রাতের নিস্তব্ধ গ্রামের পথ। চারিদিক নিস্তব্ধ । আশে পাশের বনজঙ্গল থেকে নানান রাত জাগা পোকামাকড়ের একটানা ডাক ভেসে আসছে । সেই শব্দ যেন পুরো এলাকায় এক ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করেছে। নাইম আলী তার ভ্যানটা নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। তার মনের ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে, সেটা সে অস্বীকার করবে না। তবে তার পেশায় ভয় পেলে চলে না। রাত বিরাতে গোরস্থানে কবর খোড়াই তার কাজ । আরও ভাল করে বললে সে কবর খুড়ে লাশ চুরি করে। এই লাশ বিক্রির টাকায় তার জীবন চলে । তবে ইদানীং এই কাজে বেশ ঝুকি দেখা দিয়েছে । এখন প্রতিটি গোরস্থানে পাহারার ব্যবস্থা থাকে । মানুষজন এখন সচেতন হয়ে গেছে। তাই আগের মত আর সহজে লাশ চুরির কাজ করা যায় না । নাইম আলী তাই এমন সব গোরস্থানের খোজ করতে থাকে যেখানে পাহারা থাকে না এবং যেগুলো লোকালয় থেকে অনেক দুরে অবস্থিত। আজকে সে এই কারণেই এই নবিনপুর গ্রামে এসেছে। এখানে একটা লাশের খোজ পেয়েছে । লাশের খোজ দেওয়ার জন্য তার কিছু লোকজন থাকে । তারা তাকে লাশের খোজ এনে দেয়। এমন একজনের কাছ থেকে এই লাশের খোজ পেয়েছে সে। নবিন পুরের এই জঙ্গলে একটা লাশ কবর দেওয়া হয়েছে মাস দুয়েক আগে !
মাস দুয়েক আগের লাশ শুনে নাইম আলী একটু দমে গিয়েছিল। তবে বেশ কয়েকদিন হল কোন লাশই সে খুজে পায় নি । সেই হিসাবে একটু পুরানো হলেও সেটা দিয়েই সে কাজ চালাতে হবে । হয়তো টাকা কম পাবে তবে টাকা যে পাবে সেটাই বড় কথা !
প্রায় ঘন্টা খানেক খোজার পরে সে কবরের স্থানটা খুজে পেল । এটা আসলেই কোন গোরস্তান নয় । জঙ্গলের ভেতরে কাউকে কবর দেওয়া হয়েছে । ব্যাপারটা নাইম আলীর ঠিক পছন্দ হল না । কাউকে কেন গোরস্থান ছাড়া অন্য কোথাও কবর দেওয়া হবে? সাধারনত দেখা যায় যে বড় বড় পরিবারের মানুষদের জন্য আলাদা কবরখানা থাকে । তাদের নিজেস্ব বাড়ির আশে পাশে সেই কবরগুলো হয়ে থাকে । কিন্তু একাকী এই জঙ্গলের পাশে একটা করব কেন দেওয়া হবে?
প্রশ্নটা নাইম আলীকে বার বার কুড়ে খেয়ে লাগল । মনের ভেতরে একটা কু ডেকে উঠল । বারবার ওর মনের ভেতরে কেউ যেন ওকে এই জায়গাটা থেকে চলে যাওয়ার জন্য বলতে লাগল । বারবার তার মনে হতে লাগল যে কাজটা সে করতে যাচ্ছে সেটা মোটেই ভাল কিছু না । কাজটা করা তার ঠিক হবে না।
অবশ্য এই কাজ যখন থেকে সে শুরু করেছে তখন থেকেই নানান রকম অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন সে হয়েছে। কবর খোড়ার সময়ে বা লাশ নিয়ে যাওয়ার সময়ে নানান রকম আওয়াজ কানে এসেছে । প্রতিবারই সে পিছনে ফিরে তাকায় নি ।
নাইম আলী কোদাল চালাতে শুরু করল। রাতের নিঃস্তব্ধতা পেরিয়ে একটা থপথপ আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। বিরামহীন ভাবে সে একের পর এক কোদালের আঘাত করে চলেছে মাটিতে। সেই আওয়াজ যেন চারিদিকে এক অপার্থিব শব্দ তুলছে। জঙ্গলে থাকা ইদুর বনবিড়াল কিংবা শেয়ালের দল অনেক আগেই দুরে সরে গেছে । সে কয়েকটা জ্বলতে থাকা চোখ দেখতে পেল । সেগুলো যে শেয়ালের চোখে সেটা সে জানে । এই কাজ শুরুর প্রথম দিকে এই চোখ দেখে সে ভয় পেয়ে যেত। তবে একটা সময়ে সে বুঝতে পেরেছে যে লাশের গন্ধেই শেয়ালগুলো আশে পাশে ঘুরঘুর করে । এদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই ।
শেষ আঘাতে যখন কবরের বাঁশের মাচাটা ফাঁক হয়ে গেল, তখনই চারিদিকে যেন একটা তীব্র বাতাস বয়ে গেল । নাইম আলী তখন খেয়াল করল যে চারিদিকে এতো সময়ে ঝিঝিপোকা ডাকছিল, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে । পুরো এলাকাটা একেবারে নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছে। পরিবেশটা নাইম আলীর কাছে যেন অপরিচিত ঠেকল । এর আগে অন্তত ৩৫/৪০টা লাশ সে চুরি করেছে । এমনটা তার কখনোই মনে হয় নি । আজকে মনে হচ্ছে সত্যিই অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে ।
নাইম আলী তবুও থামল না । বাঁশের চাটাইটা সরাতে ব্যস্ত হয়ে গেল । একটু পরে কবরটার মুখ বের হয়ে যাবে একেবারে ! সেখানেই সে লাশটা খুজে পাবে । তবে সে জানে না যে, সেখানে তার জন্য অন্য কিছু অপেক্ষা করছিল ।
এক
লুবনার ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আকিবের মনটা আপনাআপনি ভাল হয়ে গেল । ওর সারাদিনের ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই দূর হয়ে গেল ! দরজার মুখে সে কিছু সময় দাঁড়িয়ে নিজের বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল । আগে অফিস থেকে ফেরার সময় দরজা খুললেই লুবনাকে দেখতে পেত। ওর দিকে তাকিয়ে থাকত হাসি মুখে । যেন সে জানতোই যে এখনই আকিব দরজা দিয়ে ঢুকবে। তবে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে মেয়েটা সারাদিনই শুয়ে বসে কাটায় । আকিবের মায়ের কঠিন নির্দেশনা যে লুবনা কোন কাজ কর্ম করতে পারবে না । তার সারাদিনের কাজ হবে শুয়ে বসে থাকা আর নিজের যত্ন নেওয়া । এছাড়া আর কোন কাজ তার নেই ।
লুবনা প্রায়ই আকিবের কাছে অনুযোগ করতে বলে যে এভাবে কোন কাজ কর্ম না করে তার সময় কাটতে চায় না । আকিব তখন হাসি মুখে বলে, তুমি হচ্ছ এই বাড়ির বড় বউ । তারপর এইবারই প্রথম তোমার সন্তান হবে । তোমাকে কেউ কাজ করতে দেবে না এখন। এখন শুয়ে বসে নিজের যত্ন নেওয়া ছাড়া তোমার আর কোন কাজ নেই । আমি যখন হয়েছিলাম তখন আমার মায়েরও ঠিক একই ভাবে যত্ন নেওয়া হয়েছিল, আমার দাদীও মাকে কোন কাজ কর্ম করতে দিত না । এটাই এই বাড়ির রীতি।
লুবনা কেবল গোমড়া মুখে তাকিয়ে ছিল আকিবের দিকে । তবে মনে মনে যে খুশিও হয়েছিল আকিব তার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছিল।
আকিব ঘরে ঢুকতে যাবে ঠিক সেই সময়ে বিদ্যুৎ চলে গেল। পুরোঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। কিছু সময় অন্ধকারের ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইল সে । আকিব একটু অবাক না হয়ে পারল না। ওদের এই এলাকাতে বিদ্যুৎ যায় না বললেই চলে । আর তাছাড়া ওদের বাসায় জেনারেটরের ব্যবস্থা রয়েছে। বিদ্যুৎ যাওয়ার এক সেকেন্ডের ভেতরেই সে আপনাআপনি চালু হয়ে যায় । অথচ প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পার হয়ে গেল, অথচ সেটা চালু হল না ! আকিব এবার সত্যিই একটু বিরক্ত হল ।
নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে, ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালতে যাবে তার আগেই আবারও ঘর আলো করে লাইট জ্বলে উঠল। জেনারেটর চালু হয় নি। বিদ্যুৎ চলে এসেছে আবার । এই মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের জন্য বিদ্যুৎ যাওয়ার মানে কী সেটা আকিব বুঝলো না । কিন্তু সেটা নিয়ে আকিব চিন্তা করার ফুসরৎ পেল না। কারণ তার চোখ চলে গিয়েছে ঘরের বিছানার দিকে যেখানে একটু আগেও তার স্ত্রী লুবনা ঘুমিয়ে ছিল । এখন সেই বিছানাটা একেবারে ফাঁকা । আকিব ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না । সে দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার মুখে । তার স্ত্রী কোন ভাবেই দরজা দিয়ে বাইরে যেতে পারবে না, তাকে না টপকে। বিছানার ঠিক পাস দিয়ে বারান্দায় যেতে হয় । বারান্দায় গেলে সেটা আকিব সেটা বুঝতে পারত। দরজার কাছ থেকেই বারান্দাটা পরিস্কার দেখা যায়। একটা বড় জানালা দিয়ে পুরো বারান্দাটাই প্রায় উন্মুক্ত। বিছানার উল্টোদিকে ওয়াশরুম । বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে গেলে আকিব সেটা অনুভব করতে পারত। তাছাড়া এই অল্প সময় এবং অন্ধকারের মধ্যে লুবনার পক্ষে বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে যাওয়া কোন ভাবেই সম্ভব না । দরজা খোলা এবং দরজা বন্ধের একটা আওয়াজ অবশ্যই আকিবের কানে আসত। তা আসে নি। তারপরেও নিজের মনের সন্দেহ দূর করতে আকিব দ্রুত ওয়াশরুমের দরজা খুলে ভেতরে তাকাল । ভেতরটা একেবারে ফাঁকা, কেউ নি । আকিব এবার বারান্দায় গিয়েও হাজির হল । সেখানেও কেউ নেই !
তাহলে?
ও যে লুবনাকে এখানে ঘুমিয়ে থাকতে দেখল !
মেয়েটা গেল কোথায়?
আকিব বিছানায় বসে পড়ল । ওর এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে লুবনা ঘর থেকে গায়েব হয়ে গেছে! মনের ভেতরে একটা তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে। লুবনা কোথায় গেল?
আকিব যখন বিছানা থেকে উঠতে যাবে তখনই অবাক হয়ে দেখল লুবনা দরজার কাছে এসে দাড়িয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, আরে তুমি কখন এলে?
আকিব কিছু সময় বিমুঢ় হয়ে লুবনার দিকে তাকিয়ে রইল । তারপর বলল, তুমি কোথায় ছিল? এখানে না ছিলে?
লুবনার মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। বিশেষ করে আকিবের চেহারায় দুঃচিন্তার ছাপ দেখে সে নিশ্চিত হল কিছু একটা ঘটেছে । সে একটু এগিয়ে এল আকিবের দিকে, তারপর বলল, কী বলছ? আমি এখানে ছিলাম মানে?
আকিব কী বলবে সেটা ঠিক বুঝতে পারল না । কারণ ও যা বলবে সেটা লুবনার মোটেও বিশ্বাস হবে না । যদিও আকিব নিজের চোখেই দেখেছে লুবনা ঘরের বিছানাতে শুয়ে ছিল কিন্তু এক মুহুর্তের ভেতরে সে তো গায়েব হয়ে যেতে পারে না!
আকিব কিছু বলছে না দেখে লুবনা বলল, আমি তো আরিয়ানার ঘরে ছিলাম। দুজন মিলে মুভি দেখছিলাম নেটফ্লিক্সে ! ঘরে এসেছি মোবাইল নিতে !
আকিব বোকার মত বলল, বিদ্যুৎ না গেল?
লুবনা বলল, তোমার কী হয়েছে বলতো ? বোকার মত কী সব বলছ, এই বলছো আমি এখানে ছিলাম আবার বলছ বিদ্যুৎ গিয়েছিল ! এসব কী বলছো ? বিদ্যুৎ আবার গেল কখন ! এই কী হয়েছে তোমার ! কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলছো !
আকিব বিছানা ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেল লুবনার দিকে । তারপর ওকে জড়িয়ে ধরল । আকিবের মনে হচ্ছে যে সামনে কোন বিপদ এগিয়ে আসছে । আকিব জানে যে কী আসছে কিন্তু সে অনুভব করতে পারছে! সে তার অনাগত সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত বোধ করল ।
দুই
পুরান ঢাকার বাড়িটার সামনে যখন আজম কাদরির গাড়িটা থামল তখন তিনি খানিকটা অবাক হলেন । বাড়িটা এমন হবে তা তিনি আশা করেন নি । নিজের সেক্রেটারি জামিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটাই সেই বাড়ি?
-জ্বী স্যার । এটাই সে বাড়ি ।
-এখনই ঢুকতে হবে?
-না স্যার, আরও মিনিট দশেক পরে। আমরা একটু আগে আগে চলে এসেছি।
আজম কাদরি অপেক্ষা করতে পছন্দ করেন না। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আজকে তাকেই কিনা এই পুরানো ভাঙ্গাচোড়া বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে । ব্যাপারটা তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু এটা ছাড়া আপাতত আর কোন উপায় নেই তার হাতে নেই । তিনি বড় রকমের ঝামেলায় পড়েছেন । বিপদটা স্বাভাবিক হলে হয়তো তিনি সেটা সামাল দিতে পারতেন । কিন্তু ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক না, সেটা তিনি এখন বিশ্বাস করেছেন । বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন।
গতকদিন থেকেই তার বাসায় অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে তার বড় ছেলের বউ যখন থেকে অন্তঃসত্তা হয়েছে তখন থেকেই বাড়ির পরিবেশ খানিকটা বদলে গেছে । তার বৃদ্ধ ফুপু কয়েকবার তাকে ডেকে কিছু বলতে চেয়েছেন তবে তিনি অনেক দিন থেকেই ঠিক মত কথা বলতে পারেন না। নানান রোগে শোকে জর্জরিত। হাতের ইশারাতেই কথা বার্তা বলে থাকেন। তিনি আজম সাহেবকে ইশারায় বোঝাতে চেয়েছেন যে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে পরিবারে । ব্যাপারটা প্রথমে আমলে নেন নি। ভেবেছিলেন হয়তো বুড়ো মানুষের প্রলাপ । কিন্তু প্রথম যেদিন তার ছোট মেয়ের সাথে ঘটনাটা ঘটল, সেদিন থেকে ব্যাপারটা একটু গুরুত্বের সাথে নিলেন। তার ছোট মেয়ের আধুনিক এবং শক্ত মনের মেয়ে। এই মেয়েটা সহজে বিচলিত হয় না । একেবারে তার নিজের মত। তার বড় ছেলের থেকেও তার এই ছোট মেয়ে আরিয়ানাকে তিনি বেশি পছন্দ করেন। মেয়েটাকে কেউ সিড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল । ভাগ্যভাল যে কয়েক ধাপ গিয়েই আরিয়ানা সেটা সামলে নিয়েছিল। তবে সে স্পষ্ট দেখেছে সিড়ির মাথায় কালো লম্বা একটা আয়বয় দাঁড়িয়ে রয়েছে । তার ছোট ছেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল তখন ছাদ থেকে তার মাথা লক্ষ্য করে কেউ ফুলের টব ফেলে দিল । একটুর জন্য যে প্রাণে রক্ষা পেল । বড় ছেলের বউ ভয় পেল বেশ কয়েকবার । সে নাকি তার বড় ছেলে আকিবকে তার ঘরে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। অথচ তার ছেলে তখন অফিসে । কী হচ্ছে তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না । তার যুক্তিবাদি মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছিল না । তবে তিনি নিজে এখনও তেমন কিছু দেখেন নি ।
তবে যখন আজম কাদরির ফুপু মারা গেলেন তখন তার অবিশ্বাস করার আর কারণ ছিল না । ডাক্তার বলল তার ফুপু কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে এবং তার হার্টফেইল করেছে। ডাক্তার না বললেও আজম কাদরি নিজেও ব্যাপারটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন ফুপুর চেহারার দিকে তাকিয়ে । তিনি আসলেই কিছু একটা জিনিস দেখে ভয় পেয়েছিল ! কিন্তু সেই কিছু একটা কী?
অশরীরি কিছু? অস্বাভাবিক কিছু? জ্বীন বা ভুত?
স্থানীয় মসজিদের হুজুরকে ডেকে আনা হল । হুজুর ঘরে ঢুকতেই ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকালেন । যেন তিনি কোন কিছুর অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছেন। হুজুর তার ফুপুর ঘরে কিছু সময় একা বসে দোয়া কালাম পড়তে লাগলেন। এমন সময়ে আজম কাদরি ঘরের বাইরে থেকে ধুপ করে কিছু পড়ার আওয়াজ পেলেন । তার পরপরই দেখতে পেলেন যে হুজুর দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে এলেন । তার চেহারাতে একটা ভয়ের ছাপ । আজম কাদরির দিকে তাকিয়ে হুজুর বললেন, জনাব, আপনার বাসায় ভয়ংকর কিছু রয়েছে। এটা আমার দ্বারা সমাধান করা সম্ভব না । আমাকে মাফ করেন ! এই কথা বলে হুজুর দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।
তারপর আরও বেশ কয়েকজন আলেম হুজুরকে ডেকে আনা হল এবং অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যেকেই ভয় পেয়ে বাসা ছেড়ে এক প্রকার পালিয়ে গেল । সবার মুখেই একই কথা যে এই বাসায় ভয়ংকর কিছু রয়েছে। এবং সেটার সমাধান তাদের পক্ষে করা সম্ভব না।
যখন তিনি কোন পথ খুজে পাচ্ছিলেন না তখন আজম কাদরির কাছে এই ঠিকানাটা এসে হাজির হল । তার সেক্রেটারি জামাল জানালো তার এক পরিচিত আত্মীয়ের সাথে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল। এই লোক নাকি সেটার সমাধান করে দিয়েছিল । তবে এই লোক কাউকে ঠিক গোনার ভেতরে ধরে না । টাকা পয়সা কিছুই নেয় না । এমন কি যাকে তাকে সাহায্যও করে না । এবং সে যদি কাউকে তার বাসায় আসতে না বলে তাহলে কেউ নাকি তার বাসা খুজেও পায় না ।
টাকা পয়সা কিছু নেয় না শুনে আজম সাহেব একটু অবাক হলেন । ভুতের ওঝা বলতে যা বোঝায় তারা মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা ছাড়া আর কিছুই চায় না । কিভাবে ভুক্তোভোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতানো যায় সেইটাই তাদের প্রধান চিন্তা থাকে। আর এই লোক কিছুই নেয় না! ব্যাপারটা খানিকটা কৌতুহলদ্বীপ্ত বটে। আজকে সেই লোকের সাথে দেখা করতেই তারা এসেছে এই পুরান ঢাকার গলিতে । তারা বাড়িটার সামনে গাড়িতে করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
-স্যার চলেন । সময় হয়েছে !
আজম কাদরি গাড়ি থেকে নেমে দরজাটার দিকে পা বাড়ালেন । দরজায় কড়া নাড়ার আগেই দেখলেন সেটা একটু যেন ফাঁক হয়ে গেল । মনে হল যেন কেউ ঠিক দরজাটার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল । তার কড়া নাড়ার আগেই দরজাটা খুলে দিল । আজম কাদরি তাকাল জামালের দিকে। জামালও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। তার মুখে একটা ভয়ের ছাপ সে দেখতে পেল। সে যেন বাড়ির ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছে না মোটেও । তবে আজম কাদরিকে সে কিছু বলতেও পারছে না ।
আজম কাদরি বললেন, জামাল তুমি ঢুকতে না চাইলে, গাড়িতে বসতে পার!
-ন-না স্যার ! কোন সমস্যা নেই । আমি আপনার সাথেই আছি !
-তুমি শিওর ?
-জ্বী স্যার !
আজম কাদরি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন । জামাল ঠিক তার পেছনেই । দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখতে পেলেন পুরো ঘরটা অন্ধকার । ঢাকা শহরে বাসা বাড়ির ঘর কখনই পুরোপুরি অন্ধকার হয় না। কিন্তু এই অন্ধকার একেবারে অন্য রকম । চোখের সামনে কী সেটাই তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। অন্ধকারের ভেতরে কিভাবে যাবেন কিংবা কোন দিকে যাবে সেটা বুঝতে পারলেন না । ঠিক এই সময়ে ঘরের আলো জ্বলে উঠল । তারা দুজনেই দেখতে পেলেন ঘরের শেষ মাথায় একজন এসে ঢুকেছে। বয়সে যুবক । ২৫/২৬ এর বেশি হবে না । কালো জিন্স আর কালো শার্ট পরা । মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । ওদের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা বলল, আপনারা এই দিকে আসুন । এই যে বসার ঘর ।
আজম কাদরি ছেলেটার কথা মত আরেকটা ঘরে ঢুকল এবং ঢুকেই খানিকটা অবাক হয়ে গেল । কারণ ঘরটা একেবারে আধুনিক সাজে সজ্জিত। যুবক ওদের সোফাতে বসতে বলে নিজেও বসলো অন্য একটা সোফাতে ।
আজম কাদরি খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বসলেন। তারপর বললেন, আমি আসলে মিস্টার রাফায়েলের সাথে দেখা করতে এসেছি। আমাদের আসার কথা ছিল !
যুবক বলল, আমি জানি মিস্টার আজম কাদরি । আমার নামই রাফায়েল । আপনারা আমার সাথেই দেখা করতে এসেছেন ।
আজম কাদরি একটু অবাক হলেন বটে। কারণ এতো কম বয়সী কাউকে তিনি আশা করেন নি । যুবক তার ছেলের থেকেও কম বয়সী। চেহারায় যেন একটা ছেলেমানুষী ভাব রয়েছে । তবে এই সবের থেকে আলাদা হচ্ছে যুবকের চোখ । কারো চোখ যে এতো তীক্ষ্ণ হতে পারে আজম কাদরি এই রাফায়েল নামের মানুষটাকে না দেখলে বুঝতে পারতেন না । এই চোখের কারণেই আজম কাদরির মনে হল তারা সম্ভবত সঠিক মানুষের কাছে এসেছে !
আজম কাদরি কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফায়েল বলল, দেখুন আপনাদের সাথে যা হচ্ছে তা আপনাআপনি হতে পারে না।
-আপনি জানেন কী হচ্ছে?
-এখনও পুরোপুরি জানি না। তবে কিছুটা জানি। আমাদের পৃথিবী এবং অশরীরিদের পৃথিবী আলাদা । আমাদের ডাইমেনশন আলাদা । ওরা নিজ থেকে এই পৃথিবীতে আসতে পারে না যত সময় না আমাদের এই পৃথিবীর কেউ তাদের এখানে ডেকে নিয়ে না আসে। মাঝে মাঝে মানুষ আর ওদের চলাফেলার রাস্তা ইন্টারক্রস করে । তখন আমাদের সাথে ওদের দেখা হয়। তবে ওরা কখনই মানুষদেরকে এমনি এমনি ক্ষতি করে না। আপনাদের সাথে যা হচ্ছে তার একটাই অর্থ হচ্ছে কেউ আপনাদের জন্য বিশেষ ভাবে ওকে বা ওদেরকে ডেকে নিয়ে এসেছে ।
-কিন্তু কে এমন করে ক্ষতি করবে ? আমি তো কারো ক্ষতি করি নি।
-আপনি ব্যবসায়ী ! আপনার শত্রু অভাব থাকার কথা না । এছাড়া এসব অনেক সময় নিজের কাছের আত্মীয়রাও করে থাকে।
-কিন্তু আমার তো কাছের কোন আত্মীয় নেই । আমি আমার বাবার একমাত্র ছেলে । দাদার দুই সন্তান। বাবা আর ফুপু। ফুপু এতোদিন আমাদের সাথেই ছিলেন। সম্প্রতি মারা গেছেন । ফুপু আজীবন অবিবাহিত ছিলেন। আমার দাদাও ছিলেন একমাত্র সন্তান। এছাড়া আমার মায়ের দিককার কোন আত্মীয় আছে বলে আমার জানা নেই । আসলে আমার মাও বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন । সেই হিসাবে আমার মামা খালা বলতেও কেউ ছিল না ।
আজম সাহেব দেখলেন রাফায়েল যেন একটু চিন্তিত চোখে কী যেন ভাবছে। তারপর বলল, ওকে, আমি কালপরশু আপনাদের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করব । সেখানে গিয়ে হয়তো কিছুটা আঁচ করা যাবে । আজকে আপনারা আসুন । আর ঐ কালো ব্যাগটা নিয়ে যান।
আজম কাদরি দেখতে পেলেন সোফার ঠিক পাশে কালো রংয়ের একটা কাপড়ের ব্যাগ রাখা আছে ।
-এই ব্যাগের ফলগুলো আপনার পরিবারের সবার কাছে একটা করে দিবেন । বিশেষ করে আপনার বড় ছেলের বউ যেন কোন ভাবেই এই ফল হাত ছাড়া না করে ! এটা যত সময় আপনাদের কাছে থাকবে তত কোন অশরীরি আপনাদের কাছে আসবে না । বুঝতে পেরেছেন ?
রাফায়েল এবার ওদের আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল । কিছু সময় আজম কাদরি বোকার মত বসে রইলেন। তারপর এক সময় উঠে দাড়ালেন । জামাল ব্যাগটা তুলে নিল নিজের হাতে।
তিন
রাফায়েল ঘরের চারদিকে একবার ঘুরে দেখল। সব কিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে । যেকোন ক্রাইমসিনে যেমন খুনী তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ফেলে যায় ঠিক তেমনি ভাবে যখন খুনটা অশরীরি কেউ করে, তখনো সে নিজের কোন না ছাপ রেখে যায় । রাফায়েল আজম কাদরির ফুপুর ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই ঘরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। আরও ভাল করে বললে এখানে তাকে কোন অশরীরি হত্যা করেছিল। রাফায়েল সেই ব্যাপারটাই বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। কে আর কেনই বা একজন বৃদ্ধকে কেউ মেরে ফেলবে ! এই ব্যাপারটা জানার জন্য ওকে সেই দিন আসলেই কী হয়েছি সেটাই জানতে হবে ।
রাফায়েল আজম কাদরিকে ডাক দিল ।
-আপনার ফুপুর ব্যবহৃত কিছু নিয়ে আসবেন প্লিজ! এমন কিছু যা তিনি একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত ব্যবহার করতেন !
-যেমন?
-যে কোন কিছু? পরনের শাড়ি আছে?
-হ্যা তার শাড়ি আছে ।
-ওকে, তাহলে মৃত্যুর দিন তিনি যে শাড়িটা পরে ছিলেন সেটার থেকে কিছু কেটে নিয়ে আসুন !
-কী করবেন সেটা দিয়ে?
রাফায়েল ফিরে তাকাল । তারপর বলল, নিয়ে আসুন আমি আপনাকে দেখাচ্ছি নিজে চোখেই !
ঘরের ভেতরেই একটা বৃত্ত আঁকা হয়েছে । রাফায়েল এবং আজম কাদরি সেই বৃত্তের মাঝে বসেছে। তাদের ঠিক মাঝে কাপড়ের টুকরোটুকু রাখা হয়েছে। সেটাকে ঘিরে কিছু আঁকাবুকি করা হয়েছে। সামনে বসা রাফায়েল চোখ বন্ধ করে কিছু যেন পড়ে চলেছে। আজম কাদরি নিজেও জানেন না আসলে তিনি ঠিক কী দেখতে যাচ্ছেন । তবে এক সময় অনুভব করলেন তার চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসছে । তিনি কিছুতেই নিজেকে জাগিয়ে রাখতে পারছেন না । এক সময়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন এবং সাথে সাথেই আমার জেগেও উঠলেন ।
তবে এই জেগে ওঠার ভেতরে একটা পার্থক্য তিনি চট জলদি টের পেলেন। তিনি যেন হাওয়াতে উড়ছেন । নিজেকে বড় হালকা মনে হল তার ! নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল যেটা যেন অনেকটা হাওয়াতে ভাসছেন । ঘরের পরিবেশও যেন বদলে গেছে । ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে । ঘরের কোণার দিকের খাটের দিকে তাকাতেই আজম কাদরি তীব্র ভাবে বিস্মিত হলেন। তিনি তার ফুপুকে দেখতে পেলেন । তার ফুপু বিছানাতে ঘুমিয়ে রয়েছে । তার নিঃশ্বাসের আওয়াজও যেন তিনি অনুভব করতে পারছেন !
আজম কাদরি নিজেকে খুব শক্ত মনের মানুষই মনে করেন । সব রকম পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন সব সময়। বাবা মায়ের মৃত্যু তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন । বাবা মারা গেছেন যখন তার বয়স মাত্র বত্রিশ । তখন থেকেই তিনি সংসার ব্যবসা সব কিছুর হাল ধরেছেন । তবে তার মা বেঁচে ছিলেন অনেক দিনই । সেই সাথে বাবার বোন এই ফুপু। কোন এক অদ্ভুত কারণে তার ফুপু বিয়ে করেন নি । সারা জীবন ভাইয়ের সংসারে কাটিয়ে দিয়েছেন । মায়ের কাছে শুনেছেন যে ফুপুর মাথায় নাকি কী একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কয়েকবার নাকি বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল এই কারণে। পরে দাদা আর চেষ্টা করেন নি । দাদার পরে তার বাবা নিজের সংসারে রেখে দিয়েছিলেন বোনকে। একই ভাবে আজম কাদরিও নিজের ফুপুর দেখা শোনা করেছেন জীবনভর । মায়ের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না তিনি ।
মায়ের মৃত্যুর পরে এই ফুপুই ছিল তার গুরুজন। পরিবারের সবাই ফুপুকে অনেক সম্মান করত। তার মৃত্যুতে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে সেটা সামলেও নিয়েছিলেন । কিন্তু এখন এই সময়ে তাকে আবার জীবিত দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না । চোখ দিয়ে আপনাআপনিই পানি বের হয়ে এল ।
ঠিক তখনই দেখতে পেলেন সেটাকে । একটা কালো আয়বয়। দরজা ভেদ করে প্রবেশ করল । তারপর তার ফুপুর খাটের কাছে গিয়ে থামল । আজম কাদরি দেখতে পেলেন তার ফুপু ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। ভীত চোখে সে তাকিয়ে আছে কালো আয়বয়ের দিকে । তার ফুপু কিন্তু চিৎকার দিলেন না । আজম কাদরির মনে হল যে এই আয়বয়টাকে তার ফুপু আগে থেকেই চেনেন । বিশেষ করে এক সময়ে ফুপু যখন হাত জোর করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করলেন তখন আজম কাদরি অবাক না হয়ে পারলেন না। কোন সন্দেহ নেই যে তার ফুপু কিছু না কিছু জানতেন ! কিন্তু কী জানতেন তিনি ?
আজম কাদরি তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন বটে তবে নিজের অবস্থান থেকে কিছুতেই করতে পারছেন না । কালো আয়বয়টা কিছু বলল তবে আজম কাদরি যেন সেটা শুনতে পেল না । সে তাকিয়ে আছে তার ফুপুর দিকে। তার আর কোন দিকে খেয়াল নেই !
তিনি যখন আবার ঘুম থেকে জেগে উঠলেন তখন দেখলেন রাফায়েল নামের মানুষ খাটের উপরে চুপ চাপ বসে আছে । তিনি মেঝেতে শুয়ে ছিলেন এতো সময়ে। আবারও আগের পরিবেশে ফেরত এসেছেন। উঠে বসে রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কী দেখলাম এটা ?
রাফায়েল জানালার দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। তার দিকে না তাকিয়েই বলল, এই ঘরে সেদিন যা হয়েছিল!
-আপনি এটা কিভাবে দেখালেন ?
-এটা ধরে নিন অনেকটা সিসিটিভির মত ! একটা ঘরে যা কিছু ঘটে সেটা বেশ কিছু দিন পর্যন্ত দেখা যায় !
আজম কাদরি যদি এই ব্যাপারটা নিজের চোখে না দেখতেন তাহলে কোন ভাবেই বিশ্বাস করতেন না । নিজের চোখে দেখার কারণে বিশ্বাস না করে পারছেন না । কিছুটা সময়ে চুপ করে থেকে বললেন, কী ছিল ওটা? কালো ঐ জিনিসটা ?
-ওটাকে আপনি জ্বীন বলতে পারেন আবার অপদেবতাও বলতে পারেন আবার কোন অশরীরিও বলতে পারেন । যেটা ইচ্ছে ডাকতে পারেন।
-কেন ? কেন করলো ওমন? ফুপু ওর কী ক্ষতি করেছে?
-আপনার ফুপু শুধু ওর টার্গেট না । আমার যতদুর মনে হচ্ছে আপনাদের পরিবারের সবাই ওর টার্গেট । তিনি ছিলেন দুর্বল এই কারণে সবার আগে তার উপরেই সে হামলা করেছে ।
-কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না । আমি কোনদিন কারো ক্ষতি করি নি । ব্যবসায়িক কাজে, হ্যা অনেকের সাথে আমার দ্বন্দ্ব হয়েছে, আমি জানি কিন্তু আমি কখনই অন্যায় কিছু করি নি ।
-আপনি করেন নি কিন্তু মেবি, আপনার পরিবারের কেউ করেছে । আপনার বাবা কিংবা দাদা অথবা তারও আগের কেউ !
-এসব তো আমি কিছু জানি না ।
-সম্ভবত আপনার ফুপু জানত । আপনি কি খেয়াল করেন নি আপনার ফুপু তাকে দেখে ভয় পেলেও অবাক কিন্তু হয় নি ? একই সাথে তার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করেছে। দেখেন নি আপনি?
আজম কাদরি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন । ব্যাপারটা তিনি নিজেও দেখেছেন । রাফায়েল নামের মানুষটা যা বলছে সেটা মিথ্যা না । তার ফুপু কিছু না কিছু জানত । তার মাথায় যে কিছু একটা সমস্যা ছিল সেটার সাথে কি এর কোন সম্পর্ক আছে?
রাফায়েল বলল, আপনাদের আদি নিবাস কোথায়?
আজম কাদরি বললেন, নবিনপুর। ওটা ময়মনসিংহ জেলার একেবারে সীমান্তবর্তী একটা এলাকা। আগে আমাদের সেখানে অনেক জায়গা জমি ছিল তবে এখন প্রায় সব কিছু বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বাবা বেঁচে থাকতেই তিনি প্রায় সব কিছু বিক্রি করে ঢাকা চলে আসেন। এখন কেবল আমাদের ভিটেটা আর তার পেছনে কিছু জায়গা জমি আছে। তবে অবস্থা খুব বেশি ভাল না। একজন কেয়ারটেকার আছে সেখানে। আমি শেষ গিয়েছিলাম বছর দশেক আগে। কেয়ারটেকার যে আছে, তাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাই । সে দেখা শুনা করে ।
রাফায়েল বলল, আপনি আপনার ঐ কেয়ারটেকারকে ফোন দিয়ে বলেন যে আমি সেখানে যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে হয়তো এই রহস্যের কোন সমাধান বের করা যাবে।
চার
গাড়িটা ছুটে চলেছে নবিনপুরের দিকে । আরিয়ানা বসেছে রাফায়েলের পাশে। আরিয়ানার আসা নিয়ে আজম কাদরির প্রথমে তীব্র আপত্তি ছিল। তবে মেয়ের জেদের কাছে তিনি হার মেনেছেন । আজম কাদরি নিজেও আসতে চেয়েছিলেন তবে ব্যবসার কাজের কারণে তার আসা সম্ভব হয় নি। আরিয়ানার আসা নিয়ে রাফায়েলের কোন আপত্তি কিংবা আগ্রহ কিছুই ছিল না । সে নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। আরিয়ানা যে কেন রাফায়েলের সাথে আসতে চাইল সেটা আরিয়ানা নিজেই জানে না । মাত্র কয়েক দিন আগেও আরিয়ানা এসব জিনিসে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করত না । হেসেই উড়িয়ে দিত। কিন্তু নিজের সাথে যখন এই ঘটনা ঘটল তখন আর বিশ্বাস না করে থাকতে পারল না ।
কিন্তু পাশে বসা মানুষটার ক্ষমতা যেন এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এটাও কি সম্ভব কোন ভাবে? ওর বাবার সাথে দীদার ঘরে অনেকটা সময় সে ছিল । কী করছিল যে সেটা আরিয়ানা জানে না । তবে যখন ঘরের বাইরে বের হল তখন বাবা আর আর এই রাফায়েল দুইজনের চেহারাই ছিল গম্ভীর। নিচের ড্রয়িং রুমে বসে তারা আরও কিছু সময় কথা বলছিল। সেটা শোনার জন্যই আরিয়ানা নিচে নেমে এসেছিল । ওর সাথে পরিবারের আরও অনেকেই ছিল । তখনই আরিয়ানা জানতে পারে যে ওদের গ্রামের কোন ঘটনার সাথে হয়তো এই ঘটনা জড়িত । ওর বড়ভাই আকিব জানালো যে এই বাসায় থাকাটা লুবনার জন্য নিরাপদ মনে হচ্ছে না । কখন যে কী দুর্ঘটনা ঘটে যায়!
এমন কথা বলতে বলতেই ধপ করে আলো নিভে গেল । এবং তার সাথে সাথেই লুবনার চিৎকার কানে এল । চিৎকারটা এল দোতলার ল্যান্ডিং থেকে। আরিয়ানা দেখেছিল সবার সাথে ভাবীও ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল বটে কিন্তু সিড়ি ভেঙ্গে আর নিচে সে নামে নি । ল্যান্ডিং থেকেই ড্রইয়িং রুমের দিকে তাকিয়ে ছিল ।
আরিয়ানা রাফায়েলের কাছেই দাড়িয়েছিল । এই মানুষটাকে নিয়ে তার আগ্রহ হচ্ছে বেশ । বিশেষ করে তার বাবা যেভাবে এই মানুষটাকে সমীহ করে কথা বলছে, এমনটা সাধারণত হতে দেখা যায় না । তার নিজের বাবা হলেও সে জানে আজম কাদরি একটু অহংকারী ধরনের মানুষ । সাধারণত মানুষকে সে খুব একটা পছন্দ করেন না । তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। তার বড় ভাইও খানিকটা এই স্বভাব পেয়েছে। ছোট বেলা থেকে আরিয়ানা নিজেও এমন পরিবেশে বড় হলেও দিন দিন সে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করছে।
আরিয়ানা অনুভাব করল রাফায়েল চিৎকার শুনেই দাঁড়িয়ে পড়ল । আরিয়ানা এটা অনুভব করল কেবল । অন্ধকারে দেখতে পেল না ।
আরিয়ানা রাফায়েলকে কিছু অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করতে শুনল । তারপরেই হাতে তালি দেওয়ার আওয়াজ। সেটা যে রাফায়েলই দিল তা আর বলে দিতে হল না। সাথে সাথে একটা আলোর শিখা তার হাতের মধ্য থেকে বের হয়ে উপরের দিকে উঠে ঘরটাকে খানিকটা আলোকিত করে তুলল । সেই আলোতে সবার চোখ চলে গেল দোতলার ল্যান্ডিংয়ের দিকে। ভয় আর আতংঙ্কে সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আরিয়ানা দেখতে পেল তার ভাবী ল্যান্ডিংয়ের রেলিংয়ের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়ে তার মুখে রক্তশূন্য হয়ে গেছে।
লুবনা কিছু যেন বলতে চেষ্টা করল তবে মুখ দিয়ে কোন কথা যেন বের হল না । চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি বের হয়ে এল । আর ঠিক তখনই মনে হল কেউ যেন পেছন থেকে তাকে ধাক্কা দিল । শূন্যে পড়তে শুরু করল সে ।
আরিয়ানা ভেবেছিল ভয়ংকর কিছু সে দেখবে এখনই। ভয়ংকর কোন আওয়াজ শুনবে! দুইতলা থেকে পড়লে হয়তো লুবনা মারা যাবে না তবে তার পেটের বাচ্চাটার কী হবে সেটা আরিয়ানা জানে না। আপনা-আপনি মুখ থেকে একটা চিৎকার বের হয়ে এল ওর । সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আরিয়ানা একটা ধুপ করে আওয়াজ শোনার অপেক্ষা করতে লাগল ।
কিন্তু বেশ কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেলেও যখন আওয়াজটা কানে এল না তখন আরিয়ানা চোখ খুলে তাকাল । তারপরই জীবনের সব থেকে বিস্ময়কর ঘটনা সে নিজের চোখে দেখতে পেল। আরিয়ানা দেখতে পেল তার ভাবী দোতলার ল্যান্ডিং এবং মেঝের ঠিক মাঝে শূন্যে ভেসে রয়েছে । যেন কেউ বা কিছু তাকে ধরে রেখেছে । ভয়ে তার মুখে একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেছে। কোন কথা বলতে পারছে না । এমন কি যেন কাঁদতেও ভুলে গেছে সে।
তখনই আরিয়ানার চোখ গেল রাফায়েলের দিকে । তার একটা হাত উপরে তোলা । আরিয়ানাকে বলে দিতে হল না যে ওর সামনের মানুষটা হাতের ইশারাতেই ওর ভাবীকে ধরে রেখেছে। রাফায়েলই আগে বলল, ভয় পাবেন না । কিছু হয় নি আপনার !
আরিয়ানা দেখতে পেল লুবনা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল । নিজের পায়ে অবশ্য দাড়াতে পারল না । মেঝেতেই বসে পড়ল। আকিব আর আরিয়ানার মা দ্রুত ছুটে গেল তার দিকে ।
রাফায়েল তার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যে ফলটা রাখতে দিয়েছিলাম সেটা কোথায়?
কন্ঠস্বরে একটু যেন বিরক্তি। দেখা গেল কারো কাছেই সেই ফলটা নেই। রাফায়েল বলল, আপনারা কি বুঝতে পারছেন না যে ভয়ংকর কিছু আপনাদের সাথে বসবাস করছে! কেউ কোন কথা বলল না আর !
আজকে দুপুরের দিকে রওয়ানা দেওয়ার সময় আরিয়ানা খেয়াল করল যে রাফায়েল তাদের বাড়ির চারিপাশে কী যেন পুঁতে দিল। গাড়িতে উঠতে উঠতে সে আজম কাদরিকে বলল, আপাতত ওটা আপনাদের বাড়ির ভেতরে আর ঢুকতে পারবে না । তবে এটা কোন স্থায়ী সমাধান না । এই রকম ব্যারিয়ারগুলো খুব সেন্সেটিভ হয়ে থাকে। যে কোন কারণে ভেঙ্গে যেতে পারে । চেষ্টা করবেন যাতে বাসায় কোন মৃত্যু না হয় । যে কোন মৃতপশু কিংবা প্রাণী যাতে গেট বাইরে থেকে ভেতরে না ঢোকে । বাজার থেকে হাঁস মুরগি কিংবা মাছ কিনে আনবেন না আপাতত । ফ্রিজে যা আছে আপাতত সেটা দিয়েই কাজ চালান ।
গাড়িটা তেল নেওয়ার জন্য একটা তেলপাম্পে থামলে রাফায়েল গাড়ি থেকে নেমে এল । আরিয়ানাও সাথে সাথে নেমে এল। এতো সময় আরিয়ানা নিজের মোবাইলের ভেতরেই ব্যস্ত ছিল । রাফায়েলের সাথে কেন জানি কথা বলতে সংকোচ হচ্ছিল । নিচে নেমে এসে রাফায়েলের পাশে দাড়াল । তারপর বলল, বাসায় কি সব নিরাপদ থাকবে?
-আশা করা যায় । ব্যারিয়ার দেওয়ার শুরুর দিকে সেটা বেশ স্ট্রং থাকে । সামান্য কারণে ভেঙ্গে পড়ে না । তবে সময়ের সাথে সাথে সেটা ক্ষয় হতে থাকে । তারপর সামান্য কারণে ভেঙ্গে পড়তে পারে।
-আচ্ছা, ঐ কাজটা আপনি কিভাবে করলেন?
-কোন কাজটা?
-ঐ যে ভাবীকে শূন্যের ভেতরে তুলে ধরলেন ? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না । যদি নিজের চোখে না দেখতাম তাহলে আমি কোন দিন বিশ্বাস করতে পারতাম না।
রাফায়েল এই প্রশ্নের কোন জবাব দিল না অবশ্য । সে তখনও কিছু যেন ভেবে চলেছে।
তবে যখন আরিয়ানা নবিনপুরের নিজেদের পৈত্রিক ভিটায় পৌছাল তখন আরিয়ানার সব আগ্রহ উবে গেল একেবারে । আরিয়ানা ভেবেছিল তাদের পৈত্রিকবাড়ি বুঝি বিশাল বড় কোন বাড়ি হবে । আগের দিনের জমিদার বাড়ি গুলো যেমন হয় । কিন্তু এখানে এসে দেখল তেমন কিছুই না । যে বাড়িটার সামনে ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটাকে আদৌও কোন বাড়ি বলা চলে কিনা সেটা আরিয়ানা জানে না । লাল ইটের তৈরি বাড়ি বটে তবে বেশির ভাগটাই ভেঙ্গে চুড়ে পড়েছে । যে কয়েকটা ভাঙ্গে নি তার একটাতে কেয়ারটেকার ছলিম মিয়া থাকে তার পরিবার নিয়ে । অন্য কোন ঘরই ঠিক থাকার মত নেই ।
রাফায়েল আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখানে থাকতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না । এক কাজ কর এই গাড়িতেই ফিরে যাও।
আরিয়ানা নিজেও জানে যে এখানে থাকা ওর পক্ষে বেশ কঠিন । বিশেষ করে এখানে যে ওয়াশরুম রয়েছে সেটা আরিয়ানা ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে হয় না । কিন্তু এখন যখন যদি বাসায় ফিরে যায় তাহলে নিজের ইগোর কাছেই সে হেরে যাবে। ওর বাবা ওকে এখানে আসতে মানা করেছিল কিন্তু নিজের জেদের কারণেই এখানে এসে হাজির হয়েছে। সত্য জানার একটা কৌতুহল অবশ্য ছিল তবে সেটা তো পরেও জানতে পারত ।
রাফায়েল পুরোবাড়িটা ঘুরে দেখছে। এদিকে আরিয়ানা দাঁড়িয়ে রয়েছে উঠোনে। আরিয়ানা যখন মনে মনে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে যে আবার ঢাকাতে ফিরে যাবে তখনই একজন ওর পেছনে এসে দাড়িয়েছে । আরিয়ানা ফিরে তাকিয়ে দেখল সাদা পাঞ্জাবী পরা একজন মাঝবয়সী লোক তাদের বাড়ির উঠোনে এসে দাড়িয়েছে হাসি মুখে । ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আম্মাজী, আমি তোমার চাচা হই । শুনলাম তোমরা নাকি এখানে থাকতে আসছো কদিন !
আরিয়ানা একটু হাসল । তারপর বলল, জী, একটু কাজ ছিল।
-এইখানে তো থাকার পরিবেশ নেই । দেখো না ঘর বাড়ির কী অবস্থা !
আরিয়ানা একটু হাসল ।
-আসলে এখানে আমরা কেউই এসে থাকব না জেনেই এগুলো মেরামত করা হয় নি কখনই !
-তবুও বাপ দাদার ভিটার একটু দেখা শুনা করতে হয় নাকি !
-তা ঠিক ।
-তোমরা চল আমার বাসায় ! যে কয়দিন থাক ঐখানেই থাকবে ! কোন অসুবিধা হবে না !
-আরে না না কী যে বলেন !
-কোন সমস্যা নাই আম্মাজি ! তোমার বাবা এক কালে আমার অনেক সাহায্য করছে। আমি থাকতে তুমি এই খানে থাকবা হইতেই পারে না ।
আরিয়ানা যখন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করছে তখনই রাফায়েল পেছন থেকে বের হয়ে এল । তারপর আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, ওনার কথা শোনা উচিৎ । আমাদের এখানে থাকার মত পরিবেশ নেই।
রাফায়েলকে দেখে লোকটা যেন একটু অস্বস্তিবোধ করল ।
আরিয়ানা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বলল, চাচা উনিই মূলত কাজে এসেছেন । আমি ওনার সাথে এসেছি কেবল ।
মাঝবয়সী লোকটা আবার মুখে হাসি নিয়ে এসে বলল, কোন সমস্যা নাই । চলেন আপনারা দুইজনেই চলেন । আমার বাড়িতে থাকার ঘরের কোন অভাব নেই।
লোকটার নাম জানা গেল জমির মুন্সি ! সে এই গ্রামের চেয়ারম্যান । বর্তমানে এই গ্রামের মাথা বলা চলে । তবে এক সময়ে এই গ্রামের প্রায় সব জায়গা জমি আরিয়ানার পূর্বপুরুষদের ছিল । আরিয়ানার দাদা এবং দাদার বাবা আস্তে আস্তে জায়গা জমি সব আস্তে ধীরে বিক্রি করে দিতে শুরু করে । আরিয়ানার দাদাই মূলত তাদের সব জায়গা বিক্রি করে দিয়ে ঢাকা চলে যায় । এই জায়গা জমির অনেকটাই এখন জমির মুন্সির কাছে । তবে জমির মুন্সি কাদরি পরিবারের ক্ষমতা সম্পর্কে খুব ভাল করে জানেন। এখনো যদি আরিয়ানারা গ্রামে ফিরে এসে পুরোটা নিজেদের দখলে নিতে চায় তাহলে সেটা তারা করতে পারে, এই ব্যাপারটা জমির মুন্সি জানে খুব ভাল করেই । জায়গা জমি অনেকটা বিক্রি করে দিলেও এখনো বেশ কিছু জমি রয়ে গেছে গ্রামে । বিশেষ করে গ্রামের পূর্ব দিকের জমি গুলো এখনও আরিয়ানাদেরই রয়ে গেছে।
জমির মুন্সির বাড়ি যাওয়ার আগে বাসায় একবার ফোন দিল আরিয়ানা। সেই ফোনেই আজম কাদরি জমির মুন্সির সাথে কথাও বললেন । জমির মুন্সি তাকে জানালেন যে মেহমানদের খাতির যত্নে কোন কমতি হবে না । এটা নিয়ে যেন আজম কাদরি কোন চিন্তা না করে।
পাঁচ
দুটো দিন আরিয়ানার দেখতে দেখতে চলে গেল । গ্রামটা একেবারে সীমান্তবর্তী হলেও এখানে প্রায় সব কিছুই পাওয়া যায় । এমন কি থ্রিজি নেট পর্যন্ত চলে এসেছে । গ্রামে এর আগে আরিয়ানা কখনই আসে নি তাই সব কিছুই ওর ভাল লাগছে । জমির মুন্সির ছোট মেয়ে রিমির সাথে এরই মধ্যে বেশ ভাব জমে গেছে আরিয়ানার । সে রিমির সাথেই ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামে ।
তবে জমির মুন্সির ছোট ছেলে সাজুর আগ্রহ বেশি। বয়সে সে আরিয়ানার সমানই হবে। ময়মনসিংহ শহরে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আরিয়ানাকে দেখেই তার পছন্দ হয়েছে । হওয়ারই কথা । বাসায় আসার পর থেকেই সাজু আরিয়ানার পিছু পিছু ঘুর ঘুর করছে। পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে দেখানো, গ্রামের গাছ থেকে ডাব, পেয়ারে পেড়ে দেওয়াটা সে নিজের একান্ত কর্তব্য মনে করছে। আরিয়ানার অবশ্য খারাপ লাগছে না ।
সন্ধ্যার দিকে যখন বাসায় ফিরল তখন রাফায়েলকে দেখতে পেল সে । সারাদিনে একবারও রাফায়েলের সাথে তার দেখা হয় নি। সকালে নাস্তার আগেই সে বের হয়ে গিয়েছিল । দুপুরে খাওয়ার সময়েও আসে নি । এখন এই সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা হল। আরিয়ানা তার পাশে বসতে বসতে বলল, কোথায় ছিলেন সারা দিন?
-খোজ খবর নিচ্ছিলাম । এখন আমি মনে হয় জানি তোমাদের সাথে কেন এসব হচ্ছে।
-জানেন?
-হ্যা !
-কী কারণ?
-তোমার শুনতে ভাল লাগবে না ।
-আমি শুনতে চাই। প্লিজ বলুন !
-তোমার পুর্বপুরুষরা মোটেই ভাল মানুষ ছিলেন না ।
-ভাল মানুষ ছিলেন না বলতে ?
-মানে হচ্ছে তোমরা যে অত্যাচারি জমিদারের গল্প শোন, তোমার পূর্বপুরুষরা ঠিক তেমনই লোক ছিল । মানুষজনকে সব রকম অত্যাচার করেই তাদের এই ধন সম্পদ গড়ে তুলেছিল ।
আরিয়ানা দেখল জমির মুন্সি এসে দাড়িয়েছে বারান্দায় । সে রাফায়েলের কথায় সায় দিয়ে বলল, জ্বী আম্মাজী । এটা গ্রামের বৃদ্ধরা সবাই জানে ।
-তারপর হঠাৎ একদিন কিছু হল । সম্ভবত তোমার বাবার দাদার দাদার থেকে । তোমার বাবা আমাকে বলেছিল যে তোমরা সবাই এক বাবার এক ছেলে ছিলে । তোমাদের আর কোন আত্মীয় নেই । আসলে কথাটা ঠিক না। তোমাদের পুর্বপুরুষদের সবারই একাধিক সন্তান ছিল । তবে সবাই অদ্ভুত কারণে মারা গেছে। কেবল একজন টিকে ছিল প্রতি প্রজন্মে । তোমার দাদার বাবারা সম্ভবত ৫ ভাই তিন বোন ছিল । সবাই মারা গেছে কেবল একজন বেঁচে ছিল। তোমার দাদার বাবা। তোমার দাদার বেলাতেও তাই । তারা সাত ভাইবোন ছিল। একে একে সব মারা গেছে । কেবল তোমার দাদা আর তার বোন জীবিত ছিল । তোমার বাবা অবশ্য একজনই ছিল ।
রাফায়েল তারপর তাকাল জমির মুন্সির দিকে । তারপর বলল, আপনার বাবার সাথে আরিয়ানার দাদার একটা পরিচয় ছিল । তাই না? আমি জানি আপনি কিছু জানেন ! নিশ্চিত ভাবে না জানলেও সম্ভবত ওর দাদা এই মৃত্যু হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন কিছু করেছিল। তাই না?
জমির মুন্সি কিছু সময় চিন্তা করে বলল, বাবার মুখে শুনেছি। ছোট বেলাতে তিনি আর আরেফ কাদরি বন্ধু ছিলেন। তাদের বাসায় নাকি সে সময় কিছু পুজাপাঠ বা বলি টাইপের কিছু হয়েছিল। ভয়ংকর দর্শন এক তান্ত্রিক নাকি এসেছিল। আমার বাবা তাকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন। এই গল্প একবার সে আমাকে বলেছিল ।
রাফায়েল বলল, হ্যা এমন কিছুই হয়েছিল । কোন ভাবে সেই অপদেবতাকে আটকে দেওয়া হয়েছিল । তবে সেটা সম্ভবত আবার ছাড়া পেয়েছে ।
আরিয়ানা নিজে চুপ করে শুনছিল । নিজের কাছেই তার খানিকটা লজ্জা লাগছিল বটে নিজের পূর্বপুরুষদের ঘটনা শুনে । কিন্তু তাই বলে একজনের কৃতকর্মের সাজা অন্য কাউকে দেওয়ার কি কোন মানে আছে? আরিয়ানা তো এমন নয় ।
ছয়
রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করেই রাফায়েল যখন বাইরে বের হওয়ার উদ্যোগ নিল তখনই আরিয়ানা একেবারে তৈরি হয়েই ওর সাথে বের হয়ে এল। রাফায়েল অবশ্য আগেই বলেছিল যে আজকে রাতে সে বের হবে সেই আসল সুত্রটা খুজে বের করতে। আরিয়ানাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই একটা বড় বটগাছ রয়েছে। বটগাছটা কম করে হলেও দুই আড়াইশ বছর পুরানো। সেই বটের কাছে আজকে যাচ্ছে ওরা । ওখানে অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে !
আরিয়ানার হাতে একটা হ্যারিকেন বাতি। এই আলোর যন্ত্রটা আরিয়ানা সরাসরি এই প্রথম দেখছে । এর আগে ছবিতে কয়েকবার দেখেছিল। ওরা এগিয়ে চলছে গ্রামের রাস্তা ধরে । হ্যারিকেন হাতের সাথে দুলছে । চারিদিকে আলোটাও যেন দুলছে ওদের সাথে । আরিয়ানা ব্যাপারটা বেশ মজা লাগছে।
জমির মুন্সি আর সাজু অবশ্য তাদের সাথে আসতে চেয়েছিল তবে রাফায়েল সেটা মানা করে দিয়েছে। আর বলেছে যে যদি কোন প্রকার সাহায্যের দরকার হয় তবে ফোন করে জানাবে তাদের !
অন্ধকারে চলতে চলতে আরিয়ানা বলল, আচ্ছা আপনি এতো সহজে রাজি কেন হয়ে গেলেন শুনি?
-ঠিক বুঝলাম না ।
-মানে আমি যখনই আপনার সাথে আসতে চাইলাম, আপনি এতো সহজে রাজি হয়ে গেলেন? এমন কি যখন ঢাকা থেকে আসতে চাইলাম তখনও মানা করলেন না ! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এর পেছনে কোন না কোন কারণ আছে।
রাফায়েল একটু হাসল। যদিও আরিয়ানা সেই হাসি দেখতে পেল না। রাফায়েল বলল, তুমি বেশ বুদ্ধিমতি। হ্যা, কারণ তো আছেই । তবে তুমি না এসে তোমার দুই ভাই কিংবা বাবা আসলেও চলত ।
-মানে আমাদের পরিবারের কেউ?
-ঠিক পরিবারের কেউ না । তোমাদের সরাসরি রক্তের কেউ হতে হবে । যেমন তোমার মা কিংবা ভাবী হলে চলবে না ! একটা ব্যাপার হয়তো খেয়াল কর নি যে তোমাদের পরিবারের সবাই ভয় পেলেও তোমার মায়ের উপরে কিন্তু কোন হামলা হয় নি !
-কেন?
-কারণ তোমার মা হচ্ছে বাইরের রক্ত। তোমাদের ফ্যামিলির সরাসরি রক্ত না ।
-তাহলে ভাবী ? ভাবীও তো বাইরের মানুষ সেই হিসাবে!
রাফায়েল আবারও হাসল । বলল, ভুলে কেন যাচ্ছ যে তোমার ভাবীর গর্ভে বাচ্চা যেটা তোমাদের ভাইয়ের রক্ত!
-তা অবশ্য ঠিক!
ওরা হাটতে হাটতে ওদের বাড়ির পেছনের দিকে চলে এল। একেবারে বটগাছটার নিচে । আরিয়ানা হ্যারিকেনটা এক পাশে নামিয়ে রাখল, দেখতে পেল বটগাছের কিছু জায়গা এমনিতেই পরিস্কার করা । সম্ভবত আগেই রাফায়েল এই জায়গাটা ঠিক করে রেখেছিল।
আরিয়ানা দেখল বৃত্তের মত জায়গায় তিনটা বসার স্থান রয়েছে। বটের পাতা পেতে সেই বসার স্থান বানানো হয়েছে । মাঝে ছোট করে একটা গর্ত করা ।
রাফায়েল সেই তিনটি বসার স্থানের একটা স্থানে আরিয়ানাকে বসতে ইঙ্গিত করল । অন্য একটা স্থানে সে নিজে বসে পড়ল। তারপর ব্যাগে করে আনা কিছু জিনিসপত্র ঢালতে শুরু করল । আরিয়ানা কৌতুহল নিয়ে ব্যাপারটা দেখতে লাগল । তার কাছে এই ব্যাপারগুলো একেবারে নতুন। যাই দেখছে তাই একেবারে অন্য রকম লাগছে। এমনটা কেবল এতোদিন ভুতের গল্পে কিংবা ভুতের মুভিতে দেখে এসেছে। আজকে সরাসরি নিজের চোখেই দেখছে।
রাফায়েল ধারালো একটা ছুরি বের করল পকেট থেকে । সেটা দিয়ে নিজের তালুর ঠিক মাঝ বরাবর একটু পোঁচ দিল । রক্ত গড়িয়ে পড়ল সেই গর্তে । আরিয়ানা অবাক হয়ে রাফায়েলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল । এমন কিছু যে রাফায়েল করতে পারে সেটা সে ভাবতেও পারে নি। কিন্তু তারপর রাফায়েল যা করতে বলল, সেটা শুনে আরিয়ানা যেন আকাশ থেকে পড়ল । রাফায়েল আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, এবার তোমার পালা ?
আরিয়ানা যেন ঠিক মত রাফায়েলের কথা ধরতে পারল না । বলল, আমার পালা মানে?
-তোমার রক্ত দরকার !
-কী বলছেন ?
আরিয়ানা এবার একটু ভয় পেল । এমন একটা কাজ যে করতে হবে সেটা আরিয়ানা ভাবে নি। এই কারণেই কি তাকে আসতে রাফায়েলের কোন আপত্তি ছিল না ?
রাফায়েল বলল, ভয় পেও না । একটু ব্যাথা পাবে কেবল !
আরিয়ানা ভয়ে নিজের হাত এগিয়ে দিল । তারপর চোখ বন্ধ করল । কয়েক সেকেন্ড পরেই ব্যাথাটা অনুভব করল । তবে মুখ বুজে সেটা সহ্য করে নিল ।
রক্তের ফোটা গর্তে পড়তেই আরিয়ানা অনুভব করতে চারিদিকে পরিবেশ যেন হঠাৎ করেই বদলে গেছে । সব কিছু যেন একেবারে থেমে গেছে এবং তারপরই হ্যারিক্যানের আলোটা ধপ করে নিভে গেল । আরিয়ানা চোখ মেলে দেখল যে চারিদিকে একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। একটু আগেও যেখানে ঝিঁঝিপোকাসহ নানান পোকামাকড়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল সেখানে এখন কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না । সব কিছু যেন একেবারে শান্ত হয়ে গেছে।
এভাবে যখন সব কিছু শান্ত হয়ে এসেছে ঠিক সেই সময়ে আরিয়ানা শুনতে পেল কেউ ধীরে পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে । পাতার খচমচ আওয়াজ আরিয়ানার কানে গেল পরিস্কার । আওয়াজটা এগিয়ে এসে ঠিক ওর পাশের বসার স্থানে বসল। সেই বসার আওয়াজটাও পরিস্কার শুনতে পেল । কেউ একজন কিংবা কিছু একটা ঠিক ওর পাশে এসে বসেছে। ভারী নিঃশ্বাস নেওয়ার আওয়াজ আরিয়ানা পরিস্কার শুনতে পেল । ভয়ের একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে আরিয়ানার পুরো শরীর জুড়ে । একটা হাত রাফায়েলের হাতে ধরা । এই ভরশাটুকু নিয়েই আরিয়ানা বসে রয়েছে । নয়তো এতো সময়ে সে হয় অজ্ঞান হয়ে যেত নয়তো দৌড়ে পালিয়ে যেত। খুব গম্ভীর আওয়াজটা কানে এল একটু পরেই।
-তোমার সাহস দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে ?
আওয়াজে এমন কিছু ছিল যে আরিয়ানার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠল ।
রাফায়েল একটু কৌতুকপূর্ন আওয়াজে বলল, আপনি আমাকে চিনেন দেখছি!
-তোমাকে আমি চিনি । তুমি ভেব না যে তোমার কাছে ক্ষমতা আছে বলে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে! আমি খুব ভাল করেই জানি তোমাকে রক্ষা করার মত তোমার মাথার উপরে কেউ নেই।
এবার রাফায়েল একটু শব্দ করেই হেসে উঠল। তারপর বলল, আপনার মনে হয় যে আমার নিজেকে রক্ষা করার জন্য অন্য কারো দরকার আছে?
গম্ভীর কন্ঠটা কোন উত্তর দিল না । রাফায়েল বলল, আপনি কেন রাগ করছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি না ! আমি তো আপনাকে অসম্মান করতে ডাকি নি । সেটা করতে চাইলে পদ্ধতি অন্য রকম হত ! সেটা আপনিও জানেন । এছাড়া এই দেখুন এই জমির মালিক এখানে রয়েছে। তার সম্মতিতে তার উপস্থিতিতে আপনাকে ডাকা হয়েছে । আমাদের দরকারেই ডাকা হয়েছে । আমরা আপনার সাহায্যের জন্য ডেকেছি ।
আরিয়ানার মনে হল যে এবার বুঝি গম্ভীর কন্ঠ একটু নমনীয় হল । সে বলল, কী জন্য ডেকেছো ?
-এই জমিতে হওয়া অন্যায়ের কথা জানতে চাই!
-কোন অন্যায়ের কথা জানতে চাও বল । অন্যায় তো কম হয় নি এখানে!
-যে অন্যায়ের রেশ এখনো রয়েছে !
-সে আছে আসে পাশেই। তুমি বুঝতে পারছো না?
-জ্বী পারছি।
-সে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে । তা মা হত্যার প্রতিশোধ !
-আপনার কি মনে হয় না যথেষ্ঠ প্রাণ সে কেড়ে নিয়েছে । এবার তার শান্ত হওয়া দরকার ! আপনি নিজেও এটা জানেন যে একজনের কর্মফল কোন ভাবেই অন্য জন ভোগ করতে পারে না । এটা অন্যায় !
বেশ কিছু সময় কোন আওয়াজ শোনা গেল না । তারপর সেই গম্ভীর কন্ঠটা বলে উঠল, আমি জানি । কিন্তু এখানে আমার কিছুই করা নেই, তুমি জানো ।
-আমি সেটা জানি । আপনি কেবল আমাকে একটু সাহায্য করুন । আমি সেটার আসল উৎস জানতে চাই।
-এই বংশের পূর্বপুরুষরা যাদের উপরে অত্যাচার করেছিল তাদের ভেতরে একজনের নাম ছিল দবিনান্দ। সে তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ছিল । তাকে জোড় করে তার ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। মারামারিতে তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী মারা যায় । দবিনান্দ তার স্ত্রীর সৎকার করলেও পেটের সন্তানের সৎকার করে নি । পেট কেটে সেই সন্তান বের করে । তাকেই এই পৃথিবীতে রেখে যায় । তার উপরে আদেশ ছিল কাদরি বংশের এক সন্তান রেখে বাকি সবাইকে মেরে ফেলার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাবার সেই আদেশ সে মান্য করে এসেছে। তবে মোজ্জামেল কাদরি নিজেদের ছেলেমেয়ের মৃত্যু ঠেকাতে আরেক তান্ত্রিকের সাহায্য নেয়। তুমি জানো এই রকম অশীরিকে কিভাবে সামাল দিতে হয় । এই জিনিস সবাই পারে না । সেই তান্ত্রিক কোন মতে সেটাকে বন্দি করে কেবল । শতবর্ষী সেই তান্ত্রিক এই মাস দুয়েক আগে মারা গেছে। মৃত্যুর আগে সে তার সাগরেদদের বলে যায় কিভাবে তার দেহকে মাটিতে কবর দিতে হবে । সেভাবে কাজ করা হয়েছিল । তার সাথে তার সব নিয়ন্ত্রিত শক্তিও তার কবরেই বন্দী ছিল কিন্তু কদিন আগে এক লাশচোর সেই কবর খুড়ে লাশ বের করার চেষ্টা করে । সেখান থেকে আবার মুক্ত হয়ে যায় তোমাদের এই অভিশপ্ত। আবারও প্রতিশোধ নিতে হাজির হয়ে কাদরি পরিবারের সামনে !
এক টানা কথা বলে কন্ঠটা থামল । তারপর বলল, আশা করি যা জানার জেনেছো । এরপরে আমাকে আর বিরক্ত করবে না ।
রাফায়েল বলল, আপনাকে ধন্যবাদ । তবে আর বিরক্ত করব না সেই কথা দিতে পারছি না !
আরিয়ানা অনুভব করল যে সেই জন আস্তে ধীরে উঠে দাড়াল । তারপর ধীরে ধীরে পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল ।
সাত
গ্রামের রাস্তা ধরে আরিয়ানা হাটছে। ওর সাথে আজকে সাজু রয়েছে । সন্ধ্যা পার হয়েছে একটু আগে । তবে এখনও অন্ধকার হয় নি চারিদিকে । মোবাইলের আলো ছাড়াই এখনও পথ হাটা যাচ্ছে। আরিয়ানা সাজুকে জিজ্ঞেস করল, ঐদিকে কী আছে?
সাজু বলল, ওটা পরিত্যাক্ত । কয়েকবার এখানে জমি পরিস্কার করে চাষবাসের চেষ্টা অবশ্য করা হয়েছিল তবে সেটা সফল হয় নি । এখানকার জমিটা বেশ রুক্ষ । সহজে কিছু ফলবে না ।
ওরা হাটতে হাটতে আরো ঘন বনের ভেতরে ঢুকে পড়ল । অনেকটা সময় ধরেই তারা হাটছে। গ্রাম থেকে অনেকটা দুরেই চলে এসেছে। সাজুর কাছে একটা টর্চ লাইট ছিল। সেটা সে জ্বালিয়ে দিল । চারিপাশে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। আজকে দুপুরের পর থেকে ওরা পুরো গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে । শুরুতে রিমি ওদের সাথে থাকলেও সন্ধ্যায় রিমির এক স্যার পড়াতে বাসায় আসে । সেই স্যারের কাছে পড়তেই রিমি চলে গেছে । আরিয়ানা সাজুর সাথে গ্রামের পথে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে ।
শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হলেও আরিয়ানার এই গ্রামটা অদ্ভুত সুন্দর মনে হচ্ছে । এবার ঢাকাতে ফিরে গিয়ে ওর বাবাকে অবশ্যই বলবে যেন এই গ্রামে থাকার জন্য একটা বাড়ি তৈরি করে । খুব বেশি বড় হতে হবে না বাড়িটা। ছোট দুই তিন কামরার হলেই চলবে। সেই সাথে আধুনিক একটা ওয়াশরুম । সাজুদের বাসাটা বেশ চমৎকার । তবে ওয়াশরুমটা আরেকটু ভাল ভাল হত ।
-অন্ধকার হয়ে আসছে। আমাদের বাসায় যাওয়া উচিৎ।
-হ্যা । যাওয়া উচিৎ । চল ।
কিন্তু যখনই ওরা ঘুরে গ্রামের পথ ধরতে যাবে তখনই ধপ করে সাজুর টর্চটা নিভে গেল। সাজুর কয়েকবার চেষ্টা করল বটে কিন্তু সেটা আর জ্বলল না । সাথে সাথে পুরো পরিবেশটা বদলে গেল যেন। আরিয়ানা ঠিক ঠিক বুঝতে পারল সে এসেছে। সাজুকে সাবধান করার আগেই দেখল সাজুকে কেউ যেন জোড়ে একটা ধাক্কা দিল । সাজু বেশ কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল ।
এখনই সময়। এখন আরিয়ানাকে সরে যেতে হবে । আরিয়ানা দৌড়াতে যাবে ঠিক সেই সময়ে অনুভব করল কেউ যেন ওর গলা চেপে ধরেছে । নিজের হাত দিয়ে সেই গলা চেপে ধরা হাত দুটো ধরার ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু কোন কাজ হল না । একেবারে লোহার হাত যেন ।
আরিয়ানার মনে হল ওর নিঃশ্বাস নিতে পারছে না । নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগল । কিছুতে নিজেকে সে মুক্ত করতে পারল না। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! শরীরের শক্তিও যেন কমে আসছে। আর পারছে না ও ! যখন আরিয়ানার মনে হল যে এবারই ওর মৃত্য হবে ঠিক সেই সময়ে কানে এল শব্দ দুটো !
‘অপ্রে ভিয়েস্তা’
চারিদিকটা একেবারে আলোকিত হয়ে এল সেটা । আরিয়ানা দেখতে পেলে একটা আলো ঝলকানী তীব্র বেগে এগিয়ে এসে সরাসরি আঘাত করল ওর গলা চেপে ধরা অশরীরিটাকে । ছিটকে দূরে সরে গিয়ে পড়ল সেটা। তীব্র একটা বাতাস অনুভব করতে পারল ও নিজে।
এদিকে আরিয়ানার গলাটাও ছুটে গেল । আরিয়ানা মাটিতে পড়ে কাঁসতে শুরু করল ।
রাফায়েল একেবারে ওর কাছে চলে এসেছে । আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ঠিক আছো?
আরিয়ানা নিজেকে সুস্থির করে নিতে আরও কয়েক মুহুর্ত সময় লাগল। তারপর বলল, হ্যা আমি ঠিক আছি।
-গুড । এখন আরও কাজ বাকি । মনে আছো তো কী করতে হবে?
-হ্যা মনে আছে ।
রাফায়েল বলল, সাজু। এদিকে এসো ।
সাজু ধাক্কা খেয়ে একটু দূরে সরে গিয়েছিল । দ্রুতই ফিরে এল ওদের সামনে । একটু ভয় যে সাজুর করছে না, সেটা সাজু অস্বীকার করবে না । তবে এখন আরিয়ানার সামনে নিজেকে সাহসী প্রমান না করতে পারে তাহলে আর কখনই পারবে না ।
সাজুর হাতের টর্চটা আবার জ্বলে উঠেছে। গাছের আড়ালেই বড় পেট্রোলের ক্যানটা রাখা। আরিয়ানা আর সাজু সেটা নিয়ে নির্ধারিত দিকে দৌড় দিল। ওদের সাথে সাথে কালো অশরীরিটাও উঠে দাড়িয়েছে। ওদের যাওয়ার পথের দিকে ছুটে গেল কিন্তু কিছু একটাতে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। তারপর আবারও যখন চেষ্টা করল আবারও একই ভাবে শক্ত অদৃশ্য কিছুর সাথে ধাক্কা গেল। কয়েকবার চেষ্টা করেও ওদের পিছু নিতে পারল না। বারবার সেই অদৃশ্য দেয়ালে ধাক্কা দিতেই লাগল। ভয়ংকর রেগে গিয়েছে ওটা। অদৃশ্য দেয়ালটা যে কোন ভাবেই হোক ভেঙ্গে ফেলবেই এবার !
আরিয়ানা যখন দৌড়াচ্ছে তখনও ও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে পরিকল্পনাটা কাজে দিয়েছে। রাফায়েল ওকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করেই অশরীরিটাকে ওর দিকে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে। এমন একটা ভয়ংকর কাজে সে রাজিও হয়েছে!
ঐদিন রাতের ঘটনা যখন রাফায়েল ওর কাছে ব্যাখ্যা করল তখন আরিয়ানার বিস্ময়ের সীমা ছিল না । রাফায়েল জানালো রাতে যে ওদের সামনে এসেছিল সে একজন ওয়াচার ফেইরি । প্রতিটি এলাকাতেই এমন প্রচুর ওয়াচার ফেইরি থাকে । এটাকে জ্বীনও বলা যেতে পারে । তবে রাফায়েলের ভাষায় এরা সব কিছু দেখে আর মনে রাখে। জ্বীনদের উইকিপিডিয়াও বলা যায় এদেরকে। এদের ডেকে নিয়ে এসে অতীতের অনেক কথা জানা যায় । তবে সমস্যা হচ্ছে এদের যদি সঠিক ভাবে না ডেকে নিয়ে আসা হয় তাহলে এরা ক্ষতি করতে পারে। এই যেমন আরিয়ানার নিজের রক্ত দিয়ে ওয়াচারকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে । এটা আরিয়ানাদের জায়গা। সেই জায়গাতেই এই ওয়াচারের বসবাস । এই কারণে সে খানিকটা দায়বদ্ধ ওদের কাছে । এখানে যদি আরিয়ানা না থাকত তাহলে কোন ভাবেই ওয়াচারের মুখ দিয়ে কোন কথা বের করানো যেত না। কিংবা তখন তার সাথে বিনিময় করতে হত । কিছু দিতে হত তাকে । কিন্তু এদেরকে কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করা বেশ কষ্টসাধ্য । রাফায়েল অবশ্য ভয় দেখিয়েই তথ্য আদায় করে । তবে এই ওয়াচার ফেইরি যদি বয়সে অনেক বেশি হয় তাহলে কোন ভয়েই কাজ হয় না ।
আরিয়ানা কেবল অবাক হয়ে রাফায়েলের কথা শুনছিল । রাফায়েলের সাথে সে যত থাকছে তত নতুন কিছু যেন আবিস্কার করছে । এসব যে সত্যিই কোন দিন সম্ভব এটা আরিয়ানার নিজেরই বিশ্বাস হত না । এখনও হচ্ছে না। যদিও সে ওয়াচার ফেইরিকে নিজের চোখে দেখে দেখে নি তবে নিজে সেটার অস্তিত্ব অনুভব করেছে। পরিস্কার ভাবে তার কন্ঠ শুনতে পেয়েছে।
আরিয়ানা বলল, এখন কী করবেন?
-দুইটা কাজ করতে হবে। ঐ কবরটাকে পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। কিন্তু এখানে আরেকটা সমস্যা রয়ে গেছে। যদি সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিইও সেই অশরীরিটা তবুও থেকে যাবে । ওটাকে নিয়ে যেতে ওদের জগতে । সেটার জন্য আগে ওটাকে ধরতে হবে !
-কিভাবে ধরবেন ?
-একটা উপায় অবশ্য আছে । তবে সেটা হয়তো তোমার পছন্দ হবে না।
-বলুন শুনি?
-তোমাকে টোপ হিসাবে রেখে !
আরিয়ানা প্রথমে মনে হল ও যেন ভুল শুনলো। কিন্ত রাফায়েলের চোখ দেখেই মনে হল রাফায়েল ওর সাথে কোন প্রকার ঠোট্টা তামাশা করছে না । সে আসলেই ওকে টোপ হিসাবে ফেলতে চাচ্ছে।
আরিয়ানা একটা লম্বা দম নিয়ে বলল, আমি রাজি !
-সত্যিই রাজি? এটা কিন্তু বেশ ঝুকিপূর্ণ হবে।
-কিন্তু যদি ওটাকে আমরা ধরতে না পারি তাহলে এই ঝুকি আমাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তাই না?
-হ্যা তা সত্যি !
-তাহলে এই ঝুকিটা আমি নিতে চাই । আমার যদি কিছু হয়েও যায় তবুও ।
-তোমার বাবাকে আমি কী জবাব দেব তখন?
-আপনাকে কোন জবাব দিতে হবেনা । আমি বাবার জন্য আলাদা একটা ভিডিও রেখে যাব যদি কিছু হয়ে যায় আমার । এখন বলেন কী করতে হবে আমাকে ?
রাফায়েল ওর পরিকল্পনার কথা খুলে বলল। অশরীরিদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট হচ্ছে তারা নির্দিষ্ট কোন স্থান কিংবা বস্তু অবলম্বন করে ঘোরাফেরা করে । এই যেমন এই অশরীরির ক্ষেত্রেই যদি ধরা হয় তাহলে এই শিশুটির দেহ হচ্ছে তার অবলম্বন। ঐ তান্ত্রিক যখন তার দেহের ভেতরে অশরীরিটাকে বন্দি করল তখন তান্ত্রিকের দেহ হয়ে গেল তার অবলম্বন । এখন যদি আগেই সেটাকে ধ্বংশ করে দেওয়া হয় তাহলে এই অবলম্বনকে ধ্বংস করে দেওয়া হয় তাহলে সেটা একেবারে ভবঘুরে হয়ে যাবে। কিছুক্ষেত্রে আবার দেখা যায় অবলম্বন ধ্বংস করে দিলে অশরীরি ধ্বংস হয়ে যায় তবে এটা তেমন কিছু নয় । এটাকে বিশেষ ভাবে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে । এই উদ্দেশ্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটা এখান থেকে স্ব-ইচ্ছেতে যাবে না । এটাকে জোর করে নিয়ে যেতে হবে । আগে ওটাকে আটক করতে হবে এবং তারপর ধ্বংস করতে হবে ওটার অবলম্বনকে। অবলম্বন ধ্বংশ না করে কোন অপদেবতাকে কোন ভাবেই তার জগতে ফেরত নিয়ে যাওয়া যায় না। এই কারণে ওটাকে ধরা যেমন জরুরী ঠিক একই ভাবে সেটার অবলম্বনকে ধ্বংস করাও জরুরী। দুটো যদি এক সাথে করা যায় তবে সব থেকে ভাল হয় ! রাফায়েলের একার পক্ষে দুটো কাজ এক সাথে করা সম্ভব নয়।
যে হলুদ লেবুটা ওর সাথে আছে ওটা ছাড়া ওকে ঘুরে বেড়াতে হবে । তাহলেই অশরীরিটা আরিয়ানার কাছে আসবে । এর আগে অবশ্য একটা সার্কেল বানাতে হবে । ওটা সার্কেলের ঢুকতে পারবে ঠিক তবে আর বের হতে পারবে না ।
সে মোতাবেকই কাজ করা হল । বনের একটা নির্দিষ্ট স্থান ঠিক করা হল। সেটা অবশ্যই সেই করবের কাছাকাছি। এই কাছের আগে অবশ্যই রাফায়েল একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে নিল যাতে কাজের সময়ে সেই অশরীতি ওদের দেখতে না পারে। রাফায়েল তারপর সেই সার্কেলটা নিজের মত করে বন্ধ করে দিল যেখানে অশরীরিটা ঢুকবে ঠিকই তবে আর বের হতে পারবে না । তবে অবশ্যই আরিয়ানাকে মনে রাখতে হবে যে ওটা সার্কেলের ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথেই আরিয়ানাকে বের হয়ে যেতে হবে !
এই কাজে সাহায্যের জন্য আরিয়ানা সাজুকে সাথে নিল। যদিও সাজু প্রথমে সব কিছু বিশ্বাস করল না তবে আরিয়ানার সাথে থাকার সুযোগ সে হারাতেও চাইল না।
এখন দুইজন দৌড়াচ্ছে সেই কবরটার দিকে । সাজুর হাতে পেট্রলের ক্যান । আরিয়ানার হাতে এখন রয়েছে সাজুর টর্চটা । সাজু দৌড়াতে দৌড়াতে আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি দেখেছো দেখেছো তুমি? ওর হাত থেকে কিভাবে আলো বের হয়ে এল?
আরিয়ানা দেখে নি । তখন ও নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল। অন্য কোন দিকে তাকানোর ফুরসৎ তার ছিল না। তবে সে জানে সাজু যা দেখেছে সেটা সত্যি । সেই তীব্র আলোর ঝলকানী সে অনুভব করেছে । কোন মানুষ কি এই কাজ গুলো করতে পারে?
কে এই রাফায়েল?
এখন অবশ্য এসব ভাব্বার সময় নেই । আরিয়ানা অনুভব করছে পুরো জঙ্গলে যেন ঝড় শুরু হয়েছে । যে কোন ভাবেই হোক আগে সেই কবরটাকে ধ্বংস করতে হবে ।
অন্ধকারের ভেতরে ওরা দৌড়েই চলেছে। আরিয়ানার কাছে মনে হল যে চারিদিক থেকে কিছু একটা ওদের দিকে ধেয়ে আসছে। ওদেরকে ধরার চেষ্টা করছে। রাফায়েল বলেছিল এমনটা হতে পারে । তবে সেটাতে যেন ভয় না পায়। কারণ আসল অশরীরিটা যেহেতু সার্কেলের ভেতরে বন্দি থাকবে তাই কোন ক্ষতি তাদের হবে না। রাফায়েল আরও বলেছিল এমন কাজ করার সময়ে পেছন থেকে অনেক আওয়াজ শোনা যায় । পেছন থেকে অনেক পরিচিত মানুষের ডাক কানে আসতে পারে। সেদিকে কোন ভাবেই কান দেওয়া যাবে না ।
-আরিয়ানা! আরিয়ায়া ! মা আমার !
আরিয়ানা থমকে দাড়াল । তার বাবার কন্ঠ সে শুনতে পেয়েছে ! ডাকটা এসেছে পেছন থেকে।
রাফায়েল অনুভব করল যে আগে মোকাবেলা করা যে কোন অশরীরির চেয়ে এটা একটা অন্যরকম । এটা অনেক বেশি রাগান্বিত হয়ে আছে । বারবার সার্কেলের দেয়ালে আঘাত করছে । যে কোন ভাবেই সেটা ভেঙ্গে ফেলবে যেন । ঠিক এই সময়ে অশরীরিটা দেয়ালে আঘাত দেওয়া বন্ধ করে দ্রুত রাফায়েলের দিকে এগিয়ে গেল । রাফায়েল এতো সময়ে দেখেছে ওটা সব সময় রাফায়েলের কাছ থেকে দুরে থেকেছে। ঢাকাতে যখনই রাফায়েল গিয়ে হাজির হয়েছে তখনই সেটা রাফায়েলের কাছ দুরে সরে গেছে । প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমনটা হয়ে থাকে । কিন্তু এবার যেন একটু ব্যতিক্রম হল । রাফায়েল এটার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না । এতো দ্রুত ওটা রাফায়েলের দিকে এল যে সামনে নিতে পারল না । সরাসরি রাফায়েলের বুকে একটা আঘাত লাগল । খানিকটা ছিটকে গিয়েই পরল একটু দুরে । প্রায় সাথে সাথেই উঠে দাড়াল । তবে এবার সামলে নিয়েছে সে । আরেকবার যখন হামলা করতে এল তখন আর আগের মত সরাসরি রাফায়েলের শরীরে আঘাত আনতে পারল না । তার আগেই আলোর ঝলকানী গিয়ে সরাসরি গিয়ে আঘাত করলো ওটাকে ! খানিকটা ছিটকে গিয়ে পড়ল দুরে । তবে সাথে সাথেই উঠে দাড়াল আবারো । আবারো এগিয়ে এল রাফায়েলের দিকে।
রাফায়েল বুঝলো এভাবে ওটাকে থামান যাবে না । যতবার আঘার করবে ততবার সেটা এগিয়ে আসবে। এবার রাফায়েল অন্য পথে এগোতে হবে !
সাজু তাকিয়ে দেখল আরিয়ানা থেমে গেছে।
-কী হল? দাড়ালে কেন?
-আমার বাবার ডাক শুনলাম ।
-তোমার বাবা এখানে আসবে কোথা থেকে? রাফায়েল কী বলেছিল মনে নেই তোমার? কেউ নেই এখানে । কেউ নেই এখানে কেউ নেই ! আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে । আর বেশি দুরে না ।
-কিন্তু !
-কোন কিন্তু না আ। চল জলদি ! এখানে দাঁড়ানো যাবে না !
আরিয়ানা যেন আবার নিজের হুশ ফিরে পেল ! তারপর আর না ভেবে দৌড়াতে শুরু করল !
আরও মিনিট পাঁচেক দৌড়ানোর পরে ওরা ভ্যানটা দেখতে পেল । রাফায়েল এই ভ্যানের কথা বলেছিল । বলেছিল যে ভ্যানের কাছেই পাবে কবরটা। ভ্যানটা পার হতেই তীব্র একটা দুগন্ধ নাকে এল। লাশ পঁচার গন্ধ যে এতো তীব্র হতে পারে সেটা আরিয়ানার কল্পনার বাইরে ছিল ।
রাফায়েল তার দুই হাত তুলে ধরে আছে সামনে ! সামলের কালো অশরীরিটার পুরো শরীর জুড়ে একটা আলোর রেখা জড়িয়ে ধরে আছে । রাফায়েল সেটাকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে। রাফায়েল ওটার শক্তি দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গেল । ওটা যে এতো শক্তিশালী যে হবে রাফায়েল সেটা ভাবে নি । আলোর রেখাটা আরও আষ্ঠে পিষ্ঠে সেটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার যেন ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেটা । সেই সাথে ভয়ংকর আওয়াজ করে চলেছে । চারিদিকে যেন ঝড় বয়ে চলেছে । তখনই রাফায়েল অনুভব করল যে ওটার শক্তি কমে আসছে যেন । বুঝতে পারল যে কবরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওরা । এখন শক্তি কমে আসবে ! এবার ওটাকে ওর নির্ধারিত জায়গায় পাঠান যাবে।
আরিয়ানা দেখতে চাইলো না সেই লাশের চেহারা । রাফায়েল ওদের কবরের ভেতরে তাকাতে মানা করেছিল। কেবল বলেছিল করবের ভেতরে যেন এই পেট্রোল ঢেলে দেওয়া হয় ! আরিয়ানা আলো বন্ধ করল। সাজু পুরো পেট্রলের ক্যানটা খালি করে দিল। তারপর দিয়াশলাইয়ের আগুন সেখানে ফেলেই দূরে সরে এল । দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন । সেই সাথে বিশ্রি মাংস পোড়া গন্ধে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । আরিয়ানার পেট আর সহ্য করতে পারল না । সে বমি করে দিল । মাটিতে বসে রইল বেশ কিছুটা সময়ে । আবহাওয়া একেবারে শান্ত হয়ে গেছে হঠাৎ করেই । একটু আগের অবস্থা যেন কোন দিন ছিলই না।
আবার যখন আরিয়ানা আর সাজু আগের স্থানে ফিরে এসেছে তখন রাফায়েলকে দেখল শান্ত হয়ে বসে থাকতে। সব কিছু যেন শান্ত হয়ে গেছে । আরিয়ানা ভয়ে ভয়ে বলল, সেটা কোথায়?
-যেখানে থাকার কথা ।
-আর কোন ভয় নেই, না?
-আপাতত না।
সাজু এগিয়ে এসে বলল, আরেকটা ঐটা বের করতে পারবেন?
-কোনটা?
-ঐযে আলো বের হল আপনার হাত থেকে !
-কী বলছো এসব ? চোখে নিশ্চিত ভুল দেখছো ! চল চল রাত হয়েছে অনেক ! তোমাদের ক্ষুধা লাগে নি! আমার তো অনেক ক্ষুধা লেগেছে ! আজকে বেশ জম্পেশ একটা খানা দিতে হবে এখন !
প্রাচীন পাপকে পেছনে ফেলে ওরা তিন জন এগিয়ে চলে গ্রামের দিকে ।