আমি কিছু সময় চুপ করে শুয়ে রইলাম । ঘরে আশেয়া এসেছে সেটা আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি। তবে এমন একটা ভান করে রইলাম যেন আমি এখনও ঘুমিয়ে রয়েছি। তবে সেটা খুব বেশি সময় আমাকে কাজে দিল না । আয়েশার কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি।
-নায়েব সাহেব ! নায়েব সাহেব ।
দুইবার ডাক দিলো সে । আমি অনুভব করলাম আমার ভেতর থেকে উঠে পড়ার একটা প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে । আমার মনের একটা অংশ আয়েশার আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই উঠে পড়ার একটা তাগাদা অনুভব করলাম । আমি বিচানাতে উঠে বসলাম । দেখলাম আয়েশা একদম আমার বিছানার উপরে বসে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । ঘর অন্ধকার । তবুও আমি ওর চেহারা ঠিক দেখতে পাচ্ছি । বিশেষ করে ওর চোখ । গতদিন আমি সেটা একদমই খেয়াল করি নি কিংবা গতদিন এমন ছিল না । আজকে রয়েছে । অন্ধকারের ভেতরে একটু যেন লালের আভা । আগুন লাল ।
আয়েশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় পেও না নায়েব । আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না । তোমার কাছে এসেছি কথা বলতে । জানো তো কতদিন কারো সাথে কথা বলি না ।
কতদিন বলতে সে কি বুঝিয়েছে সেটা আমি বুঝতে পারলাম । সালটা আমি মনে মনে হিসাব করেছি । কম করে হলেও দেড়শ থেকে দুইশ বছর । আমার সামনে একজন দুইশ বছরের মেয়ে বসে রয়েছে । কিভাবে বসে আছে সেটা আমি জানি না । তবে বসে আছে এটাই কেবল জানি ।
আয়েশা বলল, একশ নব্বই বছর ।
আমি চমকে উঠলাম । আয়েশা আমার মনের কথা টের পাচ্ছে । কী সর্বনাশের একটা ব্যাপার ।
-ভয় পেও না নায়েব !
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম । মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না । কিভাবে বের হবে? যখন সামনে একজন দুইশ বছরের পুরানো প্রেতাত্মা বসে রয়েছে তখন কিভাবে আমি স্বাভাবিক থাকবো কিংবা ভয় পাবো না ।
আয়েশা হঠাৎ কথা শুরু করলো । আমার বড় ইয়াকুব ভাই খুব জ্ঞানী মানুষ ছিল । দুনিয়ার যত বস অকাজের জ্ঞান দিয়ে নিজের ব্রেন ভর্তি করেছিল । সেই নানা জ্ঞানের একটা জ্ঞান ছিল মমি বিষয়ক জ্ঞান । তার যুবক বয়সে সে মিশরে গিয়েছিল। সেখান থেকেই তার মাথায় এই মমি করার ভুত চাপে । সে যখন ফিরে এল তখন সে ঘোষণা দিল যে ফারাও দের মত এখন থেকে তাদের বংশের মানুষের মৃত দেহো মমি করা হবে । বাবা প্রথমে শুনে তো খুব রেগে গেলেন তবে বাবা জানতেন সে মারা গেলে তার ছেলে এই কাজ করবেই । তিনি চেয়েছিলেন তার মরার পর যে জলদি তাকে কবর দেওয়া হয় । হয়েছিলও কিন্তু ইয়াকুব রাতের আধারে তার মৃত দেহ বের করে কবর থেকে । তারপর সেটার সাথে কি না করেছিল । একেবারে জীবন্ত করে রেখে দিলো ঐ বাড়ির পাতাল ঘরে । আমাকে একদিন নিয়ে গেল সেখানে । আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে বাবার দেহটা একদম পঁচে নি । কিভাবে সে এই কাজ করেছিল সেটা আমি জানি না তবে সে করেছিল । আমি বাবাকে ভালবাসতাম । আমি প্রায়ই যেতাম ঐ ঘরে । এরপর ইয়াকুব এরপর বাড়ির এক চাকরকে মেরে মমি বানানো । বাবার সাথে থাকার জন্য । এভাবে গুনে গুনে মোট ছয়জনের জায়গা হল । তার ভেতরে আমার মাও ছিল । ইয়াকুবের মাঝে কি পাগলামী এসে ভর করেছিলো কে জানে । আমি যে কিভাবে মারা গেলাম সেটা আমি নিজেও জানি না । হয়তো স্বাভবিক ভাবে নয়তো ইয়াকুবই আমাকে মেরেছিল । আমার স্থান হল ঐ ঘরে !
আয়েশা বেশ কিছু সময় বসে রইলো চুপ করে । কোন কথা বলল না । আমি বললাম, এরপর?
-এরপর কি হয়েছি আমি জানি না । একদিন জেগে উঠলাম । হেটে চলে বেড়াতে পারি । খানিকটা অবাক হলাম । কেবল আমিই না আমার বাবা সেই চাকর সবাই জেগে উঠলো । তবে ইয়াকুব সেখানে ছিল না । সম্ভব তার মরার পর কেউ ছিল না যে তার মমি করতে পারবে । তবে কোন একটা উপায় হয়তো সে বের করেছিল যার ফলে আমরা এতোদিন জেগে উঠেছি । তবে কেবল জেগে উঠেছি কিন্তু আমরা বেঁচে নেই । আমাদের ক্ষুধা লাগে না । দিনের বেলাতে আমরা বের হতে পারি না । আমাদেরকে কেউ নিয়ন্ত্রন করে । আলী ওয়াজেদ । সেই আমাদের জাগিয়ে তুলেছে । তার কোন সমস্যা হলেই সে রাতে আমাদের ঘরে আসে । তারপর সেই স্থানে আমাকে পাঠায় । গতদিন দেখলে না, কাউকে আক্রমন করতে পাঠিয়েছিলো সে । আমাকে অবশ্য যেতে হয় না । বাবাই বেশি যায় । বাবার সাথে চাকরেরা যায় মাঝে মধ্যে ।
আমি আসলে কি যে বলবো সেটা আমি বুঝতেই পারলাম না । এতোদিন এই সব কাহিনী আমি মুভিতে দেখেছি । দ্য মমি নামের একটা মুভি দেখেছিলাম যেখানে এভাবে প্রাচীন মিশরের মমিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে । এভাবে বেঁচে ওঠে । কিন্তু এখানে চোখের সামনে এমন একটা ঘটনা চোখের সামনে ঘটবে সেটা ভাবতেও পারছি না ।
তারপর থেকেই আয়েশা প্রায় প্রতি রাতে আমার সাথে দেখা করতে আসতে লাগল। আমার সাথে তার কত কথা । সেই সময়ে কিভাবে থাকতো, কী কী করতো আরও কত কি? সারাটা দিন আমার ভয় ভয় লাগলেও যখন আয়েশা এসে হাজির হত তখন আমি যেন অন্য জগতে চলে যেতাম। আমার তখন আর অন্য কিছু মনে থাকতো না । আমার কেবল মনে হত আয়েশার কথাই শুনি কেবল । কী যেন এক তীব্র আকর্ষন রয়েছে ওর কথায় !
দিনের বেলা আমার যখন কাজ থাকতো না তখন আমি আমি বাইরে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম । আমার কেন জানি বাড়ির ভেতরটা কেমন ভয় করতে শুরু করলো । আয়েশা আসা পর্যন্ত আমার ভয়ই করতো । একদিন বিকেল বেলা হেটে বেড়াচ্ছি তখনই সেদিনের সেই পুলিশটাকে দেখতে পেলাম । সে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে । তার কাছে যেতেই খেয়াল করলাম যে তার মুখের কাছে বেশ বড় একটা ক্ষত । সেটা কিভাবে হয়েছে সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না । লোকটা যেন একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে । আমার সামনে এসে থামলো । তারপর বলল, আপনার সাথে কি কয়েকটা কথা বলা যাবে?
আমি বললাম, জি বলুন ।
সে কিছু বলার আগে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল । দেখলাম সেখানে দুইজন মানুষের ছবি আর তাদের নাম ঠিকানা রয়েছে । আমি কৌতুহল নিয়ে তাকালাম লোকটার দিকে । লোকটা বলল, এরা কারা জানেন?
-কারা?
-এরা আপনার পোস্টে আপনার আগে ওখানে চাকরি করতো। দুইজনের কোন খোজ নেই । গত এক বছরে নায়েব পদে চাকরি করতে মোট তিন জন এসেছে এখানে । আপনি সহ চার জন। দুজন মিসিং । মিসিং বলতে তাদের মিসিং রিপোর্ট লেখা হয়েছে অন্য জনের কোন মিসিং রিপোর্ট লেখা হয় নি । তবে আমি জানি সেও মিসিং । এবং আপনিও মিসিং হবেন হয়তো ।
আমি কিছু বললাম না মুখে । তবে আমি জানি এই লোক যা বলছে তার ভেতরে সত্যতা আছে । আর ঐ তিনজন কিভাবে গায়েব হয়েছে সেটা আমিও জানি । অন্তত অনুমান তো করতেই পারছি । পুলিশ সাহেব বলল, দেখুন আমি নিজে যা দেখেছি তা আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না । সেদিন কিভাবে আমি রক্ষা পেয়েছি সেটা আমি জানি । পরপর ছয়টা গুলি করেছি । ছয়টা । কিছু হয় নি ওটার । আমার হাতে কোন প্রমান নেই । তাই আইনের লোক হয়েও আমার কিছুই করার নেই আসলে । আর আপনি তো জানেনই আদালত এইসব মোটেই বিশ্বাস করে না । এই প্রত্যন্ত এলাকাতে এসে তাই তার সাথে যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছে নেই আমার । তবে আমি আপনাকে পরামর্শ দিবো যে আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যান । যদি নিজের প্রাণের মায়া থাকে ।
লোকটা আমাকে ক্রস করে চলে গেল । আমি কিছু সময় এদিক ওদিক হাটাহাটি করে আবার জমিদার বাড়ির দিকে হাটা দিলাম । আমার কেন জানি ভয় ভয় করতে লাগলো । মনের ভেতরে পুলিশ সাহেবের কথাটা বারবার ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো । আমার আগে তিন জন নায়েব গায়েব হয়ে গেছে । কোথায় গেছে কেউ জানে না । আমিও যদি গায়েব হয়ে যাই তাহলে ? আমার খোজ কি কেউ পাবে? কেউ কি আমার খোজ করবে?
নিজের কাছে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়াম । এই এলাকা ছাড়তে হবে আমার । এখানে বেঘোরে প্রান হারানোর কোন মানে নেই । তৃষা বলেছিল ওর জন্য যদি অপেক্ষা করতে পারি তাহলে হয়তো সে ফিরে আসলেও আসতে পারে । সেই অপেক্ষাটা আমাকে করতে হবে । এবং এই কারনে আমাকে তো জীবিত থাকত হবে !
পরদিনই আমি আলী ওয়াজেদকে বললাম যে আমি একটু বাড়িতে যেতে চাই । বাসা থেকে খবর এসেছে আমার বাবার শরীর খারাপ । যদিও এটা মিথ্যা কথা । বাসায় সবার শরীরই ভাল । আমি এখনই চাকরি ছেড়ে দিতে চাই না । অন্তত ইনাকে সেটা জানাতে চাই না । বাসায় ফিরে গিয়ে তারপর ফোন করে বলে দিলেই হবে যে আমি আর ফিরে আসবো না । তবে আলী ওয়াজেদ আমার দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইলো । আমার কেন জানি মনে হল আমার মিথ্যাটা তিনি ধরে ফেললেন । আমি যে এখান থেকে চলে গেলে আর ফিরে আসবো না সেটাও সে বুঝে গেল । তবে মুখে সে কিছু বলল না । একটু গম্ভীর থেকে বলল, এখন তো সময় পার হয়ে গেছে আজকে বরং না যাও । আগামী কাল সকালে তোমামকে গাড়িতে কবে পৌছে দেওয়া হবে । ঠিক আছে?
একবার মনে হল যে বলি এখন চলে যাই, একটু রাত হলেও সমস্যা হবে না । তবে এই কদিনে আলী ওয়াজেদ খানের সাথে মিশে আমি যা বুঝেছি তা হচ্ছে তার কথাই হচ্ছে শেষ কথা । এর পরে কেউ কিছু বললে সে খুব রেগে যায় । আমি শেষ সময়ে এসে তাকে রাগিয়ে দিতে চাই না । আগামীকাল সকালে গেলেই চলবে ।
জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম । আগের মতই আমার ঘুম ভাঙ্গলো । আমি জানতাম আমার ঘুম ভাঙ্গবে । আজকে যখন উঠে বসলাম দেখি আয়েশা ঘরের জানালার কাছে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে । কিছু যেন শোনার চেষ্টা করছে ।
আমি বললাম কি হচ্ছে?
আয়েশা আমার দিকে তাকালো । ওর চোখে আমি কেমন একটা চিন্তার রেখা দেখতে পেলাম । আয়েশা আমার দিকে এগিয়ে এল । তারপর বলল, তোমার বিপদ ।
-মানে?
-মানে তোমার বিপদ । এটাই হচ্ছে বড় কথা । আমি আরও একটু আগে যদি টের পেতাম !
আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনই বাইরের দরজাতে ধাক্কা পড়ল। বেশ জোরে ।
-ওরা চলে এসেছে।
-কা…..
আমি শব্দ টা শেষ করলাম না । কারণ আমি জানি কারা এসছে । কিন্তু কেন এসেছে? আমি কি করেছি? আমি যদি চলেও যেতে চাই তাহলে এটা কি খুব বড় কোন অপরাধ ? এই কারণেই কেন আলী ওয়াজেদ আমাকে মেরে ফেলতে চাইবে । আমার মনের কথাই যেন আয়েশা বুঝে ফেলল । তারপর বলল, আমাদের মত কয়েকজনের দিনের পর দিন এই পৃথিবীতে থাকার কথা না । এখানে আমাদের টিকে থাকার জন্য একজন মানুষের রক্ত দরকার ।
-আমার রক্ত?
-আপাতত হ্যা । তোমার রক্ত । আজকে সেই জন্যই ওরা এসেছে ।
-তুমি?
-আমারও দরকার । তবে ভয় পেও না । আমার কাছ থেকে তোমার ভয় নেই ।
আমি কথাটা বিশ্বাস করলাম । এখন এই কথা বিশ্বাস করা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই । দরজাতে এবার রীতিমত আঘাত করা শুরু হয়েছে । বুঝতে পারলাম দরজা আর বেশি সময় টিকে থাকবে না । আয়েশা আমার হাত ধরলো । এরপর আমাকে টেনে নিয়ে গেল আমার শোবার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এল । বসার ঘরের দরজাটা নড়ছেই । ওটা যে এখনই ভেঙ্গে পড়বে সেটার ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই । কত সময় হাতে পাবো আমি জানি না । আমাকে ছোট ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে গেল। পরপর দুট ওয়াশ রুম এখানে । একটা আমি ব্যবহার করি । অন্যটা বন্ধ থাকে । আজকে দেখলাম সেটা খোলা । সেই দরজাই আয়েশা খুলে ফেলল । অবাক হয়ে দেখলাম যে ওটা ওয়াশ রুম না । ওপাশে আরেকটা দরজা দেখা যাচ্ছে ।
আয়েশা দরজা খুলে ফেলল । আমি বাইরের অন্ধকার দেখতে পেলাম । আমার ঘর টা ছিল জমিদার বাড়ির শেষ দিকে । এই দরজা দিয়ে আমি একেবারে পাচিলের বাইরে বের হয়ে এলাম । আয়েশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখনও বিপদ কাটে নি । ওরা তোমার পেছনে আসবে । তোমাকে এখন দৌড়াতে হবে । এটাই কেবল তোমাকে বাঁচাতে পারে । আমি আর কিছুই করতে পারবো না । ওদের কাছ থেকে তোমাকে পালাতে হবে । মনে রাখবে কোণ ভাবেই থামবে না । কোন ভাবেই না ।
আমার কি হল জানি না আমি আয়েশাকে জড়িয়ে ধরলাম । ওর শরীরের সাথে যখন আমার শরীরটা মিশলো তখন টের পেলাম ওর ভেতরে কোন প্রাণের স্পন্দন নেই । একেবারে জড় পদার্থ সেটা ।
আয়েশা বলল, আর শুনো, যখন ওরা তোমার পেছনে চলে আসবে তখ সোজা দৌড়াবে না । একেবারে দৌড়াবে । মনে থাকবে?
-আচ্ছা । মনে থাকবে ।
তখনও দরজা ভেঙ্গে পড়ার আওয়াজ পেলাম । ওরা ফেতরে ঢুকে পরেছে । একটু পরেই টের পাবে যে আমি ঘরের ভেতরে নেই ।
আমি আর দেরি করলাম না । আমি অন্ধকারে দৌড়নো শুরু করলাম । পথ ঘাট সব অচেনা মনে হল । অন্ধকারে যেন কিছুই চেনা যাচ্ছে না । আমি সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম ।
কত সময় দৌড়েছি আমি নিজেও জানি না । একটা সময়ে আমার মনে হল আমি বুঝি আর পারছি না । দম নেওয়ার জন্য এক জায়গায় থামলাম । ঠিক তখনই আমি পেছনে আওয়াজ পেলাম । সাথে সাথে পেছনে তাকিয়ে দেখি জ্বলন্ত দুটো চোখ। ওরা চলে এসেছে ।
কত সময় ধরে আমার পেছনে চলে এসেছে আমি জানি না । তবে মনে হল ওরা অনেক সম্ময়েই আমার পেছন পেছন আসছে । আমাকে জানতে দেয় নি । সেদিনের সেই আয়োবয়টাই । আমার কেন জানি মনে সেটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে ।
আমি আবার দোড় দিলাম । তবে এবার আর সোজা না একে বেঁকে । পেছন থেকে যেন সব কিছু ভেঙ্গে চুড়ে আসছে । একটা সময় আমার সব শক্তি শেষ হয়ে এল । আমি হার মেনে নিলাম । মনে হল আমার পক্ষে আর পালানো সম্ভব না । অবশ্য আমাকে নিজ থেকে থেমে পড়তে হল না । একটা গাছের গুড়ে পা আটকে আমি হোঁচ খেয়ে পড়ে গেলাম । আর উঠলাম না । আর উঠে লাভও নেই ।
কয়েক সেকেন্ড পরেই অনুভব করলাম আমার পিঠের কাছে একটা কিছু এসে দাড়িয়েছে । নিজের মুখটা আমার কাছে নিয়ে এসেছে তবে আমি কোন নিঃশ্বাসের অনুভূতি পেলাম না । একটা হিসহিস আওয়াজ পেলাম । এখনই বুঝি আমার জীবনের শেষ মুহুর্ত চলে এসেছে । শেষ বারের মত পরিবারের কথা মনে পড়লো । তারা বুঝি আমার লাশটাও খুজে পাবে না । কোন দিন জানতেও পারবে না যে আমার কি হয়েছে ! এরপর তৃষার কথা মনে পড়ল । ও নিশ্চয়ই ভাববে আমিও বুঝি অন্য সবার মত অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি । ওকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে জীবন শুরু করেছি !
এই তাহলে বিদায় !
তক্ষনই ঘটলো ঘটনাটা । মনে হল যেন পিঠের উপর থেকে কিছু ছুটে চলে গেল । একটা কিছু মাটিতে পড়ার আওয়াজ পেলাম । তারপরই ধাস্তাধস্তির আওয়াজ শুনতে পেলাম । তারপর কিছু একটা এসে দাড়ালো আমার থেকে একটু দূরে । আমি কোন মতে উঠে বসেই আয়েশাকে দেখতে পেয়াম ! আমার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে । ওর পেছনটা আমার দিকে তবে ওকে চিনতে আমার মোটেই কষ্ট হল না । আমি কেবল তাকিয়ে আয়েশা একভাবে তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে । সামনে দাঁড়ানো আরেকটা জলন্ত চোখের দিকে । চারিদিকে সব যেন থেমে গেছে । আমার কাছে মনে হল আমরা যেন অনন্ত কাল ধরে একভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ।
তারপরেই ঘটলো ঘটনাটা । সামনের সেই জলন্ত মমির চোখ যেন একটু নিভে গেল । তারপর সেটা ঘরে ফিরে যেতে থাকলো। দেখলাম আয়েশা এবার আমার দিকে ফিরে তাকালো । ওর জলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরেই কেমন যেন একটা কাপন অনুভব করলাম । তবে ধীরে ধীরে কমে এল । আমার দিকে তাকিয়ে আয়েশা বলল, যাও, থেমো না । যাও।
আমি আবারও দৌড়াতে শুরু করলাম । কত সময় দৌড়ালাম জানি না এক সময় মনে হল পাকা রাস্তার কাছে চলে এসেছি । রাস্তায় পাশে দাড়াতেই একটা ট্রাকের দেখা পেলাম । হাত দিয়ে ইশারা করতে সেটা থেমেও গেল ।
তারপর কেটে গেছে আরও বেশ কিছু সময় সময় । নতুন চাকরি নিয়েছে । এবার ঢাকাতেই । মাঝে মাঝে এখনও আমার রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় । ঘুম ভেঙ্গে মনে হয় কেউ ঘরের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আর আমাকে দূর থেকে দেখছে । আমি বছাড়া ছেড়ে উঠে বসি । পুরো ঘরে কাউকে দেখতে পাই না ।