গাড়ি থেকে সবাই নামতেই মীরা বলল, তোমরা ভেতরে ঢোক আমি আসছি।
শিহাব রিমন আর নিলা আর কিছু জানতে চাইলো না । কারণ মীরাকে তারা খুব ভাল করেই চেনে । মীরা একবার যা বলবে সেটা সে করবেই । তাই ওরা আর দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন করলো না । মীরা গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই রওয়ানা দিল । মীরার মনে তখন অন্য চিন্তা কাজ করছে । একবার ভাবলো ও যাকে দেখেছে হয়তো সেটা চোখের ভুল ছিল । এই শীতের ভেতরে রবিকে ওখানে দেখার কোন কারণ নেই । সে হয়তো এখন আরাম করে ঘুমাচ্ছে ।
মীরা রাতের বেলা খুব একটা বের হয় না । সারা দিন অফিসে কাজ করে রাতের বেলা বের হওয়ার মত শক্তি থাকে না । তবে দিনটা বৃহস্পতিবার কিংবা শুক্রবার হলে আর পরিচিত বন্ধুবান্ধব রা যদি এক সাথে হয় তাহলে ঠিকই বের হয় । ঢাকা শহরে অনেক রেস্টুরেন্ট আছে যেগুলো সারা রাত খোলা থাকে । রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা গল্প আর খাওয়া দাওয়া চলে মাঝে মাঝে । আজও সেই পরিকল্পনা মতই বের হচ্ছিলো । আজকে ওদের লক্ষ্য ছিল পুরান ঢাকার বিখ্যাত আল সাহারা হোটেল । এখানকার বিরিয়ানী পুরো ঢাকাতেই বিখ্যাত । আর এটা সারারাত খোলা থাকে । এর আগেও ওরা এই হোটেলে এসেছে । হোটেলের সামনে একটা চায়ের দোকান আছে। এখানকার চা টাও বেশ চমৎকার । সব মিলিয়ে বন্ধুদের সাথে চমৎকার সময় কাটে । আজও তেমন একটা সময় কাটানোর জন্যই মীরা আসছিলো । সাথে আর তিন বন্ধু ছিল । রাত বারোটার কিছু বেশি বাজে । রাস্তা ঘাট ফাঁকা । দ্রুত চলছে গাড়ি । ঠিক এমন সময়ই মানুষটাকে দেখতে পেল সে । একটা ভ্যান গাড়ি যাচ্ছে । ভ্যানের সামনেই বসে রয়েছে সে । ভ্যান চালকের সাথে কথা বলছে । চেহারা সে পরিস্কার দেখেছে । তাই মনের ভেতরে প্রশ্নটা জাগলো ওর ! রবি এখানে এই রাতের বেলা কি করছে?
ভ্যানটা খুজে পেতে মীরার খুব বেশি সময় লাগলো না । গাড়ি থেকেই দেখতে পেল ভ্যানটা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে থামছে । তখন রবি ভ্যান থেকে কিছু নিয়ে সামনের ফুটপাথের লোকজনকে কিছু দিচ্ছে । আবারও ভ্যান চলতে শুরু করছে । মীরা প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না । চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে । গাড়ির আলো আগে থেকেই নিভিয়ে দিয়েছে যাতে ওরা ওকে দেখতে না পারে । আরও কিছু সময় রবিদের পেছনে চলার পরপরই সে বুঝতে পারলো রবি আসলে কি করছে ! ভ্যানের উপরে খাবারের প্যাকেট রয়েছে । বরি রাতে রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা এই মানুষ গুলোতে সেই খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিচ্ছে । ব্যাপারটা ধরতে পেরেই মীরা হঠাৎ কেমন একটা অনুভূতি হল । সে বুঝাতে পারবে না । নিজের কাছে একটা লজ্জাবোধ জন্ম নিল । আর দেরি করলো না সে । গাড়িটা ঘুরিয়ে আবারও হোটেলের দিকে রওয়ানা দিল ।
পুরো সময়টা জুড়ে মীরা বন্ধুদের সাথে থাকলেও ওর মনযোগ রইলো রবির দিকে । ঘুরে ঘুরে সেই রবির কথাই মনে হচ্ছে আর যতবার এই কথা মনে হচ্ছে ততবারই যেন নিজেকে খানিকটা ছোট মনে হচ্ছে ওর সামনে ।
রবিউল হাসান রবি নামের ছেলেটা মীরার সাথেই চাকরি করে । একই অফিসে । মেটইন ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি । দেশের দশটা ভাল কোম্পানীর ভেতরে একটা । এখানকার স্যালারী রেঞ্জ খুবই ভাল । এখানে যারা কাজ করে তারাও আচার আচরন, পোশাক আশাকে সব সময় সেরা । সব থেকে সেরাদেরই স্থান হয় এখানে । কিন্তু রবি যেন এদের ভেতরে একেবারে বেমানান । বলতে গেলে অফিসের কেউ ওকে ঠিক পছন্দ করে না । কারণ ও অন্য সবার সাথে মিশতে পারে না । কেউ মিশতে চায় না । বরি পোশাক পরিচ্ছদ সাধারন মানের । যেখানে অফিসের অন্য সবাই ব্যন্ডেড পোশাক ছাড়া কিছু পরেই না সেখানে রবি নিউমার্কেটের সামনের দোকান থেকে জামা কাপড় কেনে । পায়ের দামী সুজ নেই । হাতে ভাল ব্যন্ডের মোবাইল নেই । কিছুই নেই । সবাই ভাবে এতো টাকা বেতন পায়, টাকা গুলো কি করে ! কিপটামী করে কেন ! তবে কাজ কর্মে বরি বেশ ভাল এবং দক্ষ । অফিসের বস তাকে পছন্দ করে । আর রবি এতোদিনে বুঝে গেছে যে অন্য সবার সাথে তার খাব খাবে না । তাই সেও খুব একটা দরকার ছাড়া মিশে না । অফিসের কাজ কর্ম ছাড়া অন্য কারো সাথে তার ঠিক কথাও হয় না । রবিকে নিয়ে হাসিঠোট্টা চলতে থাকে অফিসে এবং সবার ভেতরে সব চেয়ে বেশি হাসি ঠোট্টা করে মীরা নিজে । কিন্তু আজকে এই দৃশ্যটা দেখে মীরা অন্য কিছু ভাবতে পারছে না ।
দুই
সামনে মানুষ গুলোর দিকে তাকিয়ে রবি ভ্যান চালক সালামের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে তো খাবার কম পড়বে !
-জি ভাইজান । আমারও তাই মনে হইতাছে । এরা খবর পাইয়া গেছে যে আপনি এদের রাতের বেলা খাবার দেন । তাই দেখেন না প্রতিদিন লোক বইসা থাকে ।
রবি বলল, সেইটা না হয় বুঝলাম কিন্তু আজকে কি করবো? আবুলকে বলবো খাবার চড়াতে !
-ভাইজান আজকে দেরি হইয়া যাইবে । কাল থেকে বেশি করে আনলেই হবে । আজকে আর কি করবেন?
-কিন্তু আশা নিয়ে এসেছে । খালি হাতে চলে যাবে !
রবি আস্তে খাবারের প্যাকেট গুলো একজনের কাছে এগিয়ে দিচ্ছে আর সামনের দিকে তাকাচ্ছে । কালকেই একেবারে টাই টাই হয়েছিলো । আজকে একবার মনেও হয়েছিলো যে কয়েক কেজি চাল বেশি রান্না করে । সেটা করলেই বরং ভাল হত ।
শেষ প্যাকেট টা দেওয়ার পরেও দেখলো আরও গোটা বিশেষ মানুষ দাড়িয়ে রয়েছ । তার ভেতরে আবার দুইটা বাচ্চাও রয়েছে । এই রাতের বেলাতেও ওরা খাবারের আশাতে বসে রয়েছে ! মনটাই খারাপ হয়ে গেল রবির । এখন ও কি করবে ? রবি খুব ভাল করে জানে রাতে ক্ষুধা পেটে ঘুমানোর কি যন্ত্রনা । কত দিন সে রাতে কেবল পানি খেয়ে ঘুমিয়েছে ।
এদের এখানে দাড় করিয়ে কি কোন হোটেলের কাছে যাবে?
খুজে দেখবে খাবার পাওয়া যায় কিনা !
তাই করতে হবে । নয়তো বরি জানে এদের এভাবে রেখে চলে গেলে রাতে ওর ঘুম আসবে না । শান্তি লাগবে না । বরি যখনই বলতে যাবে ওরা একটু অপেক্ষা করুক এখানে রবি খাবার নিয়ে আসছে তখনই দেখতে পেল একটা গাড়ি এগিয়ে আসতে ওদের দিকে । একেবারে ওদের সামনে এসে থামলো । গাড়ি থেকে যে মানুষটা বের হল সেই মানুষটাকে দেখে রবি আসলেই চমকে গেল । এই মানুষটাকে এখানে সে কোন ভাবেই আশা করে নি ।
মীরা গাড়ি থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে নেমে এল । তারপর রবির দিকে তাকিয়ে বলল, এদিকে এসো তো একটু ।
বলে নিজের গাড়ির পেছন দিকে চলে গেল । রবি কনফিউজ মন নিয়ে মীরার পেছন পেছন গিয়ে হাজির হল । মীরা ততক্ষনে গাড়ির ডিক্কি খুলে ফেলেছে । সেটার দিকে তাকিয়ে রবি অবাক হয়ে গেল । সেই সাথে একটা আনন্দের অনুভূতি খেলা করলো মনে । সাথে সাথে সালামকে ডাক দিল।
মীরার গাড়ির ডিক্কির ভেতরে কম করেও ৫০ প্যাকেট খাবার । সালাম আর রবি মিলে খাবার গুলো হাতে নিয়ে সামনে দাড়ালো মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে লাগলো । আরও বেশ কিছু খাবার ছিল । সেগুলো সামনে গিয়ে আরও কয়েকজনের মাঝে দিয়ে দেওয়া হল । সব কাজ কর্ম শেষ করতে করতে প্রায় রাত দুইটা বেজে গেল ।
সালাম হাসি মুখে বলল, দেখলেন ভাইজান, রিজিক বইলা একটা ব্যাপার আছে ! এই এতো গুলো লোক । এগো রিজিক লেখাই ছিল এইখানে !
রবি হাসলো । এই সত্যিই টা সে ভাল করেই জানে । রিজিক আসলেই বড় একটা ব্যাপার । কার রিজিক কখন কিভাবে লেখা আছে সেটা বুঝি কেউ কোন দিন নিশ্চিত করে বলতে পারে না । এই আজকের কথাই ধরা যাক । ঐ মানুষ গুলো দেখতে পাচ্ছিলো খাবার শেষ হয়ে গেছে । রাতে তাদের বুঝি না খেয়েই ঘুমাতে হবে । কিন্তু কোথা থেকে মীরা এসে হাজির হল । রবি অন্তত কোন দিন আশা করে নি মীরা এই সময়ে এইখানে হাজির হতে পারে !
ফুট পাঠের পাশেই বসে রইলো ওরা । একটু পরে সালাম ভ্যান নিয়ে চলে গেলেও রবিকে যেতে দিলো না মীরা । বলল, সে ওকে পৌছে দিবে । আরও বেশ কিছু সময় বসেই রইলো । তারপর মীরাকে রবি বলল, তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না ।
-কেন ? কিসের জন্য?
-এই যে আজকে এভাবে এসে হাজির হল খাবার গুলো নিয়ে । নয়তো মানুষ গুলো না খেয়ে ঘুমাতো আজ রাতে ।
-তুমি প্রতি রাতে এভাবে আসো?
-হ্যা ।
-তো বেতনের টাকা পয়সা সব এখানে শেষ হয় ?
রবি হাসলো । বলল, আসলে আমিও এই রকম ভাবে বড় হয়েছি তো আমি এদের কষ্ট খুব ভাল করে জানি । কত রাত আমি কেবল পানি খেয়ে ঘুমিয়েছে সেটা আমার থেকে ভাল কেউ জানে না । তাই চেষ্টা করি যাতে কিছু মানুষ যেন আমার কারণে খেয়ে ঘুমায় ।
মীরা অনেক টা সময় চুপ করে বসে রইলো ওর পাশে । তারপর বলল, আমি আসলে তোমার অপরাধি?
-কেন?
-তুমি জানো কেন ! আসলে আমি অনেক কিছু না জেনেই তোমাকে নিয়ে হাসি ঠোট্টা করেছি কিন্তু এখন যখন জানতে পারলাম আসল কথাটা তখন নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে । তুমি কি চমৎকার একটা কাজ করছো আর আমি !
-আরে বাদ দাও ! এসব চিন্তা করে লাভ নেই । যা হয়েছে হয়েছে । আজকে তুমি না আসলে কি যে হত ! এই জন্য তোমাকে অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য !
-আচ্ছা শুনো !
-হুম ।
-আমি কি রাতে এরপর থেকে আমি কি আসতে পারি তোমার সাথে? একটু আগে যখন আমি খাবার গুলো দিচ্ছিলাম ঐ লোকগুলোর চোখে মুখে কি একটা আনন্দের আভা দেখতে পাচ্ছিলাম সেটা সত্যিই প্রাইসলেস অনুভূতি ছিল । আমি কত কিছু করেছি আনন্দের জন্য কত পার্টি কত কিছু কিন্তু এমন আনন্দ যেন আমি পাই নি কোন দিন । কী এক আনন্দময় অনুভূতি।
রবি এই ব্যাপারটা খুব ভাল করেই জানে । মানুষকে এক বেলা খাওয়ার মত আনন্দের কাজ আর কিছু হতে পারে না ।
রবি আর মীরার মাঝে এরপর কিছু হয়েছিলো কি না সেটা অন্য কোন গল্প ।