এক আনন্দময় অনুভূতি

4.7
(63)

গাড়ি থেকে সবাই নামতেই মীরা বলল, তোমরা ভেতরে ঢোক আমি আসছি।
শিহাব রিমন আর নিলা আর কিছু জানতে চাইলো না । কারণ মীরাকে তারা খুব ভাল করেই চেনে । মীরা একবার যা বলবে সেটা সে করবেই । তাই ওরা আর দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন করলো না । মীরা গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই রওয়ানা দিল । মীরার মনে তখন অন্য চিন্তা কাজ করছে । একবার ভাবলো ও যাকে দেখেছে হয়তো সেটা চোখের ভুল ছিল । এই শীতের ভেতরে রবিকে ওখানে দেখার কোন কারণ নেই । সে হয়তো এখন আরাম করে ঘুমাচ্ছে ।

মীরা রাতের বেলা খুব একটা বের হয় না । সারা দিন অফিসে কাজ করে রাতের বেলা বের হওয়ার মত শক্তি থাকে না । তবে দিনটা বৃহস্পতিবার কিংবা শুক্রবার হলে আর পরিচিত বন্ধুবান্ধব রা যদি এক সাথে হয় তাহলে ঠিকই বের হয় । ঢাকা শহরে অনেক রেস্টুরেন্ট আছে যেগুলো সারা রাত খোলা থাকে । রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা গল্প আর খাওয়া দাওয়া চলে মাঝে মাঝে । আজও সেই পরিকল্পনা মতই বের হচ্ছিলো । আজকে ওদের লক্ষ্য ছিল পুরান ঢাকার বিখ্যাত আল সাহারা হোটেল । এখানকার বিরিয়ানী পুরো ঢাকাতেই বিখ্যাত । আর এটা সারারাত খোলা থাকে । এর আগেও ওরা এই হোটেলে এসেছে । হোটেলের সামনে একটা চায়ের দোকান আছে। এখানকার চা টাও বেশ চমৎকার । সব মিলিয়ে বন্ধুদের সাথে চমৎকার সময় কাটে । আজও তেমন একটা সময় কাটানোর জন্যই মীরা আসছিলো । সাথে আর তিন বন্ধু ছিল । রাত বারোটার কিছু বেশি বাজে । রাস্তা ঘাট ফাঁকা । দ্রুত চলছে গাড়ি । ঠিক এমন সময়ই মানুষটাকে দেখতে পেল সে । একটা ভ্যান গাড়ি যাচ্ছে । ভ্যানের সামনেই বসে রয়েছে সে । ভ্যান চালকের সাথে কথা বলছে । চেহারা সে পরিস্কার দেখেছে । তাই মনের ভেতরে প্রশ্নটা জাগলো ওর ! রবি এখানে এই রাতের বেলা কি করছে?

ভ্যানটা খুজে পেতে মীরার খুব বেশি সময় লাগলো না । গাড়ি থেকেই দেখতে পেল ভ্যানটা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে থামছে । তখন রবি ভ্যান থেকে কিছু নিয়ে সামনের ফুটপাথের লোকজনকে কিছু দিচ্ছে । আবারও ভ্যান চলতে শুরু করছে । মীরা প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না । চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে । গাড়ির আলো আগে থেকেই নিভিয়ে দিয়েছে যাতে ওরা ওকে দেখতে না পারে । আরও কিছু সময় রবিদের পেছনে চলার পরপরই সে বুঝতে পারলো রবি আসলে কি করছে ! ভ্যানের উপরে খাবারের প্যাকেট রয়েছে । বরি রাতে রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা এই মানুষ গুলোতে সেই খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিচ্ছে । ব্যাপারটা ধরতে পেরেই মীরা হঠাৎ কেমন একটা অনুভূতি হল । সে বুঝাতে পারবে না । নিজের কাছে একটা লজ্জাবোধ জন্ম নিল । আর দেরি করলো না সে । গাড়িটা ঘুরিয়ে আবারও হোটেলের দিকে রওয়ানা দিল ।

পুরো সময়টা জুড়ে মীরা বন্ধুদের সাথে থাকলেও ওর মনযোগ রইলো রবির দিকে । ঘুরে ঘুরে সেই রবির কথাই মনে হচ্ছে আর যতবার এই কথা মনে হচ্ছে ততবারই যেন নিজেকে খানিকটা ছোট মনে হচ্ছে ওর সামনে ।

রবিউল হাসান রবি নামের ছেলেটা মীরার সাথেই চাকরি করে । একই অফিসে । মেটইন ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি । দেশের দশটা ভাল কোম্পানীর ভেতরে একটা । এখানকার স্যালারী রেঞ্জ খুবই ভাল । এখানে যারা কাজ করে তারাও আচার আচরন, পোশাক আশাকে সব সময় সেরা । সব থেকে সেরাদেরই স্থান হয় এখানে । কিন্তু রবি যেন এদের ভেতরে একেবারে বেমানান । বলতে গেলে অফিসের কেউ ওকে ঠিক পছন্দ করে না । কারণ ও অন্য সবার সাথে মিশতে পারে না । কেউ মিশতে চায় না । বরি পোশাক পরিচ্ছদ সাধারন মানের । যেখানে অফিসের অন্য সবাই ব্যন্ডেড পোশাক ছাড়া কিছু পরেই না সেখানে রবি নিউমার্কেটের সামনের দোকান থেকে জামা কাপড় কেনে । পায়ের দামী সুজ নেই । হাতে ভাল ব্যন্ডের মোবাইল নেই । কিছুই নেই । সবাই ভাবে এতো টাকা বেতন পায়, টাকা গুলো কি করে ! কিপটামী করে কেন ! তবে কাজ কর্মে বরি বেশ ভাল এবং দক্ষ । অফিসের বস তাকে পছন্দ করে । আর রবি এতোদিনে বুঝে গেছে যে অন্য সবার সাথে তার খাব খাবে না । তাই সেও খুব একটা দরকার ছাড়া মিশে না । অফিসের কাজ কর্ম ছাড়া অন্য কারো সাথে তার ঠিক কথাও হয় না । রবিকে নিয়ে হাসিঠোট্টা চলতে থাকে অফিসে এবং সবার ভেতরে সব চেয়ে বেশি হাসি ঠোট্টা করে মীরা নিজে । কিন্তু আজকে এই দৃশ্যটা দেখে মীরা অন্য কিছু ভাবতে পারছে না ।

দুই
সামনে মানুষ গুলোর দিকে তাকিয়ে রবি ভ্যান চালক সালামের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে তো খাবার কম পড়বে !
-জি ভাইজান । আমারও তাই মনে হইতাছে । এরা খবর পাইয়া গেছে যে আপনি এদের রাতের বেলা খাবার দেন । তাই দেখেন না প্রতিদিন লোক বইসা থাকে ।
রবি বলল, সেইটা না হয় বুঝলাম কিন্তু আজকে কি করবো? আবুলকে বলবো খাবার চড়াতে !
-ভাইজান আজকে দেরি হইয়া যাইবে । কাল থেকে বেশি করে আনলেই হবে । আজকে আর কি করবেন?
-কিন্তু আশা নিয়ে এসেছে । খালি হাতে চলে যাবে !

রবি আস্তে খাবারের প্যাকেট গুলো একজনের কাছে এগিয়ে দিচ্ছে আর সামনের দিকে তাকাচ্ছে । কালকেই একেবারে টাই টাই হয়েছিলো । আজকে একবার মনেও হয়েছিলো যে কয়েক কেজি চাল বেশি রান্না করে । সেটা করলেই বরং ভাল হত ।
শেষ প্যাকেট টা দেওয়ার পরেও দেখলো আরও গোটা বিশেষ মানুষ দাড়িয়ে রয়েছ । তার ভেতরে আবার দুইটা বাচ্চাও রয়েছে । এই রাতের বেলাতেও ওরা খাবারের আশাতে বসে রয়েছে ! মনটাই খারাপ হয়ে গেল রবির । এখন ও কি করবে ? রবি খুব ভাল করে জানে রাতে ক্ষুধা পেটে ঘুমানোর কি যন্ত্রনা । কত দিন সে রাতে কেবল পানি খেয়ে ঘুমিয়েছে ।
এদের এখানে দাড় করিয়ে কি কোন হোটেলের কাছে যাবে?
খুজে দেখবে খাবার পাওয়া যায় কিনা !
তাই করতে হবে । নয়তো বরি জানে এদের এভাবে রেখে চলে গেলে রাতে ওর ঘুম আসবে না । শান্তি লাগবে না । বরি যখনই বলতে যাবে ওরা একটু অপেক্ষা করুক এখানে রবি খাবার নিয়ে আসছে তখনই দেখতে পেল একটা গাড়ি এগিয়ে আসতে ওদের দিকে । একেবারে ওদের সামনে এসে থামলো । গাড়ি থেকে যে মানুষটা বের হল সেই মানুষটাকে দেখে রবি আসলেই চমকে গেল । এই মানুষটাকে এখানে সে কোন ভাবেই আশা করে নি ।
মীরা গাড়ি থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে নেমে এল । তারপর রবির দিকে তাকিয়ে বলল, এদিকে এসো তো একটু ।
বলে নিজের গাড়ির পেছন দিকে চলে গেল । রবি কনফিউজ মন নিয়ে মীরার পেছন পেছন গিয়ে হাজির হল । মীরা ততক্ষনে গাড়ির ডিক্কি খুলে ফেলেছে । সেটার দিকে তাকিয়ে রবি অবাক হয়ে গেল । সেই সাথে একটা আনন্দের অনুভূতি খেলা করলো মনে । সাথে সাথে সালামকে ডাক দিল।
মীরার গাড়ির ডিক্কির ভেতরে কম করেও ৫০ প্যাকেট খাবার । সালাম আর রবি মিলে খাবার গুলো হাতে নিয়ে সামনে দাড়ালো মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে লাগলো । আরও বেশ কিছু খাবার ছিল । সেগুলো সামনে গিয়ে আরও কয়েকজনের মাঝে দিয়ে দেওয়া হল । সব কাজ কর্ম শেষ করতে করতে প্রায় রাত দুইটা বেজে গেল ।
সালাম হাসি মুখে বলল, দেখলেন ভাইজান, রিজিক বইলা একটা ব্যাপার আছে ! এই এতো গুলো লোক । এগো রিজিক লেখাই ছিল এইখানে !
রবি হাসলো । এই সত্যিই টা সে ভাল করেই জানে । রিজিক আসলেই বড় একটা ব্যাপার । কার রিজিক কখন কিভাবে লেখা আছে সেটা বুঝি কেউ কোন দিন নিশ্চিত করে বলতে পারে না । এই আজকের কথাই ধরা যাক । ঐ মানুষ গুলো দেখতে পাচ্ছিলো খাবার শেষ হয়ে গেছে । রাতে তাদের বুঝি না খেয়েই ঘুমাতে হবে । কিন্তু কোথা থেকে মীরা এসে হাজির হল । রবি অন্তত কোন দিন আশা করে নি মীরা এই সময়ে এইখানে হাজির হতে পারে !

ফুট পাঠের পাশেই বসে রইলো ওরা । একটু পরে সালাম ভ্যান নিয়ে চলে গেলেও রবিকে যেতে দিলো না মীরা । বলল, সে ওকে পৌছে দিবে । আরও বেশ কিছু সময় বসেই রইলো । তারপর মীরাকে রবি বলল, তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না ।
-কেন ? কিসের জন্য?
-এই যে আজকে এভাবে এসে হাজির হল খাবার গুলো নিয়ে । নয়তো মানুষ গুলো না খেয়ে ঘুমাতো আজ রাতে ।
-তুমি প্রতি রাতে এভাবে আসো?
-হ্যা ।
-তো বেতনের টাকা পয়সা সব এখানে শেষ হয় ?

রবি হাসলো । বলল, আসলে আমিও এই রকম ভাবে বড় হয়েছি তো আমি এদের কষ্ট খুব ভাল করে জানি । কত রাত আমি কেবল পানি খেয়ে ঘুমিয়েছে সেটা আমার থেকে ভাল কেউ জানে না । তাই চেষ্টা করি যাতে কিছু মানুষ যেন আমার কারণে খেয়ে ঘুমায় ।
মীরা অনেক টা সময় চুপ করে বসে রইলো ওর পাশে । তারপর বলল, আমি আসলে তোমার অপরাধি?
-কেন?
-তুমি জানো কেন ! আসলে আমি অনেক কিছু না জেনেই তোমাকে নিয়ে হাসি ঠোট্টা করেছি কিন্তু এখন যখন জানতে পারলাম আসল কথাটা তখন নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে । তুমি কি চমৎকার একটা কাজ করছো আর আমি !
-আরে বাদ দাও ! এসব চিন্তা করে লাভ নেই । যা হয়েছে হয়েছে । আজকে তুমি না আসলে কি যে হত ! এই জন্য তোমাকে অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য !
-আচ্ছা শুনো !
-হুম ।
-আমি কি রাতে এরপর থেকে আমি কি আসতে পারি তোমার সাথে? একটু আগে যখন আমি খাবার গুলো দিচ্ছিলাম ঐ লোকগুলোর চোখে মুখে কি একটা আনন্দের আভা দেখতে পাচ্ছিলাম সেটা সত্যিই প্রাইসলেস অনুভূতি ছিল । আমি কত কিছু করেছি আনন্দের জন্য কত পার্টি কত কিছু কিন্তু এমন আনন্দ যেন আমি পাই নি কোন দিন । কী এক আনন্দময় অনুভূতি।

রবি এই ব্যাপারটা খুব ভাল করেই জানে । মানুষকে এক বেলা খাওয়ার মত আনন্দের কাজ আর কিছু হতে পারে না ।

রবি আর মীরার মাঝে এরপর কিছু হয়েছিলো কি না সেটা অন্য কোন গল্প ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 63

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →