এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই কলেজ ছাত্রের নৃশংস হত্যাকাণ্ড মফস্বল শহরে হইচই ফেলে দিল। কয়েক দিন ধরে সবাই কেবল এটি নিয়েই কথা বলতে লাগল। সবার মুখে কেবল এই হত্যাকাণ্ডের আলোচনা। সবার একটাই প্রশ্ন, কেন কেউ এই কলেজ ছাত্রদের এভাবে হত্যা করবে? হত্যাকাণ্ডে কোনো ছুরি বা বন্দুক ব্যবহার করা হয়নি। কেউ ভারী কোনো কিছু দিয়ে তাদের মাথা এবং গোপনাঙ্গে একের পর এক আঘাত করেছে, একেবারে থেতলে দিয়েছে। যেন কেউ প্রবল আক্রোশে তাদেরকে আঘাত করে গেছে। এই মৃত্যুতে মৃতের পরিবারসহ তাদের বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত সবাই খুব শোকাহত। তবে পুলিশ শত চেষ্টা করেও আসল খুনি কে ধরতে পারেনি। তারা তাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ফারিদ আহমেদ ফেসবুকে লেখাটা পড়ে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মোবাইলটা পকেটে পুড়ে জানালার দিকে তাকালেন। সন্ধ্যার ব্যস্ত সড়কে বাসার দিকে যাচ্ছেন তিনি। অফিস থেকে বের হয়ে একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে এমন একটা সংবাদ এসেছে যা তাকে একই সাথে চিন্তিত এবং রাগান্বিত করেছে। কী করবেন সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে খবরটা জানার পর থেকে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না।
বাসায় ঢুকতেই তার স্ত্রী রেবেকা এগিয়ে এলেন। তার হাতের ব্যাগটা নিতে নিতে বললেন, “তোমার চেহারা এমন কেন লাগছে?”
ফরিদ আহমেদ সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার ছেলে কোথায়?”
স্বামীর কন্ঠস্বর শুনেই রেবেকা স্পষ্টই বুঝতে পারলেন যে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তিনি বললেন, “কী হয়েছে?”
“তোমার ছেলেকে ডাক দাও আগে। তার সামনেই বলি!”
“ওর মন খুব খারাপ। খুব শকে আছে। জানো না ওর দুই বন্ধু মারা গেছে!”
“ডাক দিতে বলছি ডাক দাও।”
রেবেকা স্বামীর এই রূপ দেখে একটু অবাকই হলেন। তার স্বামী ফরিদ আহমেদ শান্ত মাথার মানুষ। তিনি সহজে রেগে যান না। তবে রেগে গেলে তাকে থামান মুস্কিল সেটাও রেবেকা জানেন খুব ভাল করেই। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ছেলেকে ডাক দিতে ভেতরে গেলেন। ছেলে ফারদিনকে নিয়ে ফিরে এলেন বসার ঘরে। ফরিদ আহমেদ তখন নিজের টাইটা খুলে ফেলেছেন। ছেলে ঘরে ঢুকতেই তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঐ মেয়েটার সাথে তোমরা কী করেছ?”
ফারদিন কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল তার বাবার দিকে। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কোন মেয়ে বাবা?”
তবে এবার ফরিদ সাহেব যা করলেন তাতে ঘরের সবাই একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ফরিদ সাহেব উঠে গিয়ে সোজা এক চড় বসালেন ফারদিনের গালে। চড়টা এতোই জোড়ে যে ফারদিন ঠিকমত তাল সামলাতে না পেরে সোফার উপরে পড়ে গেল। রেবেকা সাথে সাথে ছেলেকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন। স্বামী আর ছেলের মাঝে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “কী করছ তুমি?”
“কী করছি? তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস কর যে তোমার ছেলে আর তার দুই বন্ধু মিলে কী করেছে? জিজ্ঞেস কর।”
রেবেকার মাথায় যেন কিছুই ঢুকছিল না। তিনি স্বামীর কথা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। একবার ছেলে একবার স্বামীর দিকে তাকাতে লাগলেন। ফরিদ আহমেদ বললেন, “তোমার এই গুণধর ছেলে আর তার দুই বন্ধু মিলে ওদেরই ক্লাসের সাবিহা নামের একটা মেয়েকে রেপ করেছে!”
পুরো রুমের ভেতরে যেন বোমা পড়ল। রেবেকা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তার ছেলে এমন কিছু করতে পারে সেটা যেন তারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না। ফরিদ আহমেদ বললেন, “কেবল সেখানেই থেমে থাকেনি তারা। সেই রেপের দৃশ্য তারা ভিডিও করেছে। মেয়েটাকে ভয় দেখিয়েছে যে এটা নেটে ছেড়ে দিবে। সেই মেয়ে কী করেছে জানো? লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে সুইসাইড করেছে।”
“না, এটা হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি না। আমার ছেলে এমন কিছু করতে পারে না।”
“জিজ্ঞেস কর তোমার ছেলে। জিজ্ঞেস কর! আমি ভুল বলছি কিনা!”
রেবেকা তাকালেন ফারদিনের দিকে। নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না যেন। ফারদিন কিছু বলছে না তবে তার চোখ স্পষ্ট করেই বলে দিচ্ছে যে সে অপরাধটা করেছে। রেবেকার বিস্ময়টা যেন কাটলোই না।
ফরিদ আহমেদ আবার বললেন, “আমার ছেলে হয়ে এই কাজটা তুই কিভাবে করলি? একবারও ভাবলি না যে তোর নিজের ঘরে একটা বোন আছে! একবারও ভাবলি না। তুই যে আমার ছেলে এটা ভাবতেই এখন আমার ঘৃণা হচ্ছে!”
ফারদিন তখনও চুপ করে আছে। মুখ দিয়ে একটা কথাও বলছে না। রেবেকা বললেন, “তুমি কিভাবে জানলে?”
ফরিদ আহমেদ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছেন না। কিভাবে কী করবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। তিনি এই জেলার এডিসি। তার ছেলে এই অকাজ করেছে যদি এটা বাইরে প্রকাশ পায় তাহলে কী হবে সেটা তিনি ভাবতেও পারছেন না। ভাগ্য ভাল যে থানার ইনচার্জ খবরটা জানার পরে সোজা তার কাছে এসেছে আজকে।
কলেজ ছাত্রদের খুনের কোন কুলকিনারা পুলিশ করতে পারছিল না। যেকোন খুনের পরে, সেটা সমাধানের জন্য প্রথম কাজটাই হচ্ছে খুনের মোটিভ খুঁজে বের করা। পুলিশ সেই মোটিভই খুঁজে বের করতে চাইছিল। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিল না যে এই দুজন কলেজ ছাত্রকে কেন কেউ এভাবে নৃশংস ভাবে খুন করবে।
তদন্তের জন্য তাদের মোবাইল ফোনগুলো পরীক্ষা করা হয়। প্রথম দর্শনে একজন টিনএজ ছেলের মোবাইলে যা থাকে সেখানেও তাই ছিল। ইন্সপেক্টরের কী মনে হল যে ফোনের মেমোরি কার্ডটা খুলে ডাটা উদ্ধার করার সফটওয়্যার চালু করল। মেমোরি কার্ডের মুছে ফেলা ডাটা দেখার জন্য এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। যদিও শতভাগ মুছে যাওয়া ডাটা ফিরে আসে না, যা আসে সেটাই সই। বেশ কিছু ছবি আর ভিডিও এসে হাজির হল। এবং সেই ভিডিওর ভেতরে একটা ভিডিও দেখে ইন্সপেক্টরের মাথা ঘুরে গেল। সেখানে দেখা যাচ্ছে তিনজন ছেলে পালা করে একটা মেয়ের সাথে জোর জবরদস্তি করে সেক্স করছে। সোজা কথায় মেয়েটাকে রেপ করছে তারা। এবং সেটাই ভিডিও করে রেখেছে। ভিডিওতে মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এবং মেয়েটাকে সে চিনতে পারল। মাস খানেক আগেই মেয়েটার কেস তার কাছে এসেছিল, সে নিজের ঘরে সুইসাইড করেছে গলায় ফাঁস লাগিয়ে। টিনএজ মেয়ের আত্মহত্যা বলেই বেশি চিন্তা করে নি। এখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে তার কাছে। এবং সেই সাথে আরও একটা ব্যাপার ইন্সপেক্টরের কাছে পরিষ্কার হয়েছে। এই জোড়া খুনের মোটিভ। প্রতিশোধ। এতো নৃশংস ভাবে খুনের পেছনের কারণটাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইন্সপেক্টর থানাতে রিপোর্ট করার আগে ফরিদ আহমেদের কাছে এসেছে। কারণ তার ছেলে ফারদিনই হচ্ছে সেই তৃতীয় ধর্ষণকারী।
পুলিশ খুনি হিসাবে এখনও কাউকে ধরতে পারেনি। যদিও তাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে একজন। মেয়েটির বড় ভাই। সে আর্মিতে রয়েছে, মেজর। বোনের মৃত্যুর খবর পেয়ে শহরে এসেছে। তার শহরে আসার তিন দিন পরে প্রথম খুনটা হয়েছে। তার সাত দিন পরে আরেকটা। তবে ইন্সপেক্টর আহসানের হাতে কোন প্রমাণ নেই। সে মেয়েটির বড় ভাই মেজর পলাশ রহমানকে ধরতে পারছেন না। তার শক্ত অ্যালিবাই রয়েছে।
দুই
মেজর পলাশ কিছু সময় দিবার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথম যখন মেয়েটা তাকে ফোন করে দেখা করতে চেয়েছিল, পলাশ একটু অবাকই হয়েছিল—অপরিচিত একটা মেয়ে কেন তার সাথে দেখা করতে চাইবে? যখন শুনল মেয়েটা এডিসির মেয়ে, তখন ব্যাপারটা একটু হলেও তার কাছে পরিষ্কার হলো। গতদিনই থানার ওসির সাথে তার কথা হয়েছে। তার বোন সাবিহার সুইসাইডের ব্যাপারে নতুন একটা তথ্য ইন্সপেক্টর তাকে জানিয়েছে। যদিও পলাশ সেটা আগে থেকেই জানে।
ইন্সপেক্টর যখন তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি খুন দুটি করেছেন?”
পলাশ যখন ইন্সপেক্টরের চোখে চোখ রেখে বলল, “আপনার কী মনে হয়? একজন ভাই হিসেবে বোনের ধর্ষণকারীদের সাথে আমার কী করা উচিত?”
কিছু সময় একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। পলাশ তখন বলল, “আমার দুর্ভাগ্য যে এমন কিছু করার আগেই তারা মারা গেছে। বেঁচে থাকলে তাদের সাথে আমি কী করতাম, আমি নিজেই জানি না। তবে আরও একজন কিন্তু বেঁচে আছে। তার দেখা পেলে তার সাথে আমি কী করব, সেটার গ্যারান্টি আমি দিতে পারছি না।”
ইন্সপেক্টর তখন পলাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেশে আইন-কানুন আছে!”
“থাকলে আমার বোনকে মরতে হত না। আর তার খুনিরা এভাবে নৃশংসভাবে খুনও হত না। দেশে আইন-কানুন থাকলে ধর্ষণকারী জেলখানার ভেতরে থাকত। সেটা কি আছে?”
“আমরা ধরতে গিয়েছিলাম। তার আগেই সে পালিয়ে গেছে!”
ইন্সপেক্টর যেন খুব মজার কোনো কথা বলেছে এমনভাবেই পলাশ হেসে ফেলল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, “পালিয়েছে, ভালো করেছে। তবে আমার হাতের কাছে যদি আসে, সে তখন বুঝবে যে না পালিয়ে ধরা দিলেই বুঝি ভালো হত!”
“আপনি জানেন আপনাকে আমি এই কারণে এখনই গ্রেফতার করতে পারি!”
“আপনি আমার কিছুই করতে পারবেন না! বুঝেছেন!”
পলাশ আর দাঁড়ায়নি। ঘুরে চলে এসেছে। আজকে এই মেয়ে তার সাথে দেখা করতে এসেছে। কোনো রেস্টুরেন্টে সে বসেনি, শহরের খোলা পার্কে এসে বসেছে। দিবা পলাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার ভাইয়াকে মাফ করে দেন, প্লিজ!”
“তুমি যদি আমার জায়গায় থাকতে, তাহলে কী করতে?”
দিবা চট করে জবাব দিতে পারল না। পলাশ বলল, “আমি যদি তোমার সাথে ঠিক একই কাজ করি, তারপর সেই ভিডিও করে নেটে ছেড়ে দিই, তাহলে তোমার কেমন লাগবে?”
দিবা তারপর যা বলল তা শুনে পলাশ একটু অবাকই হল। দিবা বলল, “আপনি চাইলে আমার সাথে তাই করতে পারেন। আমি বাধা দেব না। এমনকি সেটা নেটে ছেড়েও দিতে পারেন। তবুও আমার ভাইয়াকে মাফ করে দিন, প্লিজ। আমি আপনার পায়ে পড়ি!”
এই বলে সত্যি সত্যিই পায়ে পড়তে গেল। পলাশ অবশ্য একটু সরে গিয়ে তাকে থামাল। মেয়েটা তার বোনের বয়সী। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ভাই-ভক্ত খুব। ভাইয়ের আচরণে সে নিজেও কষ্ট পেয়েছে খুব। কিন্তু ভাইয়ের নৃশংস মৃত্যু সে চায় না। যে কোনোভাবেই তাকে রক্ষা করতে চায়।
পলাশ বলল, “তোমার ভাইকে বল পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে। আইন যদি তাকে শাস্তি দেয়, আমি আর কিছু করব না। কিন্তু যদি সে তার অপরাধের শাস্তি না পায়, তাহলে আমি কিছু করব। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমি অন্য দুজনকে মারিনি, আমি তখন জানতাম না কিছুই। কিন্তু এখন জানি। আইন যদি তোমার ভাইকে শাস্তি না দেয়, এবার আমি আইন নিজের হাতে তুলে নেব—এটা তুমি নিশ্চিত থাকো।”
পলাশ দিবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটা দিল।
পরের কয়েক দিনেই অনেক কিছু বদলে গেল। পত্রিকায় যখন খুনের আসল কারণ বের হল, তখন পুরো শহরজুড়েই হইচই পড়ে গেল। তবে এবার আর সেই কলেজ ছাত্রদের পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বলল না। বরং এবার যেন সবাই খুশি। বেশির ভাগই মনে করল যে কাজটা করেছে, খুব ভাল কাজ করেছে। ধর্ষণকারীদের সাথে এমনই হওয়া উচিত। ফরিদ সাহেবকে শহর থেকে বদলি করে দেওয়া হল। তিনি যেন ছেলের বিচারকাজে কোনো প্রকার প্রভাব খাটাতে না পারেন, সেই ব্যাপারে প্রশাসন থেকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হল। জনরোষ নিরসনের জন্য কেসের বিচার খুব দ্রুত হল। ধর্ষণ ও আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য তার ১৫ বছরের সাজা হল। তবে তার বয়স কম দেখে কোর্ট তাকে ৯ বছর সাজা দিল।
তিন
জেল থেকে বের হয়ে ফারদিন কিছু সময় এদিক-ওদিক তাকিয়ে রইল। কেউ যে আসবে, সেটা ফারদিন জানত খুব ভাল করেই। তার বাবা মাত্র একবার এসেছিলেন জেলে। মা আর বোন এসেছিল কয়েকবার। শেষবার যখন বাবা এসেছিলেন, তখন বাবার কাছ থেকেই জেনেছিল যে দিবা পড়তে আমেরিকা চলে গিয়েছে। কিছুদিন পরে তিনি আর তার মাও চলে যাবেন—এমন ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তার সাথে আর দেখা হবে না। তার কারণে ফরিদ সাহেব আর চাকরিটা করতে পারেননি। আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়েছেন। এখানে যা জায়গা-জমি ছিল, সব বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন তারা দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। তবে যাওয়ার আগে তার নামে ব্যাংকে কিছু টাকা রেখে যাবেন যাতে জেল থেকে বের হয়ে সে কিছু করতে পারে!
ফারদিনের কিছুই বলার ছিল না। কিছুই করার ছিল না। যে অন্যায় সে করেছে, তার শাস্তি তার প্রাপ্য। সারা জীবন ধরেই তাকে এটা বহন করে চলতে হবে।
এই সবকিছু যখন ভাবছে, তখনই দেখতে পেল একটা গাড়ি এসে থামল ওর সামনে। কাঁচ নামিয়ে দেখতেই একটা মুখ দেখা গেল। কেমন যেন একটু পরিচিত মনে হল ফারদিনের কাছে।
ওর দিকে তাকিয়ে সে বলল, “চিনতে পারছিস?”
“নিলয়?”
“এই তো চিনেছিস। আয়, উঠে আয়!”
নিলয় ওদের ক্লাসেই পড়ত। বেশ ভাল ছাত্র ছিল। পড়াশোনায় ভাল করার কারণেই তাকে সবাই চিনত। নিলয়কে এখানে সে আশা করে নি। ফারদিন গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, “তুই এখানে?”
“আরে আমি তো এখানেই থাকি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমি।”
“আরে তাই নাকি! শুনে খুব ভাল লাগল।”
“তুই যে ছাড়া পাবি, আজকে জানতাম। তাই নিতে এলাম। চল, বাসায় চল!”
“বাসায়?”
“হ্যাঁ। সমস্যা নেই। আমি একা থাকি বাসায়। চল।”
এই বলে নিলয় পকেট থেকে একটা বোতল বের করে দিল। বলল, “এটা না তোর পছন্দের ছিল!”
ফারদিন বেশ অবাক হল রেডবুলের ক্যানটা দেখে। এতদিন পরেও নিলয় এটা মনে রেখেছে। কত বছর পরে রেডবুলের ক্যান দেখতে পেল। আর কিছু চিন্তা না করেই সে ক্যানটা খুলে ফেলল। এক চুমুক দিতেই স্বাদটা নিতে পারল। দুই সিপের পুরোটুকু শেষ করে ফেলল।
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যান। তুই যে মনে রেখেছিস, আমি খুব খুশি!”
আরও কিছু বলতে যাব, তখনই ফারদিনের মাথাটা একটু চক্কর দিয়ে উঠল। ঠিক যেন বুঝতে পারল না, এমন কেন হল।
“এই, আমার যেন কেমন লাগছে!”
“অনেক দিন পরে খেয়েছিস তো, তাই হবে হয়তো।”
“হ্যাঁ। তাই মনে হয়!”
ফারদিন আরও কিছু বলতে গেলে, তবে বলতে পারল না। তার আগেই জ্ঞান হারাল।
ফারদিনের জ্ঞান ফিরল আট ঘণ্টা পরে। যখন তার চেতনা ফিরে এল, তখন সে দেখতে পেল একটা পুরানো স্যাঁতস্যাতে ঘরে সে পড়ে আছে। তার হাত এবং পায়ে শিকল পরানো। শিকলগুলোর দিকে তাকিয়ে ফারদিন একটু অবাক হয়ে গেল। কারণ সেখানে তালা দেওয়া না, একেবারে ঝালাই করে আটকে দেওয়া হয়েছে। তার নামে যখন সে অজ্ঞান ছিল, তখন কেউ এই কাজ করেছে! কে করেছে? নিলয়!
তীব্র এক বিস্ময়ের অনুভূতি জাগল ওর মনে। কিছুই যেন বুঝতে পারল না। অবশ্য সবকিছুর উত্তর যে পেয়ে গেল, একটু পরেই। যখন ভারী দরজাটা খুলে নিলয়কে ঘরে ঢুকতে দেখল। ওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “যাক, জ্ঞান ফিরেছে।”
“এসব কি হচ্ছে? আমি এখানে কেন? আমার সাথে কী করবি তুই?”
“ঠিক যা করেছিল রাফি আর ববির সাথে!”
তীব্র সেই বিস্ময় ভাব ফারদিনকে বিমূঢ় করে দিল। বিশ্বাসই করতে পারছিল না। সে যদি বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে না থাকত, তাহলে হয়তো কোনোদিন বিশ্বাস করত না।
নিলয় বলল, “ওদের দুজনকে তো প্রাপ্য শাস্তি দিয়েছি, তবে তোরটা আরও কষ্টের হবে। এই যে দেখছিস এই ঘর, এটা পাতাল ঘর। এখন থেকে এখানেই থাকবি তুই, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরবি। প্রথমে ভেবেছিলাম এখানে ওদের মত করেই মারব, তবে পরে মনে হল, তার থেকে তোকে বরং কষ্ট দিয়েই মারি। এটাই সব থেকে ভালো।”
“কেন?”
“এখনও বুঝিসনি? সাবিহা যে আমার প্রেমিকা ছিল, সেটা টের পাসনি? লাজুক মেয়েটা সেদিন আমার সাথে দেখা করতে আসছিল, আর তোরা ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে কী করেছিলি মনে নেই? সাবিহা সুইসাইড করার আগে আমাকে সব বলেছিল। আমি সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম তোদের মেরে ফেলব। তুই যদি পুলিশে ধরা না দিতি, তোকেও সেদিনই মেরে ফেলতাম। এতোগুলো দিন আমি এই দিনের জন্য অপেক্ষা করেছি।”
“নিলয়, আমার এভাবে রেখে যাস না। আমি চিৎকার করব। কেউ না কেউ শুনবে!”
নিলয় হাসল। তারপর বলল, “চিৎকার করতে থাক। দেখি কেউ শোনে কিনা। তোকে এখানে আনব বলেই এই ঘরটা মেরামত করা হয়েছে। পুরো ঘরটাই বায়ুনিরোধক। ঐ যে কোনার দিকে একটা ছোট ছিদ্র দেখছিস, ওটা দিয়ে বাতাস আসবে সামান্য। সেটা দিয়ে হয়তো কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে পারবি। না পারলে নাই, এখানেই মরবি। খুব বেশি হলে ১৫ দিন টিকবি। মানুষ না খেয়ে এগারো দিন সর্বোচ্চ বাঁচতে পারে। দেখি তুই ক’দিন বাঁচতে পারিস!”
নিলয় আর দাঁড়াল না। বের হয়ে এল। পেছন থেকে ফারদিনের চিৎকার শোনা গেল বটে, বসে দরজা বন্ধ করতেই সেটা কানে আসা বন্ধ হয়ে গেল! নিলয় সেখানে তালা দিয়ে আস্তে আস্তে বের হয়ে পুরানো জমিদার বাড়িটা থেকে বের হয়ে এল। বহু বছর ধরেই এটা পরিত্যক্ত হয়ে আছে। ভাগ্যগুণে এটার খোঁজ পেয়েছিল সে। জমিদার বাড়ির শরিকদের নিয়ে অনেক দিন ধরে মামলা চলছে। সেই মামলার সমাধানের দায়িত্ব এসেছিল নিলয়ের হাতে। বাড়িটা ঘুরতে এসেই তার মাথায় এই পরিকল্পনাটা এসেছিল। আরও বছর খানেক সে মামলা চালিয়ে নেবে। ততদিনে ফারদিনের নাম নিশানা মুছে যাবে!
আজকে তার প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হয়েছে। এতদিন পরে আজকে নিলয় একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবে।
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
সরাসরি মেসেজ পাঠাতে চিঠি.মি এপ ব্যবহার করুন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.