পিয়া আর তমালের গল্প

4.6
(42)

পিয়া আস্তে আস্তে হাটছে। পিয়া পেছনে না তাকিয়েই জানে যে ওর ঠিকই জানে যে তমাল ওর পেছন পেছন আসবে । আগে এই ব্যাপারটা পিয়া খুব বিরক্ত করত তবে ওর দুর্ঘটনার পরে পিয়ার খারাপ লাগে না । বরং নিজেকে খানিকটা নিরাপদ মনে হয় এখন। বিশেষ করে যখন সে সত্যটা জানতে পারল তমালের ব্যাপারে তখন থেকেই তমালের জন্য মনের ভেতরে একটা অন্য রকম অনুভূতি এসে জড় হয়েছে। একটা মানুষ নিরবে ওকে এভাবে পছন্দ করতে পারে সেটা পিয়ার ধারণার বাইরে ছিল । আজকে পিয়া নিজ চোখে ব্যাপারটা দেখতে চায় যে তমালের অনুভূতিটা কেমন হয় । সেই মোতাবেকই ও পরিকল্পনা করেছে । যদিও দূর্ঘটনার পর থেকে বাসার সবাই ওর ব্যাপারে একটু বেশি সতর্ক থাকে । নানান রকম রেস্টিকশন দিয়ে রাখে । এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না ! আরো কত কতই না নিয়ম! 

তবে কলেজে থাকলে ওর বাসার লোকজন খুব বেশি চিন্তা করে না । বিশেষ পিয়ার বাবা একেবারেই নিশ্চিন্তে থাকেন । পিয়ার বাবা আতাহার সাহেব তমালের ব্যাপারটা জানেন । মূলত তমালের ব্যাপারটা পিয়া জেনেছেই ওর বাবার কাছ থেকে । পিয়া যখন কোমাতে ছিল সেই সময়ে তমাল প্রতিদিন ওকে দেখতে আসতো হাসপাতালে । প্রতিদিন মানে প্রতিদিন । আতাহার সাহেবই পিয়াকে তমালের কথা বলেছিলেন যখন পিয়া খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিল । প্রায় ৬০ দিন পিয়া কোমাতে ছিল ।  পিয়া প্রথমে তমালকে চিনতেই পারে নি । তবে যখন আতাহার সাহেব তমালের মসজিদের ব্যাপারটা বললেন তখন পিয়ার মনে একটা বিস্ময় জেগেছিল । বিস্ময় জেগেছিল আতাহার সাহেবের মনেও । 

পিয়ার এক্সিডেন্টের পরে আতাহার সাহেব চিকিৎসার ত্রুটি যেমন করেন নি ঠিক একই ভাবে উপরওয়ালার কাছেও পিয়ার সুস্থ হওয়ার জন্য বারবার দোয়া করেছেন । একদিন মসজিদে তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে গিয়ে দেখলেন মসজিদের বারান্দায় একজন ছেলে মোনাজাতরত রয়েছেন । ছেলেটা রীতিমত উপরওয়ালার কাছে কান্নাকাটি করছে । সেই আওয়াজ তার কানে আসছে । তারপর তীব্র বিস্ময় নিয়ে তিনি আবিস্কার করলেন এই ছেলেটাই তার মেয়ের সাথে পড়ে এবং এই ছেলেটাই প্রতিদিন তার মেয়েকে দেখতে যায় । তাকে বলে দিতে হল না যে তমাল নামের এই ছেলেটা তার মেয়ের জন্য উপরওয়ালার কাছে কান্নাকাটি করছে !

আজকে পিয়া কলেজ থেকে ইচ্ছে করেই একটু দেরি করে বের হল । এতো দিনে একবারের জন্যও পিয়া তমালের সাথে কথা বলে নি । তমাল কখনও পিয়ার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে নি । কেবল দুর থেকেই ওকে লক্ষ্য করে গেছে । ওর পিছু নিয়েছে । এই পিছু নেওয়ার ব্যাপারটা পিয়া টের পেয়েছিল ঠিকই তবে কিছু বলে নি । প্রথম প্রথম একটু বিরক্তি লাগলেও এক সময়ে সেটা সয়ে গেল । কিন্তু ওর দুর্ঘটনার পরে সব কিছু বদলে গেল । 

আজকে পিয়া ঠিক করে তমালের সাথে একটু মজা করবে। এই পরিকল্পনা করেই সে বাসা থেকে বের হয়েছে । 

কলেজের যখন প্রায় সবাই বের হয়ে গেল তখন পিয়া বের হল গেট দিয়ে । কলেজের প্রধান গেটের ঠিক ডান দিকে চটপটির দোকানের দিকে তাকাল । তমাল ওখানেই বসে ছিল । ঠিক ওর পাশের তমালের লাল রংয়ের সাইকেলটা দাড় করানো । সাইকেলটা পিয়া খুব ভাল করেই চেনে।

পিয়া আস্তে আস্তে হাটতে হাটতে কলেজের ডান দিকের দেয়ালের পাশের পায়ে চলা পথটার দিকে পা বাড়াল । পিয়া জানে ওকে এই পথে আসতে দেখে তমাল একটু অবাল হবে । তবে ঠিকই ওর পিছু নেবে। 

কলেজ থেকে পিয়াদের বাসায় যাওয়ার দুইটা পথ আছে । একটা পথ সোজা মেইন রাস্তা দিয়ে রিক্সাতে করে । অন্যটা এই কলেজের পেছন দিয়ে সর্টকাট রাস্তায় । এই রাস্তায় দিয়ে খুব একটা যায় না । যখন একেবারে রিক্সা পাওয়া যায় না তখন এই পথে যায় । আজকে যদিও রিক্সার অভাব ছিল না তবুও এই পথে পা বাড়ালো । 

এক সময়ে কলেজের দেয়ালের শেষ প্রান্তে এসে হাজির হল । তমাল তখনও ওর পেছনে । পিয়া তিন রাস্তার সংযোগ স্থানে এসে দাড়াল । এবার রাস্তাটা দুই দিকে চলে গেছে । একদিক যাবে ওদের বাসার দিকে । অন্যটা গিয়েছে পাশের গ্রামের দিকে । তার রাস্তার ওদিকে রয়েছে একটু খাদ । খাদটা কাটা যুক্ত গাছ গাছালিতে ভরা । 

এখন পিয়া যে রাস্তায় যাক না কেন যত সময় না তমাল এই তিন রাস্তার মাথায় না আসছে তত সময়ে তমাল ওকে দেখতে পাবে না । এই সুযোগটাই পিয়া নিল । সে কোন দিকে না গিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে গেল । তমাল যখন আসবে ওকে না দেখবে তখন কী করবে সেটাই পিয়ার দেখার ইচ্ছে ।

কয়েক মিনিটের ভেতরেই তমাল এসে হাজির হল । স্বাভাবিক ভাবেই পিয়ার সেদিকে যাওয়ার কথা সেই পথের দিকেই তাকাল। তখনই থমকে গেল । কারণ হিসাব মত পিয়াকে ওর দেখতে পাওয়ার কথা । সংযোগ স্থল থেকে রাস্তাটা যতদুরে সেই দুরুত্ব ওতো দ্রুত পিয়ার অতিক্রম করার কথা না । তমালের মুখে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল । ঝোপের আড়াল থেকেই সেটা সে দেখতে পেল বেশ ভাল ভাবেই । 

তমাল দ্রুত ওর সাইকেলে উঠল তারপর পিয়াদের বাসার দিকে দ্রুত বা বাড়াল । পিয়া একটু হাসি আটকানোর চেষ্টা করল । ওকে খুজছে তমাল। ঠিক চার মিনিট পরে তমাল ফিরে এল আগের জায়গাতেই । ওর মুখে চিন্তার ছাপ । পিয়াকে খুজে পাচ্ছে না । সাইকেলটা ওখানেই ফেলে দিল । স্ট্যান্ড দেওয়ার চেষ্টা করল না । কারণ অন্য দিকে সাইকেলে চলার পথ নেই । পিয়া দেখল ব্যাগ আর সাইকেল রেখে তমাল এবার উল্টো দিকের পথে দৌড় দিল ওকে খোজার জন্য । প্রায় ছয় মিনিট পরে আবারও আগের জায়গাতে ফিরে এল । 

দুইদিকে এই অল্প সময়ে যতদুর যাওয়ার সম্ভব সে দেখে এসেছে । পিয়াকে দেখতে পায় নি । চিন্তা ওর পুরো মুখে দেখা যাচ্ছে । ঝোপের আড়াল থেকে সেটা পিয়ার চোখ এড়াল না 

তখনই মনে হল তমাল এবার কী করবে !

সত্যিই তাই করল । কাটা যুক্ত খাদের দিকে নামতে শুরু করল । হুড়মুড় করে নামতে থাকল । তমালের মনে ভয় যে হয়তো পিয়া খাদের দিকে গেছে !

পিয়া এবার ঝোপ থেকে বের হয়ে গেল । খাদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তমাল  তমাল !

তমাল ডাকটা শুনতে পেয়েছে । ঝোপ নড়তে দেখল । তমাল উঠে আসছে । আরও কিছু সময় পরে উঠে এল সে । ওকে দেখে একটু যেন নিশ্চিত হল । 

পিয়া তখন তাকিয়ে ওর দিকে । তমালের শার্টের কয়েক জায়গা ছিড়ে গেছে । কাঁটায় লেগে শরীরের কয়েকটা জায়গা কেটে গেছে । 

পিয়া ভাবতেই পারে নি তলাম এভাবে অবলিলায় খাদে নেমে যাবে ওকে খুজতে !

পিয়া তমালের দিকে তাকিয়ে বলল, এভাবে কেউ নামে ! 

তমাল খানিকটা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো পিয়ার দিকে । তখনও যেন ঠিক মত বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে । একটু আগে পিয়াকে না দেখতে পেয়ে তমালের মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল তমাল সেটা বলে বোঝাতে পারবে না । বারবার মনে হচ্ছিল যে ওর কোন বিপদ হল না তো ! 

দুই দিকে যখন পিয়াকে তমাল দেখতে পেল না তখন ওর মাথাটা ঘুরে উঠেছিল । তখন মনে হয়েছিল যে পিয়া হয়তো কোন ভাবে খাদের দিকে পড়ে গিয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই সে খাদে নেমে গিয়েছিল । কিন্তু যখন পিয়া ওর নাম ধরে ডাকল তখন জানে যেন প্রাণ এল । আবার ফিরে এল উপরে । এতো সময়ে ওর কোন হুশই ছিল না । যখন বুঝতে পারল যে পিয়া নিরাপদে আছে তখন অন্য দিকে খেয়াল হল । শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় কেটে গেছে কাঁটার খোচা খেয়ে । সেদিকে অবশ্য খুব একটা মনযোগ দিল না। পিয়া সুস্থ আছে সেটাই বড় কথা ।

পিয়া তমালের দিকে তাকিয়ে বলল, এভাবে কেউ নামে নিচে?

তমাল একটু বোকার মত হাসল । পিয়া আবার বলল, ইস কেটে গেছে ! 

তমাল দেখল পিয়া ওর ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ওর কাঁটা স্থান গুলো মুছে দিল । তারপর বলল, চল আসায় এখানে স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছি।

তমাল খানিকটা আমতা আমতা করে বলল, আরে কিছু হয় নি ।

-কিছু হয়েছে কি হয় নি সেটা আমি জানি । চল । কথা কম ! চল আমার সাথে!

এক প্রকার ধমক দিয়েই থামিয়ে দিল !

তমালের কাছে সব কিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে । ওর পিয়ার সাথে কথা বলছে। পিয়া ওর উপর খবরদার করছে, ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন আনন্দ অনুভূতি মনে হচ্ছে !

ওরা হাটতে লাগল বাসার দিকে । তমাল আর পিয়ার গল্পটা এখান থেকেই শুরু ! 

সরাসরি গল্পের লিংক পেতে হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রাম চ্যানেলে যুক্ত হৌউন । লিংক পাবেন এইটের একেবারে নিচের দিকে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 42

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →