মিমির মেজাজটা সকাল থেকে খারাপ হয়ে আছে । মিমি নিশ্চিত জানে জয়িতা খুনের পেছনে তার স্বামী রাকিবের হাত আছে কিন্তু মিমির হাতে কোন প্রমাণ নেই । ইনভেস্টিগেশনে উঠে এসেছে যে জয়িতা এক্সিডেন্ট করেই মারা গেছে । কোন সন্দেহ নেই । এক্সিডেন্টের সাথেও দুর দুরান্তে স্বামী রাকিবের কো যোগ সুত্র নেই । তবুও মিমি জানে যে এটা কোন ভাবেই স্বাভাবিক মৃত্যু নয় । কেন একজন মানুষ রাত তিনটায় বাসা থেকে বের হয়ে সোজা গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিবে? কোন কারণ কি আছে ?
মিমির গাটস ফিলিং এটা বলছে যে এই মৃত্যুর পেছনে অন্য কোন কারণ রয়েছে । সন্দেহ হওয়ার সব থেকে বড় কারণ হচ্ছে রাকিব হাসানের আগের বউটারও ঠিক একই ভাবে মৃত্যু হয়েছিলো । এই নিয়ে একটা কেসও হয়েছিলো । সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে ছিল । তারপর হঠাৎ একদিন মাথা খারাপ হয়ে গেল। ছাদ থেকে সোজা লাফ দিয়ে পড়লো পাশের জলাশয়ে । রাকিব তখন ব্যবসার কাছে সিলেট গিয়েছিলো । তাকে কোন ভাবেই মৃত্যুর সাথে সংযোগ করা যায় নি ।
সব কিছু পরিস্কার থাকা স্বত্ত্বেও মিমির মনের সন্দেহ কোন ভাবেই দুর হচ্ছে না । তার কেবল মনে হচ্ছে এর পেছনে কোন না কোন ব্যাপার আছেই । থাকতে বাধ্য ! কিন্তু কী সেই ব্যাপার সেটা সে কোন ভাবেই বের করতে পারছে না । এই কারণেই মেজাজটা আরও বেশি খারাপ হচ্ছে ।
সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে বের হয়ে পাশের ক্যান্টিনে চা খেতে গেল । আজকের মত তার ডিউটি শেষ । বাসায় যাওয়ার আগে এখান থেকে এক কাপ চা খাওয়ার অভ্যাস তার প্রতিদিনের । ক্যান্টিনটা ডিবির পাশে হলেও এখানে বাইরে থেকে অনেক মানুষ আসে চা খেতে । বিশেষ করে পাশেই বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা অফিস আছে । সেখানকার লোকজন আছে । তাছাড়া ডিবিতে সারা দিন নানান লোকজন আসতেই আছে । সেই কারণে সব সময় লোকে ভরেই থাকে । আজও বেশ কিছু লোকজন বসে আছে । কোন টেবিলই ফাঁকা নেই । মিমি এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিলে দেখতে পেল একজন বসে আছে চুপচাপ । সেই টেবিলের উল্টো দিকে গিয়ে বসলো । মিমি বসতে না বসতেই টেবিলে দুই কাপ এসে হাজির । কাপ দুটোই সামনে বসা মানুষটার সামনে রেখে ওয়েটার চলে গেল ।
মিমি একটু অবাক হল । কারণ একই সাথে কেউ দুই কাপ অর্ডার দেয় না । এক কাপ খেয়ে আরেক কাপ অর্ডার দেয় । সামনে কালো শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা মানুষটা মন দিয়ে একটা বই পড়ছিল । বইটার থেকে চোখ তুলে তাকালো মিমির দিকে । চেহারাটা পরিস্কার দেখতে পেল সে । একটা ধাক্কার মত খেল সে । এতো তীক্ষ্ণ চোখ ছেলেটার যে বুকের ভেতরে গিয়ে বাঁধে ! মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । ওর দিকে তাকিয়ে মানুষটা বলল, একটা কাপ আপনার জন্য!
এই বলে সে চায়ের কাপটা মিমির দিকে বাড়িয়ে দিল।
মিমি সত্যিই অবাক না হয়ে পারলো না । মানুষটা কিভাবে জানলো যে মিমি এখন এখানে এসে ক্যান্টিনে বসে চা খেতে চাইবে । আর ঠিক এই সময়েই অর্ডার দিয়ে দিল । কাকতালীয় ব্যাপার ?
মিমির মনের কথা যেন বুঝে ফেলে সামনে বসা মানুষটা বলল, এতো কেন ভাবছেন? সিম্পল চা এক কাপ । খেয়ে নিন । আপনাদের ই তো ক্যান্টিন । প্রতিদিনই তো আসেন এখানে ।
মিমি জানে যে চায়ে কিছু দেওয়া থাকবে না । ক্যান্টিনটা পুলিশের লোকজনই চালায় । ওকে চেনে খুব ভাল ভাবেই । মিমি চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে বলল, কে আপনি?
-আমি কেউ না । পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হল যে এক কাপ চা খেয়ে যাই ।
-আচ্ছা, তা আপনি সব মেয়েদেরই কি এভাবে চা অফার করেন?
ছেলেটা হাসলো । অদ্ভুত সেই হাসি দেখে মিমি কিছু সময় কেমন যেন অনুভব করলো। ডিবিতে থাকার দরুন অনেক ধরনের মানুষের সাথে তার ওঠাবসা । মানুষের দিকে তাকিয়েই সে অনেক কিছু বলে দিতে পারে । তাদের কথা বলার ভঙ্গি, আচরন হাত পা নাড়ানো সব কিছুর দিকে সে খেয়াল করে । কিন্তু সামনে বসা এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে সে কিছুই বুঝতে পারছে না যেন । অবশ্য এতো চিন্তাই বা কেন করছে !
ছেলেটা বলল, আমি নোভার পরিচিত । নোভা কাল আমাকে ফোন করে বলেছিলো যে আপনি নাকি কোন একটা ব্যাপার নিয়ে খানিকটা চিন্তিত ।
এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বসলো মিমি । নোভা ওর কাছের বন্ধু । দুজন এক সাথেই বিসিএস দিয়ে ঢুকেছে পুলিশে । ট্রেনিংও একই সাথে হয়েছে । পরে সে গিয়েছে এসএসফে আর মিমি এসেছে পুলিশের ডিবিতে । কদিন দুদিন আগে নোভার সাথে জয়িতার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করেছিলো । নোভা তখন ওকে বলেছিলো যে ওর পরিচিত একজন আছে যে তাকে সাহায্য করতে পারবে । খুব অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার হলে সেটা সমাধান কেবল মাত্র এই মানুষটাই করতে পারবে । আর কেউ না ।
মিমি বলল, আপনার নাম রাফায়েল !
রাফায়েল হাসলো । তারপর বলল, আরে আপনি দেখি আমাকে চিনেন !
মিমি একটু শক্ত মুখে বলল, শুনুন আপনি নোভাকে কিভাবে ভুগোল বুঝিয়েছেন আমি জানি না কিন্তু আপনাকে আগেই বলে দিই যে আমি কিন্তু নোভা না
-আরে আমি কখন বললাম যে আপনি নোভা । দেখুন আপনাকে আমি কোন কিছু বিশ্বাস করতে বলছি না । কিছু বিশ্বাস করতেও হবে না । আপনার মত আমিও খানিকটা কৌতুহলী । কিভাবে দুজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হঠাৎ করে পাগল হয়ে গেল এবং আত্মহত্যা করলো । স্বাভাবিক মানুষ কিন্তু এমন কাজ করে না । যদি না ….
-যদি না তাদের উপর ভুত এসে ভর করে ….
কথাটা মিমি বলল খানিকটা ব্যাঙ্গ সুরে । তবে সামনে বসা রাফায়েল নামের মানুষটা এটা নিয়ে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ করলো না । চায়ে আরেকটা চুমুক দিতে দিতে মিমির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন আপনার মনে একটা সন্দেহ এসেছে । আমার মনেও । চাইলে আমরা একে অন্যকে সাহায্য করতে পারি । না চাইলেও কোন সমস্যা নেই । আমি আমার মত করে খুজে বের করবো । একটু হয়তো দেরি হবে এই যা । স্বাভাবিক ব্যাপার হলে আপনিও হয়তো খুজে বের করে ফেলবেন । কিন্তু …
-কিন্তু ..?
-কিন্তু যদি ব্যাপারটা স্বাভাবিক না হয় তাহলে আপনি কোন দিন এটার সমাধান করতে পারবেন না । আমার কিংবা আমার মত কারোর সাহায্য আপনার লাগবেই ।
-আচ্ছা …?
-জ্বী ! আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে রাকিব হাসান আবারও বিয়ে করবে এবং সেও একই ভাবে মারা যাবে …. কেন বললাম এই তো ভাবছেন ? আমি জানি যে আপনাদের কাছে এই তথ্য আছে যে রাকিব হাসানের দুজন স্ত্রী মারা গেছে । কিন্তু আগে সে আরও একটা বিয়ে করেছিলো । এবং সেও অস্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে !
এবার মিমি একটু নড়েচড়েই বসলো । এই তথ্য ওর কাছে নেই । তাহলে সামনে বসে এই মানুষটা কিভাবে জানতে পারলো ? নাকি ব্লাফ দিচ্ছে ?
-না, আমি ব্লাফ দিচ্ছি না ।
-তাহলে কিভাবে জানেন এই তথ্য?
-বললে বিশ্বাস করবেন না । তাই বলে লাভ নেই । আপনি নিজে খুজে বের করুন । আপনাকে সাহায্য করছি । মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান নামের মনু মেম্বারের বাসায় গিয়ে হাজির হবেন । সেখানে রাকিব সাহেব ব্যাপারে খোজ খবর করবেন । ঠিক আছে কি ! তারপর আপনার যদি ইচ্ছে হয় আমার সাথে যোগাযোগ করবেন । আমি আপনাকে আর বিরক্ত করবো না । ও হ্যা আরেক টা কথা । সেটা হচ্ছে আমার কাছে যদি আসার পরিকল্পনা করে থাকেন তাহলে একটা তথ্য বের করবেন । সেটা হচ্চে রাকিব সাহেবের দুই স্ত্রীর মৃত্যুর আগে কোন ভাবে তার কাছে বড় পরিমানের টাকা এসেছিলো কিনা ! ঠিক আছে ! আজকে আসি !
মিমি কে খানিকটা অবাক করে দিয়ে রাফায়েল উঠে দাড়ালো । সোজা হাটা দিলো দরজার দিকে । মিমি কোন কথা বলল না কিংবা বলতে পারলো না । একটু যে অবাক হয় নি সেটা সে বলবে না । রাফায়েল নামের মানুষটা যে রহস্যময় সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । তবে সে ঠিক করলো যে সিরাজদিখানে সে খোজ পাঠাবে । সত্যটা সে একবার যাচাই করতে চায় । সেটা করতে তো সমস্যা নেই ।
দুই
খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে মিমি বসে আছে নিজের অফিসে । রাফায়েল নামের মানুষটা ওকে খানিকটা ধন্ধে ফেলে দিয়েছে । রাকিবের সম্পর্কে সে জানে তার থেকেও বেশি কিছু জানে রাফায়েল নামের এই মানুষ টা । কিভাবে জানে সে ? কিভাবে বের করলো ?
নোভা রাফায়েল নামের মানুষটার অনেক প্রশংসা করেছিলো । নোভাকে সে অনেক দিন থেকে চিনে । সে এমনি এমনি কারো প্রশংসা করার মানুষ নয় । তাহলে সে যা বলেছে সে সব সত্যি ?
নাহ ! চিন্তাটা আবার মাথা থেকে বের করে দিল ! এর ভেতরে বাস্তব কিছু আছে ! থাকতে বাধ্য !
হতে পারে রাফায়েল নামের মানুষ খুব ভাল একজন ডিকেকটিভ ! পুলিশের থেকে ভালভাবে খোজ খবর সে বের করতে পেরেছে ! পারতেই পারে ! এর ভেতরে অস্বাভাবিক কিছু নেই ।
-ম্যাম !
নিজের চিন্তা থেকে খানিকটা সরে এল । তাকিয়ে দেখলো কনস্টেবল হামিদ দাড়িয়ে সামনে ।
-কি ব্যাপার হামিদ !
-একজন মানুষ এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে ! বলেছে আপনি নাকি তাকে আসতে বলেছেন !
মিমি বলতেই যাচ্ছিলো যে ও কাউকে আসতে বলে নি কিন্তু মাঝ পথেই আটকে গেল । কারণ সে বুঝতে পেরেছে কে এসেছে ! ঠিক সাতদিন পর মিমি জানতে পেরেছে রাকিবের ব্যাপারে । আজই সব খবর তার হাতে এসেছে ! রাকিবের সত্যই আরেকটা বউ ছিল সিরাজদিখানে । সেই বউটাও অদ্ভুত ভাবেই অপঘাতে মারা পড়েছিলো । রাতের বেলা পুকুরে ডুবে । রাকিব সেদিন ঢাকাতে এসেছিলো একটা কাজে । তাই বউয়ের এই অপঘাতে মৃত্যূর কোন সন্দেহ তার উপরে পড়ে নি । সবাই ভেবে নিয়েছিলো যে কোন কারণে সে রাতের বেলা পুকুর পাড়ে এসেছিলো এবং পানিতে পড়ে মারা গেছে । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মেয়েটি সাতার জানতো । তাহলে পানিতে ডুবে কিভাবে মরলো সেই প্রশ্নের কোন ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারে নি । পুলিশ কিছুদিন খোজ খবর করে ছেড়ে দিয়েছিলো ।
মিমি বলল, নিয়ে আসুক তাকে !
মিমির মনে হল যে একটু পরে যে এসে হাজির হবে সে কোন ভাবেই রাফায়েল নামের মানুষটি নয় । তবে সেটা হল না । দরজা ঠেলে রাফায়েলই ভেতরে ঢুকলো । ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো । তারপর সোজা এসে ওর সামনে বসে পড়লো । তারপর বলল,
-খোজ পেয়েছেন নিশ্চয়ই !
-যে প্রশ্নের উত্তর আপনি জানেন সেটা কেন করছেন ?
রাফায়েল হাসলো । মিমি এই হাসি দেখতে একটু নরম হল । রাফায়েলের চোখ তীক্ষ্ণ হলেও মুখের হাসিটা সুন্দর । মেয়েদের ঘায়েল করা হাসি । রাফায়েল বলল, আপনি তো আবার কোন কিছু বিশ্বাস করেন না । তাই আমার জানার কথা না হিসাব মত ।
-আপনি জানেন তবে এর ভেতরে অস্বাভাবিক কিছু নেই । হয়তো আপনার নেটওয়ার্ক ভাল ।
-পুলিশের থেকেও ?
মিমি একটু থামলো । যে যত যাই কিছু বলুক না কেন এদেশে পুলিশের থেকে ভাল নেটওয়ার্ক আর কারো নেই । পুলিশ যদি ইচ্ছে করে তাহলে যে কাউকে খুজে বের করতে পারে । আর পুলিশ খুজে বের করতে না পারা মানে হচ্ছে কেউ বের করতে পারবে না ।
মিমি বলল, এ থেকে কী প্রমাণ হয় বলুন ?
রাফায়েল কিছু সময় তাকিয়ে রইলো মিমির দিকে । তারপর বলল, দেখুন আমি জানি যে রাকিবকে আপনারা ধরতে পারবেন না । অর্থ্যাৎ কোন ভাবেই তার বউয়ের মৃত্যুর সাথে তাকে সংযুক্ত করতে পারবেন না ।
-তাহলে ? মানে সে কিছু করে নি !
-আমি সেই কথা বলি নি । বলেছি যে আপনারা কানেক্ট করতে পারবেন না । হয়তো মেরে তক্তা করে কিছু স্বীকার করাতে পারবেন কিন্তু আদালতে সে সব টিকবে না । ডিফেন্স লইয়ার এক চুটকিতে সব কিচু উড়িয়ে দিবে ।
-আচ্ছা আমি আগে শুনি কি হয়েছে ? না শুনলে কিভাবে বুঝবো?
-বিশ্বাস করবেন না ।
-না করি । ধরুন গল্প শুনছি আপনার কাছ থেকে ।
-কাজের সময়ে কি গল্প শোনা ঠিক হবে । তাই আবার অফিসে বসে !
মিমি কি যেন ভাবলো । তারপর বলল, আচ্ছা চলুন । বাইরে যাওয়া যাক । সামনে রমনা পার্ক আছে । ওখানে আমি মাঝে মাঝে গিয়ে বসি ।
রাফায়েল বলল, তার চেয়ে বরং আপনাদের এই মিন্টুরোডে গিয়ে বসি । আমার একজন পছন্দের লেখক আছে । ছেলে মানুষী ধরণের লেখক । তার লেখাতে প্রায়ই সে মিন্টু রোডের কথা বলে । প্রেমিকার সাথে মিন্টু রোডে হাটে । বৃষ্টিতে ভিজে !
মিমির কেন জানি খুব মজা লাগলো । খানিকটা হেসে বলল, আপনি দেখি আসলেই মজার মানুষ । ভুতের ওঝারাও গল্প পড়ে !
রাফায়েল শব্দ করে হেসে উঠলো ।
তিন
সত্যি বলতে মিমির এই রাস্তার পাশে ফুটপাথের উপরে বসে চা খেতে মোটেও খারাপ লাগছে না । ডিবিতে সে পোস্টিং হয়ে এসেছে প্রায় চার বছরের বেশি । এই সময়ের ভেতরে সে অফিসের বাইরে ক্যান্টিনে গিয়ে চা খেয়েছে কেবল । আর বেশি কিছু করে নি । কিন্তু বাইরেই যে এতো চমৎকার একটা পরিবেশ রয়েছে সেটা তো আগে কখনও খেয়াল করে নি । ক্যান্টিন থেকে চা আনিয়েছে । তারপর দুজন চুপচাপ বসে চা খাচ্ছে এখানে । মাঝে মাঝে গাড়ি হুস হাস করে চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে ।
মিমি বলল, তো আপানর গল্প শুরু করুন !
চায়ে একটা বড় চুমুক দিয়ে রাফায়েল বলল, আপনি ব্যাংক থেকে যখন লোন নিতে যান তখন আপনাকে কী করতে হয়?
-কি করতে হবে? ব্যাংকে যেতে হয় ! ফরম ফিল আপ করতে হয় । তারপর কিছু সম্পদ গচ্ছিত রাখতে হয় !
উত্তর শুনে হাসলো রাফায়েল । যেন কাঙ্খিত উত্তরটা সে পেয়েছে । তারপর বলল, অনেকটা সেই রকমই হয়েছে এখানে । আমাদের রাকিব সাহেবও টাকা নিয়েছে কিছু বন্দক রেখে । তারপর যখন টাকা ফেরৎ দেন নি তখন যে টাকা দিয়েছে সে বন্দকী জিনিস পত্র নিয়ে গেছে ।
মিমি কিছু সময় চেয়ে রইলো রাফায়েলের দিকে । পুরো ব্যাপারটা ধরতে ওর কিছুটা সময় লাগলো । তারপর বলল, তার মানে আপনি বলতে চান যে রাকিব সাহেব তার স্ত্রীদের বন্ধক রেখেছিলো ?
-অনেকটা সেই রকমই ।
-তারপর?
-গল্প হিসাবে শুনুন । আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে না । সিরাজদিখানের বসুলপুর নামে একটা গ্রাম আছে । অনেকটা ভেতরে । বেশির এলাকাই পানির নিচে । কেবল শীত কালে খানিকটা পানি কমলে সেখানে একটা একটা স্থান জেগে ওঠে । সারা বছর পানির নিচে থাকে বলে এখানে লোকজন নেই বললেই চলে । বনজঙ্গলে ছেয়ে আছে সব স্থানে । যখন পানি কমে আসে তখন একটু যাওয়ার পথ আসে । সেই পথ দিয়ে একটা সময় পর্যন্ত হাটলে একটা উচু মন্দির পাওয়া যায় । সেই মন্দিরে একটা ভয়ংকর দর্শন মূর্তি আছে । মুঠক দেবী । সেই দেবীর জন্য একজন পুরোহিত সেখানে থাকে । সারা বছরই সেখানে থাকে সে । যখন পানি ওঠে তখন পুরো এলাকা বন্ধ হয়ে যায় পানিতে তখনও সে কোন ভাবেই মন্দির ছেড়ে বের হয় না।
মিমি মনযোগ দিয়ে শুনছিলো । শুনতে তার মোটেও খারাপ লাগছিলো না । রাফায়েল আবারও বলে চলল, এই মুঠক দেবীর কাছে মানুষ যায় টাকার জন্য । ব্যাংক লোক বলতে পারেন । সেই মন্দিরে যায় । নিজেদের চাহিদার কথা বলে এবং সেই অনুপাতে জিনিস পত্র বন্ধক রাখে ।
-জিনিস পত্র বলতে ?
-এখানে বন্ধকী জিনিস হিসাবে কেবল মাত্র নিজেদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ ! এমন কি সেটা নিজের জীবন ! এবং সেই সাথে প্রিয় মানুষের জীবনও রাখা যায় । প্রিয় মানুষ বলতে ঠিক বন্ধু হলে চলবে না । স্বামী কিংবা স্ত্রী, ছেলে মেয়ে মা বাবা ইত্যাদি ।
-এরপর ?
-যদি টাকা সময় মত আপনি ফেরৎ দেন তাহলে কোন সমস্যা নেই কিন্তু যদি দিতে না পারে তাহলে ঠিক ঠিক মুঠক দেবী আপনার কাছে আসবে আর তার জিনিস নিয়ে যাবে ।
-ওকে গল্প বুঝলাম । এখন রাকিবের ব্যাপারটা বলুন ।
-তার খোজ খবর নিয়ে আমি যা জেনেছি তা হচ্ছে সে এতিম । বাবা মা নেই । আমেনা মানে তার প্রথম স্ত্রীর বাবার বাড়িতে কাজ জাইগির থেকে পড়তো । সেখানে আমেনা সাথে পরিচয় তারপর বিয়ে । তবে এক সময়ে আমেনার বাবা আলুর গুদাবে আগুন লেগে গিয়ে অবস্থা পড়ে যায় । ঘর জামাইয়ের অবস্থাও তাই ভাল থাকার কথা না । তারপরই শ্বশুরের কাছে কিছু টাকা চেয়েছিলো ব্যবসার জন্য । শ্বশুর মশাই সাফ মানা করে দেয় । তখনই সে মুঠক দেবীর খোজ পায় সে । সেখানে গিয়ে টাকা মানত করে । বন্ধকী হিসাবে নিজের একটা তর্জনী রাখে । খুব একটা আশা যে ছিল সেটা কিন্তু না । কিন্তু কথা মত পরদিন রাতের বেলা বাইরে বের হয়ে যখন সে টাকা ভর্তি থলেটা পায় তখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় । একেবারে দুই লক্ষ টাকা । টাকায় কোন ভেজাল নেই ।
সেই টাকা নিয়ে সে ব্যবসায় নামলো এবং লস খেল । টাকা সে ফেরৎ দিতে পারলো না । ভেবেছিলো যে কিছু হবে না । কিন্তু নির্ধারিত দিনে ঠিকই মুঠক দেবী এসে হাজির হল এবং রাকিবের তর্জনি নিয়ে চলে গেল ।
মিমি এতো তন্ময় হয়ে শুনছিলো যে আপনা আপনিই বলে উঠলো তারপর?
-তারপর আর কি ! সাহস হয়ে গেল ওর । সে আবার গেল মন্দিরে । এবং এবার বন্ধক রাখলো নিজের স্ত্রীকে । পরদিন উঠোনে সে ৫০ লাখ টাকা ভর্তি ব্যাগ পেল । ব্যাগটা নিয়ে সে যত্ন করে রেখে দিল আলমারিতে । পরবর্তি সময়ে সে টাকা ফেরৎ দেওয়ার কোন চেষ্টাই করলো না । সময় পার হওয়ার ঠিক দুইদিন আগে সে কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হল টাকার ব্যাগ নিয়ে । ঢাকায় এসে হাজির হল । আর গেল না বাসায় । এরপরের খবর আপানারা জানেন । ঢাকাতে এসে একটা ফ্ল্যাট কিনলো । সেখানেই থাকা শুরু করলো কিন্তু কিছু না করার জন্য টাকা শেষ হয়ে আসছিলো দ্রুত । বিয়ে করলো আবার । আবারও বন্ধক আর আবারও টাকা !
মিমি কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনার গল্পটা ভাল । আপনি চাইলে আপনার ঐ কি না জানি লেখক আছে অপু না কি তানভীর তার মত লেখক হয়ে যেতে পারেন । বুঝেছেন !
রাফায়েল হাসলো । তারপর বলল, হ্যা ভাবছি ! শেষ জীবনে এমন কাজই করবো । একটা বই বের করলো ।
সাথে সাথেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল । তারপর বলল, তবে রাকিব সাহেব আবারও বিয়ে করবে এবং আবারও সে একই কাজ করবে ! আবারও একটা মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যাবে !
মিমি কিছু বলতে গিয়েও বলল না । কিছু সময় দুজনই চুপ করে রইলো । তারপর মিমি বলল, আপনি কোন ভাবে এটা ঠেকাতে পারেন না । আইমিন সেই মুঠোক দেবীকে !
-দেখুন সে দেবী ! তার ক্ষমতা অনেক । সে তো ইচ্ছে করে কিছু করছে না । মানুষ যাচ্ছে তার কাছে মানত করছে নিজ ইচ্ছেতে সব কিছু রেখে আসছে তারপরেই না সব হচ্ছে । আমাদের দেশের ব্যাংক গুলো কি করে ? আপনি যদি ব্যাংকের টাকা ফেরৎ না দেন তাহলে ব্যাংকের লোকজন কি ছেড়ে দিবে ! এটা সিম্পল একটা ব্যাপার !
চার
তারপর প্রায় চার মাস কেটে গেছে । রাফায়েলের সাথে মিমির আর দেখা হয় নি । তবে মিমি ব্যাপারটা ভুলে যায় নি । রাকিব সাহেব ঠিক তিন মাস পরে যখন বিয়ে করলো তখনই মিমি একটু নড়ে চড়ে বসলো । সে ঠিক ঠিকই তার উপরে নজর রেখে ছিলো । বিয়ের করে মিমি আরও একটু বেশি সতর্ক হয়ে উঠলো ।
নিজের চরদের কেবল বলে রাখলো যে রাকিব যদি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের দিকে যায় তখনই যেন তাকে জানানো হয় ! সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো কিন্তু তারপরেও দেরী হয়ে গেল । যখন মিমির লোকজন তাকে খবর দিলো তখন রাকিব ওদের কাছ থেকে গায়েব হয়ে গেছে । রাকিব ঠিক ঠিক টের পেয়ে গিয়েছিলো যে ওর উপরে নজর রাখা হচ্ছে । তাই সুযোগ পেয়েই সে গায়েব হয়ে গেছে । মিমি তারপরেও শেষ চেষ্টা করার জন্য সেই বসুলপুরে গিয়ে হাজির হল । সেখান থেকে নৌকা নিয়ে অনেক খুজে যখন সেই মন্দিরে গিয়ে হাজির হল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । ভয়াল দর্শন সেই মন্দিরে দাড়াতেই বুকের মাঝে একটা ভয় মিশ্রিত অনুভূতি এসে জড় হল । নৌকা থেকে সিড়িতে পা রাখতেই খেয়াল করলো সে সিড়ির একেবারে মাথায় কালো কাপড়ের লুঙ্গি টাইপের কিছু একটা পরা এক লোক দাড়িয়ে আছে । খালি শরীর । একটা চোখ ঘোলা । দেখেই বোঝা যায় সেটা নষ্ট ! চেহারা দেখলেই ভয় লাগে অথচ তার কন্ঠটা মিমিকে অবাক করলো । ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কী চাই তোমার মা?
মিমি সামলে নিয়ে বলল, আমি একজনকে খুজতে এসেছি ।
-সে চলে গেছে !
-চলে গেছে ?
-হ্যা ।
-যে জন্য এসেছিলো?
-সে নিয়েই চলে গেছে !
-আপনি জানেন সে কি করেছে?
-জানি !
-জানেন? তারপরেও তাকে বাঁধা দেন নি ?
-আমার বাঁধা দেওয়ার অনুমূতি নেই মা ! আমি কেবল এখানে আছি দেবীর দর্শনার্থীদের সাহায্য করার জন্য । বাঁধা দেওয়ার জন্য না ।
মিমির হঠাৎ খুব অসহায় লাগলো । নৌকার মাঝি ওর দিকে খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে । নৌকাতে আরও দুজন স্থানীয় পুলিশ রয়েছে । তারা কেউ নামে নি নৌকা থেকে । তারা এই স্থান সম্পর্কে জানে ভাল করেই । মিমির মনে হল যে এখানে আর থেকে লাভ নেই । চলে যাওয়াই ভাল । নৌকাতে উঠতে যাবে তখন পেছন থেকে সেই লোকটা বলল, সব অন্যায়ের শেষ আছে । এটারও আছে । প্রতিবার সে সফল হবে না । জেনে রেখো আর বিশ্বাস রেখো !
মিমি যখন ঢাকায় ফিলো তখন রাত সাড়ে নয়টা । রাকিবের উপরে সে প্রচন্ড রেখে আছে । মনে মনে ঠিক করেই নিল যে কাল সে রাকিবকে তুলে আনবে । তারপর তাকে যে কোন মামলাতে আটকাবে । আজকে রাতে তার টাকা পাওয়ার কথা । পুরো টাকা সে ফেরৎ দেওয়ার ব্যবস্থা করবে । যাতে তার স্ত্রীকে মরতে না হয় !
কিন্তু সকালে সে জানতে পারলো যে রাকিব তার ফ্ল্যাটে ফিরে নি । এমন কি সেখানে তার স্ত্রীও নেই । তাদের চোখ কেবল রাকিবের দিকে ছিল । তার স্ত্রীর দিকে কোন খোজ রাখা হয় নি ! সন্ধ্যা বেলা যখন আরও খোজ নেওয়া গেল তখন জানা গেল যে রাকিব ফ্লাট বিক্রি করে দিয়েছে বেশ কয়েকদিন আগেই । কোথায় গেছে কেউ জানে না !
মিমির মনের ভেতরে কেমন যেন একটা হতাশা কাজ করলো । রাকিবের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের প্রমান তার কাছে নেই । এতোদিন সে যা করেছেন নিজ উদ্যোগে করেছে । কিন্তু এখন যদি দেশ ব্যাপি তার খোজ খবর করতে চায় তাহলে তার উপরওয়ালা সেটার কারণ জানতে চাইবে । এদিকে কেস বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই ।
এভাবে কেটে গেল আরও দুটো মাস ! ঠিক তারপরই হঠাৎ করে আবারও রাকিবের খোজ পাওয়া গেল । অন্য একজন আসামী ধরতে গিয়ে রাকিবকে আবিস্কার করে সে । রায়েরবাগের একটা বাসায় অভিযান চালানোর সময় রাকিবকে খুজে পাওয়া যায় ! খানিকটা নিয়ম ভেঙ্গেই তাকে ধরে নিয়ে আসে মিমি । জিজ্ঞাসাবাদে যখন জানতে চাওয়া হয় যে তার স্ত্রী কোথায় ? তখন রাকিব হো হো করে হেসে ওঠে । জানায় যে কদিনের জন্য সে গেছে তার বাপের বাসায় !
তারপরই মিমি কথাটা জানতে চাইলো । বলল, সময় কয় দিন আছে?
অদ্ভুত সেই হাসিটা তখনও লেগে আছে রাকিবের মুখে । সে বলল, লাভ নেই কোন । আপনি কোন ভাবেই তাকে বাঁচাতে পারবেন না ।
কষে একটা চড় মারলো রাকিবের মুখে । তারপর জিজ্ঞেস করলো, কয়দিন আছে ?
-আজ রাত !
মিমি রাকিবের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বের হয়ে এল থানা থেকে । মেয়েটা মানিকগঞ্জ আছে ! কিন্তু সেখানে গিয়ে সে কি করবে? মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবে? আর এমন সময় সেই রাফায়েল নামের মানুষটা কোথায়?
আর কোন খোজ খবর সে করে নি !
মিমি নোভাকে ফোন দিলো । সব কিছু জানিয়ে রাফায়েলের খোজ করতেই নোভা বলল, টেনশন নিস না । ঠিক সময়ে সে হাজির হয়ে যাবে ।
-তুই এতো নিশ্চিত ভাবে কিভাবে জানিস?
-আমি নিশ্চিত করে কিছুই জানি না । কেবল জানি যে সে হাজির হয়ে যাবে ।
মিমি আর কিছু জানতে চাইলো না । তার গাড়ি তখন ছুটে চলেছে মানিকগঞ্জের দিকে । মেয়েটা যে মারা যাবে আজকে রাতে এই তথ্যের কোন প্রমাণ নেই । যখন প্রথম রাফায়েল তাকে বলেছিলো ব্যাপারটা তখন সত্যিই সে বিশ্বাস করে নি । কিন্তু এখন সে বিশ্বাস করে সব কিছু । কেন বিশ্বাস করে সেটা সে জানে না । কেবল জানে যে এটা হতে চলেছে । মিমি যে যাচ্ছে মেয়েটাকে রক্ষা করতে, কিভাবে সে রক্ষা করবে সেটা সে জানে না । তবুও সে যাচ্ছে !
নির্দিষ্ট বাড়িটা খুজে বের করতে খুব একটা কষ্ট হল না । বাড়ির অবস্থা দেখে মনে হল যে খুবই করুণ অবস্থা । গ্রামের এক কোনে ছোট একটা টিনের বাড়ি । বাড়ির সামনে আরও ছোট একটা উঠোন । ভেতরে প্রবেশ করতেই বুঝতে পারলো যে বাড়ির পরিবেশ খানিকটা অস্বাভাবিক । উঠোনে কয়েকজন লোক দাড়িয়ে রয়েছে । তাদের ভেতরে একজন মওলানা গোছের মানুষও আছে । মিমিকে উঠনে প্রবেশ করতে দেখে সবাই একটু যেন নড়ে চড়ে বসলো ।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পরে মাওলানা এগিয়ে এসে বলল, জ্বী কাকে চান আপনেরা ?
-এটা রুহীদের বাসা না ?
-জ্বী ।
-সে কোথায় ?
-তারে জ্বীনে পাইছে । ভেতরে চিকিৎসা চলছে । আপনে তারে কিভাবে চিনেন?
মিমি প্রথম কিছু সময় বুঝতে পারলো না কী বলবে ! উঠোনের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে । উঠোনে আর একটা মেয়ে মানুষও নেই । তবে ঘরের ভেতরে দরজা দিয়ে একটা মেয়েকে উকি দিতে দেখা যাচ্ছে । মিমির পুরো পরিবেশটা বুঝতে একটু সময় লাগলো । ওকে এখানে কেউ ঠিক পছন্দ না করাই কথা । সাধারণ গ্রামের পরিবেশে মেয়েদের এভাবে পুরুষদের সামনে এসে কথা বলা টা অনেকেই স্বাভাবিক ভাবে নেয় না । আর মিমি বর্তমানে একটা জিন্স আর শার্ট পরে আছে । এই পোপাশে পছন্দ না করারই কথা । নেহৎ ওর পেছনে পুলিশের দুজন লোক দাড়িয়ে আছে বলে ওরা কেউ কোন কথা বলছে না ।
মিমি বলল, আমি রুহীর হাজব্যান্ড মানে রুহীর স্বামীর কাছ থেকে আসছি !
রুহীর স্বামীর নাম বলাতে মিমি দেখতে পেল সবার চোখ মুখের ভাব একটু পরিবর্তন হল । মিমি দেখলো যে ঘরের ভেতর থেকে মাঝ বয়সী এক মহিলা বের হয়ে এল দ্রুত । তারপর অন্য কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মিমির হাত ধরে ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে গেল !
পাঁচ
সময়টা এখন রাত । মিমি আর বাসায় ফিরে যায় নি । রুহীর মা তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসার পরে অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে । গত একসপ্তাহ ধরে রুহীর সাথে যা ঘটছে তার একটা সারমর্ম মিমির সামনে এসেছে । সপ্তাহ খানেক আগে হঠাৎ করে রাকিব রুহীকে তার মায়ের কাছে রেখে যায় । হাতে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বলে যে সে এক মাসের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে । ফিরে এসে তাকে নিয়ে যাবে । প্রথম দুইদিন সব ভালই ছিল কিন্তু তিন নম্বর দিনে রুহী রাতের বেলা হঠাৎ ভয় পেয়ে ওঠে । চিৎকার করে বলে যে ওর রুমে কেউ দাড়িয়ে আছে । রুহীর মার মায়ের মনে হয় যে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে । কিন্তু দ্বিতীয় দিন যখন একই ভাবে ভয় পায় তখন রুহীর মা একটু চিন্তিত হয়ে ওঠে । তিন নম্বর দিনে রুহীর সাথে সাথে রুহীর মাও জিনিসটাকে দেখতে পায় । ঘরের এক কোনে দাড়িয়ে আছে । বিশাল আকার । একেবারে ছাদ পর্যন্ত চলে গেছে । চারটা হাত । পা দুটো অনেকটা ঘোড়ার পায়ের মত । ঘরে অন্ধকার ছিল না । চাঁদের আলো এসে পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো সব । চোখ দুটো যেন জ্বলছিলো ! রুহী আর রুহীর মা সারারাত ভয়ে জড় সড় হয়ে বসে ছিল বিছানার উপরে । বিশাল সেই অপশরীরি কিন্তু তাদের কাছে আসে নি । এক ভাবেই সে দাড়িয়ে থাকে ঘরের এক কোনে । তবে পরের দিন একই ভাবে তাকে দেখা যায় এবং সে ঘোরের কোন থেকে এগিয়ে আসে রুহীর দিকে ।
মিমি বুঝতে পারছে কী হতে চলেছে । আজকে ঠিক ঠিক সে রুহীর কাছে চলে আসবে । এবং রুহীকে নিয়ে যাবে । কিন্তু সেই কথা তো মিমি এদের বলতে পারছে না । বলতে পারছে না যে তার প্রাণের স্বামী তার জীবনের বিনিময়ে বড় পরিমানের টাকা নিয়েছে ।
মিমির নিজের কাছে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে । কয়েকদিন আগেও সে এসব কিছুই বিশ্বাস করতো না । কিন্তু এখন সে মানসিক ভাবে এক অশরীরি কিংবা এক দেবীর সাথে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ! কী হাস্যকার লাগছে নিজের কাছেই । রাফায়েল নামের মানুষটা ওর মনের উপরে কী পরিমান প্রভাব ফেলেছে সেটা ভাবতেই অবাক লাগছে । অবশ্য নিজেকে বুঝানোর জন্য একটা ব্যাখ্যা সে দাড় করিয়েছে । রাফায়েল বলেছিলো যে বিশ্বাস না করলেও সমস্যা নেই । কিন্তু আরও একটা মেয়ের জীবন যদি বাঁচানো যায় তবে ক্ষতি কী !
ওর কাছে এই রুহীর জীবন বাঁচানোই বড় কথা ! এখানে যে কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটেছে কিংবা ঘটতে চলেছে সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । মিমি খোজ খবর নিয়ে জেনেছে যে আগের তিন জনের বেলাতেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে । প্রথমে তারা কিছু দেখে ভয় পেয়েছে । তারপর ঘর একদিন রাতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে । এবং মারা পড়েছে । এই মেয়েটাও একই ভাবে ভয় পাওয়া শুরু করেছে । এখন আজকে এই মেয়েটাও যদি ঘর থেকে বের হয়ে যায় এবং মারা যায় তাহলে কোন ভাবেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না সে ।
বাইরে বের হয়ে এল সে । সিপাহী দুজন চুপ করে দাড়িয়ে আছে উঠোনের এক কোনে । তার মন ভার । রাতের বেলা এই বাসায় কেন তাদের ডিউটি দিতে হবে সেটা তারা ঠিক বুঝতে পারছে না । বারান্দায় কোনে দুপুরের সেই মৌলবী বসে আছে । তার সাথে আরও কয়েকজন মাদ্রাসার ছাত্র । তারা এক ভাবে তেলওয়াত করে যাচ্ছে ।
মিমি মৌলবীর সামনে গিয়ে বলল, আপনারা তৈরি তো?
মৌলবী মিমির পরিচয় জেনেছে । তাই সে এখন মিমিকে খানিকটা সমীহের চোখে দেখা শুরু করেছে । সে বলল, জ্বে মেডাব । সব তৈরি । আমাদের পার করে কেউ ভেতরে যাইতে পারবে না !
মিমি যদিও খুব একটা আস্বস্ত হল না তবে নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভাল । সে সিপাহী দুইজনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো । তারপর আবারও ভেতরে চলে গেল । শোবার ঘরের রুহী শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে । তার মা চুপচাপ মেয়ের পাশে বসে আছে । মিমি বসলো পাশে রাখা একটা চেয়ারে । রুহীর মা বলল, আফা, আমার মেয়ের কিছু হইবো না তো ?
মিমি ঠিক জানে না সে কী উত্তর দিবে । তবে বলল, আশা তো তাই করি ! তবে রুহীকে ঘরের বাইরে বের হতে দেওয়া যাবে না । ঠিক আছে কী ?
-জ্বে !
-যাই হোক না । মওলানা সাহেব বলেছেন নিজ ঘরের ভেতরে মানুষ সব সময় নিরাপদ থাকে । এর বাইরে গেলেই বিপদ । যত ভয়ই পান না কেন রুহীকে ঘরের ভেতরেই রাখতে হবে । বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না !
তারপর সময় কাটতে লাগলো আস্তে ধীরে । রাতে রুহীর মা সবার জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলো । সবাই ভাল করে খাওয়া দাওয়া করলেও মিমি ঠিক মত খেতে পারলো না । ওর মনের ভেতরে অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা আসছে । ওর মনের ভেতরে কেমন যে কু ডেকে উঠছে । মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা খারাপ ঘটবে। পুলিশ চাকরির সময় ওর এই ইন্দ্রীয়গ্রাহী চিন্তা সব সময় কাজে দিয়েছে । যতবার ওর মনে হয়েছে যে খারাপ কিছু ঘটবে ততবার তাই ঘটেছে । আজও মিমির এমন কিছুই মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে !
নোভা বলেছিলো রাফায়েল ঠিক সময় মত চলে আসবে কিন্তু কোথায় সে ! তার কোন খোজ নেই । সে আজ আর আসবে না। তার তো কোন ভাবেই জানার উপায় নেই যে আজকে এখানে মিমি আছে ! কিংবা এখানে এসব কিছু ঘটবে ! কিন্তু নোভা তাকে এমন ভাবে কথাটা বলেছিলো যেন নোভা কতটা তীব্র ভাবেই না ব্যাপারটা বিশ্বাস করে । সেই বিশ্বাসের খানিকটা সঞ্চারিত হয়েছিলো মিমির ভেতরেও । তাই সেও হয়তো আশা করেছিলো যে হয়তো রাফায়েল এসে হাজির হবে । কিন্তু সে হয় নি !
ছয়
হঠাৎ একটা চিৎকারে মিমির তন্দ্র ছুটে গেল । সাথে সাথে কোমরের পিস্তলটা হাতে চলে এল । বসে থাকতে থাকতে তখন যে চোখ লেগে এসেছিলো সেটা জানে না । চোখ খুলে কয়েক মুহুর্ত লাগলো সব বাস্তবে ফিরে আসতে । রুহী আরেকবার চিৎকার দিল আর তখনই মিমি দেখতে পেল সেটাকে !
ঘরের আলো জ্বালানোই ছিল । কোন কারণে সেটা নিভে গেছে । তবে ঘর অন্ধকার হয় নি । চাঁদের আলোতে দেখা যাচ্চে সব কিছু পরিস্কার । সেই আলোতেই মিমি দেখতে পেল সেটা কে !
মুঠোক দেবীকে !
ঘরের সিলিংয়ের সমান উচু প্রায় ! চারটা হাত বড় বড় । লম্বা ঘোড়ার মত পা ! মুখের ভাবটা রাগান্বিত । যেন মুখটা খিচিয়ে আছে সে ! তাকিয়ে আছে রুহীর দিকে । মিমি আর কোন চিন্তা না করেই সরাসরি গুলি চালালো ওটার দিকে । একবার দুইবার তিনবার !
পরপর তিনটা !
কিন্তু ওটা এমন ভাবে দাড়িয়ে রইলো যেন কিছু হয়ই নি ! এমন কি মিমির দিকে ফিরে তাকালো না পর্যন্ত । একভাবে সে তাকিয়ে আছে রুহীর দিকে । তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো ওর দিকে । গুলিতেও যখন কোন কিছু হল না তখন মিমি খানিকোটা বিহবল হয়ে উঠেছিলো । সেটা কাটতেই সে রুহীর সামনে গিয়ে হাজির হল । তারপর এক টানে ওকে নিয়ে ছুট দিল দিলো দরজার দিকে । তখন অনুভব করলো একটা তীব্র আর ভয়ংকর চিৎকার বের হয়ে এসেছে ওটার মুখ দিয়ে । এতো তীব্র আর ভয়ংকর চিৎকার মিমি জীবনে শুনেছে বলে মনে পড়লো না । রুহীকে কোন ভাবেই আর আটকে রাখা গেল না । সে বিছানা ছেড়ে ছুট লাগালো ।
সেই অশরীরি তখনও দাড়িয়ে আছে আগের স্থানে । তবে তার চোখ রুহীর চলে যাওয়ার দিকে । কোন সন্দেহ নেই যে সেও ঠিক তার পেছন পেছনে যাবে ।মিমির সাথে সাথেই মনে পড়লো যে আগের মৃত্যুতেও ঠিক একই ভাবে ভিক্টিম গুলো ঘর থেকে কোন কিছু দেখে ভয় পেয়ে বের হয়ে গেছে এবং কোন জলাশয়ে মৃত অবস্থায় পরে পাওয়া গিয়েছিলো । মিমি আর কোন চিন্তা করলো না। সেই ঠিক রুহীর পেছন পেছন ছুট লাগালো !
দরজা দিয়ে বের হতেই দেখতে পেল দরজার পাশেই মাওয়ালা মশাই দাড়িয়ে আছে । মিমি না দাড়িয়েই বলল ঘরের ভেতরে কিছু আছে । ওটাকে ঘরের ভেতরে আটকাতে পারেন কিনা দেখেন ।
উঠনে নেমেই নিজের সিপাহীদের দিকে তাকিয়ে বলল, দরজা দিয়ে মানুষ ছাড়া যা বের হয়ে তার দিকে গুলি করবে !
সিপাহী দুজনের হাতে বন্দুক আগেই চলে এসেছিলো । তবুও মিমির কথা শুনে ওরা খানিকটা অবাকই হল !
একজনের মুখ দিয়ে বের হয়ে এল, মানুষ ছাড়া মা…..
মিমি আর কিছু শুনতে পেল না । সে তখন বাড়ির বাইরে বের হয়ে এসেছে । ডান দিকে তাকিয়ে দেখলো রুহীকে দেখা যাচ্ছে । অন্ধকারের ভেতরেও তার পাগলের মত দৌড়ানোটা সে পরিস্কার ভাবেই দৌড়াতে দেখতে পেল । আর কোন চিন্তা না করে সেও দৌড়াতে লাগলো । আগে রুহীকে শান্ত করতে হবে । কোন ভাবেই তাকে পানির ভেতরে যেতে দেওয়া যাবে না । রাফায়েল নামের মানুষটা বলেছিলো যে মুঠক দেবী তার শিকারকে পানির ভেতরে টেনে নিয়ে যায় । যদি কোন ভাবে রুহীকে পানির থেকে দুরে রাখা যায় তাহলে কি তাকে রক্ষা যাবে ?
মিমি নিজের চিন্তা ভাবনা দেখে নিজেই খানিটকা অবাক হয়ে গেল । কদিন আগে পর্যন্তও সে এই সবে বিশ্বাস করতো না অথচ এখন সে নিজেই কিভাবে একজন অশরীরি থেকে একজনকে রক্ষা করা যায় সেই চিন্তা করছে ।
কী আশ্চর্য্য !
তখনই পেছন থেকে চিৎকার শোনা গেল । মাওলানার চিৎকার ! সাথেই গুলির আওয়াজ ! মিমি নিজের দৌড়ানোর গতি বাড়িয়ে দিল !
রুহীকে মিমি ধরে ফেলল একটু পরেই । মিমির ট্রেনিং নেওয়া শরীর । দৌড়াতে সে এক্সপার্ট । রুহীর খাপছাড়া দৌড়কে ধরতে পারলো সে । রুহী তখন নিজের ভেতরে নেই যেন । চিৎকার করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলছে । আর অদৃশ্য কোন কিছু থেকে ভয় পাচ্ছে যেন !
মিমির প্রথমে কিছু সময় বেগ পেতে হল রুহীকে সামলাতে । এক সময় মিমি কষে একটা চড় মারলো রুহীর গালে । চড়টা খেয়েই যেন একটু ধাতস্ত হল ! একটু শান্ত হল যেন । মিমির দিকে তাকিয়ে কোন মতে বলল, আপু ওটা আসছে !
-আমি জানি ! আমাদের শান্ত থাকতে হবে । আমাদের পানির কাছ থেকে দুরে যেতে হবে । বুঝেছো !
এই লাইণটা বলতেই রুহী আর মিমির দুজনের চোখ তাদের ডান দিকে চলে গেল । চাঁদের আলোতে ওরা দুইজনই পরিস্কার দেখতে পেল যে ও গ্রামের একটা বড় দীঘির পাশে এসে দাড়িয়েছে । চাঁদের আলো সেই দীঘিতে পড়ে কেমন চিকচিক করছে ।
মিমির মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বের হয়ে গেল শব্দ ”ক্রাপ”
রুহীর হাত ধরে আবার যখন সে বাঁ দিকে দৌড়াতে যাবে তখনই সেই অশরীরিটাকে দেখতে পেল । দ্রুত অন্ধকারের ভেতরে আরও একটা জমাট অন্ধকার যেন ওদের দিকে এগিয়ে আসছে । একেবারে ১০ গজের ভেতরে এসে থামলো ওটা । মিমি বুঝলো যে কোন ভাবেই দৌড়িয়ে পারবে না ওরা ! হাতের বন্ধুক চলে এল সামনে । ওটার দিকে তাক করা ! যদিও জানে যে গুলি করলে হয়তো কিছুই হবে না । তবুও গুলি চালিয়ে দিল সে !
একবার। দুইবার ।
কিন্তু তিনবারের গুলি চলতেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো । মিমি দেখতে পেল গুলির সাথে সাথে একটা আলোচর ঝলকানী এসে লাগলো অশরীরির গাছে । এবং সাথে সাথেই সেটা বেশ খানিকটা পেছনে সরে গেল ।
তারপর আবারও এল আলোর ঝলকানীটা !
সেটা আসছে ওদের ঠিক পেছন থেকেই ।
তখনই সে পেছন থেকে কারো আওয়াজ পেল !
পেছনে তাকিয়েই দেখতে পেল তাকে ।
রাফায়েল ! চাঁদের আলোতে একজন এগিয়ে আছে । নোভা ঠিকই বলেছিলো । ঠিক সময়ে চলে আসবে সে !
ওদের ঠিক পাশে এসে দাড়াতেই মিমি বলল, আপনি মাত্র এলেন ?
রাফায়েল বলল, আমার আরও কাজ থাকে ! আপনাদের মত এতো বড় বাহিনী নেই আমার !
মিমি বলতে যাচ্ছিলো যে একজনের জীবনের থেকে কী এমন জরূরী কাজ কিন্তু বলল না । এখন এই সব প্রশ্ন করার সময় না । তারপরই তীব্র বিস্ময় নিয়ে আবিস্কার করলো যে রাফায়েল নামের মানুষটার মুখ দিয়ে কিছু অদ্ভুত কিছু শব্দ উচ্চারণ করছে, এবং সাথে সাথে তার দুই হাতের ভেতর থেকে আলোর মত কিছু যেন বের হয়ে যাচ্ছে । সরাসরি গিয়ে আঘাত করছে সামনের অশরীরিটাকে !
কিভাবে হচ্ছে এটা ?
কিভাবে ?
আজকে রাতে আর কি ঘটবে ?
আর কি দেখে অবাক হবে সে !
মিমির বিস্ময়ের ঘোরটা কাটতেই দেখলো রাফায়েল সেই আলোর ঝলকানি বের হওয়ার বন্ধ হয়ে গেছে । মিমি বলল, চলে গেছে ওটা ?
-না ।
-তাহলে !
-ওটা নিজের বন্ধকী না নিয়ে যাবে না ।
-তাহলে এখন কোথায়?
-সাময়িক ভাবে চলে গিয়েছে । আসবে এখনই !
-আপনি কিভাবে করছেন এসব ? কিভাবে আলো বের হচ্ছে ?
-ধরে নিন আমি খানিকটা জোনাকী পোকা ! নিজের শরীর থেকে আলো বের করতে পারি !
মিমির কেন জানি রাগ হল । এতো বিপদের ভেতরেও লোকটার ঠোট্টা করতে ইচ্ছে করছে ! মিমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই অনুভব করলো যে একটা তীব্র বাতাস যেন সব কিছু ভেঙ্গে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে !
রাফায়েল মিমির দিকে তাকিয়ে বলল, রুহীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন ! শক্ত করে ! তারপর আমার পেছনে দাড়ান !
মিমি তাই করলো । রুহী নিজেও মিমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে । এতো সময়ে বুঝতে সে ঠিকই পেরেছে যে ভয়ংকর কিছু তার জন্য আসছে এবং ওর পাশের এই মানুষ গুলোই কেবল ওকে হয়তো রক্ষা করতে পারে !
মিমি দেখলো রাফায়েল দিক ওদের সামনে দাড়ালো । তারপর নিজের হাত দুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে প্রস্তুতি নিল কিছুর একটা ! যখন বাতাসটা তীব্র ভাবে ওদের আঘাত করলো মিমি দেখতে পেল যে রাফায়েল নিজের দুটো হাত দিয়ে ঢালের মত করে কিছু একটা যেন ধরে আছে । একটা বড় ঢাল ধরে ঠেললে যেমন হয় ঠিক তেমন ভাবে ঠেলছে । এবং সব থেকে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে ওদের শরীরে কোন বাতাস লাগছে না । মিমি চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারছে যে আশে পাশ দিয়ে কী তীব্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওদের শরীরে কোন বাতাস লাগছে না । যেন সত্যিই ওদের সামনে কোন ঢাল রয়েছে । অদৃশ্য কোন ঢাল ।
এক সময়ে বাতাস থেমে গেল ! মিমি রুহীকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ওটা চলে গেছে কি ?
-না । আবার আসবে ! শুনুন আমার একার পক্ষে মুঠক দেবীর সাথে যুক্ত করে তাকে আটকিয়ে রাখা সম্ভব না । আপনি একটা কাজ করুন । রুহীকে নিয়ে সোজা যাবে গ্রামের ভেতরে । দেখবেন কোন গোয়াল ঘর পান কিনা !
-গোয়াল ঘর?
-হ্যা । গোয়াল ঘরের গিয়ে গোবর পাবেন সেটাই রুহীর শরীরে মেখে দিবেন !
-মানে ? কী বলছেন এসব ?
-যা বলছি শুনুন । প্রতিটি দেবদবীর মত মুঠিক দেবীও পবিত্রতা পছন্দ করে । পশু পাখির বিষ্ঠা শরীরে লাগলে সেটা তখন তার কাছে অপছন্দের কারণ হয়ে যায় । সে তখন রুহীকে আর নিবে না । চলে যাবে ! আর দেরি করবেন না । দ্রুত যান ! আমি দেখি কত সময় আটকে রাখতে পারি !
মিমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই আাবরও সেই ভয়ংকর চিৎকার শুনতে পেল । সেটা আবার আসছে !
আর বাড়তি কোন কথা না বলে রুহীকে নিয়ে সে গ্রামের দিকে দৌড় দিল । দৌড়াতে দৌড়াতে রুহী বলল, ছগির চাচাদের বড় গরুর গোয়াল আছে ।
-চল ঐ দিকে ।
পেছন থেকে তখনও সেই চিৎকার ভেসেই আসছে !
যখন গোয়ালের কাছে পৌছালো তখন বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেছে । গোয়ালে তালা মারা দেখেই মিমি নিজের পিস্তল দিয়ে সেখানে গুলি করলো । ভয়ংকর আওয়াজ হল । মিমি যখন বাড়ির ভেতবে ঢুকেছিলো তখনই দেখছিলো বাড়ির আলো জ্বলে আছে । অবশ্য গ্রামের সব বাড়িতেই সম্ভবত সবাই জেগে গেছে । যে আওয়াজ আর গোলাগুলোর আওয়াজ শোনা গেছে । ঘুম না ভেঙ্গে তো উপায় নেই !
গুলির আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে বের হয়ে দুইজন । ওদের কাছে কোন ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় নেই । রুহীকে নিয়ে সে ভেতরে ঢুকে গেল । একটা ছোট ৪০ পাওয়ারের আলো জ্বলছে ভেতরে । ঘরে ঢুকতেই একটা কটু গন্ধ এসে লাগলো নাকে। রুহীর দিকে তাকিয়ে বলতে হল না কিছু । সে নিজ হাতেই মেঝেতে পড়ে থাকা গোবর সে নিজেই নিজের শরীরে মাখতে শুরু করলো । মিমিও এই কাজে তাকে সাহায্য করলো ! কিন্তু সেটা মাত্র এক মিনিট । তারপরই তীব্র সেই চিৎকার ওরা শুনতে পেল একেবারে গোয়াল ঘরের কাছেই । সাথে সাথেই গোয়াল ঘরের দরজাটাকে কেউ যেন দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দিল । এবং সেই সাথে সাথেই তাকে দেখতে পেল ওরা ! সেই চার হাতওয়ালা মুঠোক দেবী ! গরু গুলো ভয়ানক ভাবে ডাকছে শুরু করেছিল আগে তবে যেই না দরজার সামনে মুঠোক দেবী এসে হাজির হল তখনই সব গুলো একেবারে চুপ করে গেল । সরে গেল ঘরের এক কোনে !
ঘরের লাইটটা ফেটে গেল তবে ঘর অন্ধকার হল না । এক কদম এক কদম করে এগিয়ে এল রুহীর দিকে । মিমি একদম রুহীর কাছে রয়েছে । সেও খুব ভাল করে দেখতে পাচ্ছে অশরীরিটাকে । এতোই ভয় পেয়েছে যে ওরা নড়তে পর্যন্ত ভুলে গেছে !
অশরীরিটা এবার সেই ভাবেই দাড়িয়ে রইলো বেশ কিছু সময় । কিছু যেন চিন্তা করছে ! মিমির কেবল মনে হল যেন ওরা যেন অনন্তকাল ধরে ওখানেই ওভাবে দাড়িয়ে রয়েছে ! তারপর সেই মুঠোক দিবে দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল ! মিমির বুক থেকে একটা ভয়ের নিঃশ্বাস যেন বের হয়ে গেল । রাফায়েল ঠিকই বলেছিলো ।
রুহী বলল, আপু চলে গেছে ওটা ?
-তাই তো মনে হচ্ছে !
-আরও কিছু সময় বসে থাকি এখানে ?
ভয়ের ব্যাপারটা কেটে যেতেই মিমি নাকে তীব্র গন্ধ এসে লাগলো । বমি চলে এল যেন । সাথে সাথে গোয়াল ঘর থেকে বের হয়ে গেল । উঠোনে বের হয়ে দেখলো বাড়ির প্রায় সবাই ভীত মুখে দাড়িয়ে । মিমি ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের টিউবওয়েলটা কোন দিকে ।
একজন হাত দিয়ে ডান দিকে দেখিয়ে দিল !
মিমি সেদিকেই ছুটলো !
প্রায় আধাঘন্টা ধরে নিজেকে পরিস্কার করলো সে ! তবুও যেন গন্ধ শরীর থেকে গেল না । কখন যে পাশে রাফায়েল এসে দাড়িয়েছে খেয়াল করে নি । খেয়াল করতেই দেখতে পেল রাফায়েলের কপালে কেটে যাওয়ার চিহ্ন । রাফায়েল ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি না থাকলে হয়তো মেয়েটাকে বাঁচানো যেত না ।
-আমি আর কী করলাম । যা করার আপনিই তো করলেন ?
-উহু ! আমি কিছুই করি নি । কিছু সময়ে কেবল আটকে রাখার চেষ্টা করেছি । কিন্তু একজন দেবীকে আটকে রাখার ক্ষমতা তো আমার নেই ।
-তা এখন কী হবে?
-কী হবে মানে?
-মানে দেবী যে তার জিনিস না নিয়ে চলে গেলেন ? এটা ?
রাফায়েল হাসলো ! তারপর বলল, দেবী তার পাওনা ঠিকই তুলে নিবে !
-কিভাবে?
রাফায়েল আর জবাব দিলো । কেবল হাসলো ! তারপর বলল, হয়তো আর কোন দিন দেখা হবে না। ভাল থাকুন !
এই বলে সে ঘুরে হাটা দিলো । আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে !
পরিশিষ্টঃ
রাকিবের নতুন জায়গাতে ঘুম আসে না সহজে । তবে এই লকাপে কেন জানি খুব ভাল ঘুম এল । আশ্চর্যজনক ভাবে আজকে লকাপে কেবল সে একা । এই সেলে আর কোন কয়েদী নেই । রাকিব খুব বেশি চিন্তিত হল না । সে জানে তাকে পুলিশ খুব বেশি সময় আটকে রাখতে পারবে না । সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টা । তারপর কোটে হয়তো চালান করে দিতে পারে বড়জোর ! আর কিছু করবে না !
রুহী মেয়েটার জন্য একটু মন খারাপ হল । আজকে মেয়েটা মারা যাবে । অবশ্য ওর কারণেই এতো পুরো ৫০ লক্ষ্য টাকা এসেছে ওর হাতে । এবার আরও একটু সাবধান হতে হবে ওকে । পুলিশ ওর উপরে সন্দেহ করছে । এবার মনে মনে ঠিক করলো যে আরও সাবধান হবে সে !
গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল রাকিবে । প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলো না সে কোথায় আছে । লকাপে আছে সেটা বুঝতে একটু সময় লাগলো । উঠে বসতে যাবে তখনই পুরো শরীর জমে গেল তার । লকাপে সে একা নেই । সামনে ওটা কে ?
চার হাত ওয়ালা কালো অয়বয়টা চিনতে মোটেও কষ্ট হল না তার । এর আগেও তার সাথে রাকিবের দেখা হয়েছে। সেটা আস্তে আস্তে ওর দিকে এগিয়ে আসছে !
রাকিবের পালিয়ে যাওয়ার কোন পথ খোলা নেই !
এই গল্পটি একেবারে যে আমার মৌলিক ভাবনা সেটা বললে মিথ্যা বলা হবে । গল্পের সব কিছু আমার হলেও, এই যে দেবীর কাছে কিছু চেয়ে তার বদলে কিছু গচ্ছিত রাখার কন্সেপ্টটা আমি কোন একটা গল্পে পড়েছিলাম । গল্পের লেখকের নাম সম্ভবত মুহাম্মদ আলমগীর তৈমুর । সেবার বই।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
😒🤩
Voy paiche…