শেয়াল সন্নাসীর অভিশাপ

oputanvir
4.7
(52)

শিমুর দিনটা যে এভাবে শেষ হবে সেটা সে কোন দিন ভাবেও নি । আজকে সকালের দিনটা কত চমৎকার ভাবেই না শুরু হয়েছিলো ।পছন্দের মানুষটার সাথে সকাল বেলাতেই দেখা । ওর দিকে তাকিয়ে কী চমৎকার ভাবে হাসি দিয়েছিলো । সেই হাসির জের ছিল পুরো দিন ধরে । ক্যাম্পাসেও আজকে বেশ চমৎকার একটা ঘটনা ঘটেছে । সব মিলিয়ে পুরো দিনটা ছিল একেবারে মনের মতন । কিন্তু এখন ? এমন একটা বিভীষিকার সামনে সে পরবে কোন দিন ভাবতেও পারে নি । শিমু ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে । বুকের ভেতরে ঢিপঢাপ করছে । ব্যাগের ভেতরে মোবাইল রয়েছে । কিন্তু ওর দিকে তাক করা পিস্তলটা দেখে সেটা বের করার কোন সাহস ওর হল না ।

গাড়িটা কোন দিকে ছুটে চলছে সেটা শিমু জানে না । মাইক্রো গাড়িতে মোট চারজন রয়েছে । শিমুর পাশেই একজন বসে আছে । তার হাতে পিস্তল । সে একটু সতর্ক ভাবেই বসে আছে । তার চোখ সামনের দিকে । সামনে ড্রাইভারের পাশে সম্ভবত দলের প্রধান বসে আছে । তার চোখ সামনের দিকে । সে কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত ।

শিমু হঠাৎ বলল, আমরা খুব বেশি বড়লোক নই । আমার বাবা আপনাদের খুব বেশি টাকা দিতে পারবে না । প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন ।
পাশে বসা লোকটা বলল, চুপ $#^&। কোন কথা না । কথা বললে গুলি করে দেব ।
লোকটা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই নেতা মানুষটা বলে উঠলো, জগলু । তোকে না বলেছি ভাষা ঠিক করতে ।
-সরি বস ।
নেতা এবার শিমুর দিকে ফিরে তাকালো । শিমুকে এই মানুষটাই গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে । ক্যাম্পাস থেকে বের হচ্ছিলো তখনই দেখলো জিন্সের প্যান্ট, আর সাদা শার্ট পরা একটা ৩০/৩২ বছরের ছেলে ওর দিকে এগিয়ে এল । এগিয়ে এসে বলল, তুমি শিমু না? আফরোজা শিমু?

অপরিচিত মানুষ মুখে নিজের নাম শুনে একটু অবাক হল সে । বলল, হ্যা । কেন?
লোকটা একটু হেসে বলল, আমি তোমার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে আছি । এখানে আমার ছোট ভাগ্নেকে ভর্তি করাতে এসেছি । তোমাকে দেখতে পেলাম ।
শিমুদের ক্যাম্পাসে সামার ফলে শিক্ষার্থী ভর্তি চলছে । আজকেও অনেকে এসেছে । শিমু কী বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । তবে ওর ফ্রেন্ড লিস্টে যেহেতু আছে তাই মুখের উপরে কিছু না বলে চলেও যেতে পারলো না । রাস্তা দিয়ে তার পাশেই হাটতে লাগলো । লোকটা টুকটাক কথা বলতে লাগলো । বিশেষ করে ক্যাম্পাসের কেমন পরিবেশ, ক্যাম্পাস বুলিং হয় কিনা স্যারেরা কেমন এই সব । শিমুর কাছে যা খুব স্বাভাবিকই মনে হয়েছিলো । কিন্তু এরপর যা হল সেটার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না । কখন যে একটা মাইক্রবাস ঠিক ওদের পাশে চলে এসেছে শিমু সেটা একদম টের পেল না । তারপর লোকটা কেবল আস্তে করে নিজের পিস্তল বের করলো । ঠান্ডা গলাতে বলল, চুপচাপ উঠে পড় । চিৎকার করলে গুলি করে চলে যাবো । ব্যাস !
শিমুর বাধ্য মেয়ের মত গাড়িতে উঠে পড়লো । ভয় আর বিস্ময়ে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে । সেই যে গাড়িতে উঠেছে তারপর থেকে সে চলছেই ।

নেতা লোকটা বলল, শোনো মেয়ে, তোমাকে কেবল এক স্থানে পৌছে দেব আমরা । তারপর টাকা নিয়ে চলে যাবো । আমাদের কাজ শেষ । তোমার বাবা বড়লোক কী বড়লোক না সেটা নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই । আরেকটা কথা তোমাকে বলি । আমাদের পেমেন্ট করা হয়েছে অর্ধেক । বাকিটা কাজ শেষ করে । তোমাকে পৌছে দিয়ে বাকিটা নিয়ে যাবো । এখন এই পথে যদি তুমি কোন প্রকার ঝামেলা কর, চিৎকার কিংবা পালানোর চেষ্টা তাহলে স্রেফ তোমাকে গুলি করে দিয়ে আমরা সরে পরবো । টাকা যেহেতু আমরা পেয়েছি অর্ধেক সেটা দিয়েও কাজ চলবে । বুঝতে পেরেছো আমি কী বলতে চাইছি ?

শিমু খুব ভাল করেই বুঝতে পালরো । বুঝতে পারলো যে এই লোকগুলো কোন ঝামেলা করবে না । যারা ওকে ধরে নিয়ে যেতে বলেছে শিমুকে তাদের দরকার, এই লোক গুলোর না । শিমুর খুব বেশি কান্না এল ! এই জীবনে কি আর মা বাবাকে দেখতে পাবে না সে ? কী করা হবে ওকে নিয়ে? চিৎকার করে ওর কান্না করতে মন চাইলো তবে সে ভয়ে সেটা করতে পারলো না । এভাবে ভয়ে ভয়ে বসে থাকতে থাকতে শিমু কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো সেটা সে নিজেই বলতে পারবে না । এমন একটা পরিস্থিতে যে শিমু ঘুমিয়ে পড়তে পারে সেটা ওর নিজের ধারণার বাইরে ছিল । যখন ওর ঘুম ভাঙ্গলো, দেখলো গাড়ি থেমে গেছে । ভোর হবে হবে করছে । একটা মেঠো পথের পাশে ওদের গাড়ি দাড়িয়ে রয়েছে ।

সিমু দেখতে পেল ওর পাশে কিংবা ড্রাইভারের সিটে কেউ নেই । তবে ড্রাইভার চুপচাপ বসে আছে । তার চোখ সামনের দিক । সেই দিকে চোখ যেতেই শিমু দেখতে পেল ওরা দুইজন সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । আর দুর থেকে কয়েকজন মানুষ আসছে ।
তাহলে এদের কাছেই ওকে হস্তান্তর করা হবে ?
শিমু নিজের ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো । মোবাইল ফোনটাতে ১১৮ মিসকল উঠে আছে । ফোন বেজেছিল সেটা সে টের পেয়েছিলো । কিন্তু ধরতে সাহস হয় নি । কিডন্যাপাররা খুব একটা গাও করে নি ফোনটা বন্ধ করার ব্যাপারে । খুব জলদি ডায়াল করলো নিজের মা কে ! কিন্তু তখনই দেখতে পেল নেটওয়ার্ক নেই ।

আশে পাশে তাকালো সে । চারিপাশে বন জঙ্গলের মত জায়গা । তার মাঝ দিয়ে রাস্তা । শিমু দুরে ভোরের আলোতে দেখতে পেল যে পাহাড় দেখা যাচ্ছে । কোন জায়গাতে চলে এল ওরা ? এই জায়গার সাথে শিমুর কী সম্পর্ক ?
শিমু দেখতে পেল লোক গুলো চলে এসেছে কাছে । দুইজনের সাথে কথা বলছে । ওর পাশে যে লোকটা বসে ছিলো সে হাতের ইশারা করে দেখালো গাড়ির দিকে । শিমু দেখলো হেটে আসা লোকগুলোর ভেতর থেকে একজন অন্য কিডন্যাপারের হাতে একটা প্যাকেট দিল । বুঝতে পারলো যে পাওনা পরিশোধ করছে । এবার ওকে হস্তান্তর করা হবে । লোকগুলো গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো । শিমুর বুকের ভেতরটা আবারও কেঁপে উঠলো । এতো সময়ে এই কিডন্যাপারেরা ওর সাথে অনেক ভাল ব্যবহারই করেছে । কিন্তু এখন ওকে এদের হাতে দিয়ে দেওয়া হবে তখন ওর সাথে কী করা হবে ?
সব থেকে বড় প্রশ্ন এরা আসলে কারা?
শিমুকে এরা কেন এভাবে কিডন্যাপ করে নিয়েছে এবং শিমুর কাছ থেকে আসলে এরা কী চায়?
শিমুর সাথে এদের কিসের শত্রুতা?

শিমুর ভয় করতে লাগলো । কিন্তু তার থেকেও ওর মনে একটা কৌতুহল জেগে উঠলো ।

দুই

-বস একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

তুহিন সিটে হেলান দিয়ে বসে ছিল । গাড়ি চলছে ঢাকার দিকে । আপাতত আর কোন ঝামেলা নেই । তবে শিমু নামের মেয়েটার ব্যাগটা রয়ে গেছে গাড়িতেই । মোবাইল ফোনটা জগুলুর পছন্দ হয়েছে । তবে এখন সেটা বন্ধ । তুহিন অবশ্য জগলুকে বলেছে ফোনে হাত না দিতে । এখন এক ফোন থেকেই ওর কাছে পৌছে যেতে পারে পুলিশ । সেটা ও চায় না মোটেও । চোখ না খুলেই তুহিন বলল, কি?
-মেয়েটাকে নিয়ে ওরা কী করবে বলে আপনের মনে হয়?
-জানি না ।
-মুক্তিপন তো চাইবে না । তাই না?
-নাহ । আমার তা মনে হয় না । ওরা আসলে …..

কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল তুহিন । এই গ্রামের পরিবেশ তুহিনের কাছে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয়েছে । একটা গুমট ভাব সব সময় ছিল । সবার মুখ কেমন যেন থমথমে । তুহিনের কেবল মনে হয়েছে যে কোন স্বাভাবিক কাজে মেয়েটাকে ওরা ধরে নিয়ে আসে নি । এর পেছনে অন্য কোন কারণ রয়েছে । কোন অশুভ কারণ । তুহিন অবশ্য সেই কারণের কথা জানতে চায়ও নি । টাকা নিয়েছে আর কাজ করেছে । এর বাইরে কিছু সে ভাবে নি । কিন্তু এখন কেন জানি মেয়েটার জন্য চিন্তা লাগছে । কেন চিন্তা লাগছে সেটা তুহিন নিজেও জানে না ।

শিমুর মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি জেগে উঠলো । ওর সাথে আসলেই যে এমন কিছু ঘটছে সেটা সে নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না । চারিপাশে ভীত চোখে সে তাকিয়ে রইলো । ও এখন একটা বড় ডোবা পুকুরের পাশে বসে আছে । ঠিক বসে আছে বলতে ওকে এখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে । আশে পাশে আর কোন কোন মানুষ নেই । এমন কি একটা ঝিঝি পোকার ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না । সূর্য ডুবেছে বেশ আগেই । তবে আলো রয়েছে এখনও কিছুটা । সেই আলোটাও আস্তে আস্তে কমে আসছে । আর সেই সাথে শিমুর মনে একটা অশুভ ভয় দানা বাঁধছে । শিমু যে পালিয়ে যাবে তার উপায়ও নেই । শিমুর পায়ে একটা শিকল দিয়ে আটকে রাখা রয়েছে । শিকলটা বেশ লম্বা । অন্য প্রান্তটা মাটির একটা গভীর আংটা দিয়ে পুতে রাখা হয়েছে । শিকলটা যদিও বেশি মোটা না তবে ওর পক্ষে সেটা ছেড়া কোন ভাবেই সম্ভব না । এমন কি সেই আংটাও তুলে ফেলা সম্ভব না । গ্রামের লোকজন ওকে এভাবে এই ডোবা পুকুরের পাশে এভাবে বেঁধে রেখে চলে গেছে ।

সকাল বেলা গ্রামের লোকজন কিডন্যাপারদের কাছ থেকে নিয়ে গ্রামে চলে আসে । ওর হাতটা গ্রামের একজন শক্ত সমর্থ পুরুষ ধরে ছিল কেবল । ওকে যখন নিয়ে আসা হয় গ্রামের ভেতরে, ও দেখছিলো, সবাই কেমন ওর দিকে তাকিয়ে আছে । গ্রামটা বেশ অবস্থা সম্পন্নই মনে হল ওর কাছে । সম্ভবত দেশের একেবারে শেষ প্রান্তে । আলো ফুটতেই সে ভারতের পাহাড় দেখতে পেয়েছে । কোন গ্রাম সেটা শিমু জানে না ।
সাধারণ একটা গ্রামই মনে হল । গ্রামের মানুষ যেমন হয় এখানেও তাই । ছেলে বুড়ো নারী সবাই রয়েছে । ওকে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল গ্রাম প্রধানের বাড়িতে । গ্রাম প্রধানের চেহারাতে একটা গম্ভীর্য রয়েছে । শিমু একটু সাহস করে বলল, আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন? আমি কী করেছি?
লোকটা শিমুর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, তুমি কিছু কর নি ।
-তাহলে? কেন নিয়েছেন আমাকে ? আমাকে যেতে দিন ।
-তুমি কিছু করো নি কিন্তু দোষ তোমারই । আর তোমাকে দিয়েই সেই পাপ দুর হবে ।
-আপনারা কী বলছেন ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।
-আর কিছু বুঝতে হবে না ।

চোখের ইশারা করলো গ্রাম প্রধান । ওকে যে লোকটা নিয়ে এসেছিলো সেই ওকে নিয়ে গিয়ে পাশের একটা ঘরে বন্ধ করে রাখলো । টিনের একটা ঘর । শিমু কেবল অসহায়ের মত জানাল দিয়ে মানুষজন দেখতে লাগলো । দেখতে পেল অনেকেই ওকে দেখতে আসছে । বিশেষ করে গ্রামের মহিলা আর বাচ্চা রা । কয়েকজনের সাথে সে কথা বলার চেষ্টা করলো বটে কিন্তু কেউ ওর কথার কোন জবাব দিল না । দুরে দেখতে পেল গ্রাম প্রধান লোকটা আরও কয়েকজনের সাথে কি যেন কথা বলছে । শিমুর কান্না আসতে লাগলো । কিন্তু ওর কিছুই যেন করার নেই । ও এখন ঠিক বুঝতেই পারছে না যে ওকে কেন এরা এভাবে ধরে নিয়েছে । ওর বাবার কাছ থেকে যে কোন টাকা পয়সা চাওয়া হবে না সেই ব্যাপারে শিমু নিশ্চিত । তাহলে?
কেন ওকে এভাবে এখানে ধরে নিয়ে আসা হল?

দুপুর বেলা শিমুকে বেশ ভাল রকমের খাওয়ানো হল । বিশেষ করে হাঁসের কসানো মাংস দিয়ে সাদা ভাত । এই পরিস্থিতে কারো খাওয়া আসার কথা না । তবে শিমুর বেশ ক্ষুধা লেগেছিলো । আর রান্না এতো ভাল হয়েছিলো যে শিমু না খেয়ে পারলো না । এক মহিলা ভাত তরকারি নিয়ে এসেছিলো । ওর পাশেই বসে ছিল খাওয়া পর্যন্ত । খাওয়া শেষ করে মহিলা হঠাৎ বলল, মাগো, আমাদের তুমি মাফ করে দিও ।
শিমু ঠিক বুঝতে পারলো না । বলল, কি বলছেন আপনি?
-আমাদের যতখানি খারাপ ভাবতেছো আসলে আমরা এমন না । কিন্তু আমাদের আর কোন পথ নাই ।
-কী বলছেন এসব ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।
মহিলা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তখনই দরজার কাছে একজন এসে দাড়ালো । শিমু দেখলো গ্রাম প্রধান সেখানে দাড়িয়ে । মহিলা চুপ হয়ে গেল ! শিমু আবারও বলল, প্লিজ বলুন !
মহিলা আর কিছু বলল না । খাওয়ার প্লেট নিয়ে উঠে চলে গেল । গ্রাম প্রধান লোকটা কিছু সময় সেখানে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো । তারপর সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল ।

বিকেল হলেই ওকে ঘর থেকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা হল । বাড়ি ভর্তি তখন গ্রামের মানুষ । ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । শিমুর সবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । গ্রাম প্রধান কয়েকজন লোকের সাথে কথা বলছে ! শিমু সেই মহিলাকে দেখতে পেল । মহিলা কেমন মন খারাপ করে তাকিয়ে রয়েছে শিমুর দিকে । শিমু একটু হাসলো মহিলার দিকে । সে নিজে জানে না যে ওর সাথে এখন কী হবে তবে মহিলাকে হাসি দিয়ে শান্তনা দিল । তাকে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই হাসলো সে ।

তারপর ওকে নিয়ে গ্রামের লোকজন এগিয়ে যেতে লাগলো। প্রথমে সবাই ওর পেছন পেছন আসলেও একটা নির্দিষ্ট পরে দেখতে পেল সেই আট দশ জন শক্ত সমর্থ পুরুষ বাদ দিয়ে আর কেউ রইলো না ওর সাথে । সবাই পিছনে থেমে গেছে ।

গাছ গাছালি ভর্তি বনের ভেতরে হাটতে শুরু করলো ওরা । ঘন বন পার হতেই একটু খোলা জায়গা দেখতে পেল ও । তখনই ব্যাপারটা খেয়াল করলো ও । পরিবেশটা কেমন যেন গুমট হয়ে গেছে । ওর সাথে যে লোকগুলো ছিল ওদের চেহারাতেও একটা ভয়ের ছাপ সে দেখতে পাচ্ছে । ওকে দ্রুত হাটিয়ে নিয়ে এল । তখনই ডোবা পুকুরটা চোখে পড়লো ওর । ওখানেই শিমুর পায়ে শিকল দিয়ে আটকে ওরা দ্রুত সরে গেল ।
শিমু কিছুটা সময় কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মত দাড়িয়ে রইলো । তারপর বেশ কিছুটা সময় নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলো । কিন্তু কোন কাজ হল না । শেষে আর কোন উপায় না দেখে সে চুপ করে আবার বসে পরলো ।

অন্ধকার নেমে আসতেই ওর মনের সেই ভয়টা আরও বেড়ে গেল । বারবার কেবল মনে হতে লাগলো যে এখানে ভয়ংকর অশুভ কিছু আছে । কিছু একটা যেন ঠিক নেই । বনের ভেতরে জোনাক পোঁকা থাকে, সেই সাথে ঝিঁঝিঁ ডাকতে থাকে । কিন্তু চারিপাশটা একেবারে শান্ত । এতো শান্ত কেন সব ? শিমুর মনে হল সব কিছু চুপ করে আছে কারো জন্য? কেউ যেন আসবে? কিছু একটা আসবে?

এই সময় আকাশে চাঁদ দেখা গেল । বিশাল চাঁদ টা একেবারে চারিদিক আলোকিত করে দিল । তখনই শিমুর চোখ গেল পুকুরের ডোবার দিকে । সেটার পানি এতো সময় একেবারে স্থির ছিল । কিন্তু সেটা নড়ে উঠলো একটু । শিমুর বুকের ভেতরটা যেন একটু করে কেঁপে উঠলো । মনে হল যেন ওর চোখে ভুল দেখলো । কিন্তু আবার যখন কেঁপে উঠলো তখন বুকের ভেতরে একটা তীব্র ভয় দেখা দিল । তখনই সে বিস্ময় নিয়ে দেখলো পুরো পুকুরের পানি জুড়ে কেমন ছোট ছোট কিছু একটা যেন ভেসে উঠেছে ।
শিমুর ভয় করছে কিন্তু সে চোখ সরাতে পারছে না । সে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে । পানি থেকে তখনই আস্তে আস্তে সেগুলো ভেসে উঠলো । শেয়াল !
হ্যা কোন ভুল নেই । শেয়ালই । শিমু শেয়াল খুব ভাল করেই চেনে ! পুরো পানি জুড়ে ভেসে উঠেছে শেয়ালের মুখ ।
পানির নিচে শেয়ার থাকতে পারে?
শিমুর বুকের ভেতরটা তীব্র ভাবে স্পন্দন দিতে শুরু করলো । কিন্তু তখনই আসল আতঙ্কটা টের পেল । এই শেয়ার মাঝেও আরও একটা মাথা জেগে উঠেছে । সেটা ঠিক শেয়ালের মাথা না । সেটা একটা মানুষের মাথা ! মানুষ আর শেয়ালের মাথার মিশ্রন ।
ওর দিকে জলন্ত চোখ তাকিয়ে রয়েছে । এবং সেটা আস্তে আস্তে পানি থেকে উঠে আসতে শুরু করলো ।
শিমুর মুখ দিয়ে আপনা আপনি একটা চিৎকার বেরিয়ে এল । সে নিজেকে আবার মুক্ত করার চেষ্টা করলো বটে কিন্তু কোন লাভ হল না । শিমু দেখলো জলন্ত চোখের শেয়ালমুখো মানুষটা পানি থেকে একেবারে উঠে এল । চোখ যেন জ্বলছে । শরীর থেকে পানি ঝরে পড়ছে । ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । শিমু তাকিয়ে দেখলো সেটা ওর থেকে হাত দশেক দুরে । সাধারন মানুষের থেকে আরও ফুট খানেক লম্বা হবে । চোখে আগুণ জ্বলছে । চুল গুলো জটা ধরা । এই চুলের জটের কারণেই যেন আরও লম্বা লাগছে । পরনে কেবল মাত্র একটা নেংটির মত কাপড় আটকে আছে ।
শিমু আবারও নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলো । দুরে যাওয়ার চেষ্টা করলো বটে কিন্তু কোন কাজ হল না ।

তাহলে এর জন্য ওকে নিয়ে এসেছিল? সামনে দাড়ানো এই লম্বা লাল চোখ বস্তুটা দেখতে মানুষের মত হলেও সেটা কোন মতেই মানুষ হতে পারে না ।
এক পা এগোলো । শিমুর মনে হল ওর দিন এবার শেষ ।
আর কোন উপায় নেই । আর কোন উপায় নেই ।

তখনই সেই লাল চোখে যখন একেবারে কাছে চলে এসে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিবে তখনই কান ফাটিয়ে একটা বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেল সে । কানের কাছ দিয়ে গুলি যাওয়ার আওয়াজটা শুনতে পেল সে । সাথে সাথে একটা তীব্র চিৎকার শুনতে পেল । দেখলো সামনে দাড়ানো সেই জটাধারী কয়েক কদম পিছিয়ে গেছে । চিৎকারটা তার মুখ থেকেই এসেছে । এমন ভয়ংকর চিৎকার শুনে শিমুর বুকের ভেতরটা যেন আবারও বের হয়ে আসতে চাইলো । আবারও গুলির আওয়াজ শুনতে পেল সে । শিমু দেখলে পেল যে সামনে দাড়ানো জটাধারী আবারও ছিটকে গিয়েছে দুরে ।
পেছনে তাকিয়েই মানুষটাকে দেখতে পেল সে । একজন নয় দুজনকে । একজনের হাত রাইফেল । অন্য জনের হাতে একটা পিস্তল । দুজনকেই সে চিনতে পারলো । এদের কে এখানে সে মোটেই আশা করে নি ।
আরেকটা গুলির আওয়াজ হল ।

তুহিন চলে এল একেবারে শিমুর কাছে । পায়ের শিকল বরাবর একটা গুলি চালালো । সেটা ছিড়ে যেতেই তুহিন বলল, দৌড়াতে হবে !
শিমু কোন কথা বলে কেবল মাথা ঝাকালো । তখনই পেছন থেকে আবারও সেই গর্জন । আর দেরি করলো না ওরা । তুহিন শিমুর একটা হাত ধরে টান দিল । তারপর দুজনে দৌড়াতে শুরু করলো । পেছন থেকে সেই হুংকারের আওয়াজ সে ঠিকই শুনতে পাচ্ছে । তুহিন দৌড়ানো অবস্থায় পেছনে তাকিয়ে পিস্তল চালাচ্ছে । পেছনে আসা প্রাণীটার শরীরে সেটা লাগছে ঠিকই, কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে গেলেও আবারও দৌড়ে আসছে !
-ওটা কি ?
দৌড়াতে দৌড়াতে জানতে চাইলো তুহিন । শিমু বলল, আমি কিভাবে বলব?
-বাহ তোমার পেছনে লেগেছে তুমি জানো না?
-আমার পেছনে লাগে নি । আপনি আমাকে এখানে এনে ফেলেছেন !
-হয়েছে হয়েছে । এখন দৌড়াও ।

সামনে থেকে জগলুর আওয়াজ পাওয়া গেল ।
-বস জলদি ! ওটা চলে আসছে ।
বলেই সে রাইফেল চালালো । তারপর আবার দৌড়াতে শুরু করলো ।

কত সময় ওরা দৌড়ালো নিজেরাও বলতে পারবে না । একটা সময়ে পৌছালো মাইক্রোটার কাছে । বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনেই ড্রাইভার সেটা স্টার্ট দিয়ে রেখেছিলো । ওরা উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো । দম ছেড়ে একটু বাঁচলো যেন ।
কিন্তু সেটা খুব বেশি সময় স্থায়ী হল না । কয়েক মিনিট পার হতেই ভয়ংকর একটা ধাক্কা লাগলো ওদের গাড়িতে । গাড়িটা এক পাশে সরে গিয়ে ধাক্কা খেল একটা গাছের সাথে । স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল । ড্রাইভার বারবার চেষ্টা করতে লাগলো গাড়িটা চালু করতে কিন্তু পারলো না । শিমু তখনই বলল, ওরা চলে এসেছে ।

সত্যিই তাই । ওরা বলতে শিমু কী বোঝাতে চেয়েছে সেটা তুহিন বুঝতে পারলো । সেই জটাধারী জন্তুর সাথে এবার এসেছে অসংখ্য শেয়াল । সবার চোখ জ্বলছে । তাকিয়ে আছে ওদের দিকে । আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে । তুহিন বলল, জগলু তোর কার কত গুলো গুলি আছে?
-বস দশটা । সব মিলিয়ে ! এরা তো মরে না । পিছিয়ে যায় কেবল। এই গুলিতে মানুষ মরে, এরা তো মানুষ না ।
সেটা তুহিনও দেখেছে । কম করে হলেই ছয়টা গুলি লেগেছে সামনের ঐ জটাধারী শরীরে । কোন মানুষের পক্ষে এর পরেও দাড়িয়ে থাকা সম্ভব না । নিজের চোখে সে না দেখলে হয়তো কোন দিন বিশ্বাস করতো না । কিন্তু এখন বিশ্বাস না করে তো উপায়ই নেই ।

পিস্তল লোড করে রেডি হল তুহিন । জগলুকে বলল, একেবারে কাছে না এলে গুলি করবি না । গুলি করবো মাথা বরাবর । ঠিক আছে ?
-জি বস ।

ওরা গুলি করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বসে রইলো । এদিকে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়ি চালু হলেই টান দিবে । মনে থাকবে? চেষ্টা করে যা ।
ড্রাইভার চেষ্টা করতেই থাকলো গাড়িটা স্টার্ট দিতে ।

এদিকে ওরা আসছেই । গাড়ি থেকে আর যখন হাত বিশেষ দুরে তখনই ওরা থেমে গেল । শিমু দেখলো, ওদের সবার চোখ ডান দিকে ঘুরে গেছে । প্রাণী গুলোর দেখাদেখি শিমু সহ গাড়িতে বসে থাকা সবার চোখও ডান দিকে ঘুরে গেল । দেখলো অন্ধকারের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এসেছে । মানুষটা হাতটা সামনে নিল । তারপর মুখ দিয়ে দুইটা শব্দ ভেসে এল ।
”অপ্রে ভিয়েস্তা”

গাড়িতে বসে থাকা সবাই তীব্র বিস্ময় নিয়ে দেখলো সেই রহস্যময় লোকটার হাত থেকে আলোর ঝলকানী বের হল। তারপর সেটা সরাসরি গিয়ে আঘাত করলো সেই প্রাণীর গুলোর দিকে ।
আবারও শোনা গেল ”অপ্রে ভিয়েস্তা”
আবারও আলো আঘাত করলো ।

একটা সময়ে জন্তু গুলো পিছু হাটলো ! আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল বনের ভেতরে । তারপর সেই রহস্যময় লোকটা ওদের গাড়ির সামনে এসে দাড়ালো । গাড়ির আলোতে দেখতে পেল ওরা । কালো রংয়ের একটা শার্টের সাথে কালো জিন্স পরা । মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । ওদের সামনে আসতেই তুহিন পিস্তলটা তাক করলো তার দিকে । জগলুও দেখাদেখি তাই করলো ।
আগন্তুক বলল, আই এম নট ইয়োর এনিমি ।
শিমু বলল, আপনি কে?
-আমি কে সেটা এখন জরুরী না । গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছে তার মানে গ্রামবাসি ঠিক শুনতে পেয়েছে । ওরা এখানে চলে এলে সমস্যা । চল এখান থেকে ।
-কিন্তু গাড়ি….

বলতে বলতেই এবার গাড়িটা স্টার্ট হয়ে গেল । শিমু বলল, আপনি আসুন আমাদের সাথে ।
আগন্তক কোন কথা বলে গাড়িতে উঠে বসলো । গাড়িটা দ্রুত এগিয়ে চলল সামনের দিকে ! তুহিন তখনও কেমন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রয়েছে আগন্তকের দিকে । তাকে যেন ঠিক তুহিনের পছন্দ হচ্ছে না । শিমু বলল, আপনি কিভাবে ওসব করলেন ? আমি তো কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না । ঐ শেয়াল গুলো আর ঐ মানুষটা এসব কি? কিভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে ? আর কে আপনি ?

আগন্তক বলল, জগতে এমন অনেক কিছু আছে যার কোন ব্যাখ্যা নেই । আরও কিছু হজম হবে না এখন । কেবল নিজের নাম বলি । আমার নাম রাফায়েল ।

তিন
শিমুর জীবনে যে এই রকম একটা অদ্ভুত আর ভয়ংকর ঘটনা ঘটবে সেটা শিমু কোন দিন ভাবতেও পারে নি । এখনও ওর ঠিক বিশ্বাস হয় না যে কিভাবে ও কিডন্যাপ হয়ে গেল । আবার সেখান থেকে সে মুক্তিও পেয়ে গেল । সেই ভয়ংকর জটাধারী আর সেই অদ্ভুত মানুষটা । সব মিলিয়ে শিমুর কাছে কেমন স্বপ্নই মনে হয় । বারবার মনে হয় যেন ও স্বপ্নই দেখেছে । কারণ ওর সাথে এমন কিছু হওয়ার কোন কারণ নেই । হওয়ার কথা না ।

শিমু বাসার মানুষজন ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি হইচই করে নি । বিশেষ করে শিমুর সাথে সাথে কী কী হয়েছে সেটা শোনার পরে শিমুর বাবার চেহারাটা একটু যেন বদলে গিয়েছিলো । সেখানে একটা চিন্তার ছাপ পরেছিলো । তিনি আর কিছু জানতে চান নি । নিজের মনে কি যেন ভাবছিলেন । কয়েকদিন বাসাতেই শিমু ছিল সাবধানে । বাইরে বের হলেও ওর সাথে ও মা যেত । তবে সেটা কমে এল । ওকে বারবার সাবধান করে দেওয়া হল যেন অপরিচিত কারো সাথেই যেন কথা না বলে । ক্যাম্পাস থেকে সোজা বাসায় চলে আছে । শিমুর বাবা আরেকটা নতুন গাড়ি কিনে সেটা কেবল শিমুর ব্যবহারের জন্য দিয়ে দিলেন । বললেন যে ক্যাম্পাস কিংবা অন্য যেখানেই যাও এই গাড়িতে করেই যেতে হবে । একা একা কোথাও যাওয়া চলবে না ।

তুহিন নামের মানুষটার সাথে আরেকবার দেখা হল । ও যখন খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে আবার কাজ কর্ম শুরু করেছে তখন সে এসেছিলো ওর ক্যাম্পাসে । ক্যাম্পাসের বাইরের গেটেই ওর জন্য দাড়িয়ে ছিল । শিমুকে দেখে একটু সংকুচিত হয়ে এগিয়ে এল । আজকে কেন জানি এই মানুষটাকে ওর মোটেও ভয় লাগলো না । ও নিজেই এগিয়ে এল । তারপর বলল, কেমন আছেন কিডন্যাপার সাহেব ?
তুহিন হেসে ফেলল । তারপর বলল, ভাল।
-তা এখানে কী মনে করে ?
-কোন কারণ নেই । মনে হল তোমার সাথে দেখা করে যাই ।
-কফি খাবেন?
তুহিন যেন একটু অবাক হল শিমুর কথা শুনে । কদিন আগে শিমুকে সে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো । আর আজকে শিমু তাকে কফি খাওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানাচ্ছে । অন্য কেউ হলে তো ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিত ।
কফির কাপ নিয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে শিমু বলল, অবাক হচ্ছেন যে কফি খাওয়াতে চাইলাম দেখে?
-একটু তো হয়েছিই ।
-তা এটাই কি আপনার পেশা? মানুষজনকে তুলে নিয়ে যান?
তুহিন বলল, ঠিক পেশা না । পার্ট টাইম জব ।
-তো মেইন জবটা কি?
-আমি মানুষের হয়ে মানুষজনকে পেটাই । এটাই আমার কাজ ।
-বাহ ! দারুন । শুনে খুশি হলাম । তা পুলিশ ধরে না ?
-হুম । ধরবে না কেন । তবে ছেড়েও দেয় । আমার মাথার উপরে কিছু লোকজন আছে । তারাই নিজেদের দরকারে ছাড়িয়ে নেয় ।
-একটা কথা জানতে পারি কি?
-হ্যা বল ।
-আমাকে রক্ষা করতে আবার কেন এলেন?

এই প্রশ্নটার উত্তর সে চট করে দিল না । একটু ভাবলো । তারপর বলল, জানি না ঠিক । আসলে ঐ লোকগুলোর আচরণ আমার কাছে খানিকটা অদ্ভুতই লেগেছিলো । কেবল কৌতুহল বসত আমি লুকিয়ে ছিলাম । ওদের পিছু নিয়েছিলাম । তোমার সাথে আসলে ওরা কি করতে চায় এটা দেখা জন্য । কিন্তু যখন ওরা ওখানে তোমাকে রেখে এল সত্যিই অবাক হয়েছিলাম । তখনই ঠিক করেছিলাম অন্ধকার হলেই তোমাকে নিয়ে কেটে পড়বো । কিন্তু ….

পরের ঘটনা ও শিমু নিজেও জানে । শিমু বলল, আপনার কী মনে হয় ? ওটা কি ছিল ?
-জানি না । আমি ভেবেও বের করতে পারি নি । আমি মোট এগারোটা গুলি করেছি ওটাকে । কোন মানুষ যে যে নয় এটা আমি নিশ্চিত । কোন মানুষ হলে এমনটা হত না ।
-জানেন আবার বাবা সম্ভবত কিছু জানে ।
-তাই নাকি ?
-হ্যা । আমাকে যখন আপনারা বাসায় নামিয়ে দিলেন আমি বাবাকে বলেছিলাম আমার সাথে কী কী হয়েছে । অন্য কেউ হলে অবিশ্বাস করতো কিংবা আরও নানান প্রশ্ন করতো কিন্তু বাবা কোন বাড়তি প্রশ্ন করলেন না । সামনে থেকে চলে গেল । বাবার মুখ দেখেই মনে হয়েছিলো যে বাবা কিছু জানে । আমিও বাড়তি কিছু আর জিজ্ঞেস করি নি । তবে ঐদিন যেমন মনে হচ্ছিলো যে আমার এসবের সাথে কি সম্পর্ক, হয়তো ওরা আমাকে ভুল করে নিয়ে যেতে পারে, এখন আর তেমনটা মনে হচ্ছে না । এখন মনে হচ্ছে যে কিছু তো একটা সংযোগ আছেই । সেই সংযোগটা কী?

তুহিন বলল, তা তো আছেই । আমার সাথে দুইটা লোক দেখা করেছিলো । তারা স্পেসিক ভাবে তোমার ছবি আর তোমার ঠিকানা আমাকে দিয়েছে । কোন র‍্যানডোম ভাবে আমি তোমাকে নিয়ে যাই নি ।
শিমু যেন আরও একটু নিশ্চিত হয়ে গেল । মানে হচ্ছে ওকে ওদের চাই । একবার ওরা মিস করেছে । আবারও কি ওরা এই কাজটা করতে পারে ? তুহিন তখন বলল, আমার কেন জানি মনে হয় ওরা হয়তো আবারও তোমার পিছনে আসবে । তাই সাবধানে থেকো তুমি ।

এই কথাটাই সত্য প্রমানিত হল ঐদিনই । বাসায় গিয়েই জানতে পারলো যে ওর বাবা ওকে বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে ।
প্রথমে শিমু যেন কথাটা ঠিক মত বিশ্বাস করতে পারছিলো না । কিন্তু পরে বাবার মুখের গাম্ভীর্য দেখে বুঝতে পারলো যে সে কি পরিমান সিরিয়াস । শিমু বেশ কয়েকবার জানতে চাইলো কিন্তু বাবা কোন উত্তর দিল না । কেবল বলল যে ওকে যেতে হবে মানে যেতে হবে । আর কোন কথা সে শুনবে না । আর যতদিন না তার বাইরে যাওয়া হচ্ছে তাকে বেশ সাবধান থাকতে হবে । বিশেষ করে সামনের পূর্নিমার আগের দুইদিন থেকে ওর বাসার বাইরে যাওয়া একদম বন্ধ ।

বাবার কথার কোন প্রতিবাদ শিমু করলো না । কারণ বাবা কোন কারণে খুব বেশি চিন্তিত । তার চেহারাতেই সেটা পরিস্কার ভাবে ফুটে উঠছিলো । তাই শিমু বাড়তি ভাবে আর অন্য কিছু জিজ্ঞেস করলো না । বাবার বাধ্য মেয়ে হিসাবে সব সময় থেকে এসেছে সে । কিন্তু ঘটনা ঘটলো ঠিক তার পরের দিন । ক্যাম্পাস থেকে বাসায় পৌছে সে অবাক হয়ে দেখলো তাদের বাসার বসার ঘরে সেই রহস্যময় মানুষটা বসে আছে । মানুষটাকে সে দেখেছিলো অন্ধকারে । পরে গাড়ির ভেতরে আলোতে । কালো শার্ট প্যান্ট পরা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে সে গাড়ির পেছনের সিটে বসে ছিল উদাস হয়ে । ঢাকায় ফেরার পুরো রাস্তা টা সে চুপ করে কিছু যেন ভাবছিলো । কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত যেন সে । তারপর ঢাকার একটু আগেই সে নেমে গেল । যাওয়ার আগে শিমুকে বলে গিয়েছিলো যে তার সাথে আবার দেখা হবে । একেবারে যে বাসায় চলে আসবে সেটা শিমু ভাবে নি ।

বাবাকে লোকটার সামনে বসে থাকতে দেখে সে চুপ করে দাড়ালো । কিছু জানতে চাওয়া টা ঠিক সমীচীন মনে করলো না ।
রাফায়েল নামের মানুষটা বলল, আপনি গ্রামের মানুষ গুলোর কথা একবারও ভাববেন না । ওটা তো আপনারই গ্রাম ।
শিমুর বাবা বললেন, মোটেই না । সেটা আর আমার গ্রাম না । এক সময় আমার পূর্ব পুরুষদের ছিল । আর ওরা যা করেছে তারপর কোন ভাবেই ওটা আমার গ্রাম হতে পারে না । আমার ক্ষমতা থাকলে ওদের পুরো গ্রাম আমি ধ্বংশ করে দিতাম ! শিমুর কাছে আমি আপনার কথা শুনেছি । আপনি আমার মেয়েকে বাঁচিয়েছেন । এই জন্য আপনার কাছে আমি চিরো কৃতজ্ঞ । কিন্তু আপনি যা চাইছেন তা কোন ভাবেই সম্ভব না । খুব জলদিই আমি শিমুকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিবো । ওরা চাইলেও আর আমার মেয়ের সন্ধান পাবে না ।
রাফায়েল বলল, আমি মানছি ওরা যা করেছে তা মোটেই ঠিক করে নি । কিন্তু সেটা করেছে ওরা বাধ্য হয়েছে । আপনি তো সবই জানেন ।
-আমি আর কিছু জানতে চাই না । আপনি প্লিজ আসুন । প্লিজ !

রাফায়েল এবার হতাশ হয়ে উঠে দাড়ালো । শিমুর দিকে একটু ফিরে তাকালো । তারপর আর কিছু না বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো ।
শিমু হঠাৎ বলল, কী হয়েছে আমাকে বলবেন?
কথাটা রাফায়েলকে উদ্দেশ্য করে বলা । শিমুর বাবা শিমুকে ধকম দিয়ে বলল, তোর শুনতে হবে না । তুই ঘরে যা ।
শিমু একবার রাফায়েলের দিকে তাকালো । তারপর খানিকটা মন খারাপ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো । নিজের বাবার আচরণ দিন দিন কেমন যেন ঠেকছে তার কাছে । কিন্তু তার বাবা তো আগে এমন ছিলেন না মোটেই । এতো কঠোর হয়ে গেলেন কেন !

রাতে শিমু না খেয়েই শুয়ে পড়লো । ওর খুব মন খারাপ লাগছে । রাফায়েল নামের মানুষটা কেমন কাতর কন্ঠে ওর বাবাকে অনুরোধ করছিলো । গ্রামের লোক বলতে কারা সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । কি এমন হয়েছে ঐ গ্রামে । সেদিন খাওয়ানোর সময়ে ঐ মহিলাও কেমন কাতর কন্ঠে বলেছিলো যে তাদের আর কোন উপায় নেই । আজকে রাফায়েলের কন্ঠেও এমন কিছু শুনতে পেল । আর রাফায়েল কেন বলল যে গ্রামটা ওদের । ওদের গ্রাম বলতে সে কি বুঝিয়েছে ?

এমন সময় শিমু অনুভব করলো যে ওর মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । সে টা যে ওর বাবা তা বুঝতে শিমুর বুঝতে কষ্ট হল না । শিমুর বাবা নরম সুরে বলল, রাগ করেছিস মা ?
শিমু কিছু বলল না । ওর একটু মন খারাপ লাগছে । ওর বাবা বলল, তোর কিছু হয়ে যাক সেটা আমি কোন দিন চাই না । কোন দিন না ।
শিমু বলল, আমাকে সব খুলে বলবে বাবা ? প্লিজ !

শিমু একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ শুনলো । ওর বাবা তারপর বলল, ঐ গ্রামটা আমাদের ছিল ।
-আমাদের ছিল মানে?
-মানে আমার পূর্বপুরুষেরা ঐ গ্রামের রাজা ছিল । আগে সব হিন্দু রাজা থাকলেও ঐ রমিজগড়ের রাজা ছিল মুসলিম । প্রজা বৎসল রাজা হিসাবে তার বেশ সুনাম ছিল । তার নাম ছিল আউরউদ্দিন খাঁ। সব কিছু বেশ ভাল ভাবেই চলছিলো । এমন সময় একদিন এক জটাধারী সন্নাসী রমিজগড়ে এসে হাজির হল । বিশাল জট আর তার সামনে কয়েকটা শেয়ালের বাচ্চা । লোকে তাকে শেয়াল বাবা বলে ডাকতে শুরু করলো । আমাদের সেই পূর্ব পুরুষ রাজা আউরউদ্দিন খাঁ শেয়ালবাবাকে আপ্পায়ন করলেন । তাকে প্রাসাদের রাখতে চাইলেন তবে সে থাকলো না । রাজ্যের শেষ সীমানাতে একটা একটা বড় পুকুর ছিল । সেই পুকুরের ধারে শেয়ালবাবা ডেরা বাঁধলেন । কোথা থেকে বেশ কিছু শেয়াল এসে জড় হল তার ওখানে । এমন করে কিছু দিন চলে গেল । একদিন রাতে রাজা হঠাৎ স্বপ্ন দেখলেন যে জটাধারী শেয়াল বাবা তাকে ডাকছেন । তিনি ঘুম থেকে উঠে গেলেন । ঘুমন্ত স্ত্রীকে বিছানাতে রেখেই বের হয়ে গেলের প্রাসাদ থেকে । একজন কাছের চরকে নিয়ে সে হাজির হলেন সেই পুকুরের কাছে । রাজাকে আসতে দেখে জটাধারী সন্নাসী হাসলো একটু । যেন সে জানতোই যে রাজা আসবে । রাজা সামনে এসে বললেন, আপনি আমাকে ডাকছিলেন বাবা?
জটাধারী বলল, হ্যা । তোর জন্য একটা সুসংবাদ আছে ।
-কি সুসংবাদ?
-আজ রাতে তুই যে তোর স্ত্রীর সাথে মিলন করেছিস, এই মিলনেই তোর জমজ বাচ্চা হবে । একটা ছেলে আর একটা মেয়ে । এই ছেলেই হবে তোর এই রাজ্যের রাজা । এবং এক সময়ে এই ছেলেই আশে পাশের সব রাজ্যের মালিক হয়ে উঠবে ।
রাজা তো শুনেই আত্মহারা হয়ে গেলেন । কিন্তু তারপর জটাধারী শেয়ালবাবা যা বলল তা শুনে তার চোখ কপালে উঠলো । সে বলল, কিন্তু এটা ঘটার জন্য তোকে আরেকটা কাজ করতে হবে ।
-কী কাজ বাবা?
-ছেলের সাথে যে মেয়েটা হবে সেটাকে আমার কাছে দিয়ে যেতে হবে । আমি অনেক দিন ধরে তপস্যা করছি । সেই তপস্যার জন্য দরকার রাজ রক্ত ।
-কি বলছেন আপনি?
-ভেবে দেখ । এমন সুযোগ আর আসবে না । তোর একটা মেয়ে আছেই । এই মেয়েকে যদি উৎসর্গ করিস তাসলে আমি সেই এমন তপস্যা করবো যে তোর ছেলে দিগবিজয়ী হবে, নয়তো সে একজন সাধারণ রাজাই হয়ে থাকবে ! ভেবে দেখ । সিদ্ধন্ত তোর ! এখন যা । তোর হাতে ঠিক দশ মাস সময় আছে । ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবি ।

রাজা চিন্তিত মনে ফিরে এলেনে প্রাসাদে । কয়েক সপ্তাহ পরেই রাজা জানতে পারলেন যে রানীর কোল জুড়ে সন্তান আসছে । তারও কয়েকজন দিন পরে জানা গেল যে সন্তান একজন নয়, দুইজন । এই খবর জানার পরেই রাজার মনে সেই চিন্তা ফিরে এল । জটাধারী যে কথা বলল সেটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন । কী করবেন তিনি ! এক সন্তানের জন্য অন্য সন্তানকে কী উৎসর্গ করবেন?

বাবার এই চিন্তাযুক্ত মুখ রাজকুমারী চোখ এড়ালো না । সে তখন অষ্টাদশী । মেয়ে বলে রাজা তাকে মোটেই ঘরে বসিয়ে রাখেন নি । তাকে অস্ত্র চালানো শিখিয়েছেন, রাজ কার্য শিখিয়েছেন । রাজার মনে এমন একটা বাসনা ছিল যে যদি আর কোন ছেলে না হয় তাহলে এই মেয়ের হাতেই সে রাজ্য দিয়ে যাবেন ।
রাজকুমারী ঠিকই কারণটা বের করে ফেলল । সেদিন যে চরটা সাথে গিয়েছিলো তার কাছ থেকেই সব খবর পেয়ে গেলন । রাগে তার মাথা গরম হয়ে গেল । সে সেদিন রাতেই চারজন বিশ্বস্ত লোক নিয়ে বের হলেন প্রসাদ থেকে । তখনও সেই সন্নাসী পুকুরের ধারেই ডেরা পেতে বসে আছে । সেখানে গিয়ে রাজকুমারী হুকুম করলেন যাতে এখন সন্নাসী এখনই এই রাজ্য ছেড়ে চলে যায় । সে কোন ভাবেই তার বোনকে তার হাতে তুলে দিবে না । কিন্তু যদি রাজা নিজে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তার কিছু করার থাকবে না । তাই এই সন্নাসীকেই এই রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিবে সে । সন্নাসী না থাকলে রাজা তো তার বোনকে কাউকে দিতে পারবে না।

সন্নাসী রেগে গেল । এতোটুকু পুচকে মেয়ে তাকে হুকুম করছে যেখানে তার বাবা পর্যন্ত তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে । সন্নাসী আরও কিছু বলতে যাবে তখনই রাজকুমারী নিজের তরবারী বের করে সন্নাসীর বুকে বিধিয়ে দিল । একেবারে এফোড় ওফোড় করে দিল । সাথে সাথেই মারা গেল সন্নাসী । তারপর সেই চরেরা সন্নাসীর লাশ পলিথিনে পেঁচিয়ে পাথর বেঁধে পুকরের জলে ফেলে দিলো । সেই সাথে যত শেয়াল ছিল যত গুলোকে ধরতে পারলো সব গুলোকে হত্যা করলো তারপর একই ভাবে পানিতে ফেলে দিল ।

একবারে অনেক কথা বলে শিমুর বাবা থামলেন । শিমু তখন আগ্রহ নিয়ে শুনছিলো । বাবা থামতেই শিমু বলল, তারপর ?
শিমুর বাবা বললেন, রাজা এরপর কয়েকবার বাবা সন্ধানে গিয়েছিলেন তবে তার দেখা পান নি । এক সময়ে রাজার সন্তান জন্ম হল । কিন্তু দুজনেই মৃত । এরপর থেকে রাজ পরিবারে অভিশাপ লাগলো । রাজ পরিবারের প্রথম মেয়ে সন্তানেরা মারা যেত । এভাবেই রাজ বংশ এগিয়ে চলল । এক সময়ে রাজা আমল শেষ হল । আমরা রাজা থেকে জমিদার হলাম । তারপর ব্যবসায়ী হলাম কিন্তু আমাদের সেই অভিশাপ কিন্তু ঘুচলো না । প্রথম মেয়ে সন্তান পেট থেকেই মৃত হিসাবে জন্মাতো । আমার বাবার দাদার যখন প্রথম সন্তান মৃত হয়ে জন্মালো তখন সে একটা সিদ্ধান্ত নিল । জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে দিয়ে শহরে চলে এল । আমার দাদার প্রথম সন্তান মেয়েই ছিল । সে জীবিত ছিল । আমার বাবারও মেয়ে হল প্রথম সন্তান । তোর ফুপি এখন আমেরিকা থাকে । আমার প্রথম সন্তানও তুই ।

শিমু বলল, তা তো বুঝলাম । কিন্তু সমস্যাটা কোথায় ?
-সমস্যা টা যখন থেকে আমরা গ্রাম ছেড়ে দুরে চলে এসেছি তখন থেকে অভিশাপটা আমাদের গায়ে লাগছে না । গিয়ে লেগেছে ঐ গ্রামবাসীর উপরে । এবং সেটা আরও ভয়ংকর ভাবে । বাবার দাদা চলে আসার পর থেকেই নাকি প্রতি পূর্নিমাতে সেই গ্রাম থেকে একটা মেয়ে গায়েব হয়ে যেত । পরে তার লাশ পাওয়া যেত সেই পুকুরে । একজন দরবেশ ডেকে এনে সেই পুকুরটা বন্ধ করে দেওয়া হল । পরে অনেক দিন সেটা ঠিক ছিল । সেটা আবারও শুরু হয়েছে সম্প্রতি । গ্রামের ১১টা মেয়ে এর মধ্যেই মারা গেছে । সামনে আরও একজন মারা যাবে । ওরা ভেবেছিলো তোকে যদি ওখানে নিয়ে ফেলা হয় তাহলে হয়তো আর ওদের উপরে দিয়ে সেই অভিশাপটা যাবে না ।

শিমু বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, রাফায়েল নামের ঐ লোকটা কী বলছিলো ?
-বলছিলো যে সে আর দুইদিন পরেই পূর্নিমা । সে এই শেয়াল বাবা অভিশাপটা কাটাতে পারবে । তার জন্য তোকে তার দরকার । তুই যদি ঐ পুকুরের সামনে যাস তাহলে সে সব ঠিক করে দিতে পারবে । তুই বল তোকে আমি ঐ বিপদের ভেতরে যেতে দিতে পারি? মুখের কথার কোন বিশ্বাস নেই । যত সময় আমরা ঐ এলাকার বাইরে আছি আমাদের কোন ভয় নেই ।

শিমু কোন কথা বলল না । মনের ভেতরে কি যেন চিন্তা চলছে । বারবার মনে হচ্ছে আর দুইদিন পরে আরেকটা মেয়ে মারা যাবে ।
মারা যাবে !

শিমুর বাবা ওকে রেখে চলে গেলেন । শিমুর একফোটা ঘুম এল না । বারবার কেবল গ্রামের কথা মনে হতে লাগলো । তখনই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে সে । শিমু যাবে । সেই গ্রামে যাবে ।

নিজের মোবাইলটা বের করলো । তুহিনকে একটা বড় মেসেজ পাঠালো । কোন কারণ নেই যে তুহিন আসবে । কিন্তু শিমু জানে সে তুহিন আসবে ।

চার
গ্রাম প্রধান আজম বারী গম্ভীর মুখে সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । তার মুখ থমথমে । আজম বারী সারা জীবনে মানুষকে হুকুম দিয়ে এসেছে । এই পুরো গ্রামটা তার কথায় উঠে বসে । কোন দিন কাউকে ছেড়ে কথা বলেন নি । কারো কাছে কোন কৈফিয়ৎ দেন নিজের কাজের জন্য । কিন্তু সামনের বসা মানুষটার সামনে বসে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূত হচ্ছে । সে নিজ চোখে মানুষটার ক্ষমতা দেখেছে । আর এখন কেবল সামনের মানুষটারই ক্ষমতা আছে তার গ্রামের মানুষকে রক্ষা করার ।
আজম বারী বলল, আমি আসলে ….
রাফায়েল ঠান্ডা কন্ঠে বলল, আপনি আসলে ….? আপনি কীভাবে কাজটা করতে পারলেন শুনি? নিজেদের ভালোর জন্য বাচ্চা একটা মেয়েকে এভাবে বলি দিয়ে দিটে একটুই গায়ে বাঁধলো না?
-কিন্তু আমাদের আর কী করার ছিল?
-কিছু করার থাকুক বা না থাকুক যা করেছেন তা কোন ভাবেই আপনার অন্যায়কে জায়েজ করে না । আমি ভেবেছিলাম আপনাদেরকে আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে সাহায্য করবো । কিন্তু সেই ইচ্ছেটা আমার মরে গেছে । গ্রামে এতো গুলো জোয়ান জোয়ান পুরুষ মানুষ যখন একটা ছোট মেয়েকে মৃত্যুর মুখে রেখে আসতে পারেন সেই গ্রামে রক্ষা করার কোন মানে নেই । আমি কেবল এইটাই বলতে এসেছি ।
আজম বারী বলে উঠলো, বাবা এমন কথা বলবেন না । আমাদের ভুল হয়েছে কিন্তু আপনি ছাড়া আর কেউ নেই বাবা । আমাদের আর কেউ না । কালকে পূর্নিমা কাল আবারও কাউকে না কাউকে মেরে ফেলবে ! দয়া করে কিছু করেন ।

রাফায়েলে গ্রাম প্রধানের কথায় খুব বেশি আমল দিল না । তার মুখ শক্তই হয়ে আছে । সে ডান দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে বেশ কিছু গ্রাম বাসী দাড়িয়ে আছে । অসহায় ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে । রাফায়েল বলল, আপাতত আর কিছু করার নেই । শেয়াল সন্নাসীর আক্রমনের এরিয়া আপনার এই গ্রাম । গ্রামের মেয়েদের গ্রামের বাইরে নিয়ে যান আজকে । গ্রাম ছেড়ে দুরে । রাত পার করে আবার সকালে ফিরে আসবেন !
আজম বারী বলল, এই কাজটা আমরা করেছিলাম । মেয়েদের গ্রামের বাইরে নিয়ে গেলে মহিলাদের কাউকে না কাউকে টেনে নিয়ে যায় । মহিলাদের নিয়ে গেলে সামনে যাকে পায় তাকেই নিয়ে যায় । কাউকে না পেলে গ্রামের গৃহপালিত পশুদের মেরে ফেলে । এভাবে গ্রামে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোন সমাধান না । এতো মানুষ গুলো কোথায় যাবে বলেন বাবা !

তখনই একটা হইচই শোনা গেল । রাফায়েল তাকিয়ে দেখলো একটা ভীড় ওদের দিকে এগিয়ে আসছে । কিছু সময় তাকিয়ে থেকেই অবাক হয়ে গেল সে । কারণ ভীড়ের সামনে একজনকে সে দেখতে পেয়েছে । এই মানুষটাকে সে এখানে কোন ভাবেই আশা করে নি । ভীড়টা এসে থামলো আজম বারী আর রাফায়েলের সামনে । আজম বারীও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।

শিমুর ঠিক পেছনে তুহিন দাড়িয়ে । তুহিনের হাত পকেটে । রাফায়েল বুঝতে পারলো সেখানে একটা পিস্তল রয়েছে । গ্রামের মানুষ কিছু করতে গেলে হয়তো সেটা বের করবে । শিমু রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, আই ওয়ান্ট টু হেল্প । আপনি বলেছিলেন যে আমি হলে বিপদটা কাটানো যাবে !
রাফায়েল আজম বারীর দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন । নিজেদের স্বার্থের জন্য এই মেয়েটাকে আপনারা কি বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন আর সেই নিজ থেকে আপনাদেরকে রক্ষা করতে এসেছে । এমন কি জানে যে ওর নিজের জীবনের শংঙ্কা রয়েছে ।
আজম বারী মাথা নিচু করলো । শিমু দেখতে পেল ভীড় ঠেলে সেদিনের সেই মহিলাটি বের হয়ে এল । ওকে সেদিন যত্ন করে খাইয়েছিলো । সে শিমুর কাছে এসে শিমুর হাত ধরে ওকে ভিড় ঠেলে ভেতরের দিকে নিয়ে গেল ।

যাওয়ার সময়ে অন্য সবার দিকে শিমুর দেখছিলো । কয়েক দিন আগে যখন শিমুকে ওরা কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছিলো তখন তাদের চোখের দৃষ্টি আর আজকে সবার চোখের দৃষ্টির মেলানোর চেষ্টা করছিলো শিমু । নিজের কাছেই ভাল লাগছিলো ওর । ও এখানে কেন এসেছে ও নিজেই জানে না । তবে যদি সে না আসতো তাহলে হয়তো মনের ভেতরে একটা অশান্তি কাজ করতো সব সময় ।
শিমু জানে যে এখানে এসে নিজের উপরে একটা বড় বিপদ ডেকে এনেছে । কোন নিশ্চয়তা নেই যে সে আবার ভাল ভাবে আবারও নিজের বাসায় ফেরৎ যেতে পারবে । কিন্তু তারপরেও সে এসেছে এখানে ! এখন এই মানুষ গুলোর চেহারাতে একটা আনন্দের ছোয়া সে দেখতে পাচ্ছে । সাথে আছে জগলুও । এবং ওদের সাথে আজকে বেশ ভারী কিছু অস্ত্র রয়েছে । যদিও জানে যে এই অস্ত্র দিয়ে ওরা শেয়াল সন্নাসীকে বেশ সময় আটকে রাখতে পারবে না ।

পাঁচ

তুহিন গভীর কন্ঠে বলল, আপনি কি নিশ্চিত কাজটা সম্ভব হবে?
রাফায়েল তখনও পানির দিকে তাকিয়ে আছে । ওরা দাড়িয়ে আছে সেদিনের সেই পুকুরের কাছে । এখানেই শিমুকে রাখা হয়েছিলো । তুহিন আবারও বলল, আপনার কী মনে হয়?
-কোন ব্যাপারে?
-সব কিছু এখান থেকে শুরু?
-হ্যা । তাই তো মনে হয় ।
-এই পুকুরটাই যদি সকল সমস্যার শুরু তাহলে পুরুকের সব পানি সেচ করে তুলে ফেললে কিংবা পুকুরটি ভরাট করে ফেললেই তো হয় !
-তা করা হয় নি ভাবছেন?
-হয়েছে?
-হ্যা । চেষ্টা চালানো হয়েছে ঠিকই । তবে কাজ হয় নি । পানি সব টুকু সেচ দিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে, মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয় নি । শেয়াল সন্নাসীর জাগার সময়ে সব আবার আগের মত হয়ে যায়।
-ইন্টারেস্টিং !
-জগতে অনেক অলৌকিক ব্যাপার থাকে যা আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না । পারার কথাও না ।
-আপনার ব্যাপারেও কিন্তু আমার বেশ কৌতুহল রয়েছে । সেইদিন আপনি কিভাবে ঐ কাজটা করলেন? এমন যে হতে পারে কেউ করতে পারে সেটা আমি নিজের চোখে না দেখলে কোন দিন বিশ্বাস করতাম না ।

রাফায়েল কিছু বলল না । কেবল হাসলো । তারপর পুকুরের পাড়ের কাছে বসে কিছু যেন পরীক্ষা করলো । তুহিন পেছন থেকে বলল, আসলে কিভাবে কি করবে ঠিক করেছেন?
-রাজকুমারী শেয়াল সন্নাসীকে মেরে তো ফেলেছিল কিন্তু তার দেহটাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল । আর তান্ত্রিকদের দেহ সঠিক ভাবে সৎকার না করলে সেটা ভয়ানক পিশাচে পরিনত হয়ে যায় । ওটাকে সম্পূর্ণ ভাবে পুড়িয়ে ফেলতে হয় । বিশেষ করে মাথাটা । একেবারে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে হয় ।
-এখন এটা কিভাবে সমাধান হবে?
-কালকে শেয়াল সন্নাসী জেগে উঠবে আবার । তার দেহ এখন পুকুরেই পাওয়া যাবে । এবং সেটা শিমু ছাড়া আর কারো চোখে পড়ার কথা না । শিমুর বংশের বড় মেয়ে । যতদুর জানি ওর বড় ফুফু আছে । তিনি হলেও চলবে । শিমুকে এই কংকালটা তুলতে হবে এবং তা সম্পূর্ন ভাবে পুড়িয়ে ফেলতে হবে । তাহলেই কেবল সমাধান হবে ।

ছয়

চাঁদ এখনও ওঠে নি । তবে উঠে পড়বে যে কোন সময় । শিমু চুপ করে বসে আছে সেই পুকুরের কাছেই । গতদিন তাকে যেভাবে রাখা হয়েছিলো আজও শিমুকে ঠিক সেভাবেই রাখা হয়েছে । আজও শিমুর পায়ে একটা শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে । তবে আজকে এই কাজটা করা হয়েছে শিমুর নিরাপত্তার জন্য । কোন ভাবে যদি ওদের প্লান ভেস্তে যায় তাহলে শেষ রক্ষা হিসাবে এই শিকল শিমুকে হয়তো আরও কিছু সময় আটকে রাখবে । কারণ একবার যদি শেয়াল সন্নাসী ওকে পুকুরের পানির ভেতরে পায় তাহলে ওকে নিচে টেনে নিয়ে যাবে । এই শিকলের কারণে হয়তো কিছু সময় পাওয়া যাবে । এছাড়া আজকে শিমুর সাথে তুহিন রয়েছে । রয়েছে জগলুও । ওদের সাথে ভারি কিছু অস্ত্র রয়েছে । এগুলো রাফায়েল ওদের যোগার করে দিয়েছে । লোকটা যে রহস্যময় সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । এমন সব কাজ করছে সেটা তুহিন বেশ অবাকই হয়েছে ।

ওদের প্লানটা বেশ সহজ । তবে সতর্কতার দরকার পড়বে । শিমুরা পুকুরের পাশেই বসে রয়েছে । ওদের চারিদিকে ঘিরে ঘিরে একটা বৃত্তের মত করে করে লবন জাতীয় কিছু ছিটিয়ে দিয়ে গেছে রাফায়েল । এই পুকুর থেকেই উঠবে শেয়াল সন্নাসী যাবে ওদের পাশ দিয়েই কিন্তু এই বৃত্তের ভেতরে থাকলে শেয়াল সন্নাসী ওদের দেখতে পাবে না । তার চোখে ওরা থাকবে অদৃশ্য ।

প্লানটা হচ্ছে শেয়াল সন্নাসী ওদের পার করে যখন গ্রামের দিকে চলে যাবে তখন তুহিন কিংবা জগলুকে বৃত্ত থেকে বাইরে আসতে হবে এবং আরও একটা বড় বৃত্ত আকা আছে সেইটার মুখটা বন্ধ করে দিতে হবে । এই বড় বৃত্তটার মুখটা বন্ধ করে দিলে পুরো পুকুর টা তখন শেয়ার সন্নাসীর চোখের আড়াল হয়ে যাবে । সে আর কিছুই বুঝতে পারবে না । কিন্তু যখন বড় বৃত্তটার মুখ টা না বন্ধ করেই শিমু বৃত্ত থেকে বের হয়ে পড়ে তাহলে শেয়াল সন্নাসী সাথে সাথে ওর উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে। তখন সে ছুটে আসবে ওর দিকে । এই কাজটা কোন ভাবেই করা যাবে না ।

একবার যখন বড় বৃত্তটার মুখটা বন্ধ করে দেওয়া হবে তখন শিমু বের হতে পারে ছোট বৃত্তটা থেকে । তারপর শিমুকে সোজা নেমে যেতে হবে পুকুরের পানিতে । সেখানে সে খুজে পাবে শেয়ার সন্নাসীর কংকালটাকে । সেটা তাকে তুলে আনতে হবে । এবং পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে একেবারে । তাহলেই শেয়াল সন্নাসীর হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে ওরা ।

প্লানটা সহজ সরলই মনে হচ্ছে । কিন্তু এতে কিছু সমস্যা আছে । এক হচ্ছে শেয়াল সন্নাসী টের না পেলেও পুকুরের ভেতরে অনেক শেয়াল থাকবে । সেগুলো ঠিকই শিমুকে দেখতে পাবে এবং ওর উপরে হামলা করতে পারে অবশ্যই । অন্য দিকে গ্রামের ভেতরে শেয়াল সন্নাসী ঠিকই হামলা চালাবে । এবং যদি নির্ধারিত সময়ের আগে শিমু কংকালটা বের করে না আনতে পারে এবং শেয়ার সন্নাসী পানির ভেতরে চলে আসে তাহলে হয়তো শিমুর আর কোন ভাবেই পানি ছেড়ে উপরে ওঠা হবে না । সুতরাং ওকে এর আগেই উপরে উঠতে হবে এবং বৃত্তের ভেতরে অবস্থান নিতে হবে ।

ওদিকে রাফায়েল থাকবে পুরো গ্রামের সাথে । আগেই গ্রাম থেকে সকল মেয়েদেরকে অনেকটা দুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে । গ্রামের লোকজনকে কয়েকটা বড় বাড়িতে জড় করা হয়েছে । এবং সেখানেও এই বেস্টনী আঁকা হয়েছে যাতে করে শেয়াল সন্নাসী কোন ভাবেই তাদের কাছে না যেতে পারে । কিন্তু এসব করেও শেষ রক্ষা হয়তো নাও হতে পারে । শেয়ার সন্নাসীর আশে পাশে অসংখ্য শেয়াল সব সময় ঘোরাফেরা করে । সমস্যা হচ্ছে এর ভেতরে অতিপ্রকৃত শেয়াল ছাড়াও সত্যিকারের কিছু শেয়ালও বিদ্যমান । এই বেস্টনী অতিপ্রকৃত প্রাণী গুলোকে দুরে রাখতে পারলেও সাধারণ শেয়াল গুলোর পক্ষে এই বেস্টনী পার করা কোন ব্যাপার না । সেই ক্ষেত্রে যদি সেই সাধারণ শেয়াল গুলো কোন ভাবে এই বেস্টনি গুলো নষ্ট করে দেয় তাহলে তখন শেয়াল সন্নাসীকে আটকানো মুসকিল হয়ে যাবে । এই কারনে গ্রাম বাসীকে রক্ষা করার দায়িত্বে থাকবে রাফায়েল । এখানে ওদের তিনজনকে সামলাতে হবে ।

শিমু আস্তে আস্তে তুহিনের সাথে গল্প করছিলো । মনের ভেতরে সেদিনের মত আজকে ভয় লাগছে না । বিশেষ করে তুহিন নামের মানুষটা সেদিন যেভাবে ওকে রক্ষা করতে এসেছিলো, আজও মনের ভেতরে একটা বিশ্বাস জন্মেছে যে আজকেও সে ঠিক ঠিক রক্ষা করবে ।

আরও কিছু সময় কথা বলার পর হঠাৎ করেই ওরা দুজন খেয়াল করলো যে চারিদিকটা একেবারে শান্ত হয়ে গেছে । শিমু অনুভব করলো যে ঠিক সেই দিন সব কিছু যেমন করে শা্ত আর নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো আজও ঠিক সেই ভাবে সব কিছু একেবারে শান্ত হয়ে গেছে । শিমুর মত তুহিনও যেন কিছু বুঝতে পেরেছে । তার হাতে বের হয়ে এসেছে রিভালবার । সেটা তাক করা পুকুরের দিকে । যেন এখনই সেখান থেকে ভয়ংকর কিছু বের হয়ে আসবে !

শিমু বুকে দুরু দুরু ভাব নিয়ে একভাবে তাকিয়ে আছে পুকুরের দিকে । চাঁদের আলোতে পানিটা কেমন যেন টলচল করছে । কোন রোমান্টিক আবহাওয়ার পরিবেশ হওয়ার কথা ছিল । চাঁদের আলোত কোন টচমল পানির ধারে সে বসে আছে তার প্রিয় মানুষটির সাথে ! আহা এমন যদি হত !

তখনই পানির ভেতরে একটা অস্বাভবিক ব্যাপার খেয়াল করা গেল । শিমু অনুভব করলো সে আপনা আপনিই তুহিনের আড়ও কাছে চলে এসেছে । তুহিন আর জগলু পিস্তল হাতে তাক করে রয়েছে পানির দিকে । তখনই ওরা তিনজন একসাথে সেই ভয়ংকর প্রাণীটির মাথাটা দেখতে পেল । পানি উপরে জেগে উঠেছে । কিছু সময় সে পানির উপরেই ভেসে রইলো । তারপর আস্তে আস্তে পানি থেকে উপরে উঠতে শুরু করলো । প্রথমে মাথা তারপর বুক তারপর পুরো দেহ পাড়ে উঠে এল । শিমু তখন ভয়ে সিটিয়ে রয়েছে । ওর মনে তখন কেবল একটা সম্ভবনাই দেখা দিয়েছে যে এখনই শেয়াল সন্নাসী এখনই ওর দিকে ঝাপিয়ে পড়লো ।

শেয়াল সন্নাসী কিছু সময় দাড়িয়েই রইলো । যেন কিছু সে বুঝতে পেরেছে । তারপর একেবারে ফিরে তাকালো শিমুদের দিকে । লাল চোখ দিয়ে একেবারে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে । শিমুর দম বন্ধ হবার জোগার ! তুহিন পিস্তল তাক করে রয়েছে একেবারে শেয়াল সন্নাসীর দিকে । গুলি করেই দিবে । যদিও জানে যে এই গুলিতে খুব একটা কিছু হবে না তার ! তবুও বিনা যুদ্ধে সে কোন ভাবেই হেরে যেতে প্রস্তুত না । আর পাশে বসে থাকা এই মেয়ে এখন তার হেফাজতে রয়েছে । নিজের জীবন থাকতে এই মেয়েটির কোন কিছু সে হতে দিবে না !
তবে শেয়াল সন্নাসী আর কিছু করলো না । একভাবে আরও কিছু সময় তাকিয়ে থেকে সে আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে হাটা দিল । সন্নাসী চলে যাওয়ার পরপরই জগলু বলল, বস বের হব কি ?
তুহিন আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করলো । তারপর বলল, হ্যা । এখন বের হওয়া যায় ! চল ।

আস্তে আস্তে খুব সাবধানে বের হয়ে এল ওরা । পুরো পুকুরটা রাফায়েল লবন নিয়ে বেস্টোনী করে দিয়েছিলো । কেবল কিছু অংশ বাকি রেখেছিলো যাতে করে শেয়াল সন্নাসী বের হতে পারে । তুহিন মন্ত্রপড়া লবন দিয়ে সেই অংশটুকু আবারও ঢেকে দিল । তারপর শিমুর দিকে তাকিয়ে বলল, আসো । এই কাজ এখন তোমার !

শিমু ভয়ে ভয়ে উঠে দাড়ালো । তারপর বৃত্তের বাইরে পা রাখলো । শিকলটা বেশ সাবধানেই ধরে সে পুকুরে পা রাখলো । এবং সাথে সাথেই দেখতে পেল পুকুরের পানিতে বেশ কিছু লাল চোখ জেগে উঠেছে । একটু ভয় পেল সে । তবে তুহিন ঠিক ওর পেছনেই রয়েছে । বলল, ভয় নেই। ওরা শেয়াল কেবল । বেশি কিছু করতে পারবে না ।
শিমু তাকিয়ে দেখলো জগলু ওর পেছনে চলে এসেছে । দুজনের হাতেই পিস্তল !

শেয়াল গুলো আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে । একদম কাছে আসতেই তুহিন প্রথম গুলিটা করলো । একটা লাল চোখের মাথা বরাবর গিয়ে লাগলো সেটা। পানির মাঝে হারিয়ে গেল সেটা । তবে আরেকটা এগিয়ে এল আবার ! তুহিন আবার গুলি করলো ! জগলুও একের পর এক গুলি করা শুরু করেছে । তবুও যেন ওরা আসা থামছেই না । একের পর এক আসছেই !

তুহিন শিমুর দিকে তাকিয়ে বলল, এভাবে ওদের আসা থামানো যাবে না । তুমি ডুব দিয়ে খোজা শুরু কর !

শিমু লম্বা দম দিল তারপর আরও একটু সামনে গিয়ে পানিতে ডুব দিল। প্রথমে সব কিছু ঝাপসা মনে হলেও এক সময়ে চোখে সব সয়ে এল । চোখ মেলে খুজতে লাগলো । কিন্তু চোখের সামনে কিছুই যেন পেল না সে । কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার ।
দম ফুরিয়ে এলে আবারও উপরে উঠে এল সে । দেখতে পেল তুহিন আর জগলু একই ভাবে গুলি করে চলেছে । একটা শেয়াল ঠিক শিমুর মাথা কাছে চলে এল । শিমু কাছে থাকার জন্য তুহিন কিংবা জগলুর কেউ গুলি করতে পারছে না । শিমু ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো । তবে সেটা সামলে নিল সাথে সাথেই ।
রাফায়েলের একটা কথা মনে পড়লো তখনই । শিমুকে সে বলেছিলো যে এই সব কিছু শিমুর থেকে শক্তিশালী নয় । শিমু কাছে আসা শেয়ালটাকে হাত দিয়ে চেপে ধরলো । দেখতে পেল সেটা দাঁত বের করে চিৎকার করছে বটে তবে আর কিছু করতে পারছে না । শিমুর খুব বেশি শক্তি প্রয়োগও করতে হচ্ছে না । হাত দিয়ে তুলে ধরলো সেটাকে । পানি থেকে উপরে তুলতেই কেমন যে ধোঁয়া ধোঁয়া হল সেটা । তারপর মিলিয়ে গেল ।

ব্যাপারটা তুহিন আর জগলুও দেখতে পেল । তারা গুলি থামিয়ে ঠিক একই কাজ করতে শুরু করলো । শিমু আবারও নিচে ডুব দিল । তারপর খুজতে লাগলো সেই মাথার খুলির কংকালটি !

সাত
রাফায়েল একভাবে তাকিয়ে রয়েছে সামনে । সে জানে শেয়াল সন্নাসি ঠিক এই পথেই আসবে । গ্রামের সব মেয়ে গুলোকে গ্রামের একেবারে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে । তাই এই দিক দিয়ে হিসাব করলে দেখা যাবে আজকে কোন মেয়ের প্রাণহানী ঘটবে না । কিন্তু অন্যান্য ছেলে বুড়ো পুরুষেরা ঠিকই আছে । আজকে তাদের খানিকটা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে । মোড়লের ঘরের ভেতরেই সবাই রয়েছে হাত দেশী অস্ত্র নিয়ে ।
অশরীরি গুলোতে রাফায়েল ঠিকই আটকে দিতে পারবে । রাফায়েলের প্রতিরক্ষা বেস্টনি গুলো পার হয়ে তারা আসতে পারবে না । কিন্তু আসল শেয়াল গুলোও শেয়াল সন্নাসীর কথা শুনবে বেশ ভাল ভাবেই ।

তখনই দেখতে পেল তাকে । এগিয়ে আসছে ওদের দিকেই । সাথে রয়েছে অগণিত শেয়াল । চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শেয়ালের জলন্ত চোখ গুলো ।

শেয়াল সন্নাসী আরও কিছুদুর এগিয়ে আসতেই থেমে গেল । রাফায়েল জানতো যে থেমে যাবে । কারণ ওখানেই প্রথম, সুরক্ষা বেস্টনী দেওয়া । সেটা পার করতে পারবে না কেউ । কিন্তু রাফায়েল তখনই দেখতে পেল কয়েকটা শেয়াল সামনে এগিয়ে এসে পা দিয়ে সেই লবন গুলো সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে । বুঝতে পারলো এগুলো সাধারণ জীবন্ত শেয়াল । এদেরকে মন্ত্র দিয়ে আটাকানো যাবে না । আগে থেকেই সব কিছু বলা ছিল । হাতের ইশারা করতেই বেশ কয়েজন যুবক বের হয়ে গেল ঘর থেকে । সেই শেয়াল গুলোর কাছে গিয়ে হাতের লাঠি কিংবা শাবল দিয়ে আঘাত করে সরিয়ে দিতে লাগলো যাতে করে তারা কোন ভাবেই লবনের দেওয়াল নষ্ট না করতে পারে ।

প্রথম প্রথম কাজ হল বটে তবে এতো পরিমান শেয়াল একের পর এক আসতে লাগলো যে ওরা ঠিক মত পেরে উঠলো না । এক সময় একটা বেস্টনী ভেঙ্গে পড়লো । সাথে সাথেই ওরা পরের বেস্টনীর ভেতরে চল গেল । যখন মনে হচ্ছিলো যে আর কোন ভাবেই আটকানো যাবে না তখনই রাফায়েল লক্ষ্য করলো যে সব গুলো শেয়াল থেমে গেছে ।
শেয়াল সন্নাসী উল্টো দিকে ঘুরে হাটা দিয়েছে । তার পেছন পেছন কিছু শেয়ালের দল হাটা দিয়েছে । তবে কিছু তখনও তাদের উপর আক্রমন করে চলেছে । রাফায়েল তখনই বুঝতে পারলো যে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে । শেয়াল সন্নাসী শিমুকে অনুভব করতে পেরেছে । তখনই রাফায়েল শিমুর কাছে যাওয়ার একটা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো কিন্তু এখন এভাবে এদের একা রেখে চলে গেলে এই শেয়াল গুলো গ্রামের পুরুষদের উপর হামলে পড়বে !

শিমু কয়েকবার পানির নিচে ডুব দিয়ে খোজ করার চেষ্টা চালিয়েই গেল । পুকুরটার এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত চলল খোজ কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না । যখন সে একেবারে হতাশ হয়ে যাচ্ছে, মনে হল যে আর খোজ পাওয়া যাবে না তখনই সে আলোটা দেখতে পেল । মাটি থেকে অল্প অল্প লাল আলো বের হয়ে আসছে ! কিন্তু দম শেষ হয়ে গিয়েছিলো ওর । মাথা তুলল পানির উপরে । তখনই অনুভব করলো কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে । পানি থেকে সব শেয়াল উপরে উঠে গিয়েছি । তুহিনের ডাক শুনতে পেল । ফিরে তাকিয়েই দেখলো তুহিন ওকে চিৎকার করে পাড়ে আসার জন্য বলছে । কারণটা বুঝতে পারলো সাথে সাথেই । শেয়াল মাথার ঐ সন্নাসীকে সে দেখতে পেল সব শেয়াল গুলোর মাঝে । ওর দিকে তাকিয়ে আছে । শিমুকে বলে দিতে হল না যে শেয়াল সন্নাসী এবার ওকে দেখতে পাচ্ছে । তার চোখের দৃষ্টিতেই সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে !

রাফায়েল বলেছিলো এই পুকুরই তার শক্তির প্রধান উৎস । এখানেই সে সব থেকে শক্তিশালী । শিমুর এখন এই পুকুর থেকে যতটা সম্ভব দুরে সরে যাওয়া উচিৎ । কিন্তু এখন যদি দুরে চলে যায় তাহলে মাথার খুলিটা তো আর পাবে না ! আর সত্যিই কি এখন পানি থেকে উঠে পালাতে পারবে? শিমু কিছু সময় তুহিনের চোখের দিকে তাকালো । চাঁদের আলোতে স্পষ্ট তুহিনের চোখের ভাব । সেখানে সে বলছে উঠে এসো । ডুব দিও না । শিমুর মনে হল তুহিন ঠিক ঠিক জানে শিমু এখন কী করতে যাচ্ছে ! এবং করলোও তাই । অন্য সব কিছু চিন্তা বাদ দিয়ে সে ডুব দিলো !

তুহিনের মনেই হচ্ছিলো যে মেয়েটা পাগলামো করবো ! এবং করলোও তাই । শিমুর ডুব দেওয়া দেখেই তুহিনের মনে হল যে এখন যেভাবেই হোক এই শেয়াল বদমাইশটাকে পানির থেকে দুরে রাখতে হবে । কোন ভাবেই তাকে পানিতে মানতে দেওয়া যাবে না !

জগলু …. একটা চিৎকার দিল সে !

জগলুকে আর আলাদা ভাবে কিছু বলতে হল না । একটা এ কে ৪৭ ওর দিকে ছুড়ে দিল সে । সেটা হাতে নিয়ে এবার সোজা ফায়ার শুরু করলো শেয়াল সন্নাসী আর তার শেয়াল গুলোর দিকে । শেয়াল গুলো গুলির আঘাতে ছিটকে পড়ছে বটে কিন্তু সেগুলো ফিরে ফিরে আসছে বারবার ! শেয়াল সন্নাসীর দিকে গুলি লাগছে বটে তবে সেটা তাকে খুব বেশি কিছু করতে পারছে না ।
জগলু এদিকে তার সট গান টা নিয়ে একই ভাবে গুলি করে চলেছে । গুলির আওয়াজে কেবল মনে হতে লাগলো এখানে ভয়ংকর কোন যুদ্ধ সংগঠিত হচ্ছে । কত সময় ধরে সেই যোগাগুলি চলল সেটা যে সবাই ভুলে গেল । তুহিনের মনে হল যেন অন্তত কাল ধরে সে গুলি করেই চলেছে । কিন্তু একটা সময়ে গুলি শেষ হয়ে এল । জগলুর দিকে তাকিয়ে দেখে সে আগেই খালি হয়ে গেছে । কিন্তু শেয়াল সন্নাসী তখনও দাড়িয়ে !

তুহিন এবার পুকুর আর সন্নাসীর মাঝে দাড়ালো । হাতে বের হয়ে এল চকচকে লম্বা ছুরি । ওর জীবিত থাকতে কোন ভাবেই শেয়াল সন্নাসীকে পুকুরে যেতে দিবে না সে । শেয়াল সন্নাসী এক লাফেই যেন এগিয়ে তুহিনের কাছে । তুহিন ছুরিটা চালালো বটে । সেটা বিধলো শরীরে কিন্তু খুব একটা ফল হল না । শেয়াল সন্নাসী কয়েক মুহুর্ত থামলো । তারপর তুহিনকে এক ধাক্কা মেরে ১০ হাত দুরে ছুরে ফেলে দিল । তীব্র একটা ব্যাথা অনুভব করলো সে । মনে হল যে চোখে অন্ধকার দেখলো সে ।
শিমুর কথা মনে হতেই আবারও উঠে দাড়ালো সে । তখনই চোখ গেল জগলুর দিকে । জগলু একটা রকেট লাঞ্চার কাধে তুলে নিয়েছে । এই জিনিসও রয়েছে সেটা তুহিনের জানা ছিল না ।

জগলু ট্রিগার টিপে দিতেই সেটা সবেগে গিয়ে আঘাত করলো শেয়াল সন্নাসীর শরীরে । তুহিনের মনে হয়েছিলো যে এইবার বুঝি একটা হিল্লে হল । কিন্তু ধোঁয়ার কুণ্ডলী যখন সরলো তখন বুঝলো যে কিছুই হয় নি শেয়াল সন্নাসীর । সে তখনও দাড়িয়ে রয়েছে ! তুহিন আর জগলুর দুজনের মুখই এবার হা হয়ে গেছে । বুঝতে পালরো এই প্রাণীকে কাবু করা তাদের কর্ম নয় । তাই বলে এভাবে ওরা হাত পা গুটিয়ে বসে তো থাকতে পারে না ।

তুহিন যখন শরীরে ব্যাথা নিয়ে উঠে দাড়ালো তখনই অনুভব করলো যে শেয়াল সন্নাসী কেমন যেন থেমে গেছে । বুঝতে অসুবিধা হল না যে সন্নাসী সামনে যেতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না । তারপরই একটা হেচকা টান খেল সে । পুকুর থেকে আরও ২০ গজ দুরে ছিটকে পড়লো । তুহিন তখনই দেখতে পেল রাফায়েলকে । সে নিজের হাত দুটো দড়ি ধরে রাখার মত করে অদৃশ্য কিছু একটা ধরে রেখেছে যেন । সেটা ধরে টান টান করে আটকে রেখেছে শেয়াল সন্নাসীকে !
শেয়াল সন্নাসী নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে । নিজের হাত দিয়ে গলায় অদৃশ্য কিছু ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না । তখনই আশে পাশ থেকে শেয়ালের দল আবারও এসে হাজির হতে লাগলো । রাফায়েলের উপর ঝপিয়ে পড়তে শুরু করলো । রাফায়েল দুই হাত দিয়েই সন্নাসীকে আটকে রেখেছে । তার পক্ষে শেয়ালের আক্রমন রোধ করাটা কষ্টকর ! তুহিন বুঝতে পারলো ওকে কী করতে হবে । দৌড় গিয়ে সে রাফায়েলের সামনে হাজির হল । দেখতে পেল জগলুও হাজির হয়েছে একই ভাবে । দুজনের হাতেই তখন লম্বা ছুরি বের হয়ে এসেছে । প্রতিটা শেয়াল রাফায়েলের শরীরে ঝাপিয়ে পড়ার আগেই তুহিন সেটার ভবগতি সাঙ্গ করে দিতে লাগলো । একের পর এক । কিন্তু সংখ্যায় ওরা অগণিত । কত সময় সেগুলোকে আটকে রাখতে পারবে সেটা তুহিনের জানা নেই । তবে সে হাল ছাড়বে না !

কত সময় পার হয়েছে ওদের তিনজনের কারোই হিসাব নেই । রাফায়েল ব্যস্ত শেয়াল সন্নাসীকে আটকে রাখতে এবং তুহিন আর জগলু ব্যস্ত শেয়ালের আক্রমন ঠেকাতে। ওরা সবাই বুঝছিলো যে বেশি সময় আর আটকে রাখা যাবে না । শেয়াল সন্নাসী ছুটে যাবে । আর একবার ছুটে গেলে শিমুকে আর বাঁচানো যাবে না !

-হেই শেয়ালের ছাও !!

সব কিছু ছাপিয়ে কন্ঠটা ওদের সবার কানে এসে লাগলো । তিন জন তো বটেই শেয়াল সন্নাসীও ফিরে তাকালো ডান দিকে । এতো সময় ওরা আক্রমন আটকাতেই ব্যস্ত ছিল । শিমুর দিকে খেয়াল দেওয়ার সুযোগ ওদের ছিল না । এরই ভেতরে শিমু পানি থেকে উঠে এসেছে । পায়ের কাছে খুলিটা পড়ে থাকতে দেখলো সবাই । শিমু তাকে প্রেট্রোলও ঢেলে দিয়েছে । হাত দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ডাক দিয়েছে ।

শেয়াল সন্নাসীও বুঝতে পেরেছে কী হতে চলেছে । সে একটা প্রবল ঝাকি দিল । তাতেই ছুটে গেল রাফায়েলের বাঁধন । তবে সেটাও পর্যাপ্ত সময় পেল না । শিমু আগুনটা ছেড়ে দিল । খুলিতে পড়তেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো সেটা । সেই সাথে একটা তীব্র চীৎকার বের হয়ে এল শেয়াল সন্নাসীর মুখ দিয়ে । তবুও সে থামলো না । শিমুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো । তবে বাঁধা পেল আবারও ।
রাফায়েলের অদৃশ্য দড়ি তাকে আবারও পেছন থেকে আটকে ধরেছে ! গলায় হাত দিয়ে শেয়াল সন্নাসী নিজেজে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো । তবে এবার সেই ছাড়ানোর চেষ্টায় জোর নেই । আস্তে আস্তে সেই জোর কমে আসছে । জলন্ত লাল চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে শিমুর দিকে । শিমু সেই দৃষ্টিতে মোটেও কাবু হল না । শত বছর আগে ঠিক এমনই এক মেয়ের কাছে তার পরাজয় হয়েছিলো । আজও একই ভাবে সে চিরোতরে পরাজিত হল !

পরিশিষ্ট

শিমু তুহিনের ক্ষত গুলো দেখছে । শেয়ালের নখের আঘাতে তুহিন ক্ষত বিক্ষত । অনেক স্থান থেকে রক্ত ঝড়ছে । জগলুও একই অবস্থা । রাফায়েল তখন পুকুরটা পরীক্ষা করছে । বোঝার চেষ্টা করছে সমস্যা সমাধান হয়েছে কিনা !

শিমু দেখতে পেল কিছু সময় পরেই গ্রামের অনেক কয়জন মশাল হাত পুকুরের কাছে এসে হাজির । সবার মুখেই চিন্তার ছাপ ! ওদের দেখে যেন একটু স্বস্তি পেল সবাই । আজম বারী এগিয়ে রাফায়েলের কাছে গিয়ে দাড়ালো । রাফায়েল তার দিকে না তাকিয়েই বলল, কালই এই পুকুরের পানি সেচ দিয়ে বের করে ফেলবেন । অনেক গুলো শেয়ালের কংকাল পাবেন আশা করি । সেগুলো সব পুড়িয়ে ফেলবেন । এবং পুকুরটাও ভরিয়ে ফেলবেন । শেয়াল সন্নাসী শেষ হয়েছে । আর ওদের পরিচর্যা করুন । ওরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে আপনাদের জন্য লড়াই করেছে । এটা ভুলে যাবেন না !

আজম বারী সহ অন্য কারোকে আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রাফায়েল ডান দিকে জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালো । শিমু রাফায়েলের চলে যাওয়া দেখলো । ভোর হতে যদিও অনেক বাকি তবুও শিমুর মনে হল যে চারিদিকটা অনেক আলোকিত হয়ে গেছে । শিমু আবারও তুহিনের ক্ষত দেখায় ব্যস্ত । শিমুর মনে হল এই ছেলেটার সাথে যেভাবে ওর পরিচয় হয়েছে সেটা এতো সহজে চলে যাবে না । তবে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত সে ঠিকই নিয়েছে । বিদেশে সে যাবে না । এই দেশেই থাকবে । এবং এই গ্রামে নিজেদের একটা বাড়ি বানাবে । এটাই ওদের গ্রামের বাড়ি । এখানে সে আবারও ফিরে আসবে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 52

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →