দ্যা ডোর অব হেল

4.9
(42)

ছুটির দিন গুলোতে আমি চাই একটু সুখে শান্তিতে কাটাতে। বিশেষ করে সময়টা আমি তৃষার সাথে অতিবাহিত করতে চাই। সারাটা সপ্তাহ তৃষা ব্যস্ত থাকে, আমি নিজেও আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এই একটা দিনই পাই একে অন্যকে একান্ত ভাবে পাওয়ার জন্য কিন্তু সেখানেও বাঁধা। এসব কি সহ্য করা যায়!

আমার মুখ গোমড়া দেখে তৃষা চোখ গরম করলো। বলল, অপু ও আমার ফ্রেন্ড!

আমি বললাম, তো আমি কি করবো? নাচবো! দেখো সপ্তাহে একটা দিন তোমাকে কাছে পাই, একটু আদর ভালোবাসা দিব, একটু আদর পাবো, একান্তে সময় কাটাবো! এর মাঝে অন্য কেউ আসলে কি ভালোলাগে! তাও আবার এই সময়ে!

ঘড়িতে এখন সকাল এগারোটার মত বাজে। এই সময়ে কেউ কারো বাসায় আসে! কিন্তু তৃষার ঐ বন্ধু আসতেছে। কি যেন নাম মেয়েটার আলিয়া সম্ভবত। জুরাইন থাকে। একটু কেমন যেন! তবে মানুষ হিসাবে ভাল। তৃষাকে খুবই ভালোবাসে। প্রতিবারই যখন আসে রাজ্যের জিনিস পত্র নিয়ে আসে তৃষার জন্য। তৃষাকে অবশ্য অনেকেই পছন্দ করে। কিন্তু তৃষা সবাইকে পাত্তা দেয় না। তবে এই যে অল্প কয়েকজনকে পাত্তা দেয় আলিয়া তাদের একজন। তাই আমারও তাকে পাত্তা না দিয়ে উপায় নেই।

এখন আসছে, তার মানে হচ্ছে বিকেল সন্ধ্যার আগে সে যাবে না। আজকের পুরোদিন মাটি। এই দিন এইভাবে নষ্ট করার জন্য আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মেজাজ খারাপের আরও একটা কারন হচ্ছে, এই মেয়ের লিফট ভীতি রয়েছে। সে কিছুতেই লিফটে উঠবে না। এবং তাকে নিচ থেকে আমাকে নিয়ে আসতে হবে। এই ব্যাপার টা মনে আসতেই বিরক্তি আরেকধাপ বেড়ে গেল।

তৃষা আমার বিরক্তির কারন পরিস্কার বুঝতে পারলো। আমার কাছে এসে আমার নাকের সাথে নাক ঘষে বলল, আচ্ছা যাও বাবা আলিয়া চলে যাওয়ার পর কাল সকাল পর্যন্ত তুমি যা বলব তাই শুনবো?

আমি তৃষার দিকে তাকিয়ে খানিকটা দুষ্টামির হাসি দিয়ে বললাম, যা বলবো যা চাইব তাই?

-তুমি এতো দুষ্ট কেন বলত? খালি শয়তানি চিন্তাভাবনা !

আমার মনে আসলে কখন কি চলছে সেটা তৃষার চেয়ে ভাল আর কেউ বুঝে না । সে ঠিক জানে আমি কি চাইতে পারি । এবং সেটা জেনেই আমাকে এই অফার দিয়েছে । তাই এই সুযোগ না নেওয়ার কোন কারণ নেই । আমি বললাম, শুনো এসব কোন দুষ্টামি না । এটা হচ্ছে প্রতিটি স্বামীর একান্তই অধিকার ।

-আহারে আমার অধিকার ওয়ালা স্বামী ।

আলিয়া এসে হাজির হল আধা ঘন্টা পরেই । যথারীতি দেখলাম কয়েকটা বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছে । তৃষাকে আমি নামতে দিলাম না । আলিয়া একদমই লিফটে ওঠে না । আর তৃষার এই ছয় তলায় সিড়ি দিয়ে আমি উঠতে দিতে রাজি নই । আমি ওকে বললাম যে আমিই নিয়ে আসছি ।

নিচে নেমে কয়েকটা বাক্স আমি নিজে নিলাম আর কয়েকটা দিলাম দারোয়ানের হাতে । দারোয়ান একটু মুখ গোমড়া করলেও কিছু বলল না । সে লিফট দিয়ে উপরে চলে গেল । আমি আলিয়াকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম ।

আলিয়া মেয়ে হিসাবে বেশ ভাল । শান্ত ভদ্র । কেবল একটাই সমস্যা যে মেয়েটা মাঝে মাঝে কেমন যেন আচরন করে যেটার কোন ব্যাখ্যা আমি খুজে পাই না । এই লিফটে না ওঠাটাও একটা । আলিয়ার সাথে টুকটাক কথা বলছি আর সিড়ি দিয়ে উপরে ঊঠছি । চার তলাতে উঠতেই আলিয়া সিড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে গেল । ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে তাকিয়ে রয়েছে লিফটের দরজার দিকে । একেবারে যেন ভয়ে জমে গেছে । আমি কয়েকবার ওর নাম ধরে ডাক দিলাম । কিন্তু আমার ডাক যেন ওর কানেই গেল না । কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । তখনই দেখলাম পাঁচ তলার গোড়াতে তৃষার মুখ দেখা যাচ্ছে । আমার ডাক শুনতে পেয়েছে সম্ভবত । সে দ্রুত নেমে এল । তারপর আলিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। আলিয়াও তৃষাকে জড়িয়ে ধরলো । তৃষা বলল, ভয় পেয়েছিস?

-হুম ।

-এই তো আমি । ভয়ের কোন কারণ নেই । চল ।

আমি কিছু বলতে পারলাম না । কারণ আলিয়ার চেহারা দেখে আমার সত্যিই মনে হল যে ও আসলেই ভয় পেয়েছে । কী এমন দেখে মেয়েটা ভয় পেল? আমি কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম লিফটের দিকে । ভয় পাওয়ার মত কিছুই তো পেলাম না । রাতের অন্ধকার হলেও তো একটা কথা ছিল । কিন্তু এখন তো দিনের আলো । চারিদিক একেবারে আলোতে ভর্তি !

আমি আবার হাটা দিলাম । ঘরে পৌছে দেখি তৃষা আলিয়াকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে । আরও কিছু সময় লাগলো আলিয়ার স্বাভাবিক হতে ।

দুপুরের খাবারের পরে বিকাল গড়িয়ে গেল । সময়টা যতটা খারাপ যাবে ভেবেছিলাম ততটা গেল না । আলিয়া স্বাভাবিক হওয়ার পরে নিজেই সব কাজ করতে শুরু করলো । নিজেই রান্ন চড়িয়ে দিল । তৃষা আর আমিও সাহায্য করছিলাম । বিকেলে বেলা আমরা তিনজন বসলাম বারান্দায় । টুকটাক গল্প করতে লাগলাম । হাতে কফির পেয়ালা নিয়ে গল্প করতে করতে আমি প্রশ্নটা করেই ফেললাম । যদিও আমি জানি যে তৃষা আমাকে এর জন্য পরে বকবে । আমি আলিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কি দেখে ভয় পেলে?

দেখলাম তৃষা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকালো । আমি জলদি বললাম, যদি সমস্যা থাকে তাহলে বলতে হবে না । এমনি কৌতুহল জাগলো তাই বললাম আর কি?

আলিয়া কিছু সময় আমার দিকে তার পর তৃষার দিকে তাকালো । তারপর বললে কি তোরা বিশ্বাস করবি?

তৃষা বলল, বলতে হবে না । ওর কথা বাদ দে ।

-না মানে বলি আজকে? শুনবি? তবে বিশ্বাস করবি কিনা জানি না ।

তৃষা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি বললাম, কোন চিন্তা নেই। ভয়ের কথা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলে ভয় কমবে । হয়তো আমরা কোন ব্যাখ্যাও দিতে পারবো!

আলিয়া আবার তৃষার দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে । কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে আলিয়া বলতে শুরু করল, ব্যাপারটা আমার সাথে প্রথম যেদিন ঘটলো তখন ক্লাস এইটে পড়ি । আমরা তখন আজিম্পুরে থাকি। এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে । স্কুল শেষে আমাদের আলাদা কোচিং হত স্কুল থেকে । বৃত্তি পরীক্ষার জন্য । আমার বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত । সেদিনও হয়েছিল । সেই সাথে বর্ষা কাল ছিল । একটু একটু বৃষ্টি পড়ছিল । আমি যখন বাসায় এসে পৌছালাম তখন অন্ধকার হয়েছে । আমার কাছে সব কিছু স্বাভাবিকই মনে হল । প্রতিদিনই এমন সময়ই আমি বাসায় আসি । অস্বাভাবিকতার কোন কারণ নেই ।

আমি লিফট তেকে কয়েক গজ দূরে এসেছি তখনই ঘটলো ঘটনা টা । আমার কাছে মনে হল যেন পুরো জায়গাটা যেন হঠাত করেই অন্ধকার হয়ে গেল । একেবারে অন্ধকার । তারপর দেখি সেই অন্ধকারের ভেতরে কেমন একটা আলো দেখা যাচ্ছে । আলোর আভা । আলো গুলো নড়ছে । একটু পরে ভাল করে তাকিয়ে বুঝলাম যে আসলে আলো গুলো একেকটা মানুষ কিংবা মানুষের মত কিছু একটা । তাদের শরীর থেকে সেই আলোর আভা বের হচ্ছে । তাদের পরোনে কালো আলখাল্লার মত পোশাক । সেই পোশাকের চারিদিক থেকে আলো বের হয়ে আসছে । তবে মুখের দিকটা অন্ধকার । একজন না, বেশ কয়েকজন । কতজন আমি গুনতে পারলাম না । আমি মুখ দিয়ে কোন চিৎকার করতে পারলাম না । আমি যেন একেবারে জমে গিয়েছি । দেখলাম সেই মানুষের মত আয়বয় গুলো একজন মানুষকে ধরে নিয়ে আসছে। মানুষটাকে একেবারে লিফটের দরজার সামনে এসে রাখলো । লোকটার হাত পেছন দিক দিয়ে বাধা । লোকটার এক পাশ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম এবং একটু পরেই তাকে আমি চিনতে পারলাম । ইনি আমাদের আমাদের স্কুলের আগের হেড মাস্টার । এই হেড মাস্টার কে কয়েক মাস আগেই স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু দুর্নীতির কারণে । দেখলাম সে আমার দিকে কেমন করুণ চোখে তাকালো ।

আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । আমি তখনও যেন আগের মতই জমে গেছি । তীব্র একটা ভয় কাজ করছে আমার মনের ভেতরে । কিন্তু আমি সামনের ঐ মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । আমার মনে হল যেন ভয়ানক কোন বিপদে পড়েছে । এই মানুষের মত দেখতে আলখাল্লা পরা আয়বয় গুলো হেড স্যারকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে যেন । কিন্তু এখানে কেন? কিভাবে হচ্ছে এসব !

তারপরই ঘটলো সেই ভয়ের ঘটনা । আমি দেখলাম লিফটের দরজাটা খুলে গেল । আমি দূর থেকেই দেখতে পেলাম যে হেডমাস্টারের মুখে একটা লাল আভা দেখা যাচ্ছে । অর্থ্যাৎ লিফটের ভেতরটাতে যেন আগুন জ্বলছে । সেই আগুনের আভা এসে লাগছে হেড স্যারের মুখে । আমি হেডস্যারের চিৎকার শুনতে পেলাম । সে উঠে পালিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না । সেই আলখাল্লা পরা মানুষ গুলো ওকে ধরে সেই লিফটের ভেতরে নিয়ে গেল । আমি দেখলাম আস্তে আস্তে সব গুলো আয়বয় সেই লিফটের ভেতরে ঢুকে গেল । তারপর লিফটা বন্ধ হয়ে গেল ।

আমি তো মনযোগ দিয়ে শুনছিলামই, দেখলাম তৃষাও মন দিয়ে শুনছিল । তৃষাই বলল, তারপর? আলিয়া বলল, তারপর? আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল । আমি তবুও স্বাভাবিক হলাম না । আমি কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলাম লিফটের দিকে । তাকিয়ে দেখি লিফট একেবারে স্বাভাবিক । তবে…

-তবে?

-তবে আমি যেন কারো চিৎকার শুনতে পাচ্ছি । তীব্র এক চিৎকার । আর্তনাদ !

আমার কেন জানি মনে হল গল্প এখানেই শেষ না । আলিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, আরও কিছু বাকি আছে ! তাই না?

আলিয়া বলল, হুম। আছে। ঐ ঘটনার দুইদিন পরে আমাদের সেই হেড স্যার মারা যায় ।

তৃষা বলল, মারা যায়?

-হুম।

আমি বললাম, এরপর কত জনকে এভাবে দেখেছো?

আলিয়া একটা বড় দম নিয়ে বলল, হিসাব নেই । প্রায়ই দেখি কাউকে না কাউকে একই ভাবে লিফটের ঐ দরজার সামনে এনে ফেলা হচ্ছে এবং কিছু সময় পরে দরজা খুলে যাচ্ছে । মানুষটা চিৎকার করে পালাতে চেষ্টা করছে ।

-সবাই কি পরিচিত ?

-নাহ । অনেক অচেনা লোককেও দেখি । তবে একটা ব্যাপার খুব পরিস্কার । আমি যাদের দেখি তারা সবাই খারাপ মানুষ । ভাল মানুষ না। আমার মনে হয় যে আমি কেবল পাপীদের দেখি এবং ঐ লোক গুলো পাপীদের দোজখে নিয়ে যায় । লিফটের ঐ দরজাটা হচ্ছে ডোর অব হেল । আমি সেই দরজা দেখি । এমনটা ভাবার কারণ হচ্ছে আমি লিফটের কাছে গেলেই যেন আমি সেঈ মানুষদের চিৎকার শুনি । মনে হয় যেন খুব শাস্তি পাচ্ছে তারা ।

আমি বললাম, একটু আগেও কি দেখলে?

-হুম।

-কেমন দেখতে লোকটা?

আলিয়া একটু ভাবলো । তারপর বলল, বয়স বেশি না । তোমার মত হবে । বেশ লম্বা মনে হ্ল । চুল নেই বললেই চলে । মাথাটা যেন টাক হয়ে গেছে ।

আমি চিনতে পারলাম । চার তলার বাসিন্দার ছেলে । রাফফান নাম । ছেলেটাকে চিনি । এলাকাতে বেশ পরিচিত মুখ সে । এবং মরলে সে যে হেলেই যাবে সেই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই । এমন খারাপ কাজ নেই যে এই ছেলে করে না ।

আলিয়া আরও সময় থেকে চলে গেল । রাতে ঘুমানোর সময় তৃষা বলল, তোমার কি মনে হয় আলিয়া যা বলল তেমন কিছু হবে?

-কি জানি । হতেও পারে আবার নাও পারে । তবে আলিয়া যে ভয় পেয়েছে এটা সত্যি । ঐ সময়ে আমি ওর চোখে সত্যি ভয় দেখতে পেয়েছি। চোখের ভুল হলেও ও যে সত্যি সেটা দেখেছে সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই ।

পরিশিষ্টঃ

তিন দিনের মাথায় রাফসানের মৃত্যুর খবর পেলাম । কারা জানি ওকে গুলি করে মেরে ফেলেছে । পাড়ায় রাস্তায় তার লাশ পড়ে ছিল । তার মানে আলিয়া যে দেখেছিল সেটা কোন ভাবেই মিথ্যা না । আসন্ন মৃত্যু দুতকে আলিয়া আগে থেকেই দেখতে পায় । কিভাবে?

কোন কি ব্যাখ্যা আছে?

কোন ব্যাখ্যা নেই । এই জগতে কত কিছুই না হয় !

গল্পটার উৎস এই ছবিটি

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 42

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →