তৃণা নিচের দিকে একভাবে তাকিয়ে রইল । খড়স্রোতা নদীর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকলে নাকি ঘোরের মত সৃষ্টি হয়। বারবার মনে হয় সেই পানির ভেতরে ঝাপ দিতে করে। এর আগে যতবার ব্রিজ থেকে নিচের দিকে তাকিয়েছে তত বারই এমন মনে হয়েছে। তবে এইবার সে সত্যিই ঝাপ দিবে নিচে। এই জীবন তার কাছে আর সহ্য হচ্ছে না । জীবনটা এমন ভাবে এখানে শেষ হয়ে যাবে তৃণা সেটা কোন দিন ভাবে নি । কোন দিন কল্পনাও করে নি যে সেদিনের একটা সিদ্ধান্ত এভাবে এক ধাক্কাতেই জীবনটা এখানে নিয়ে ফেলবে !
তৃণা আরেকবার চিন্তা করল । ওর মৃত্যুর খবর শুনে কি ওর বাবা কাঁদবে?
গত চার বছরে বাবা একটা বারের জন্যও ওর মুখ দেখে নি । নিজের বাড়িতে ঢুকতে পর্যন্ত দেয় নি । সে পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যেদিন যে বাড়ি ছেড়েছিল সেদিনই সে তাদের জন্য মারা গিয়েছে। তাই আজকের মৃত্যু তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। হয়তো দেখা যাবে তার বাবা তার লাশ দেখতে আসবেও না । অথবা এমন হতে পারে তার লাশ হয়তো খুজেই পাওয়া যাবে না। এই নদীতে সে ঝাপ দিলে লাশ পরলে সেটা সহজে খুজে পাওয়া যাবে না । কেউ হয়তো জানতেও পারবে না যে তৃণা এখানে মারা গেছে। আচ্ছা সোয়েব কি জানতে পারবে?
সোয়েবের নামটা মনে আসতেই মনের ভেতরে একটা তিক্ততায় ভয়ে উঠল । আর কিছু যে চিন্তাই করল না । ব্রিজের রেলিংয়ে ধরে থাকা হাতটা ছেড়ে দিল । তীব্র গতিতে সে নিচের দিকে পড়তে লাগল…
গল্পের শুরু
রিক্সাটা যখন স্টেশনে এসে থামল তখন তৃণা অনুভব করল । বুকের ভেতরটা তীব্র ভাবে কাঁপছে । একটা ভয় এসে জড় হচ্ছে । বারবার কেমন হচ্ছে যে কেউ দেখে ফেলবে । একবার দেখে ফেললেই খবর চলে যাবে ওর বাবার কাছে । বাবা যখন জানতে পারবে তখন তৃণাকে কী যে করবে সেটা তৃণা ভাবতেও পারছে না । কিন্তু তারপরেও তৃণা এতো সাহসের কাজটা করে ফেলল । বাসা থেকে আজকে সে পালিয়েছে । কলেজ যাওয়ার নাম করে বাসা থেকে বের হয়েছে । প্রতিদিন এই সময়ে সে কলেজে যায় । তাই কারো মনে কোন সন্দেহ জাগবে না । তার বাবা এই সময়ে অফিসে থাকে । মা নিজের রান্না ঘরে । সন্ধ্যা পর্যন্ত না ফিরলেও কারো মনে কোন সন্দেহ জাগবে না । যখন ওকে বাড়ির লোকজন খুজতে শুরু করবে তখন সে অনেক দুরে চলে যাবে।
সোয়েব সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে । ওকে কেবল স্টেশনে গিয়ে লোকাল ট্রেন ধরে পাশের জেলার মনিপুরে যেতে হবে । সেখানেই সোয়েব অপেক্ষা করবে। ওখানেই সোয়েবের সাথে তৃণার বিয়ে হবে । সোয়েব ওকে নিয়ে সংসার শুরু করবে । প্রথম কয়েকদিন হয়তো তৃণার বাবা ওদের এই সম্পর্ক মেনে নিবে না তবে একটা বাচ্চা হয়ে গেলে ঠিকই মেনে নিবে এটা তৃণার বিশ্বাস । এছাড়া সোয়েবের পরিবার তো আছেই । সোয়েব তৃণার কথা জানিয়েছে ওর বাসায়। সোয়েবের পরিবার মেনেও নিবে বলে জানিয়েছে । তাই খুব একটা চিন্তার কারণ নেই ।
তৃণা রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে দিল । তারপর দ্রুত ঢুকে পরল স্টেশনে । পরের ট্রেন আসতে আরও ঘন্টা খানেক বাকি । তাই এখন স্টেশন ভীড় কম । তৃণা দ্রুত দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশ্রামাগারের ওয়াশরুমে ঢুকে পরল । ব্যাগের ভেতরে করে সে কোন কিছুই আনে নি। অল্প কিছু জমানো টাকা । সোয়েব ওকে কোন টাকা পয়সা আনতে মানা করেছে । তারপরেও জমানো কিছু টাকা সে ঠিকই নিয়ে এসেছে । ভেতরে ঢুকেই সে নিজের পোশাক বদলে ফেলল । মুখে বেশ ভাল করে বোরকার মত করে স্কার্ফ বাঁধল । আর নিচে একটা জিন্স পরা । বাইরে তৃণা সাধারনত জিন্স পরে বের হয় না । সেলোয়ার কামিজ ছাড়া কিছুই পরে না । তাই এই জিন্স পরাতে ওকে মানুষ চিনতে পারবে না । অন্তত তৃণার নিজের তাই ধারণা ।
টিকিট কাউন্টারে যখন টিকিট চাইল তখন বুকের ভেতরে খুব করে উত্তেজনা বোধ করছিল। ছোট শহর অনেকেই ওর বাবাকে চিনে । সেই হিসাবে তাকেও চিনতে পারে যে কেউ । তবে আশা করা হচ্ছে কাউন্টারের লোকটা কিছু না বলেই ওকে টিকিট দিয়ে দিল। সেটা নিয়ে তৃণা আবার এসে হাজির দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাগারে ! এখানেই সে বসে থাকবে ঠিক করল ।
তৃণা আরেকবার চিন্তা করল । কেন কাজটা করতে যাচ্ছে সে ?
সোয়েবের ভালবাসা কি ওর বাবা মায়ের ভালবাসা থেকেও বড়?
কিন্তু এখন সে সোয়েবকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না । মনে হয় ওকে ছাড়া সে কিছুতেই টিকে থাকতে পারবে না । ওর কাছে সব কিছু শূন্য মনে হয় । তাই নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার থেকে ওরা এক সাথে থাকবে । কোন শক্তি আর তাদের আলাদা করে রাখতে পারবে না ।
-তৃণা !
ডাকটা শুনেই তৃণার চিন্তায় ছেদ পরল । এবং সাথে সাথেই একটা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল তার শরীর জুড়ে । কেউ তার নাম ধরে ডাকছে ! এটার একমাত্র মানে হচ্ছে কেউ তাকে চেনে । চিনতে পেরেছে !
এখন?
তৃণা অনুভব করল যে তার নিঃশ্বাসে একটু দ্রুত হতে শুরু করেছে। এখন সে কী করবে?
নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল । অনুভব করল মানুষটা ঠিক ওর পাশে এসে বসেছে। পুরো ঘরে আর কেউ নেই ।
তৃণা ঘুরে তাকাল তার দিকে । ঠিক চিনতে পারল না। চেহারা এর আগে দেখেছে বলে মনে পড়ল না । তাহলে কি মানুষটা তার বাবার চেনা?
নিজেকে যথাযত ভাবে শান্ত রেখে বলল, জ্বী !
-কেমন আছো?
-জ্বী ভাল !
তৃণা এবার যুবকের চেহারার দিকে আরেকটু ভাল করে তাকাল। বয়স ত্রিশের বেশি হবে না, চোখে চশমা পরা। চুলগুলো এলোমেলো । তবে চেহারা একটা ভদ্র ভাব আছে । হাতে একটা খবর কাগজ ধরা । সেটা ভাজ করে ধরা হাতে। তৃণা বলল, আপনি কি আমাকে চিনেন? আমার বাবার পরিচিত?
-না তোমাকে আমি এখনও চিনি না । তবে পরে চিনব। আর তোমার বাবাকেও চিনি না ।
বাবাকে চেনে কথাটা তৃণার মনে একটু স্বস্তি এনে দিল । তবে অন্য কথা গুলো সে ঠিকমত বুঝতে পারল না। বলল, মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
যুবক বলল, তুমি যে কাজটা করতে যাচ্ছো সেটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত !
-মানে? কী বলছেন আপনি?
-মানে তুমি খুব ভাল করে জানো । যে কাজটা তুমি করতে যাচ্ছো সেটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না ।
তৃণা এবার উঠে দাড়াল । তারপর কন্ঠকে যথা সম্ভব কঠিন করে বলল, দেখুন আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না । তবে আমি আপনার সাথে আর কথা বলতে আগ্রহী না । আপনি এখন আসতে পারেন ।
কথা বলেই তৃণার মনে হল যে একটা বোকার মত কথা বলে ফেলল । এটা ওদের বাসা নয় । যে কাউকে যে রুম থেকে বের করে দেওয়ার অধিকার রাখে না । আর এখানে খুব বেশি চিৎকার চেঁচামিচি করাও যাবে না । কারণ এতে যদি লোক জড় হয় তাহলে তার জন্যই ব্যাপারটা ভাল হবে না । এই ব্যাপারটা সম্ভবত সামনের এই যুবকও জানে ।
যুবক কিছু সময় কেবল শান্ত ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হাতের পত্রিকাটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল । তৃণা কী করবে ঠিক বুঝল না । যুবক বলল, আমি যে তোমাকে মিথ্যা কিছু বলছি না সেটা এই পত্রিকাটা পড়লেই বুঝবে। ভেতরের ছয় নম্বর পাতায় দুই নম্বর কলামের সংবাদটা পড় ।
তৃণা কিছু বুঝল না । খবরের কাগজের এই খবর পড়লে তৃণা আসলে কী বুঝবে ?
সে হাত বাড়িয়ে খবরের কাগটা নিল । ছয় নম্বর পেইজের দুই নম্বর কলামের সংবাদটা চোখে পড়ল সে।
নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তরুণীর আত্মহত্যা
খুলনায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নওরিন আহসান তৃণা (২৫) নামে এক গৃহবধু আত্মহত্যা করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার খানজাহান আলী সেতুতে (রূপসা সেতু) এ ঘটনা ঘটে। তৃণা রূপসা নগরীর টুটপাড়ার সোয়েব আহমেদের স্ত্রী। নগরীর লবণচরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
তৃণা অদ্ভুত ভাবে খবরটা আরেকবার পড়ল। মনের ভেতরে একটা তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হল । যুবক ওকে কেন খবরটা পড়তে বলল সেটা ওর কাছে পরিস্কার হয়ে গেল মুহুর্তেই।
যুবক ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল । তারপর বলল, নিজের মৃত্যু সংবাদ পড়তে কেমন লাগল !
-মানে ! আপনি কী বলছেন এসব !
-তারিখটা দেখো !
তৃণা খবরের কাগজের তারিখটা দেখল । ১৪ই আগষ্ট ২০২৮
তীব্র একটা অবিশ্বাসের নিয়ে একবার তাকাল যুবকের দিকে আরেকবার তাকাল সংবাদপত্রটির দিকে । সংবাদ পত্রটা মোটেই ওর কাছে নকল মনে হচ্ছে না । আর এই যুবকের এই নকল পত্রিকা তৈরি করে লাভই বা কী !
যুবক যেন তৃণার মনের কথাই বুঝতে পেরে বলল, ভাবছো যে এই পত্রিকা আমি নিজে বানিয়ে নিয়ে এসেছি! কিন্তু এতো নিখুত ভাবে একটা পুরো পত্রিকা তৈরি করতে কী পরিমান খাটনি আর খরচের ব্যাপার সেটা বুঝতে পারছ তো ! এবং সব থেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে আমার এতে লাভ কী!
তৃণার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । যুবক আবার বলল, শুনো তৃণা তুমি যদি আজকে ঐ ট্রেনে চড়ে বস তাহলে নিশ্চিত ভাবেই চার বছর পরে এই পত্রিকার সংবাদটা সত্যি হয়ে যাবে । তুমি তোমার জীবন নিয়ে এতোই হতাশ হয়ে যাবে যে নিজে নিজের জীবন নিয়ে নিবে। এই ট্রেন তোমার জীবনের একেবারে আপসাইট ডাউন করে দিবে । তুমি যদি ট্রেনে উঠতে চাও আমি তোমাকে বাঁধা দেব না । তুমি চলে যেতে পার কিন্তু তুমি যখন ঝাপ দিচ্ছিলে তখন তুমি মনে মনে চাচ্ছিলে যে একটা দ্বিতীয় সুযোগের জন্য । এটাই তোমার সেই দ্বিতীয় সুযোগ!
বিশ্রামাগারের ভেতরে একেবারে নিরবতা নেমে এল। যুবক এক সময় বলল, আমি যাই তৃণা। সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব একেবারেই তোমার !
যুবক যখন দরজার দিকে পা বাড়াবে তখন তৃণা বলল, আপনি কে?
যুবক থাকল । একটু হাসল । তারপর বলল আমি কেউ না ।
-আপনি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে?
-তোমার কি মনে হচ্ছে?
-বিশ্বাস হচ্ছেনা । এটা সম্ভব না ।
-হয়তো সম্ভব না । কিন্তু এই দুনিয়াতে এমন অনেক কিছুই আছে যার কোন ব্যাখ্যা নেই । আমিও ধর সেই ব্যাখ্যা না হওয়ার ব্যাপার । আমাকে নিয়ে এতো ভেব না । কেবল নিজেকে নিয়ে ভাব । মনে রেখ তোমার বাবা মায়ের থেকে এই দুনিয়াতে আর কেউ তোমাকে ভালবাসে না । তাদের মত এতো ত্যাগ আর কেউ স্বীকার কেউ করবে না । তাদের মনে কষ্ট দিও না । কেমন!
যুবক তাকে একা রেখে চলে গেল।
তৃণা এখন কী করবে!
পরিশিষ্ট
-কী হয়েছে মা? কিছু বলবি?
জামান সাহেব একটু আগে অফিস থেকে বাসায় এসেছে । এখনও অফিদের পোশাক ছাড়ে নি । আজকে তিনি মেয়ের পছন্দের ছোট জিলাপি নিয়ে এসেছেন । এখনও সেটা তৃণার হাতে তুলে দেন নি । তার আগেই তৃনা ঘরে চলে এল । তারপর জামান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠল ।
-আরে বোকা মেয়ে ! কী হল ! কাঁদছিস কেন?
-তোমাকে খুব ভালবাসি বাবা ! তোমাকে ছেড়ে কোন দিন যাব না । কোন দিন না । আমার উপর রাগ করবে না তো কোন দিন?
-আরে পাগল মেয়ে ! তোকে রেখে কি আমি দুরে থাকতে পারি !