্তু কাজ হল না । বাইরে থেকেও আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ঠিকই । হিমি বাইরে বের হয়ে এল । এখানে আসলে আর কিছু করার নেই । আর মৃত্যু ব্যাপারটা ওর কখনও ভালো লাগে নি । ওর সাথে কাজ করতে আসা সবার মাঝে এই মৃত্যু নিয়ে কোন আলাদা অনুভূতি দেখেনি । সবার কাছেই যেন এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার । হাসপাতালের কেবল ডাক্তারেরাই না, নার্স আয়া সবার মাঝেই এক ব্যাপার । এসব দেখতে দেখতে সবার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে অথচ হিমি এখনও স্বাভাবিক হতে পারলো না । কোন দিন হয়তো পারবে । করিডোরে বাচ্চার দাদীর কাছে এসে হঠাৎ কি মনে হল দাদীকে বলল, আমার কোলে একটু দিবেন কি?
বাচ্চার দাদী তখনও খানিকটা দিশেহারা । একটু আগে তার ছেলের বউ মারা গেছে । ছেলের বাচ্চাকে কিছুতেই থামাতে পারছে না । কেমন একটা অসহায় ভাব ফুটে ওঠেছে । হিমির কথা শুনে বাচ্চাটাকে ওর কোলে দিয়ে দিল । তখনই ঘটলো ম্যাজিক । বাচ্চাটা প্রায় সাথে সাথে কান্না থামিয়ে দিল । এটা হিমি মোটেই আশা করে নি । এমন কি ওর দাদীও না । খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে । বাচ্চা একটু পরেই কেমন হেসে উঠলো । হিমির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে ।

এরপরে আরও দুইদিন বাচ্চাটাকে থাকলে হল হাসপাতালে । একটু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো সম্ভবত । সেই একটু কাশছিলো সে। বাচ্চাটার সব পরীক্ষা নীরিক্ষা করে তারপর যখন বোঝা গেল যে এখন নিরাপদ তখন বাচ্চাটাকে বাসায় পাঠানো হল । এই দুই দিন হিমি যত সময় হাসপাতালে ছিল তার প্রায় পুরো সময়টাই বাচ্চাটার কাছে ছিল । যখনই বাচ্চাটা কেঁদে উঠতো হিমি কোলে নিলেই শান্ত হয়ে যেত । ব্যাপারটা হিমির মনেও একটা আলাদা আনন্দ দিয়েছে । বাচ্চাটা এভাবে ওকে কিভাবে চিনতে পারছে কে জানে ? আর ও যখনই কোলে নিচ্ছে তখনই থেমে যাচ্ছে কান্না । সম্ভবত বাচ্চাটা ওকে সব থেকে নিরাপদ মনে করছে । বাচ্চার ডেলিভারির সময় হিমি ছিল । বলা চলে হিমিই প্রথমে বাচ্চাটাকে বের করে কোলে নেয় । বাচ্চাটা প্রথম চোখ মেলে হিমিকেই দেখেছিলো ।

বাচ্চাটা চলে যাওয়ায় হিমির মন একটু খারাপ হল । একটা কেমন যেন শূন্য শূন্য অনুভব করলো মনের ভেতরে । নিজের পাগলামী দেখে নিজেই কেমন হেসে উঠলো । মনে মনে বলল যে এক দুই দিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু হিমির ভাগ্যে বুঝি অন্য কিছু লেখা ছিল । ঠিক পরদিন হিমির সাথে অন্য রকম একটা ঘটনা ঘটলো ।
হিমি ডিউটি শেষ করে তখন বাসায় পৌছিয়েছে । ফ্রেশ হয়ে খেতে বসতে যাবে তখনই অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসে হাজির ।
-হ্যালো ।
-নওরিন হিমি বলছেন?
-জি ? কে বলছেন?
-আমি …..
ফোনের ওপাশ থেকে একটু ইতস্তত ভাব দেখা গেল । তারপর কন্ঠটা বলল, আমি দ্বীপের বাবা । দ্বীপ মানে তিনদিন আগে আমার স্ত্রী মারা গিয়েছে আপনাদের হাসপাতালে । চিনতে পারছেন?
এক সেকেন্ড লাগলো হিমির চিনতে । বাচ্চাটার নাম দ্বীপ রেখেছে তাহলে । বলল, জি জি বলুন । চিনতে পেরেছি ।
-আপনি বাসায় । আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম । বলল যে আপনার ডিউটি শেষ ।
-জি । মাত্র এসেছি ।
-আসলে কিভাবে যে বলবো বুঝতেছি না । দ্বীপ অনেক সময় ধরে কান্না করছে । কিছুতেই থামানো যচ্ছে না । মা বলল যে আপনার কোলে নাকি শান্ত হয় । একটু কি আসবেন আমার সাথে ?

হিমি বলল, আপনি আমার বাসা চেনেন?
-জি আপনার বাসার সামনেই এসেছি ।
-আচ্ছা আমি নামছি !

হিমি এই কাজটা কেন করছে সে নিজেও জানে না । কোন কি দরকার আছে । কিন্তু বাচ্চার প্রতি ওর নিজের একটা আকর্ষন কাজ করছে । এই কদিনেই যেন মায়া জন্মে গেছে ।

আধা ঘন্টার ভেতরেই পৌছে গেল ওরা । হিমি যখনই কোলে নিল দ্বীপ কে ম্যাজিকের মত আবারও কান্না থেমে গেল । হিমি নিজেও অবাক হয়ে গেল । কি এমন বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে ওদের ভেতরে কে জানে । হিমির জানা নেই ।

পেছন থেকে সাহেদ বলল, মা মিস হিমিকে কিছু খেতে দাও । আমি ওকে খাবার টেবিল থেকে নিয়ে এসেছি ।
দ্বীপের দাদী ব্যস্ত হয়ে রান্না ঘরের দিকে দৌড় দিল ।শাহেদ বলল, আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো আমি বুঝতে পারছি না ।
-আরে না । কোন সমস্যা নেই ।

একটু পরেই খাবার এসে হাজির । হিমি কোলে দ্বীপকে নিয়ে অল্প অল্প খেতে শুরু করলো । আর চারিপাশে দেখতে শুরু করলো । বাড়ির চারিদকে কেবল সুখের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে । সুখী পরিবারের ছোঁয়া । অথচ কিভাবে মেয়েটা মারা গেল ! অথচ এই বাচ্চাটা আসা নিয়ে মেয়েটার নিশ্চয়ই কত স্বপ্ন ছিল । পুরো পরিবারের একটা স্বপ্ন ছিল । সব কিছু কেমন ধ্বংশ হয়ে গেল । এমন কেন হয় সব কিছু !

এরপর হিমির একটা রুটিনের মত হয়ে গেল দ্বীপদের বাসায় আসা । পরের প্রায় ছয় মাস প্রতিদিন হাসপতালে যাওয়ার আগে কিংবা হাসপাতাল থেকে ফেরার পর সে দ্বীপদের বাসায় গিয়ে ঢু মারতো । ওটা যেন ওর নিজের বাসাই হয়ে গেল এমন একটা ব্যাপার । কোন কোন দিন শাহেদ দ্বীপকে হিমির কাছে রেখে যেত । ও নিজের মনকে বোঝাতো যে দ্বীপ একটু বড় হয়ে গেলেই আর যাওয়া লাগবে না । কিন্তু নিজের কাছেই জানে যে দিন যত যাচ্ছে হিমি তত মায়াতে পড়ে যাচ্ছে । এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে রেখে দুরে থাকা যে ওর পক্ষে সম্ভব না সেটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হল না । হিমির মা এটা নিয়ে খুব বিরক্ত । তবে মেয়ের কারণে কিছু বলতেও পারছে না ।

একদিন হিমি হাসপাতালে যাই নি। সকাল বেলা শাহেদ দ্বীপকে রেখে গেছে হিমির কাছে । সারাটা সকাল দুপুর বিকেল এক সাথেই কাটিয়ে ওরা । তখন অল্প অল্প শব্দ উচ্চারন করতে শিখেছে । দ্বীপ একটু আগে আগে কথা শিখবে বোঝা যাচ্ছে । সন্ধ্যার দিকে শাহেদ যখন দ্বীপকে নিয়ে বাসায় ঢুকলো তখনই ঘটনা ঘটলো । দ্বীপ হিমিকে মা মা বলে ডেকে উঠলো ।
ডাকটা শুনে হিমি কিছু সময় একেবারে থমকে গেল । কী যে একটা তীব্র অনুভূতি ওর নিজের মধ্যে হল ওটা সে নিজেই বলতে পারবে না । আপনা আপনি ওর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এল । এই পানির ভেতরে যে কি একটা অনুভূতি লুকিয়ে রয়েছে সেটা কোন ভাবেই ব্যাখ্যা করা যাবে না ।

শাহেদ ব্যাপারটা খেয়াল করলো ঠিকই । কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । এক সময় বলল, হিমি ।
-হুম । দ্বীপকে ঘুম পাড়িয়ে দিন । নিয়ে যাই ।
-আজকে থাকুক ও এখানে!
-থাকবে ?
-হুম । আজকে ওকে না জড়িয়ে ঘুমালে আমার ঘুম আসবে না । থাকুক প্লিজ !
-আচ্ছা । আমি তাহলে আসি !
-শাহেদ সাহেব ।
-জি !
-আমি সত্যি সত্যিই দ্বীপের মা হতে চাই । ওর কাছ থেকে দুরে কিভাবে থাকবো, আমি জানি না !
শাহেদের মুখ দেখে মনে হল যেন খুব বেশি আনন্দীত হয়েছে । বলল, আমি কতবার আপনাকে বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু সাহস হয় নি। এমনিতেও আপনি যা করছেন এর বেশি কিছু চাওয়াটা ঠিক হবে না । তাই বলতে পারি নি । মা কতবার যে বলতে বলেছে !
-আমি বাসায় জানাচ্ছি । আপনিও জানান । তারপর…
-অবশ্যই ।

শাহেদ যখন বাইরে বের হয়ে এল দেখতে পেল হিমি বারান্দায় দাড়িয়ে রয়েয়ে দ্বীপকে কোলে নিয়ে । শাহেদ কোন দিন ভাবে নি আবার সে বিয়ে করবে । কিন্তু এখন যখন হিমির কোলে দ্বীপকে দেখে তখন মনে হয় এই মেয়েটা দ্বীপের মা হলে সব থেকে ভাল হয় । দ্বীপের সাথে হিমির যে এক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে সেটা কেবল দ্বীপকেই না, হিমির সাথে ওদের পুরো পরিবারকে জুড়ে দিয়েছে । সে অসমাপ্ত দৃশ্যটা পড়ে ছিলো এতোদিন এবার সেটা পূর্ণ হবে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 64

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →