রাতের বেলা ঘুমানোর সময় তমাল একেবারে অর্পাকে আষ্ঠেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে। বিয়ের প্রথম প্রথম দুজনেই এক প্রকার রক্ষনশীল মনভাব নিয়েই সংসার শুরু করেছিল । অর্পার নিজের ভেতরেই একটা অস্বস্তি কাজ করতো যা ওকে তমালের কাছে আসতে বাঁধা দিত। নিজেকে খানিকটা ছোট মনে হত। মনে হত তমালের যোগ্য সে নয়। কিন্তু মাস খানেক যেতে না যেতেই অর্পা অবাক হয়ে বুঝতে পারলাম তমাল ওর ব্যাপার খুবই সহানুভূতিশীল। যেমনটা ও বলেছিল । সেদিনের ঘটনা এখনও এখনও অর্পার খুব ভাল করে মনে আছে। ছুটির দিন ছিল ।
সকালে ডাইনিং থেকে পানি খেয়ে গিয়ে হাত লেগে কাঁচের জগটা পড়ে গিয়েছিল । মেঝেতে কাঁচের ছড়াছড়ি। একটু নড়তে গিয়েই অর্পার পা একটু কেঁটে গেল। ঠিক তখনই তমালকে আসতে দেখল সে । তলাম এক প্রকার দৌড়ে এল ।
অর্পাকে খানিকটা ধকম দিয়েই বলল, আরে কাঁচের ভেতরে এভাবে নামে কেউ?
দ্রুত নিজের হাত দিয়ে পাটা একটু উপরে তুলে দেখল । কত খানি কেটেছে সেটা পরীক্ষা করল । তারপর অর্পাকে অবাক করে দিয়ে ওকে কোলে নিয়ে দ্রুত বসার ঘরে নিয়ে গেল সে। অর্পা কোন কথাই বলতে পারল না। অবাক হয়ে কেবল তাকিয়ে রইলো। তমালের কাছ থেকে এমন আচরণ সে আশা করে নি।
সেদিনই অর্পা প্রথম বারের মত তমালের খুব কাছে চলে এসেছিল । তারপর থেকে দিনের পর দিন কেবল একে অন্যের আরও কাছেই আসছে ওরা !
আজকেও তমাল ওকে জড়িয়েই ধরে শুয়ে ছিল । অর্পা বলল, শুনছো ?
-হুম ।
-আমাদের অফিসের নাজমা ম্যাডাম ছিলেন না ?
তমাল বলল, কে ? ঐ তোমাকে নিয়ে আজে বাজে কথা বলত?
-হুম ।
-কী হয়েছে?
-আজকে খবর পেলাম ওনার বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে নাকি উনি মারা গেছেন!
-ভাল হয়েছে!
-ছিঃ এভাবে বলে না !
তমাল এবার ওকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে উনি বাজে কথা বলেছে মনে নেই?
-তবুও একজনের মৃত্যুর পরে এমন কথা বলা ঠিক না ।
-শোন তোমার মত আমি এতো ভাল না । আমার বউকে যে খারাপ কথা বলবে তার ভাল আমি চাইব না । জাহান্নামে যাক সে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না । বরং গেলেই আমি খুশি !
অর্পা কেন জানি তমালের উপরে রাগ করতে পারল না । আর সত্যি বলতে কী ঐ মহিলার মৃত্যুতে অর্পার মন খারাপ হয় নি । অফিসে ওকে নিয়ে কত বাজে কথা সে বলেছে । মাঝে বয়সী মহিলা ওর মায়ের সমান হবে অথচ কী কুৎসীত মনভাব ।
অর্পা তমালকে আর কিছু বলল না । ওকে আরেকটু কাছে নিয়ে চোখ বুঝল । তমালে ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ ওর কানে আসছে । ছেলেটা ওকে জড়িয়ে ধরে কী নিশ্চিন্তেই না ঘুমাচ্ছে।
দুই
-আপনি কেন এমন একজনকে বিয়ে করতে চান ?
অর্পার মনে তখনও একটু সন্দেহের দানা বেঁধে আছে । তমাল নামের এই মানুষটাকে সে চেনে না । আজকে সে তার সাথে দেখা করতে এসেছে কারণ তার বড় মামা এই ছেলেটার খোজ নিয়ে এসেছে। তার সাথে বিয়ের জন্য। অর্পার আবার বিয়ের কোন ইচ্ছে ছিল না । কারণ জানে আবার যতবারই সে বিয়ে করতে যাক না তার সমস্যাটা বারবার সামনে আসবে । অর্পা মানাই করে দিচ্ছিল কিন্তু যখনই মামার কাছ থেকে ছেলের শর্ত শুনল তখনই খানিকটা অবাক হল। মনে হল এমন একটা শর্ত আবার কেউ কি দিতে পারে? অর্পার মনে হল বিয়ে না হোক, একবার দেখা করা যায় ছেলেটার সাথে।
তমাল তখন নিজের কফির দিকে মনযোগ বেশি । অর্পার মনে হল যে তলাম সম্ভবত অর্পার প্রশ্নটা ঠিক মত শুনতে পায় নি । তবে ওকে ভুল প্রমানিত করে দিয়েই তমাল বলল, পিচ্চিপাচ্চা আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। একদম সহ্য হয় না আমার ।
অর্পা একটু অবাক হয়ে তাকাল তমালের দিকে । তমাল বলল, আমার আসলে শান্তির জীবন পছন্দ । এসব আমার একদমই ভাল লাগে না । একটা পিচ্চি মানেই নিজের জীবনের সব সুখ শান্তি বাদ দিয়ে দেওয়া।
অর্পা বলল, আমার যে একটা আগে একটা বিয়ে হয়েছিল সেটা আপনি জানেন ?
-জ্বী জানি ।
-এতে আপনার আপত্তি নেই।
-আপত্তি কেন থাকবে? এটা কি আপত্তির কোন ব্যাপার !
-অনেকের কাছেই এটা বড় একটা ব্যাপার !
-আমার কাছে না।
-আমার ডিভোর্স কেন হয়েছিল আপনি কি জানেন?
-ঠিক জানি না । অবশ্য খুব একটা জরুরী জানা সেটাও না । একজনের সাথে বনিবনা নাই হতে পারে !
-না সেই কারণে হয় নি । ডিভোর্স হয়েছে আমার এই বাচ্চা না হওয়ার কারণে । যখন ডাক্তার ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দিল তখন আমার প্রাক্তন স্বামী আমার সাথে আর ঘর করতে চাইলেন না । তার কাছে একটা বাজা মেয়ে মানুষের কোন মূল্য নেই ।
শব্দটা অর্পা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করল । তাকিয়ে দেখল তমাল ওর চোখের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে। অর্পা আবার বলল, আমার সত্যি আর বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ছিল না । কারণ আমি জানি আমি যেখানেই যাই না আমার পিছু এই জিনিসটা ছাড়বে না। তবে আমার ডিভোর্সের কারণে আমার বাবা খুব কষ্ট পেয়েছেন । তার ভাষ্য ছিল আমি যে কোন ভাবেই কেন স্বামীর সাথে মানিয়ে নিলাম না কেন ! এমন কি সেটা স্বামী যদি আরেকটা বিয়ে করতে চাইতো তবুও ! আমাদের বংশে আমিই একমাত্র মেয়ে যার ডিভোর্স হয়েছে! আমার কারণে তার মান সম্মান কাটা গেছে । গ্রামে এখন সে মুখ দেখাতে পারছে না।
অর্পা এক ভাবে কথা গুলো বলে দম নিল । তমাল তখনও তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে । অর্পা থামতেই তমাল বলল, দেখুন আমার আসলে এসবের ব্যাপারে কোন কিছু বলার নেই । মানে এই যে আগে বিয়ে হওয়া কিংবা আপনার এই শারীরিক সমস্যাটা । আপনার সাথে আমার বিয়ে হতে পারে আবার নাও হতে পারে । আমরা কয়েকদিন মিশি একে অন্যের সাথে । যদি আমাদের দুজনের মনে হয় যে সামনের জীবনটা এক সাথে কাটানো যাবে তখন বিয়ের দিকে যাওয়া যাবে ! কী বলেন !
অর্পার কেন জানি কথাটা পছন্দ হল । হেসে সম্মতি জানালো ।
পরের তিন মাসে ওরা দুজন বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ করল । তারপর এক সন্ধ্যা বেলা তমাল কথা বলল অর্পাকে !
-আমার মনে হয় তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে যাবে !
অর্পা একটু হাসল । তারপর বলল, আচ্ছা ?
-হুম । তাই মনে হয় একটা সত্য কথা তোমার জানা দরকার !
অর্পা একটু যেন নড়ে চড়ে বসল । তমালকে বেশ গম্ভীর মনে হল ওর কাছে । তমাল বলল, আমি আসলে ঐ শর্তের কথা কেন বলেছিলাম জানো?
-কারণ তুমি বাচ্চা নিতে চাও না এই জন্য?
তমাল মাথা নাড়াল । তারপর বলল আসল কারণ সেটা না । হ্যা সত্যি আমি বাচ্চা কাচ্চা একদম পছন্দ করি না । তবে নিজের বাচ্চা বলে কথা ! আমি আসলে ……
অর্পা অবাক হয়ে খেয়াল করল যে তমাল ঠিক ভাবে যেন কথা বলতে পারছে না । তীব্র ভাবে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। অর্পা জানে না ওর ভেতরে কী হলে ও এগিয়ে এসে তমালকে জড়িয়ে ধরল একটু । বলল, বলতে হবে না । তোমার কষ্ট হচ্ছে । থাকুক ! আমি শুনতে চাই না ।
নিজেকে সামলাতে একটু সময় লাগল তমালের । তারপর বলল, না এটা আমাকে বলতে হবে ।
-সময় নিয়ে বল। সমস্যা নেই ।
আরও বেশ কিছু সময় পরে তমাল বলা শুরু করল ওর গল্প ।
ছোট থেকেই আমি আমার কাছের মানুষ গুলো প্রতি একটু বেশি সেন্সেটিভ । আমি যখন কলেজে উঠি তখন নিশির সাথে আমার প্রেম হয় । পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ধরেই আমাদের প্রেম চলে । বাসা থেকেও কোন আপত্তি ছিল না । ঠিক ছিল যে পড়াশোনা শেষ করে আমাদের বিয়ে হবে। অর্নাস শেষ করে আমি যখন মাস্টার্স ভর্তি হব তখন একটা দূর্ঘটনা ঘটে । নিশি ওর পরিবারের সাথে করে বাড়ি যাচ্ছিল মাইক্রোতে করে । সেই গাড়ির সাথে একটা ট্রাকের মুখোমুখো সংঘর্ষ হয় । ট্রাকের ড্রাইভার মাতাল ছিল । যদিও নিশির বাবা মা বেঁচে যান তবে সামনে বসা নিশি আর ওদের ড্রাইভার মারা যায় । আরেকটা তথ্য আমি জানতে পারি যে মারা যাওয়ার সময় নিশি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল । আমাদের সম্পর্কটা অতোটাই গভীরে চলে গিয়েছিল । যদিও আমি নিজেও জানতাম না।
তলাম কিছু সময় থামল । অর্পা কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না । তলাম বলল, আমি সেই সময়ে কোন পর্যায়ে গিয়েছিলাম সেটা আমি এখনও ঠিক মত জানি না । কয়েকবার আমি সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলাম । আসলে ঐ কষ্ট আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না । আমি আর বিয়ে বা বাচ্চা নিতে চাই নি কারণ আমি দ্বিতীয় বার আর সেই কষ্ট পেতে চাই নি । আমার বারবার কেবল মনে হয় যদি কাউকে ভালোবাসি কিংবা যদি আবার বাচ্চা হয়তো আবার এদের কাউকে হারিয়ে ফেলব । তখন আমি কিভাবে বেঁচে থাকব ! এর থেকে কাউকে আর ভালবাসব না, কষ্টও পাব না।
আমার সাথে যদি তোমার বিয়ে হয় অর্পা তোমার প্রতি ধীরে ধীরে আমার একটা তীব্র আকর্ষন সৃষ্টি হবে । তোমার যে কোন কষ্ট তোমার থেকে আমার বেশি অনুভূত হবে । আমাদের যদি ছেলে মেয়ে হয় তখন তাদের বেলাতেও একই । কিন্তু আমি এতোটা শক্তিশালী নই যে দুজনকেই আমি এক সাথে রক্ষা করতে পারব । যদি বাচ্চা হওয়ার সময় কোন কমপ্লিকেশন সৃষ্টি হয় যদি এমন হয় দুজনের একজন কে রক্ষা করতে হবে ! আমি আর সেই কষ্ট সহ্য করতে পারব না অর্পা । সত্যিই পারব না। তোমার কাছে এটা পাগলের প্রলাম মনে হতে পারে তবে এটা আমার জন্য খুব তীব্র ভাবে সত্যি । এতো ভয়ংকর ভাবে সত্যি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
অর্পা এখন ব্যাপারটা টের পায় খুব ভাল ভাবে। বিয়ের প্রথম প্রথম দুজনের ভেতরে অদৃশ্য দেওয়া থাকলেও খুব জলদি সেটা কেটে যায়। অর্পার হাতে একটা স্মার্ট ওয়াচ রয়েছে। এটা একটা ট্রাকিং ডিভাইস। অর্পা সকাল থেকে রাত কোথায় কোথায় যায় সেই তথ্য তমালের কাছে থাকে ।
অর্পা এটা নিয়ে একটু অস্বস্তি বোধ করলে তমাল কেবল বলেছিল, আমি কোন দিন জানতে চাইবো না তুমি কোথায় গেছ কেন গেছে । আমি কেবল এটা জানতে চাই তুমি যেখানেই আছো নিরাপদ আছো যেন তোমার যে কোন দরকারে আমি তোমাকে খুজে পাই। তমাল এমন ভাবে কথাগুলো বলেছিল যে অর্পা মানা করতে পারে নি। এছাড়া তমালের পরিস্কার কথা যা রাস্তায় সব সময় সাবধানে চলাচল করতে হবে । কোন ভাবেই সিএনজিতে ওঠা যাবে না । উবার ব্যবহার করতে হবে । তাও সামনের সিটে না, বসতে হবে পেছনের সিটে। এই রকম আরও কত নির্দেশণা যে তমালের আছে । অর্পা নিজের তারপর থেকে সাবধানে চলাচল শুরু করেছে। তমালের জন্য । ওকে কোন ভাবেই চিন্তায় ফেলতে চায় না ।
তিন
অর্পার চোখ তাকালো তমালের দিকে । তমাল কী কথাটা শুনেছে? মনে মনে একটু ভয় পেয়ে সে। তমালের কানে যদি জসিমের কথাটা যায় তাহলে নিশ্চিত সে রাগা রাগি করবে জমিসের সাথে ।
তাকিয়ে দেখল একটু দূরে তমাল একটা পিচ্চি ছেলের সাথে কী যেন করছে। তার মানে জসিম সে কথাটা ওকে বলেছে সেটা সম্ভবত তমাল শোনে নি।
অর্পার আগের স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ির পরে গ্রামে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আসা। এর মাঝে ও আর আসে নি। যখন স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল অর্পার বাবা তালুকদার মোহিত মিয়া অর্পার সাথে বেশ রাগারাগি করেছিল। তার একটাই কথা ছিল যে সে কেন মানিয়ে নিল না। একটু চেষ্টা করলেই স্বামীর ঘর করা যেত।
গ্রামে আসার পরে মুন্সির চেয়ারম্যানের ছেড়ে অর্পাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল এবং অর্পা বাবা তাতে রাজিও ছিল । কিন্তু অর্পা কোন রাজি ছিল না । সে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল । তারপর থেকেই অর্পার বাবা ওর সাথে এক প্রকার কথা বলাই অন্ধ করে দিয়েছিল । অর্পাও আর গ্রামে আসে নি । ঈদের সময়ে নানা আড়ি যেত । আজকে তমালের সাথে বিয়ের প্রায় বছর খানেক পরে অর্পা গ্রামে এসেছে স্বামীকে নিয়ে। গ্রামের পাশেই একটা নদী । সেই নদীর পাড়ে ঘুরতে এসেছে দুজন । তখনই জসিমদের গ্যাং টা দেখল । তমাল একটু দূরে গিয়ে ছবি তুলছিল তখন জসিম ওকে উদ্দেশ্য করে সেই বাজে শব্দটা ব্যবহার করল ।
অর্পার এখন এখান থেকে দ্রুত চলে যেতে ইচ্ছে করছে। তমালের কানে শব্দটা গেলে ও রাগ করবে খুব । তমালের রাগ খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার । অর্পা জানে সেটা । ঢাকায় ওদের পাড়াতে একবার এক ছেলে অর্পার সাথে একটু বেয়াদবী করেছিল । অর্পার সামনেই ছেলেটাকে এমন মার সে মেয়েছিল শেষে অর্পার পা ধরে মাফ চেয়ে সে পার পেয়েছিল।
অর্পার যখন মনে হল যে জসিমের বলা কথাটা তমাল শোনে নি তখনই ওর ভুল ভাঙ্গল । তলাম ওর দিকে না এসে জসিমদের দিকে এগিয়ে গেল। অর্পার মনে হল যে তমালকে ডাক দেয় সে। তবে সে ভাল করেই জানে যে কোন লাভ নেই এখন আর ।
জসিম খেয়াল করে দেখল তমালকে এগিয়ে আসতে । জসিম খু আমদে রয়েছে। অনেক দিন থেকেই অর্পাকে সে জ্বালাতন করে আসছে। মাঝে মাঝে মোবাইল নম্বর যোগার করেও সে আজে বাজে মেসেজ পাঠায় । ব্লক করে দিলে নতুন আরেকটা সীম কেনে তারপর এই কাজ করে।
তলাম জসিমের সামনে এসে বলল, ভাই সাহেব, কথাটা কেন বললেন?
জসিম পাত্তা না দিয়ে বলল, কী ?
-বললাম আমার স্ত্রীকে বাজে কথাটা কেন বললেন? ওর কাছে মাফ চান?
জসিম এবার সত্যিই যেন খুব মজা পেল । তারপর তমালের একটু কাছে এসে বলল শোনেন হিরো গিরি অন্য খানে করবেন । এটা শহর না গ্রাম । ভাল চান তো কেটে পড়েন । যান । যান !
এই বলে তমালের কাধে একটা ধাক্কা দিল । তবে যেটার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না সেটা হচ্ছে এর প্রতিক্রিয়া তমাল কশে একটা চড় কষালো জসিমের গালে । এতো তীব্র ভাবে যে জসিমের পুরো মাথা ঝিমঝিম করে উঠল ।
তীব্র বিস্ময় নিয়ে সে তাকালো তমালের তলাম যে এই কাজটা করবে সেটা জসিম ভাবতেও পারে নি । ওর গায়ে হাত দিবে এমন সাহস এই তল্লাটে কারো নেই । আর তাকে চড় !
-তোকে খাইছি রে!
এই বলে জসিম যখন তমালের দিকে চড়াও হতে যাবে তখনই জসিমের মনে হল কোন কিছু একটা সমস্যা রয়েছে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা খুব দ্রুত নিজের জায়গা থেকে সরে দাড়াল তারপর হাটুটা ঠিক ওর বুকের দিকে এগিয়ে নিয়ে এল । পরক্ষণেই ঢুপ করে একটা আওয়াজ হল জসিমের মনে হল ওর পুরো দম বন্ধ হয়ে গেছে যেন । একটা তীব্র চিৎকার বের হয়ে এল ওর মুখ থেকে । হাটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে।
এখানেই শেষ হল না । তমাল এবার ঠিক ওর মাথার ডান দিকের কান বরাবর একটা লাথি মারল । একেবারে মাপা মার । জসিম মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে । এই লাথি কোন আনকোরা অনভ্যস্ত মার নয়। একেবারে মাপা । অনেক দিনের চর্চার ফল ।
জসিমের সব থেকে কাছে চ্যালা এগিয়ে এল তমালের দিকে । তবে তমাল কেবল একটা ঘুষি মারল তার বুকে । ব্যাস সেখানেই মাটিতে পড়ে গেল সে । অন্যেরা আর সাহস করল না এগিয়ে আসার ।
অর্পা পুরো দৃশ্যটা দেখল । মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই ঘটে গেল সব । অর্পা ভেবেছিল বুঝি এবার জসিম কে সে ছেড়ে ওর দিকে আসবে তবে আসল না সে। তলাম সোজা এবার জসিমের কাছে গিয়ে হাজির হল । চুলের মুঠি ধরে মাথাটা তুলে বলল, তোকে বললাম না অর্পার কাছে ক্ষমা চাইতে ।
জসিম একটু তেজ দেখাতেই এবার মাইর পরল ওর কপালে । একের পর ঘুসি । নাক মুখ ফেটে গিয়ে রক্ত বের হতে লাগল ।
চার
মুন্সি চেয়ারম্যান কবে এভাবে দৌড়েছেন সেটা তিনি নিজেও জানেন না। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছেন এই গ্রামে তার ছেলেকে কেউ মারধোর করতে পারে। পিল্টুর কাছ থেকে যখন শুনলেন যে তালিকদারের জামাই তার ছেলেকে মারতেছে তখন তিনি বিশ্বাস করেন নি । তবে পিল্টুর মুখের ভাব দেখে আর না বিশ্বাস করে থাকতে পারেন নি । তারই গ্রামে তার এক মাত্র ছেলের গায়ে কেউ হাত দিতে পারে সেটা তিনি ভাবতেই পারছেন না । আজকে ঐ শহুরে বেটার খবর তিনি খারাপ করে ছাড়বেন । বেটার এতো বড় সাহস !
যখন নদীর সাথে এসে পৌছালেন তখন সত্যিই দেখলেন জসিম মাটিতে পড়ে আছে আর তার উপরে বসে সমাজে ঘুসি মেরে চলেছে ।
মুন্সি চেয়ারম্যান আর নিজের রাগ ধরে রাখতে পারলেন না । এক দৌড়ে সেখানে গিয়ে গিয়ে হাজির হলেন । তারপর নিজের হাতের ছড়িটা দিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে তমালের মাথা বরাবর বাড়ি মারলেন ।
সৌদি থেকে তার ছোট ভাই এই লাঠিটা পাঠিয়েছিল । লাঠিটা যখন তমালের মাথায় লাগবে ঠিক আগেই তলাম টের পেয়ে গেল । নিজেকে খানিক বাঁচাতে সরে গেল বটে তবে তাকে শেষ রক্ষা হল না । আঘাতটা লাগল ওর কাধে । সে জমিসের উপর থেকে সরে গেল ।
মুন্সি চেয়ারম্যান রাগে ফুসতেছে । বলল, তোর এতো বড় সাহস আমার ছেলের গায়ে হাত দিছিস !
মুন্সি আরেকবার এগিয়ে গেল তমালের দিকে। আরেকটা বাড়ি দিবে সে। তবে এবার ঘটল অন্য ঘটনা । মুন্সি কাছ আসতেই তলাম খপ করে মুন্সির গলা চেয়ে ধরল । তারপর বলল, তুমি ভেবেছো কি যে আমার কাছে পেছন থেকে বাড়ি মারবে বুড়ো বলে তোমাকে ছেড়ে দিবো !
মুন্সি কেবল চোখ বড় বড় করে তমালের দিকে তাকিয়ে রইলো । এখনও সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার সাথে কী হতে চলেছে । তমাল যখন তার গলা চেপে ধরেছে তখনই সে টের পেয়েছে যে তমালে হাতে কী পরিমান শক্তি । তার দামড়া ছেলে কেন তার কাছে মার খেয়েছে সেটা সে বুঝতে পারল। এবং এখন তার নিজের পালা ।
তমাল কেবল এক হাত দিয়ে মুন্সিকে তুলে একটা আছাড় মারল মাটিতে । রেস্লিং এ যেভাবে আছাড় মারে ঠিক সেই ভাবে । তমাল তারপর মুন্সির দিকে তাকিয়ে বলল, ওখানে শুয়ে থাকো । উঠলে তোমার ছেলের মতই অবস্থা হবে !
তমাল তারপর আবার ফিরে গেল জসিমের কাছে। এবার জসিমের বাচ্চাদের মত কান্নার আওয়াজ মুন্সির কানে গেল । আব্বা আমারে বাচান আব্বা । আব্বা !
-তোর আব্বা তোকে বাঁচাবে না । আগে মাফ না শুয়োরের বাচ্চা ! আগে মাপ চা হারামযাদা । বল আর কোন দিন বলবি এই কথা বল বি !
-আর কোন দিন বলব না আর কোন দিন বলব না আর কোন দিন বলব না।
পাঁচ
-এর একটা বিচার একটা করতেই হবে আপনাদের । আমার ছেলের কী অবস্থা করছে সেইটা দেখছেন !
গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বসে আছে তালুকদার মোহিত মিয়ার বৈঠক খানাতে । তালুকদার কী বলবে সেটা ঠিক বুঝতে পারছেন না । তার জামাই বেদম দিয়েছে মুন্সির ছেলেকে । কেবল তাই না সে নাকি মুন্সিকেও একটা আছাড় দিয়েছে। এটা তিনি ভাবতেই পারছেন না। এখন এটা নিয়ে থানা পুলিশ হলে সমস্যা হবে । তালুকদার মোহিত মিয়া আরও কিছু বলতে যাবে তখন দেখতে পেলেন তার জামাই ঘরে ঢুকল । সে মুন্সির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার ছেলে এই এই গ্রামের অন্তত ১১জনকে মেরে হাত ভেঙ্গে দিয়েছে । তখন বিচার কই ছিল আপনার ? আর আমার কাছে ভিডিও আছে আপনার ছেলে আমার গায়ে আগে হাত দিয়েছে । পুলিশের কাছে যাবেন, তো? যান। এই ভিডিও তাকে আমি দেখাবো । সেই সাথে আমার কাছে এই প্রমানো আছে যে সে অর্পাকে মোবাইলে আজেবাজে কথা বলত । মারামারি করতে এসে মাইর খেয়ে এই মেয়ে নপুংশ্চকের কান্নাকাটি করছেন !
পুরো বৈঠক খানার সবাই চুপ । তমাল আবার বলল, আপনার ছেলে আমার বউয়ের নামে বাজে কথা বলেছে । তার শাস্তি সে পেয়েছে । যদি থানায় যেতে চান যান । মারা মারিতে দুজন সমান ভাগিদার । কিন্তু এরপরে আপনার ছেলের নামে যে ইভিটিজিং মামলা আমি করব এবং এটা নিশ্চিত করব সে যেন জামিন না পায় ! আর আপনি আপনার গ্রামের উত্তর দিকে গাজার চাষ আছে এটা পুলিশ জানে ? বন থেকে অবৈধ কাঠ বিক্রি করেন আপনি এটা বনবিভাগের হেড কোয়াটার জানতে সময় লাগবে না।
মুন্সি আর কোন কথাই বলতে পারল না । বৈঠক খানা থেকে একে একে সবাই বের হয়ে যেতে লাগল ।
ঐদিন রাতেই মুন্সি তার লাঠিয়েন বাহিনী ঠিক করল তমালকে চিরোতরে শেষ করে দেওয়ার জন্য । ওদের পরিকল্পনা ছিল রাতে ওরা তালুকদারের বাড়ি হামলা করবে। তারপর তমালকে এলো পাতাড়ি কুপিয়ে চলে যাবে।
যখন লাঠিয়াল বাহিনী বের হয়ে গেল ঠিক তারপরেই মুন্সির ফোনে একটা অপিরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল ।
-কী মুন্সি ! তুমি সোজা হলে না !
মুন্সির শিরদাড় বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল । ওপাশ থেকে তমাল বলল, তোমার ছেলে যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আছে, সে সেখানে আছে তো? দেখেছো?
মুন্সি বলল, আমার ছেলের যদি কিছু হয় ……
-তুমি কোন বালও ছিড়তে পারবে না । বুঝছো । লাঠিয়াল বাহিনীকে ফোন করে ফেরত আসতে বল । আর আর সোজা তোমার গাজার মাঠের কাছে আসো । আধা ঘন্টা সময় দিলাম । তোমার ছেলেকে কচু কাটা করব নয়তো ।
ছয়
-শোন মুন্সি তোমাকে একটা গল্প বলি । আমাকে তোমার কেমন মনে হয়? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে !
মুন্সি তাকিয়ে রয়েছে তার ছেলের দিকে । তার ছেলে মাচার উপর শুয়ে রয়েছে । ভীত চোখ তাকিয়ে রয়েছে। তার থেকে একটু দূরে বসে রয়েছে তমাল । তার হাতের পিস্তলটা মুন্সি দেখে একেবারে চুপসে গেছে ।
অর্পার আগে বুঝেছো আমার একটা প্রেমিকার ছিল । আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু এক ট্রাক ড্রাইভার তার গাড়ির উপর ট্রাক তুলে দেয় । সেই সময়ে সে ড্রাঙ্ক ছিল । মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল । দুর্ঘটনার কেস । মাত্র তিন বছর জেল হয়। কিন্তু আমি তাকে কী করেছি জানো? যেদিন যে জেল থেকে বের হয় সেদিনই তাকে তুলে নিয়ে গেছি। প্রথমে তার দুই হাত রামদা দিয়ে এক কোপে কেটেছিল । তারপর কী করেছি জানো । মুখে নল ঢুকিয়ে কেবল মদ খাইয়েছি। মদ মদ খেয়ে সে উপরে চলে গিয়েছে। তার লাশ এখনও কেউ খুজে পায় নি।
এরপর অর্পার সাথে পরিচয় হল । বিয়ে হল । ওর অফিসে এক মহিলা ছিল যে ওকে খুব বাজে কথা বলল। তোমার ছেলে যে বাজে কথাটা বলেছিল সেটা ! একদিন তার বাসায় গেলাম । তারপর তার বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট করিয়ে তাকে মেরে ফেললাম । তারপর এক ছেলে ওকে টিজ করেছিল একদিন । সে ছেলে যে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানে না । কেউ কোন দিন জানবেও না।
তোমার ছেলে কেন বেঁচে আছে জানো?
মুন্সি চুপ করে রইলো । চোখ বড় বড় করে কেবল সে তমালের কথা শুনছে। তলাম যে মিথ্যে বলছে না এটা বলে দিতে হল না । এই ছেলে ভয়ংকর !
মুন্সি তোমার বয়স হয়েছে । এক মাত্র ছেলে মরলে তোমার জন্য কষ্টের হবে ব্যাপার । তবে এটাই শেষ । এরপর যদি কোন দিন অর্পার নামে কোন আজে বাজে কথা তুমি বা তোমার ছেলে বল কিংবা ওর পরিবারকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা কর তাহলে মনে রেখো তোমার ছেলের লাশ কেউ খুজেও পাবে না।
পরিশিষ্টঃ
তমাল আস্তে করে দরজা খুলল। ঘরের ভেতরে পা রাখতেই অর্পা বলল,
-এই রাতে কোথায় গেছিলে?
-এই একটু হাওয়া খেয়ে !
-একা একা ! আমাকে ডাকলে না কেন?
-তুমি শুয়ে ছিলে যে! ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছ ! তাই আর ডাকি নি !
-তাই না ! চোখ মেলে দেখি তুমি নাই পাশে । কেমন যেন বুক কেঁপে উঠল !
তমাল একটু হেসে অর্পার কাছে বসল। তারপর কপালে মৃদু চুমু খেয়ে বলল, ভয় নেই । আমি পাশে আছি। তোমাকে ছেড়ে যাবো না কোথাও !
I like this kind of stuff ????????