অফিস প্রেম

oputanvir
4.7
(48)

ছয়টা বাজতে না বাজতেই আস্তে আস্তে অফিস খালি হতে শুরু করল। নওরিন দেখতে একে একে সবাই উঠে দরজার দিকে হাটা দিচ্ছে। অন্যান্য দিন হলে এতো সময়ে নওরিন নিজেও অফিস থেকে বের হয়ে যেত । অফিস থেকে বের হয়েই নওরিনের প্রথম কাজটাই হচ্ছে নিচের ফ্লোরের কফিশপে ঢোকা । বেশির ভাগ দিনেই সে চেষ্টা করে একা একা সেখানে ঢুকতে। কারণ মানুষজন নিয়ে ঢুকলেই বিলটা তাকেই দিতে হয় । এই কারণে সুযোগ মত সে দ্রুত বের হয়ে যায় । লিফট ব্যবহার করে না । সিঁড়ি দিয়েই নামে। সিড়ি দিয়ে নামলে মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাত হয় কম । তবে এরপরেও মাঝে মাঝে কারো না কারো সাথে ঠিকই দেখা হয়ে যায় । তখন ইচ্ছে না থাকলেও তাকে কফি খাওয়াতে হয় ।
এই কফি খাওয়ানোর কারণেই অফিসের দিবার সাথে নওরিনের একটা ভাব হয়ে গেছে । মেয়েটাকে বেশ কয়েকবারই সে কফি খাইয়েছে। আরও ভাল করে বললে খাওয়াতে বাধ্য হয়েছে। তবে এটাও সত্য যে দিবা নিজেও নওরিনকে ট্রিট দিয়েছে । এক শুক্রবার দুপুরে নওরিনকে নিজের বাসায় নিয়ে আদর করে ভাত পর্যন্ত খাইয়েছে। নওরিনের সাথে একটা ভাল সম্পর্ক তখন থেকেই দিবার তৈরি হয়েছে।
নওরিন আরেকবার তাকাল নিজের ডেস্কের থেকে মাথা তুলে । প্রায় সবাই ততক্ষণে চলে গেছে । মনটা ওর খারাপ হল । আজকে অবশ্য দুপুর থেকেই ওর মন খারাপ । একবার তো কান্না আসছিল বেশ । এমডি স্যার কী ধমকই না দিল ! যদিও কেবিনের ভেতরে ধমক দিয়ে তবে নওরিন নিশ্চিত অনেকেই সেটা শুনেছে। নওরিনের তখনই মনে হল যে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সে বাড়ি চলে যায় । এখানে আর সে চাকরি করবে না । কিন্তু চাকরি ছাড়ার কথা মনে হতেই আরেকটা কথাও মনে হল ! বিয়ে !
নওরিনের বাসার লোকজন ওর বিয়ে নিয়ে খুব চাপ দিচ্ছে । অবশ্য নওরিন তাদের দোষ দিতে পারে না । মেয়ে বড় হলে সব বাবা মা তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু নওরিন এখনো কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারে না। কেন যে পারে না সেটাও নওরিন জানে না । ছেলেদেরকে সে যে পছন্দ করে না সেটাও না তবে একসাথে থাকার ব্যাপারটা এখনো নওরিনের কাছে কেমন যেন মনে হয় ! নওরিন এখনও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি । এখন যদি নওরিনের পরিবার জানে যে নওরিন চাকরি ছেড়ে দিয়েছে তাহলে কোন কথা না শুনেই তারা ওকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিবে।
আজকের সকালটা ভাল ভাবে শুরু হলেও দুপুরের পরে নওরিনের উপরে যেন একটা পাহাড় নেমে এল। নওরিনের কাধে অফিসের আসন্ন বার্ষিক বাজেটের তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই কাজে যে বেশ কিছু ভুল করল । আসলে সত্যি কথা বলতে নওরিন কাজটা ভাল করে করেই নি । তার মনযোগ অন্য দিকে ছিল । তাই ভুল গুলো হয়েছে। অফিসের এমডি রাফান আহমেদের হাতে যখন ফাইলটা গিয়ে পৌছাল তখন সে খুব রেগে গেল। কেবিনে ডেকে বেশ ভাল রকমের ঝাড়ি নওরিনকে দিল । তারপর কড়া কন্ঠে বলল যে আজকে আবার বাজেটের কাজ শেষ করে তবেই যেন সে বাড়ি যায় । এর আগে যেন বাড়ি যাওয়ার নামও না নেয় । সেই কাজই নওরিন দুপুর থেকে করছে।
নওরিন জানে এই কাজটা পুরোপুরি শেষ করতে করতে প্রায় দশটা বেজে যাবে। নওরিন আবারও অফিস রুমটার দিকে তাকাল করুণ চোখে । আস্তে আস্তে রুমটা ফাকা হয়ে যাচ্ছে । বাম দিকের আলো পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে । একদিকে অনেকটাই অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কারণে অফিসটাকে কেমন যে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। আটটার সময় দেখল দিবা আসছে ওর দিকে এগিয়ে । ওর হাতে একটা টেকএওয়ে কফির কাপ । কাপটা নওরিনের পরিচিত । নিচের ক্যাফের কাপ ওটা । টেবিলে কাপটা রাখতে রাখতে বলল, আমি যাই কেমন!
-চলে যাবে?
-হুম ! আর বেশি সময় থাকা যাবে না।
-আচ্ছা যাও । কফির জন্য ধন্যবাদ !
দিবা একটু হাসল। তারপর বলল, স্যার কিন্তু এখনও অফিসেই আছেন!
একটু বিস্মিত হয়ে দিবার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই নাকি?
-হুম। তুমি যত সময় থাকবে সেও থাকবে। তাই ভেব না যে একা আছো অফিসে। স্যার একটু কড়া ঠিকই তবে তিনি তার এমপ্লোয়ীদের ব্যাপারে যথেষ্ঠ কেয়ারফুল । তার বাবার মতই।
-কেয়ারফ্ল না ছাই ! এবাবে বকে কেউ !
দিবা শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, বুঝছি ! কাজ কর । আমি গেলাম !
নওরিন দিবার চলে যাওয়া দেখল। তবে এখন কেন জানি নওরিনের আর মন খারাপ লাগল না । বিশেষ করে একটু আগেও যখন সবার একে একে চলে যাওয়ার নিয়ে একটু মন খারাপ লাগছিল এখন সেই অনুভূতিটা নেই আর । নওরিন ভেবেছিল ফাইলটা সম্ভবত ম্যানেজার স্যারের কাছে দিতে হবে । স্বয়ং রাফান স্যারই যে অফিসে থাকবে সেটা সে মোটেও ভাবে নি।
আবার যখন কাজটা শেষ হল তখন সাড়ে নয়টার বেশি বেজে গেছে । ফাইলটা নিয়ে গেল সে এমডির ঘরে। নক করতেই দেখতে পেল এমডি রাফান আহমেদ মন দিয়ে কিছু যেন পড়ছে । ওকে কেবিনে ঢুকতেই সেটা এক পাশে সরিয়ে রাখল। তারপর ওকে কেবিনে ঢুকতে বলল। আজকে দুপুরে এখানেই সে বকা শুনেছে।
নওরিন এগিয়ে গিয়ে হাতের ফাইলটা বাড়িয়ে দিল রাফানের দিকে । রাফান কিছু সময় মনযোগ দিয়ে সেটা দেখল । তারপর বলল, এটাতেও ভুল আছে ।
-জ্বী? এটাও ভুল !
-হ্যা । তবে আগের থেকে কম ! আপনার কাজে কর্মে মন নেই কেন মিস নওরিন?
-আছে স্যার !
-তাহলে কাজে এতো ভুল হচ্ছে কেন?
-স্যার ……।
নওরিনের মনে হল যে আরেকবার ঝারি খাবে ! তবে এখন ঝাড়ি খেলে অবশ্য খুব বেশি কিছু মনে হবে না । অফিসে এখন কেউ নেই । ওর বকা খাওয়ার ব্যাপারটা একা একা খেলে খুব বেশি খারাপ লাগে না । মানুষের সামনে খেলে বরং খারাপ লাগে বেশি। সেখানে লজ্জার একটা ব্যাপারর থাকে ! রাফান বলল, এমন ভাবে ভুল করলে কিভাবে চলবে বলুন?
নওরিন এবার রাফানের কন্ঠে সেই উত্তাপ না পেয়ে একটু যেন অবাক হল এবং সেই সাথে একটু স্বস্তি পেল । রাফান কলম বের করে কয়েক জায়গায় গোল মার্ক করে দেখিয়ে দিল । তারপর ফাইলটা এগিয়ে দিল নওরিনের দিকে ।
-আমি স্যার ঠিক করে নিয়ে আসছি !
-দরকার নেই । কাল সবার আগে অফিসে এসে এটা ঠিক করবেন । এখন অনেক রাত হয়েছে ।
-জ্বী স্যার !
নওরিন কেবিন থেকে বের হয়ে এল । আবারও যেন ভুল হবে সেটা ভাবে নি । অবশ্য সেটা নিয়ে আর চিন্তা করল না । আপাতত দ্রুত বাসায় যেতে হবে । এখনো দশটা বাজে নি । বাস পাওয়া যাবে । না পাওয়া গেলে, রিক্সা বা সিএনজিতে করে চলে যাবে ভাবল। বেশি দেরি করা যাবে না।
অফিসের গেটের কাছে আসতেই দারোয়ান ওকে বলল, ম্যাডাম আপনাকে স্যার দাড়াতে বলেছে!
-কোন স্যার?
-এমডি স্যার !
নওরিন ঠিক বুঝল না যে রাফান কেন ওকে দাড়াতে বলল। এমনিতেও অনেক বেশ দেরি হয়ে গেছে । বাসায় আজকে ওকে বেশ ঝাড়ি খেতে হবে । যদিও বাসায় ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে পৌছাতে রাত হবে । তারপরেও বকা শোনাটা প্রায় নিশ্চিত !
ঠিক ৫ মিনিটের মাথায় কালো রংয়ের এস ইউ ভিটা এসে থামল অফিসের গেটে । নওরিন দেখল গাড়িতা রাফান নিজেই চালাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, উঠে আসুন !
-স্যার !
-বললাম উঠে আসুন গাড়িতে !
-না না স্যার ঠিক আছে ! আমি চলে যেতে পারব।
-আমি জানি আপনি চলে যেতে পারবেন । উঠে আসুন !
নওরিন আর মানা করল না । দরজা ঠেলে বসে পড়ল । গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। নওরিন কোন দিন আসলে ভাবেও নি যে ভাবে রাফানের গাড়িতে কোন দিন সে বসবে। গাড়িতে বসতে বসতে নওরিন বলল, থেঙ্কিউ স্যার !
রাফান অবশ্য উত্তরে কিছুই বলল না । কেবল হাসল । নওরিন আর কী বললে খুজে পেল না । এই পরিস্থিতি একদমই নতুন তার কাছে। এর আগে কোন দিন যে বসের গাড়িতে ওঠে নি । কেবল বসের গাড়িতে কেন, অফিসের অন্য কারোর গাড়িতেও ওঠে নি। অন্যের গাড়িতে উঠতে নওরিনের ভাল লাগে না । রাফান বলল, আজকে বাসায় সম্ভবত বকা শুনতে হবে দেরি করার জন্য, তাই না?
নওরিন বলল, তা একটু হবে ! আরও বলবে যে এতো রাত করে কোন মেয়ে বাইরে থাকে।
-মাত্র তো দশটা বাজে !
-তাতে কী? আমার বড় ভাইয়ে যখন ঢাকাতে থাকতে তখন তার বাসায় আসতে এগারোটা বাজত প্রতিদিন । কোন কথা হত না । আমার বেলাতে একটু দেরি হলেই…
-সে কোথায় এখন?
-ভাইয়ার পোস্টিং এখন রাজশাহী ।
-আপনি তার মানে একা এখন বাবা মায়ের সাথে?
-জ্বী !
এভাবে টুকটাক কথা চলতে থাকল । এক সময় নওরিন দেখল গাড়িটা একেবারে ওর বাসার সামনে এসে থেমেছে।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে নওরিন বলল, থ্যাঙ্কিউ স্যার । এতো রাতে এতো কষ্ট করার জন্য!
-আমি রাতে মাঝে মাঝেই ড্রাইভে বের হই । আজকে এদিকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল । সো কোন সমস্যা নেই।
-তবুও স্যার ! অনেক ধন্যবাদ ।
রাফান হাসল । তারপর বলল, কাল মনযোগ দিয়ে কাজটা শেষ করবেন !
-জ্বী স্যার কাল আর ভুল হবে না।

রাফান আবার হাসল । তারপর এক্সলেরেটরে পা দিল।
নওরিনের চোখের সামনে দিয়ে যখন গাড়িটা চলে গেল তখনই ব্যাপারটা খেয়াল হল নওরিনের । তার বস তার বাসার ঠিকানা কিভাবে জানল ? একেবারে বাসার সামনে এসে হাজির হল ! যদি এভাবে ঠিকানা না জানত তাহলে একেবারে বাসার সামনে এসে থামা তার পক্ষে সম্ভব হত না । কিভাবে জানল এই বাড়ির ঠিকানা !
অফিসের ডাটাবেজে বাসার ঠিকানা হয়তো থাকবে । কিন্তু ঢাকা শহরে এভাবে কেবল ঠিকানা দেখেই কোন বাড়ির সামনে চলে আসাটা প্রায় অসম্ভব যদি না এর আগেও কেউ এসে থাকে । তার মানে কি কোন ভাবে রাফান আগেও এই বাসায় এসেছে ?
কিভাবে আর সব থেকে বড় প্রশ্ন কেন?

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 48

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “অফিস প্রেম”

Comments are closed.