-নায়েব সাহেব, আপনাকে জমিদার সাহেব একটু দেখা করতে বলেছে।
দারোয়ানের কথা শুনে আমার কেন জানি হাসি পেয়ে গেল । প্রায় মাস খানেক হল এখানে এসেছি, এখানে আসার পর থেকে আমাকে নায়েব সাহেব বলেই ডাকা হচ্ছে । ব্যাপারটা আমার কাছে খানিকটা হাস্যকরই লাগছে । যদিও আমার কাজ টা খানিকটা নায়েবের মতই ।
এদেশ থেকে জমিদারি উঠেছে প্রায় সত্তর বছর কিন্তু আলী ওয়াজেদ খানের জমিদারি স্বভাবটা এখনও যায় নি । এখনও সে নিজেকে এই এলাকার জমিদার হিসাবেই মনে করে । এবং নিজেকে জমিদার হিসাবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করে ।
এই আলিপুরে আমি নায়েবের চাকরি নিয়ে এসেছি প্রায় মাস খানেক হল । গতানুগতিক চাকরি আমাকে কোন কালেই টানে নি । এমন না যে আমি চেষ্টা করি নি । চাকরিতে মন টেকে নি । আর তৃষার চলে যাওয়ার পরে তো আর কিছুই ভাল লাগছিল না । শহরের এই কোলাহক যেন দম বন্ধ লাগছিল । বুঝি তখনই এই কাজের সুযোগটা চলে এল । টাঙ্গাইল জেলার একেবারে ভেতরের দিকে এই এলাকাটা । এরপর থেকে মধুপুর গড়ের বন । এই এলাকা যে কয়েকটি গ্রাম রয়েছে তার বেশির ভাগ জমির মালিক এই আলী ওয়াজেদ খান । এখনও নিয়মিত ভাবে সবার কাছ থেকে খাজনা আদায় করা ।আগের মত করে তো খাজনা আদায়ের সিস্টেম নেই । এখন এই জমি গুলো গ্রামের কৃষকদের চাষ করতে দেওয়া হয় এবং সময় মত তাদের কাছ থেকে টাকা কিংবা ফসল নেওয়া হয় । এটা অনেকটা সেই খাজনা নেওয়ার সিস্টেম । গ্রামের এক পাশে ওয়াজেদ সাহেবের বড় জমিদার বাড়ি রয়েছে । তার নিজেস্ব লাঠিয়াল বাহিনী রয়েছে । আর রয়েছি আমি । নায়েব সাহেব । এই জমিদারির সব তদারকি করার দায়িত্ব এখন আমার । সকল হিসাব পত্র আমাকে রাখতে হয় । খুব একটা কাজ নেই । ফসল ছাড়াও বেশ কিছু ফলের বাগান রয়েছে । সেগুলো থেকে সারা বছরই কোন না কোন ফল উঠছে । সেগুলো বিক্রি করা হয়, সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থের হিসাব পত্র আমাকে রাখতে হয় । এছাড়া কিছু ব্যবসা রয়েছে। সেগুলো দেখার লোক আছে। তবে সব হিসাব আসে আমার কাছে। বাজারে অনেক গুলো দোকান রয়েছে। সেগুলোর ভাড়ার টাকাও আসে আমার কাছে। আর জমিদার সাহেবের দুই ছেলে মেয়ে থাকে শহরে । এক ছেলে এক মেয়ে । তাদের টাকা পাঠাতে হয় । সেটার হিসাব আমাকে রাখতে হয় । এই হচ্ছে আমার কাজ ।
দিনের বেশির ভাগ সময়ই আমার কোন কাজ থাকে না। মাসে কয়েকটা দিন কাজ থাকে। আমার জন্য জমিদার বাড়ির শেষ মাথায় একটা ছোট এক তলা বাসা ঠিক করা হয়েছে । এটা খানিকটা গেস্ট রুমের মত । আগে জমিদার বাড়িতে কেউ আসলে তাদের বাসার বাইরে এমন গেস্ট রুমে থাকতে দেওয়া হত । আমাকেও এমন একটা গেস্ট রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে । খাওয়া দাওয়াও আসে জমিদার বাড়ি থেকেও । আমার আসলে তেমন কোন খরচ নেই । এখানে নেট পাওয়া যায় না তেমন । মাঝে মধ্যে আসে আবার চলে যায় । তাই ইন্টারনেট থেকে একটু দূরে রয়েছি । ফোনে অবশ্য কথা বলা যায় । বাসায় মাঝে মাঝে ফোন দিই । বেশির ভাগ সময়ই এখানে ইলেক্ট্রিসিটি থাকে না । তবে আমার সেটা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না । ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে জেনারেটর চালু হয়ে যায় আপনা আপনি । সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত জেনারেটর চলে । আমার ঘরও আলোকিত থাকে । আর বনের পাশে গাছ গাছালি প্রচুর থাকার কারণে এখানে প্রাকৃতিক বাতাস প্রচুর । কৃত্রিম ফ্যান চালাতে হয় না খুব একটা। সারাদিন বই পড়ছি নয়তো লেখালেখি চলছে । মোট কথা সারাদিন আমার সময় বেশ ভাল যাচ্ছে ।
তবে একটা ব্যাপার মনের ভেতরে অস্বস্তি কাজ করছে । কেন জানি মনে হচ্ছে এই বাড়ির ভেতরে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার রয়েছে । কিছু যেন একটা ঠিক নেই । যেদিন প্রথম এই বাসায় আসার জন্য পথ খুজছিলাম, যতজন ভ্যান চালককে বললাম এখানে আসার কথা কেউই ঠিক রাজি হল না । তারা এমন চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো যেন আমি তাদেরকে ভয়ংকর কিছু বলেছি । শেষে আমাকে বেশ কিছুটা পথে হেটে আসতে হয়েছিল । মাঝ পথে জমিদার সাহেবের গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে এসেছে বাড়ি পর্যন্ত । এছাড়া যখন কাজ কর্ম করি, বাইরের কৃষক কিংবা ফল সফলের জন্য যখন বাইরে থেকে লোকজন আসে তখন তাদের চোখে একটা ভয় আমি খেয়াল করি । এটা মোটেই জমিদারের লাঠিয়ালদের ভয় নয় । অন্য কিছুর একটা ভয় । সেই ভয়টা যে কি সেটা আমি প্রথম খোজ পেলাম এখানে মাস দুয়েক কাজ করার পরে ।
সেদিন দিনটা মোটেই ভাল গেল না। আলী ওয়াজেদ সাহেবের কিছু জমি বেদখল হয়ে গেছে । বেদখল বলতে আমার যা মনে হল ওয়াজেদ আলীই আগে এই জমি দখল করেছিল । যার জমি দখল করেছিল তার ছেলে এখন বিসিএস দিয়ে পুলিশের এএসপি হয়েছে । তাই তার হাতে ক্ষমতা এসেছে । সে নিজে পুলিশ নিয়ে এসে জায়গাটা দখল নিয়ে গেল । ওয়াজেদ আলী কেবল গম্ভীর চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো । জমির পরিমান যে খুব একটা বেশি সেটা না । কিন্তু তার হাত থেকে কেউ সেটা কেড়ে নিলো এটা বুঝি তার সহ্য হবার কথা না । আমি ফিরে আসার সময় বললাম, দলীল আছে তো আমাদের কাছে। একটা কেস করতে হবে । আশা করি আমরা জমি ফেরত পাবো!
আলী ওয়াজেদ আমার দিকে কেমন চোখ গরম করে তাকালো । তারপর মুখ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ওয়াজেদ খানের জমি উদ্ধার করতে পুলিশ !
আরও কিছু বলতে গেল কিছু তবে সেই কথা সে শেষ করলো না । আমি বুঝতে পারলাম তার সম্মানে আঘাত লেগেছে । কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে সে করবে কি? অবশ্য মন্ত্রি এমপিদের সাথে পরিচয় থাকলে আলাদা ব্যাপার । আমি আর কথা বললাম না । কোন কথা বলা ঠিক হবে না ।
রাতে কেন জানি আমার ঘুম এল না । আমি বেশ কিছু সময় এদিক ওদিক করতে লাগলাম কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না । আমি এক সময় ঘর থেকে বের হয়ে এলাম । অন্ধকার রাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছি । তখনই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম । কোন প্রকার শব্দ নেই । এমন টা তো কখনই হয় না । চারিদিকে প্রচুর গাছ গাছালি রয়েছে । তাই নানা প্রকার রাত জাগা পাখি, পোকামাকড় কিংবা ঝিঝি ডাকতেই থাকে সব সময় । কিন্তু আজকে কোন আওয়াজ হচ্ছে না । কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না । এমন নিস্তব্ধতা আমার মোটেই স্বাভাবিক মনে হল না ।
আমি জমদার বাড়ির দিকে তাকালাম । আমার ঘর থেকে জমিদার বাড়ির দুরত্ব দুইশ মিটারের মত । পুরো বাড়িটা উচু পাচিল দেওয়া । মাঝে প্রচুর গাছ পালা রয়েছে । বেশ কিছু আলো জ্বলছে পুরো বাড়ি জুড়ে । আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকে কিছু বোঝার চেষ্টা করলাম । বুঝতে চেষ্টা করলাম যে কি এমন অস্বাভাবিক ব্যাপার রয়েছে এখানে ! আজকে কেন এতো বেশি অস্বাভাবিক লাগছে সব কিছু !
ঠিক সেই সময় বিদ্যুৎ চলে গেল । পুরো বাড়ি একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল । আমি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম । এখনই জেনারেটর চালু হয়ে যাওয়ার কথা । কিন্তু হল না । মিনিট পাঁচ পার হয়ে গেল । আমি অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে রইলাম । বুঝতে পারছি কোন কারনে জেনারেটর চালু হবে না । আমি ঘরের ভেরতে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে যাবো তখনই একটা দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেলাম । চারিদিকে এতো নিস্তব্ধতা যে সামান্য আওয়াজই কানে এসে লাগছে । কিছু সময় নিস্তব্ধতা তারপর থপথপ চলা আওয়াজ । কেউ যেন হাটছে । মাটিতে তার ভারী পায়ের আওয়াজ হচ্ছে । তবে আওয়াজটা জমিদার বাড়ির মুল বাড়ি থেকে আসছে না । আমার কাছে মনে হল যেন আওয়াজটা আসছে বাড়ির ওদিক থেকে । আমি জানি জমিদার বাড়ির ওপাশে আরও একটা বাড়ি আছে । আগের বাড়ি । ওটা এখন ভাঙ্গা । কেউ থাকে না । আগে সেটাই মুল বাড়ি ছিল ।
আমার সেদিকে যাওয়ার কোন কারণ নেই । কিন্তু মনের ভেতরে একটা অদম্য কৌতুহল জেগে উঠলো । মনে হল আমার এখনই এই ব্যাপারটা দেখা দরকার । কে এত রাতে এতো শব্দ করে হাটছে । আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম । এতো সময় অন্ধকারে থাকার কারণে আমার চোখে অন্ধকার কিছুটা সয়ে গেছে । আমি ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম । মূল বাড়িটা পেরিয়ে গেছি, ওপাশে যাবো ঠিক এমন সময় কেউ আমার কাধে হাত রাখলো । আমি চমকে উঠলাম । আরেকটু হলে চিৎকার দিয়েই ফেলতাম কিন্তু নিজ থেকেই চিৎকারটা আটকালাম । পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ।
লম্বাতে আমার সমানই হবে । পরনে একটা শাড়ি । আমার দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল, ওদিকে যেও না।
আমার মাথায় তখন এই প্রশ্ন এলো না যে এই মেয়েটি কে?
বাসায় মেয়ে বলতে আলী ওয়াজেদ সাহেবের স্ত্রী যাকে আমি কোনদিন দেখি নি । সে ভেতরের মহল থেকে বের হয় না। কাজের লোক আছে বটে তবে এই মেয়েকে কাজের মেয়ে মনে হল না । তাহলে এই মেয়ে কে? আলী ওয়াজেদের এক মেয়ে আছে জানি । সে ঢাকাতে থাকে । এই মেয়েকে কি সেই মেয়ে?
আমি বললাম, কেন? কি সমস্যা?
মেয়েটি হাতের ইশারায় আমাকে বসতে বলল, দেখতে পেলাম সামনেই একটা বড় সিড়ির মত জায়গা রয়েছে । সেখানে লুকানো যাবে । মেয়েটি আমাকে নিয়ে সেখানে লুকিয়ে পড়লো । কেন লুকাতে বলল সেটা আমি টের পেলাম একটু পরেই । যেই থপথপ আওয়াজ হচ্ছিলো সেটা একেবারে কাছে চলে এসেছে । আমার থেকে সামনে এগিয়ে গেল ।
এক টা মানুষ হেটে গেল । তার পায়ের থেকেই আওয়াজটা আসছে । আমি কেবল সেই চলে যাওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । অন্ধকারে তার শরীরের একটা পাশ আমি দেখতে পাচ্ছি । এবং আমার কাছে কেন জানি মনে হল সেটা জ্বলছে । লোকটার ভেতরে অস্বাভাবিক কিছু রয়েছে । ভয়ংকর অস্বাভবিক কিছু । আমি দম বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম । দেখলাম সেই মানুষটা থপথপ করতে করতে বাড়ির প্রধান গেট টার সামনে চলে গেল । তারপর আমাকে তীব্রভাবে বিস্মিত করে দিয়ে এক লাফে গেট টা পার হয়ে ওপাশে চলে গেল !
আমি মুখ হা করে কেবল তাকিয়ে রইলাম !
কি হল এটা ?
(চলবে)
Thank you!!1