গাড়িটা খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে । নিরানা একটু আগেও একটু একটু কাঁদছিলো । এতো দিনের পরিচিত স্থান, বাবা মা সব কিছু ছেড়ে আসতে বুকের ভেতরে কেমন যে হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছিলো । কিন্তু এটাই তো নিয়তি । এই দেশের প্রতিটি মেয়েকে এই ভাগ্য নেমে নিতে হয় কিংবা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয় । বিয়ের পর তো বাবার বাড়ি ছাড়তেই হয় !
নিরানা অনুভব করলো পাশের বসা মানুষটা মোবাইলটা এক পাশে রেখে ওর ছবি তোলার চেষ্টা করছে । কার গাড়ির সামনের সিট টা ফাঁকা । কেবল ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে । নিরানার সাথে ওর ছোট বোন আর কাজিন যাচ্ছে বরের বাড়িতে । কিন্তু ওরা অন্য গাড়িতে । এই গাড়িতে কাউকে উঠতে দেওয়া হয় নি ।
নিরারা মুখ তুলে তাকালো । কান্নার ভাবটা চলে গেছে ওর । মন যদিও এখনও বিষণ্ণ ।
আবিদ বলল, তোমার কাজল ওয়াটার প্রুফ না?
নিরানা মুখ দিয়ে কোন উত্তর দিলো না । কেবল মাথা ঝাকালো । আবিদ আবার বলল, তাই তো ভাবছি । এতো কান্নাকাটির পরে ওঠা ঠিক আছে কিভাবে ! এমন ভাবে কাঁদছিলে যেন বিয়ে বাড়ি না, মরা বাড়ি !
-শুনুন মেয়ে হন নি তো তাই বুঝবেন না ।
-কেন বুঝবো না শুনি? এইচ এস সির পর থেকে আমি বাড়ি ছাড়া । বছরে কেবল দুই ঈদের সময় বাসায় আসতাম । একা একা বড় হয়েছি । এখন চাকরির সুবাদে সারা বছর বাইরে থাকতে হয় !
-আপনার বাড়ির বাইরে থাকা আর আমারটা এক না । বিয়ে পরে মেয়েরা আর বাবার বাসায় আপন থাকে না । সেটা তখন পরের বাড়ি হয়ে যায় !
-হয়ে যায় কারণ তুমি মনে কর ! এমনটা মনে করা হয় । কিন্তু কেন কর ওটা তোমার বাড়ি । সারা জীবন তেমনই থাকবে । থাকা উচিৎ !
আবিদ এরপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, মিনার,
-জি ভাই ?
-বাইপাস দিয়ে যেও না । বাজারের রাস্তা দিয়ে যাও ।
-কিন্তু সবাই তো….
-যা বলছি কর …
-জি ভাই ।
নিরানা বলল, বাজারের ভেতর দিয়ে কেন? বাইপাস দিয়ে গেলে তো কম সময় লাগার কথা!
আবিদ হাসলো । এতো তাড়াহুড়া কেন শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার ?
নিরানা লজ্জা পেয়ে গেল । বলল, না, তেমন কিছু না ।
নিরানার বাড়ি থেকে আবিদদের বাসায় যেতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগে । নিরানাদের বাসা থেকে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বের হতে হতে একটু রাত হয়ে গিয়েছে । আবিদদের বাসায় যেতে যেতে রাত অন্তত এগারোটা বাজবে । তাই দ্রুত যাওয়া উচৎ।
বাজারের ভেতরে কার গাড়িটা দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ আবিদ বলল, মিনার গাড়িটা ঐ দোকানের সামনে থামাও !
-গাড়ি থামাবো?
-হ্যা । ঐ তো চায়ের দোকানের সামনে !
গাড়ির গতি কমে এল । এক সময়ে থেমে গেল । আবিদ গাড়ির দরজা খুলে বের হল । নিরানা ঠিক বুঝতে পারছে না কি করবে । এই সময়ে এই চায়ের দোকানের সামনে কেন গাড়ি থামালো সে । আবিদ বলল, কই এসো !
-এখন?
-আসো ।
নিরানা খানিকটা কৌতুহল আর দ্বিধা নিয়ে বের হয়ে এল । এই ভাবে বউ সেজে এরকম স্থানীয় বাজারের একটা চায়ের দোকানের সামনে দাড়াতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে । রাট প্রায় দশটা বাজে । মফস্বল শহরের জন্য একটু রাত । তাই বাজারটা বেশ ফাঁকাই । কয়েকটা দোকান খোলা রয়েছে কেবল । চায়ের দোকানে সামনে কোন নতুন বউ দাড়িয়েছে কিনা সেটা নিরানার জানা নেই ।
আবিদের পেছন পেছন গিয়ে হাজির হল দোকানটার সামনে । ওরা ছাড়াও আরও তিনজন কাস্টমার রয়েছে । ওরাও খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে । এমন দৃশ্য সচারচার দেখা যায় না । বর আর বউয়ের সাজে কেউ তো এমন চায়ের দোকানে এসে বসে না । আবিদ একটা বেঞ্চ দেখিয়ে নিরানাকে বসতে বলল । নিজেও বসে পড়লো ওর পাশে । নিরানার সত্যই একটু অস্বস্তি লাগছে তবে সেই সাথে একটা আনন্দ অনুভূতিও হচ্ছে । আবিদ চায়ের দোকানদারকে বলল, দুইটা সুন্দর করে দুধ চা বানান তো দেখি। নতুন বউ নিয়ে এসেছি । মান সম্মান রাইখেন ।
চায়ের দোকানের মামাকে দাঁত বের করে হাসতে দেখা গেল । সে বলল, মামা চিন্তা কইরেন না । ফাস কেলাস চা বানামু । জীবনে ভুলবেন না !
নিরানার কেন জানি অস্বস্তিটা কেটে । সামনে বসা মানুষটাকে হঠাৎ করই আপন মনে হতে শুরু হল । একটু পরে চা চলে এল । দুজন বর বউয়ের সাথে এমন টংয়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে এমন তা দৃশ্য নিরার চোখে ভাবতে লাগলো !
-নিরা
-জি !
-আমাকে কি আপনি করেই বলবে?
-তুমিতে আসতে একটু সময় লাগবে !
-আচ্ছা সেটা সমস্যা নেই । তোমার যেদিন ভাল লাগবে সেদিন দেখো । কয়েকটা কথা বলি !
-বলুন !
আবিদ চায়ের কাপে আরও একটা চুমুক দিলো । তারপর বলল, দেখো, মানুষ যেহেতু ভুল হতে পারে । খারা ভাল নিয়েই । তাই সামনে আমাদের সাথে আমাদের দুজনের ভেতরে সব কিছুই যে সঠিক হবে, আমি যে সব সময়ই সঠিক আচরন করবো কিংবা তুমিও যে সব সঠিক ব্যবহার করবে সেটা আমি আশা করি না । ভুল ভ্রান্তি হবে । ঠিক আছে !
-হুম !
-তবে যে ব্যাপার গুলো কখনই হবে সেটা আমি বলি ! আমাদের মাঝে কখনই অতীত নিয়ে কেউ কাউকে কিছু বলবে না । এই আজকের আগে তোমার সাথে কি হয়েছিলো কি করেছো সেটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই । আমাদের সব আলোচনা আজ থেকে শুরু হবে । ঠিক আছে?
-ঠিক আছে ।
-আমি বলছি না যে ঝগড়া হবে না । হবে । তবে আমরা দুজনই যতই রেগে যাই না কেন, কখনই একে অন্যকে গালী দিবো না, হাতাহাতির টো প্রশ্নই আসে না । আমাদের দেশে স্বামী স্ত্রীকে মেরেছে এটা খুবই কমন এবং গ্রহনযোগ্য একটা ব্যাপার । এটা আমার কাছে ঘৃন্য লাগে । যারা এটা করে এবং যারা এটা মেনে নেয় । দুইজনই । সব অন্যায় ক্ষমা হবে এটা না !
নিরানা এতো ভাল লাগলো কথাটা শুনে বলে বোঝাতে পারবে না । এক ভাবে তাকিয়ে রইলো আবিদের দিকে । আবিদ আবারও বলল, আমাদের দেশের আরেকটা কালচার হচ্ছে স্বামীর বাধ্য বলা হয় স্ত্রীদের । বাধ্য কথাটা শুনলেই অনেকটা চাকর মনিবের কথা মনে আছে । আমি তোমাকে মোটেই বাধ্য থাকতে বলব না । আমার প্রতি কেবল বিশ্বস্ত থাকবে । তোমার নিজের সিদ্ধান্ত একান্তই তোমার । ঠিক তেমনি ভাবে আমার নিজের সিদ্ধন্ত একান্তই আমার । আমি চেষ্টা করবো এবং আশা করবো তুমিও চেষ্টা করবে সে একে অন্যের সিদ্ধান্তে ইন্টারফিয়ার না করতে । একজনের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর চাপিয়ে না দিতে । ঠিক আছে !
-ঠিক আছে !
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে আবিদ বলল, আপাতত সিরিয়াস কথাবার্তা এই টুকুই । এই কথা গুলো বাসায় গিয়েও বলা যেত কিন্তু মনে হল একটু অন্য ভাবে বলা যাক !
-আমার পছন্দ হয়েছে আপনার এই ধরনটা !
চায়ের দাম দিতে গেলে চা ওয়ালা মামা কিছুতেই সেটা নিলো না । বলল, মামা একটা ফটু তুলে ফেসবুকে পুস্ট কইরেন । তাইলে আমার চায়ের দোকানের সুনাম হইবে ।
ওরা দুজনেই হাসলো এবং তাই করলো । নিরারা নিজের মোবাইল থেকেই ছবিটা তুলল । তারপর সেটা সাথে সাথেই ফেসবুকে পোস্ট করে দিলো ।
গাড়িতে ফিরে এসে আবিদ আরেকটা কাজ করলো । ড্রাইভারকে একটা ৫০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল, তুমি এখান থেকে বাসায় চলে যাও ।
-গাড়ি ।
-গাড়ি আমি চালাবো !
-কিন্তু ….
-এতো কিন্তু বলার কিছু নেই । যাও ……
মিনার চলে গেল । আবিদ ড্রাইভিং সিটে বসলো । নিরানা বসলো তার পাশে । আবিদ নিরানার দিকে তাকিয়ে বলল, মোবাইল সুইচ অফ করে দাও তো !
-কেন ?
-সবাইকে একটু টেনশনে রাখা যাক । বিয়ে এমন থ্রিল ছাড়া হলে ভালো লাগে ! এই যে আমি মোবাইল অফ করে দিলাম । আগামী অন্তত দুই তিন ঘন্টা আমরা কেবল গাড়ি করে ঘুরবো । বাসার মানুষ একটু চিন্তা করুক!
-এটা কি ঠিক হবে !
-আরে হবে হবে ! জলদি সুইচ অফ কর তো !!
নিরানা হাসলো । মোবাইলটা সুইচ অফ করলো না। এরোপ্লেন মোডে দিয়ে দিল । ততক্ষনে গাড়ি চলতে শুরু করেছে । বিয়ের শুরুতে আবিদকে সে মাত্র দুইবার দেখেছে । একটু মনে সংশয় ছিল যে সামনের জীবন কেমন হবে, আবিদ স্বামী হিসাবে কেমন হবে কিন্তু এখন কেন জানি মনে হচ্ছে সামনের জীবনটা খারাপ যাবে না । বিয়ের দিন রাতে অচেনা এই টংয়ের দোকানে চা টেবিল বৈঠকটার কারণে আবিদের হাজারটা অপরাধ সে ক্ষমা করে দিতে পারে ! এমন একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা দিয়ে বিবাহিত জীবন শুরু হবে সে কোন দিন ভাবতে পারে নি ।
নিরানা হাত টা আবিদের হাতের উপরে রাখলো । একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসলো ওরা । সামনের জীবনের স্বপ্নে দুজনেই বিভোর !