অতৃ

oputanvir
4.9
(105)

-আপনি কি চা খাচ্ছেন ?

আমি ফ্ল্যাক্সটা এক পাশে রেখে উপরে পাশে ফিরে তাকালাম । নীল রংয়ের একটা সালোয়ার কামিজ করে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে । আমার দিকেই তাকিয়ে আছে । আমি কিছুটা সময় অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনেক দিন এমন মিষ্টি চেহারার কাউকে আমি দেখি নি। কিছুটা সময় আমি মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । ঠিক বুঝতেও পারছিলাম না আসলেই এই মেয়ে হঠাৎ আমাকে এই কথা কেন জানতে চাইলো । আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম

-হ্যা । তবে এটা ঠিক চা না !

মেয়েটা কৌতুহল নিয়ে বলল

-তাহলে ? দেখতে তো চায়ের মতই মনে হচ্ছে ।

আমি একটু বোকার মত হেসে বললাম

-আসলে এটা চাফি ?

-চাফি ?

-চা আর কফির মিক্স !

মেয়েটা আমার পাশে খুব স্বাভাবিক ভাবে বসতে বসতে বলল

-আমাকে কি এক কাপ দেওয়া যায় ? আসলে আমার খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু এখানে কোথায় যে চা খাবো বুঝতে পারছি না। তখনই আপনাকে দেখলাম বসে বসে আরাম করে চা খাচ্ছেন । সাথে আবার ফ্ল্যাক্সও আছে । ভাবলাম যদি আরও এককাপ হয় ! তাই বলেই ফেললাম। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন কি নির্লজ্জ মেয়েরে বাবা ! চেনা নেই জানা নেই মানুষ কাছের চা চেয়ে খাচ্ছে !

এই মেয়েটা কেমন খিলখিল করে হেসে উঠলো । আমি কিছুটা সময় অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটাকে কেমন যেন পরিচিত লাগলো । তবে মেয়েটার বয়স অনেক কম । এতো কম বয়সী মেয়ের সাথে আমার কোন ভাবেই পরিচয় থাকার কথা না । কোন ভাবেই না । হয়তো মেয়েটা বেশি সুন্দর বলেই হয়তো আমার এমন মনে হচ্ছে। একটা সময় ছিল আমার প্রায় সব সুন্দরী মেয়েকেই পরিচিত মনে হত !

আমি হেসে বললাম

-না ! আমার মনে হচ্ছে না । তবে একটু অবাক লাগছে । আসলেই কোন মেয়ে অন্য অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে চা খেতে চায় না । আমার মত বুড়োর কাছ থেকে তো নয়ই !

মেয়েটা এবার বলল

-আপনাকে তো বুড়ো বলে মনে হচ্ছে না। কত বয়স আপনার ? চল্লিশ? এর বেশি তো হবে না ।

আমি এবার জোর করে হেসে উঠলাম । বললাম

-আমাকে দেখে কি আসলেই চল্লিশের মত মনে হচ্ছে ? যাও এই জন্য তোমাকে এক কাপ চাফি খাওয়ানো যায়ই ।

এই বলে আমি খুজতে লাগলাম মেয়েটা কে কিসে চাফিটা দেওয়া যায় ।

তখনই দেখলাম মেয়েটা একটা ওয়ান টাইম গ্লাস আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে । আমি সেটা নিতে নিতেই মেয়েটা বলল

-হুম । সত্যি বলছি । মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই তবুও বলি আমার বয়স ২১ বছর । কিন্তু আমাকে দেখতে আরও বেশি মনে হয় আমি জানি । আপনার মনে হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ এর ভেতরে হবে । রাইট !

-রং । ভেরি রং ইয়াং লেডি ! আমার বয়স ফিফটি টু । বুঝেছো ?

মেয়েটা কিছুটস অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থেকে বলল

-আপনি মিথ্যা বলছেন । 

-সার্টিফিকেট দেখাতে পারি ! এনআইডি কার্ড কিন্তু মানিব্যাগেই আছে । দেখবো ?

মেয়েটা অবশ্য দেখতে চাইলো না । চাফির গ্লাস নিয়ে একটু একটু চুমুক দিতে লাগলো ।

আমি একটু অবাক হলাম । মেয়েটা আমার এই চাফির কাপে চুমুক দিয়েও কোন মন্তব্য করলো না । এমনটা খুব সাধারনত হয় না । আমার যে অল্প কয়েকজন পরিচিত মানুষ আছে তারা সবাই এই চাফি খেয়ে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং আর দ্বিতীয়বার খেতে চায় নি কোন দিন। কিন্তু এই মেয়েটা খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেটাতে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে । আমি বললাম

-খেতে পারছো ?

-হুম ! বেশ ইন্টারেস্টিং !

আমি হাসলাম । তারপর বলল

-যাক আরও একজন পাওয়া গেল যার চাফি পছন্দ হয়েছে ।

-আরও একজন ! মানে আপনি আর আমি ! এই দুইজন !

আমি একটু হেসে বলল

-আমি তুমি ছাড়াও আরও একজন আছে যে এই চাফি পছন্দ করে !

-কে ?

-আছে একজন!

মেয়েটা আবারও চুপ করে করে গেল । প্রশ্ন করলো না, মেয়েটা বুঝতে পেরেছে আমি এই ব্যাপার নিয়ে আর কথা বলতে চাই না । বাহ ! সবাই যদি এমন হত যে স হজেই বুঝে নিত যে মানুষ কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী আর কোন বিষয় নিয়ে নয় ! আমি নিজে কাপে চুমুক দিচ্ছি আর মেয়েটার কাপে চুমুক দেওয়া দেখছি । হঠাৎ করেই আমার কি যেন মনে পড়ে গেল । মাথার ভেতরে হঠাৎ করেই কত দৃশ্য চলে এল । জোর করে দুরে ঠেলে দিতে চাইলেও কাজ হল না । এই দৃশ্য গুলোর কাছে আমি বড় অসহায় । তারপর হঠাৎ করেই আমাকে বলল

-জানেন এই মিন্টু রোড টা আমার বাবার অনেক প্রিয় একটা রাস্তা !

-তাই নাকি?

মিন্টু রোডটা আমার কাছে সেই আগের মতই রয়ে গেছে । পুরো ঢাকার ভেতরে কেবল এই মিন্টু রোডে আসলেই কেন জানি মনে একটা শান্তি শান্তি লাগে । ক্যাম্পাস শেষ করে যখন টিউশনীতে যেতে হত তখন আগে এখানে এসেই বসে থাকতাম কিছুটা সময় । সেই অভ্যাসটা এখনও রয়েই গেছে । এখনও অফিস শেষ করে এখানে এসে বসে থাকি । আরও কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই রোডটার সাথে।

আমি হঠাৎ মেয়েটাকে বললাম

-অনেকটা সময় তোমার সাথে কথা হচ্ছে । তোমার নাম এখনও জানা হয় নি ।

মেয়েটা একটু হেসে বলল

-আমার নাম তাইশা রহমান ।

-নাইস টু মিট ইউ মিস তাইশা ! মানে মিস আছো তো এখনও ?

মেয়েটা যেন আমার কথাতে লজ্জা পেল । তারপর বলল

-হ্যা । এখনও আছি । আরও অনেক দিন মিসই থাকার ইচ্ছে ।

-তা তুমি কি যেন কি বলছিলে ! তোমার বাবার খুব প্রিয় রাস্তা এটা । কোথায় তিনি এখন ?

এই কথার জবাব দিতে গিয়ে তাইশা হঠাৎ করেই যেন থেমে গেল । যেন কিছু নিয়ে হঠাৎ করেই চিন্তিত হয়ে গেছে । তারপর বলল

-বাবা আমার সাথেই আছে সব সময় !

আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । মেয়েটার বাবার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে কিংবা মারা গেছে। যাক এর বেশি কৌতুহল দেখানো ঠিক হবে না । আমি প্রসঙ্গ বদলাতে বদলাতে বললাম

-তুমি কি প্রায়ই আসো এখানে ?

-না । আমি তো এখানে থাকিই না ।

-কোথায় থাকো ?

-আসলে আমি আমেরিকায় বড় হয়েছি !

আমি খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না । মেয়েটার সাথে কত সময় ধরে কথা বলছি কিন্তু একটা সময়ই মনে হয় নি যে কোন বিদেশী কোন মেয়ের সাথে কথা বলছি । যে মেয়ে ছোট থেকে আমেরিকাতে বড় হয়েছে সে এতো চমৎকার বাংলা কিভাবে বলে । আমার মনের কথা মেয়েটা বুঝতে পেরে তাইশা বলল

-আপনি হয়তো ভাবছেন যে ওখানে থেকেও আমি কিভাবে এতো চমৎকার বাংলা বলি, রাইট ?

-হ্যা । এটাই কি ভাবা স্বাভাবিক না ?

-হুম । সেটার জন্য অবশ্য ক্রেডিট আমার আম্মুকে দিতে হবে ।

আমি বললাম

-আর আব্বু ?

বলেই মনে হল কথাটা বলা ঠিক হয় নি । দেখলাম মেয়ের মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল । তবে সেটা সামলে নিতে নিতে বললাম

-এখন আব্বুও থাকবে । যাক সেটা না । আপনি এখানে প্রতিদিন আসেন নাকি ?

-হ্যা । বলতে পারো । কাজ কর্ম নেই । অফিস থেকে সোজা এখানেই আসি । কিছু সময় কাটাই এখানে।

-কেন আপনার ফ্যামিলি ?

আমার ফ্যামিলি !

আমি কিছু না বলে চুপ করেই রইলাম । মেয়েটা হয়তো বুঝে নিল যে আমার আসলে বলার মত কেউ নেই । মেয়েটা আবারও চুপ করে গেল আগের মতই । আমার এসব নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না । পুরানো স্মৃতি গুলো মনে পড়ে গেলে রাতে ঘুমাতে বেশ ঝামেলাতে পড়তে হয় ।

সেদিন আর আমাদের মাঝে কোন কথা হল । মেয়েটা আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে গেল । আর বলে গেল আর কটাদিন সে থাকবে এখানে । সময় সুযোগ পেলে এখানে ঠিকই আসবে আবার । আবার হয়তো আমার সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে ।

মেয়েটা চলে গেলেই একটা দীর্ঘ্যশ্বাস বেরিয়ে গেল মন থেকে । এতো বছর একা একা থেকে কেমন যেন হয়ে গেছি । ধরেই নিয়েছি হয়তো জীবনটা এমন ভাবেই কেটে যাবে । একা একা । কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ কারো সাথে দেখা হয়ে যায় । তখন বুকের ভেতরে খাঁ খাঁ করে ওঠে । সেই শূন্যতা পূরনের ক্ষমতা আমার নেই ।

তাইশা রহমানের সাথে আমার আবার দেখা হল পরের সপ্তাহে । মাঝ খানে কদিন আমি মিন্টুরোডে আসতে পারি নি । হঠাৎ করেই গ্রামের বাসাতে যেতে হয়েছিলো । তবে পুরোটা সময় আমি কোন একটা অদ্ভুদ কারণে তাইশা নামের মেয়েটার কথা ভেবেছি । কি কারণে ভেবেছি আমি জানি না ।

অফিসের পর এসে দেখি মেয়েটা কেমন যেন একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে । সামনেই একটা নীল রংয়ের গাড়ি দাড়িয়ে রয়েছে । মেয়েটা সেটার আশে পাশে ইতস্তত করে হেটে বেড়াচ্ছে । আমাকে দেখেই এগিয়ে এল । আমার কাছে মনে হল মেয়েটা যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিল । আচ্ছা এই মেয়েটা কি এই পুরো সপ্তাহ আমার খোজে এখানে এসেছে ?

নাহ । কোন সম্ভাবনা নেই । তাইশা আমার কাছে এসে হাসি মুখে বলল

-কেমন আছেন?

-ভাল । তোমার কি খবর?

-ভাল না । আগামীকাল চলে যাবো । ভাবলাম যাওয়ার আগে আপনার কাফি আরেকবার খেয়ে যাই।

আমি বসতে বসতে নিজের ব্যাগ থেকে ফ্ল্যাক্স বের করতে লাগলাম । কেন যেন আগেই মনে হচ্ছিলো আজকেও তাইশার সাথে আমার দেখা হবে এবং মেয়েটা চাফি খেতে চাইবে । এমনটা মনে হওয়ার কোন কারণ ছিল না ।

আমি আবারও কাপে করে মেয়েটাকে চাফি ঢেলে দিলাম । মেয়েটা আগ্রহ নিয়ে সেটা খেতে শুরু করলো । কাপ শেষ করেই মেয়েটা হঠাৎ বলল

-আচ্ছা কাল তো চলে যাবো আর তো দেখা হবে না ।

এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই । দেখা হওয়াটা তেমন জরুরীও অবশ্য না। মেয়েটি বলল

-আপনার কাছে তো আমার ঋণ রয়ে গেল!

আমি অবাক হয়ে গেলাম ।

-ঋণ মানে!

-এই যে চাফি খাওয়ালেন!

-আরে এটা কোন ঋণ নাকি ?

-আমার কাছে তো মনে হচ্ছে । আসুন আপনাকেও কিছু খাওয়াই । তাহলেই এই ঋণ চলে যাবে!

আমি হেসে বললাম

-কোন চিন্তা নেই । আমাকে কিছু খাওয়াতে হবে না ।

তাইশা মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল

-কিছু তো খেতেই হবে । আপনি আমাকে চাফি খাওয়ালেন আমি আপনাকে আসুন চটপটি খাও্য়াই! আসুন । ঐ যে একটা চটপটিওয়ালা আসছে ! আসুন আসুন !

আমি প্রবল বেগে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললাম

-আরে না না । তোমাকে কিছু খাওয়াতে হবে না ।

-কেন আপনি চটপটি পছন্দ করেন না ?

-না সেটা না । একটা সময় আমি খুব চটপটি খেতাম ।

-তাহলে আজও খাবেন ! আসুন আসুন !

-দেখো মা, আমি মিথ্যা কথা বলি না । তাই পছন্দ করি না এই কথাও বলছি না । তবে টপপটি আমি খেতে পারবো না । আমার নিষেধ আছে!

-নিষেধ ?

-হ্যা ! ২৩ বছর আগে আমি একজনকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি আর কোনদিন বাইরের চটপটি খাবো না । কেবল চটপটি কেন কোন বাইরের খাবরই খাবো না কোন দিন । তাই এখনও খাই না।

মেয়েটা হঠাৎ চুপ করে গেল । আমি অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটার চোখের কোনে অস্পষ্ট পানি জমতে শুরু করেছে । আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম । বললাম

-কি হল ? আমি কি তোমাকে কষ্ট দিলাম । দেখো আমি আসলেই স্ট্রিট ফুড খাই না । তুমি আমাকে বরং একটা চকলেট কিনে দিও । তাতেই চলবে ! কমেন !!

তাইশা চোখে পানি মোছার চেষ্টা না করেই বলল

-এই ২৩ বছর ধরে আর কি কি করেন না আপনি ? একটা সময় খুব বিরিয়ানী খেতেন । ২৩ বছরে একবারও বিরিয়ানী খান নি , তাই না?

আমি এবার সত্যিই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে । বুকের ভেতরে কেমন একটা অদ্ভুদ অনুভুতি হতে লাগলো আমার । আমি কেবল কোন মতে বলতে পারলাম

-তুমি কে মা ? এই কথা তুমি কিভাবে জানলে ?

মেয়েটা সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল

-আমার একটা ডাক নাম আছে । আমার মা আমাকে সব সময় সেই নামেই ডাকে! অতৃ!

আমার কেবল মনে হল আমি হয়তো ভুল শুনলাম। এটা কি হতে পারে?

না কোন ভাবেই না ।

অতৃ!

আমার আর তৃষার নামের প্রথম দুই অক্ষর দিয়ে আমরা নামটা ঠিক করেছিলাম । ঠিক করেছিলাম যে আমাদের প্রথম মেয়ের নাম হবে অতৃ । আমি কেবল অনুভব করলাম যে আমার বুকের ভেতরে অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে!

তৃষা সব সময় খুব জোর দিয়ে বলতো আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হবে। আমি বললাম যে আমাদের বংশ তো আগে সব সময় ছেলে হয়েছে। আমার বাবা তার বাবা চাচা সবাই । আমারও তাই হবে । কিন্তু তৃষাকে কে বোঝাবে! সে একবার যা ভাববে তাই। সে তো নিজের মেয়ের নামও ঠিক করে ফেলেছিলো ।

কিন্তু তারপর ….

তারপর একদিন সব অন্য রকম হয়ে গেল । একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তৃষা নেই। কেবল ওর একটা নোট লেখা ছিল আমার সামনে।

আমার জন্য অপেক্ষা কর না । আমি আর ফিরে আসবো না ।

আমাদের সম্পর্কের শুরু থেকেই আমি এই কথাটা জানতাম। একদিন তৃষা ঠিকই চলে যাবে।আমি ওকে আটকানোর জন্য কত কিছুই না করতাম কিন্তু নিজের কাছেই জানতাম একদিন ও ঠিক ঠিকই সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে, আমাকে ছেড়ে চলে যাবে! চলে গিয়েও ছিল। কিন্তু এই মেয়ে!

কিভাবে? এই এসব কিভাবে জানে?

আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না ।

আমি তাইশার দিকে খুব ভাল করে তাকালাম । মেয়েটা কেমন ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মেয়েটার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিনই আমার কাছে কেমন যেন পরিচিত মনে হয়েছিলো।

বুচা নাক আর এই গভীর চোখ!তৃষার চোখ আর নাম পেয়েছে মেয়েটা!

তাইশা বলল

-আপনি কি জানেন আম্মু এখনও ঘুমের ঘোরে এখনও মাঝে মাঝে আপনার নাম ধরে ডাকে! আমি কতবার জানতে চেয়েছি কিন্তু আম্মু বলে নি।

আমি কোন মতে বললাম

-তারপর কিভাবে জানলে?

-আম্মুর ডায়রি পড়ে। এতোদিন সেগুলো বেজমেন্টের একটা ড্রামে লুকানো ছিল। খুজতে গিয়েই পেয়ে যাই। কত কথা আম্মু আপনাকে নিয়ে লিখেছে সেখানে আপনি আম্মুকে নিয়ে কত পাগলামো করেছে আপনাদের সেই চার মাসের সংসারটা কত চমৎকার ছিল আরও কত কি!

তাইশা কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। নিজেকে যেন সামলে নিচ্ছে। আমি ওর দিকে তখনও তাকিয়ে আছি। তাইশা বলল

-তারপর আম্মু যখন বুঝতে পারলো যে আমি তার গর্ভে এসেছি সেই সময়েই সে আপনাকে ছেড়ে যাওয়া সিদ্ধান্ত নিল । কেন নিলো সেটা আমি বুঝতে পারি নি। এতো সুখের সংসার ছেড়ে সে কেন চলে গেল! কেন?

আমার কাছে এই চলে যাওয়ার কারণ জানা ছিল। সেই ছোট বেলা থেকে তৃষার ভেতরে এক অদ্ভুত ভয় ঢুকে ছিল যে ওর জীবনে সুখ খুব বেশি দিন স্থায়ী হবে না । ওর পুরো জীবনেই এমন হয়ে এসেছ! সব কিছু যখন ঠিকঠাক চলতে শুরু করবে তখনই কিছু না কিছু অশুভ ঘটবেই। এই জন্যই ও সব কিছু ছেড়ে চলে গিয়েছিলো! আমি ওকে কতবার বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে কোন কিছু হবে না কিন্তু ও সেই একই কথা। যদি কোন কারণে আমার উপরে কোন বিপদ নেমে আসে তাহলে ও নিজেকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারবে না।

আমি তাইশার দিকে তাকিয়ে রইলাম একবাবে। এই মেয়েটা আমার মেয়ে!

আমার নিজের মেয়ে!

তাইশা বলল

-আমি কি আপনাকে বাবা বলে ডাকতে পারি একটু?

বুকের ভেতরটা কেমন যেন হুহু করে উঠলো । কোন কথা না বলে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম ।

এই ভর সন্ধ্যাবেলা আমরা বাপ মেয়ে এই মিন্টু রোডের ফুটপাতের উপর বসে আছি। দুর থেকে যে কেউ দেখলে অবাক হয়ে দেখবে একজন মাঝ বয়সী পুরুষ আর একজন তরুণী রাস্তার ধারে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। কিন্তু তারা এটা কোন দিন জানবে না যে দুজনের চোখের পানিতে কতটা আনন্দ রয়েছে। প্রায়ই দুই যুগ পরে বাবার সাথে মেয়ের দেখার হওয়ার আনন্দ!

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 105

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

3 Comments on “অতৃ”

  1. অন্যরকম এক অনুভূতি মনকে নাড়া দিল ?

  2. arekta Part hole valo hoto.. apnar sob golpoi to happy ending thake tai

Comments are closed.