প্রাচীন মমি (দ্বিতীয় পর্ব)

অপু তানভীর
4.9
(43)

প্রথম পর্ব

সকাল বেলা আমার ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় এগারোটা বেজে গেছে । একটু অবাক হলাম আমি । সাথে সাথেই আমার গত রাতের কথা মনে পড়ে গেল । সাথে সাথে আমি পুরো ঘরের দিকে চোখ বুলালাম । পুরো ঘর ফাঁকা । এরপর আমার চোখ চলে গেল । দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ।

আমি দরজা খুলে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এলাম । সেটাও বন্ধ । আমার গত রাতের কথা সব মনে পড়ে গেল । সাথে সাথে পুর শরীরে একটা কাটা দিয়ে উঠলো ।

গতকাল রাতে আমার চোখের সামনে সেই অস্বাভাবিক ব্যক্তিটা লাফ দিয়ে গেট পার হয়ে চলে গেল । আমি কেবল অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম । কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । এটা কি আদৌও সম্ভব ? তখনই আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটির একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম । মেয়েটি বলল, চলুন আপনাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসি।

-মানে? আমাকে কেন পৌছে দিতে হবে?

-কারণ এই বাসায় এখন ওরা রয়েছে । পথে ওদের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে । আপনাকে একলা পেলে ওরা ছাড়বে না।

-ওরা মানে কারা?

-এতো কিছু জানতে হবে না । আসুন আমার সাথে সাথে । কোন কথা বলবেন না । কেমন?

এই বলে মেয়েটি আমার সামনে সামনে হাটতে শুরু করলো। আমি কোন কথা না বলে মেয়েটির পেছন পেছন হাটতে শুরু করলাম । তখনই একটা ব্যাপার আমার মনে এল ।বাসার গেটের ঠিক পাশেই একটা ছোট ঘর রয়েছে । সেখানে দারোয়ান বসে থাকার কথার । সে সারারাত পাহাড়া দেয় । ব্যাটা কই এখন? একটু থেমে সেদিকে তাকালাম । অন্ধকার তখন চোখে বেশ ভালভাবেই সয়ে গেছে । কিন্তু আমি দারোয়ানের টিকিটাও দেখতে পেলাম না । ব্যাটা গেল কই?

-এই দাড়ালে কেন? জলদি এসো ।

সামনের মেয়েটি চাপা স্বরে ডাক দিল আমাকে । আমি আবারও দ্রুত হাটা দিলাম । আমার বাসার কাছে এসেছি তখনই পেছনে থপথপ আওয়াজ শুনতে পেলাম । আওয়াজটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে দ্রুত । মেয়েটিকে দেখলাম প্রায় এক লাফে আমার কাছে চলে আসতে । তারপর আমার হাত ধরে এক প্রকার হেচকা টান দিয়ে আমাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এসে ফেললো আমার ঘরের ভেতরে । তারপর সে দরজাটা বন্ধ করে দিল । আমাকে হাতের ইরাশায় চুপ থাকতে বলে সে দরজাতে কান দিয়ে কি যেন শুনতে লাগলো । আমি নিজেও ভয়ে জমে গেলাম । বাইরে যে কী হচ্ছে সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না । এমন কেন হচ্ছে !

বাইরের সেই থপথপ আওয়াজটা শুনতে পেলাম । ঘরের চারিদিকে সেই আওয়াজটা কিছু সময় ঘোরাঘুরি করলো । তারপর সেটা দূরে চলে গেল । একটা সময় দেখলাম মেয়েটার দরজার কাছ থেকে সরে এল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপাতত আর ভয় নেই ।

আমি সাথে সাথেই বললাম, ভয় নেই মানে? কিসের ভয় নেই । ওরা কারা ? আর সব থেকে বড় কথা তুমি কে? এখানে কিভাবে এলে?

মেয়েটা আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না । পুর ঘরে ঘুরে দেখতে লাগলো কি যেন । তারপর বাইরের ঘরে রাখা সোফার উপরে গিয়ে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিই তাহলে নতুন নায়েব মশাই?

আমি বললাম, হ্যা । আমাকে এরা নায়েব বলেই ডাকে । হিসাব তো আমি ম্যানেজার । এই এস্টেট দেখা শুনা করি ।

-আলী ওয়াজেদ তোমাকে নিয়ে এসছে তাহলে ? বুড়ো নায়েব না নিয়ে এসে এবার দেখি জোয়ান নায়েব নিয়ে এসেছে । বেশ ভাল । তা বিয়ে করেছো?

-না ।

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, আমার নাম আয়েশা । আমি ……

আয়েশা কথা শেষ করলো না । আমার মনে হল যে ও আমাকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না । যেন শেশ মুহুর্তে মনে হল যে আমাকে এই কথা না বলাই ভাল ।

আমি ঘরে আলোর জন্য একটা মোমবাতি জ্বাললাম । তারপর সেটা টিটেবিলের সামনে রেখে নিজেও শোফার অন্য পাশে বসলাম । আমার ভেতরে এখন খানিকটা জানার স্পৃহা । এই মেয়ে এখানে কিভাবে এল? আলী ওয়াজেদ সাহেবকে সে কিভাবে চেনে ? আয়েশা আমার দিকে হাসি মুখ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে । মোমের আলোতে ওর চেহারাটার দিকে আমার মনে হল যে চেহারাটা কেমন যে মলিন মলিন ! না ঠিক মলিন না, মনে হল অনেক পুরোনো কাউকে দেখছি । যদিও বয়সে সে আমার মতই হবে তবে কেন জানি তার চেহারা চুল বাঁধার ধরন, পরনের শাড়ি সব কিছুতেই একটা পুরানো পুরানো ভাব রয়েছে ।

আয়েশা নানান কথা বার্তা বলতে শুরু করলো । এই জমিদারির কথা । কখন সেটা শুরু হয়েছে কে ছিল এই সব । এখন কি আছে না আছে । আমি আস্তে আস্তে শুনতে লাগলাম । আমার মনে হল যে আয়েশার কথার মাঝে একটা আলাদা আকর্ষন রয়েছে । বারবার যেন শুনতেই মন চায় । আমি সেই কথার মায়ায় পড়ে গেলাম যেন ।

এইভাবে কথা বলতে বলতে আমার মনে হল যেন আমার ঘুম আসছে । হঠাৎ করে এতো ঘুম আসছে কেন সেটাই বুঝতে পারলাম না । এক সময় আমার পক্ষে চোখের পাতা খোলা রাখাই দুস্কর হয়ে গেল । আয়েশার কথা শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম ।

একটা ব্যাপার আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকলো না । আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বসার ঘরে । মানলাম আয়েশা আমাকে খাটে নিয়ে এসেছে । কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । এটার ব্যাখ্যা আমি কোন ভাবেই পেলাম না । আয়েশা যদি বের হয় তাহলে দরজা কিভাবে ভেতর থেকে বন্ধ হল । ঘরটা ভেতর থেকে ছিটকানি দেওয়া ছিল । আধুনিক লক না যে বাইরের থেকেও আটকানো যাবে । এটা কেবল ভেতর থেকেই বন্ধ করা সম্ভব ।

আমি সবারে বের হয়ে এলাম । তখনই দেখতে পেলাম বাড়ির ভেতরে দুজন মানুষ ঢুকছে । একজনকে আমি চিনতে পারলাম । সাথে সাথেই আমার কৌতুহল বেড়ে গেল । এদের একজন হচ্ছে সেই একজন যার ছেলে পুলিশের জয়েন কয়েছে এবং আলী ওয়াজেদ সাহেবের জমি ছিনিয়ে নিয়েছে । এই লোক এখানে কি করছে?

আমি পা চালিয়ে দ্রুত জমিদারের বৈঠক খানার দিকে হাটা দিলাম । সেখানে হাজির হয়ে আমাকে অবাক হতে হল । কারণ ভদ্রলোক যা বলতে এসেছিল তার সারমর্ম হল তিনি ভুল করেছেন । তিনি জমি ফেরত দিতে এসেছেন । আমার মাথায় কিছুই ঢুকও না । কি হল এটা ?

গতকাল এই লোকই বেশ দাম্ভিক ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে দিল । আজকে এমন ভেজা বেড়ালের মত আচরণ কেন করলো! যখন সে ফেরত চলে গেল আলী ওয়াজেজ আমার দিকে খানিকটা কৌতুকের সুরে বলল, কি নায়েব আমা জমি ছাড়াতে পুলিশ লাগে না ! বুঝেছো !

-কিন্তু কিভাবে হল এসব ?

উত্তরে জমিদার সাহেব কেবল হাসলেন । কোন উত্তর দি্লেন না ।

আম পরে এর আসল কারণ জানতে পারলাম । ঐদিন রাতে ঐ পুলিশের বাসায় নাকি একদম পিশাচ হামলা করেছিলো । পুলিশকে নাকি একেবারে মেরেই ফেলেছিল তবে শেশ মুহুর্তে মারে নি । মরমর অবস্থায় তাকে ফেলে চলে আসে । তারা বুঝে যায় যে হামলা কে করেছে । তবে যারা হামলা করেছিল তারা কেউ যে মানুষ নয়, এই ব্যাপারে সবাই এক মত ছিল । মানুষের সাথে যুদ্ধ করা যায় কিন্তু একদম পিশাচের সাথে কিভাবে যুদ্ধ করা সম্ভব !

এই খবর আমাকে আরও বেশি কৌতুহল করে তুলল । আমি বুঝতে পারলাম আগের দিন রাতে আমি ঠিক এমনই একজঙ্কে দেখেছিলাম । এমনই একদম আমার ঘর পর্যন্ত এসেছিল এবং চারিদিকে ঘোরাঘুরি করেছিল । কিন্ত সেটা কি আসলেই পিশাচ?

আলী ওয়াজেদ খান কি এই পিশাচ গুলো পোষে ? নাকি কোন ভাবে নিয়ন্ত্র করে ? আমি এর কোন উত্তর খুজে পেলাম না । তবে মনের ভেতরে সেই কৌতুহল জমা হয়ে রইলো । জানার একজটা আগ্রহ ঠিকই রয়ে গেল ।

দুদিন পরে আমার মনের কৌতুহল মেটাতে আমি রাতে বের হলাম । তবে আজকের রাত ঐ দিনের রাতের মত ছিল না । বাইরে ঝিঝি ডাকছিল । আলো জ্বলছিল । সব কিছু স্বাভাবিক মনে হল । আমি বাড়ির চারিদিকে নিঃশবদে হাটতে লাগ্লাম । হাটতে হাটতে আমি সেই ভাঙ্গা বাড়্র দিকে চলে গেলাম । ভাঙ্গা বাড়িটার ভেতরে ঢুকতেই যাবো তখনই সেদিনের মত কেউ আমার পেছনে এসে দাড়ালো । আমার মনে হল হয়তো আবারও আয়েশা এসে দাড়িয়েছে । আমি ঘুরে দাড়াতেই আমার ভুল ভাঙ্গলো । আমার পেছনে জমিদার আলী ওয়াজেদ খান দাড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার নায়েব এখানে কি করছো?

আমি একটু থতমত খেলাম । তারপর নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বললাম, ঘুম আসছে না । তাই একটু হাটাহাটি করছিলাম । এদিকে এই বাড়িটার ভেতরে কি আছে ?

-তেমন কিছু নেই । আসো দেখাই তোমাকে !

এই বলে সে সেই বাড়ির ভেতরের দিকে হাটা দিল । আমি একটু থেমে তার পেছনে হাটতে থাকলাম । এই বাড়িটাও দুইতলা । যার বেশির ভাগ ঘরই ভেঙ্গে পড়েছে । আমরা একটার পর আরেকটা ঘর পার হতে লাগলাম । আলী ওয়াজেদ সাহেব আগের জমিদারের নানান কথা বলতেলাগলো। তাদের পূর্ব পুরুষ কেমন ছিল । কী কী করতো ! হঠাত আমরা একটা ঘরে এসে হাজির হলাম । এবং আমি খানিকটা অবাকই হয়ে গেলাম । ঘরটা মোটেও ভাঙ্গা চোরা নয় । চারিদিকে অযত্নের ছাপ পরেছে। নিয়মিত পরিস্কার করা হয় না । কিন্তু ঘরে মানুষ আসে এটা বুঝতে পারলাম । এবং ঘরে আলো জ্বলছে । সেই আলোতেই আমি দেখতে পেলাম দেওয়ালে নানান মানুষের ছবি টাঙ্গানো ।

আলী ওয়াজেদ বললেন, এরা সব আমাদের আগেরকার পূর্ব পুরুষ । আমি একে একে সবার ছবি দেখতে শুরু করলাম । একটা ছবির সামনে এসে আমার চোখ থেমে গেল ! একজন মেয়ের ছবি । এতো গুলো পুরুষের মাঝে একটাই মেয়ে ! আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে আলী ওয়াজেদ বললেন, ইনি আয়েশা খানম । আমার প্রো প্রো পিতামহের মেয়ে ।

আমার মনে হল যেন আমি একটা হার্টবিট মিস করলাম । চোখের সামনে আয়েশাকে এভাবে দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছ না । গতদিন এই মেয়েটিই আমার সামনে এসেছিল, এই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই । কিন্তু কিভাবে?

আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না । আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো । মনে হল এখান থেকে আমার বের হয়ে যাওয়া উচিৎ ! আমি আলী ওয়াজেদকে বলে ভাঙ্গা বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম । সোজা নিজের ঘরের দিকে হাটা দিলাম । রাতের খাবার আগেই খেয়েছি । তাই শুয়ে পড়লাম সাথে সাথে ।

রাত তখন কয়টা হবে আমি জানি না, আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই আমি টের পেলাম যে আমার ঘরে কেউ রয়েছে । ঘর ময় সে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আমি অন্ধকারে তার অয়বয় দেখতে পেলাম । আমাকে বলে দিতে হল না ঘরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে !

বুকের মাঝে একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 43

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →