নীলা ভেবেছিল যখন সে আবরারকে ব্রেক আপের কথা বলবে তখন সে হয়তো খুব রেগে যাবে। এমন হতে পারে সে হয়তো ওকে একটা চড়ও মেরে দিতে পারে। যদিও আবরার কখনই ওর হায়ে হাত তোলে নি তারপরেও নীলার এমন একটা কথা মনে হল। আবরার খুবই রাগী আর ডোমিনেটিং একজন মানুষ। ওর কথা মত না চললে ও খুব রেগে যায়। সম্পর্কের শুরু থেকেই আবরার ওর উপর নিজের জোর খাটিয়ে আসছে । উঠতে বসতে চলতে সব সময় নীলাকে আবরারের কথা মত চলতে হয়েছে। একটু এদিক ওদিক হলেই আবরার অনেক রাগারাগি করেছে। প্রথম প্রথম এটা স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছে। তবে একটা সময়ে নীলার মনে হয়েছে ও একেবারে বন্দী হয়ে গেছে। নিজের জীবন সে আর নিজের মত কতে আর জীবন যে অতিবাহিত করতে পারছে না। এই সম্পর্কে থেকে ওর বের হওয়া দরকার। এবং এই সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে।
আর এই টক্সিক সম্পর্কের ভেতরে থাকবে না। নীলার সব বান্ধবীরা ওকে অনেক দিন ধরেই বলছে আবরারকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ওরা এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না নীলার মত একজন মেয়ে কেন আবরারের সাথে আছে! নীলা এটা ঠিক বুঝতে পারে যে আবরার ওকে ভালবাসে । এটা ভেতর থেকেই অনুভব করা যায়। আপনি যখন কাউকে মন থেকে ভালবাসবেন তখন আপনার আচরণে সেই ভালবাসা প্রকাশ পাবে। এবং যাকে ভালবাসবেন সেটা সামনের মানুষটা বুঝতে পারবে। নীলাও ঠিক ঠিক বুঝতে পারে। তাই তো এতো দিনে এতো জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে এসেছে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভালবাসা যতই থাকুক ওকে নিয়ন্ত্রন করার অধিকার আসলে কারো নেই । তুমি আমাকে ভালবাসো তার মানে এই তো না যে তোমার ইচ্ছে মত আমাকে চলতে হবে। এটা তো ভালবাসার শর্ত হল না। তাই নীলা একেবারে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে যে আর আবরারের সাথে সে থাকবে না।
তবে ওর মনে একটা সন্দেহ ছিল এ এই কথাটা বলার সাথে সাথে আবরার খুব রেগে যাবে। ওকে হয়ত একটা চড়ও মেরে দিতে পারে । তবে আবরার যেন একেবারে শান্ত হয়ে গেল । প্রথম কয়েক মিনিট বোঝার চেষ্টা করল যে নীলা আসলেই এই কথাটা বলছে কিনা ! যখন ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলো যে নীলা মোটেও ঠোট্টা করছে না তখন ওর চোখে একটা তীব্র বিস্ময় দেখা গেল। এটা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না । তারপরই ওর মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল । আবরার যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে।
কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, কেমন এমন টা করবে বলবে কী?
নীলা বলল, তুমি জানো না কেন আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আসলে আর নিতে পারছি না। এতো নিয়ন্ত্রণ এতো পজেসিভনেস আমার ভাল লাগছে না । আমার মনে হচ্ছে আমি প্রেম করছি না, জেলখানায় আছি । আমাকে বিকেলে বাইরে থাকার জন্যও তোমাকে জানাতে হচ্ছে। কার সাথে আছি না আছি সেটার হিসাব তোমাকে দিতে হচ্ছে ! কেন? এই হিসাব তো আমার বাবাও আমার কাছে চায় না । তুমি কেন চাচ্ছো? আর দয়া করে এসব বল না যে সামনে থেকে এসব আর করবে না, এমনটা আমরা আগেও করে দেখেছি । তুমি বদলাও নি । আজকে থেকে আমি চাই না আর তোমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে !
কেউ কিছু সময় কোন কথা বলল না। এক সময়ে আবরার বলল, একটা অনুরোধ কি করবো?
-কি?
-এক সপ্তাহ সময় দাও!
-এক সপ্তাহে কী হবে? আমাকে কনভিন্স করবে? ভাল হয়ে যাবে আর ওসব কিছু করবে না?
-না এসব কিছু করবো না।
-তাহলে?
-এই ধর নোটিশ পিরিয়ড !
-নোটিশ পিরিয়ড মানে?
-মানে এই যে ব্রেক আপ করছো এটা কার্যকর হবে এক সপ্তাহ পরে । আমি কথাদিচ্ছি এই এক সপ্তাহে আমি তোমাকে কোন কল দিব না আমাদের দেখাও হবে না। জাস্ট এই এক সপ্তাহ তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড থাকলে। তারপর এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল আমার সাথে দেখা করারও দরকার নেই । কেবল একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিবে যে ইটস ‘ওভার’।
-এসব করে লাভ কী?
-হয়তো নেই । আবার হয়তো আছে। এই রিকোয়েস্টটা রাখ প্লিজ !
নীলা কী মনে করে রাজি হয়ে গেল । যেহেতু কোন যোগাযোগ হবে না তাই কোন সমস্যা নেই।
তবে আবরার যখন রিক্সা করে হলে নামিয়ে দিতে গেল তখন নীলার মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। বিশেষ করে আবরার ওর হাত ধরে ছিল আলতো ভাবে । আর মৃদু ভাবে অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে নাড়ছিল । নীরার মোটেই অস্বস্তি লাগছিল না বরং মনে একটা আনন্দ অনুভূতি হচ্ছিল। কেন হচ্ছিল সেটা ভেবে নীলা একটু অবাক হল। একটু আগে সে আবরারের সাথে ব্রেকআপ করে এল এখন আবার তারই আদর তার ভাল লাগছে।
পরের দুইদিন কেটে গেল । তৃতীয়দিনে এসে নীলার মনের ভেতরে কেমন একটা পরিবর্তন আসা শুরু হল । বিশেষ করে আবরারকে সে মিস করা শুরু করল । তবে নিজেকে সে নিয়ন্ত্রন করেই রাখল । কারণ যতবার সে ফিরে যাবে তত বারই তার জীবন দুর্বষহ হয়ে উঠবে । উঠতে বসতে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। এতো কৈফিয়ৎ সে আর দিতে পারবে না । আর এসব ভাল লাগছে না তার।
দুই
দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কেটে গেল । নীলা আবরারকে ফোন দিল না । একই ভাবে আবরারের কাছ থেকেও কোন ফোন এল না। তবে ফোনটা এলে অন্য একজনের কাছ থেকে । নীলা ক্লাস করে বের হয়েছে এমন সময়ে নাফিস তাকে ফোন দিল । নাফিস আবরারের ফ্লাট মেট। ওরা দুজন একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে থাকে । নীলার সাথে বেশ কয়েকবারই নাফিসের দেখা হয়েছে ।
নাফিসের ফোন তার কাছে ছিল না । তাই ফোন ধরার পরে যখন নাফিস নিজের পরিচয় দিল তখন নীলা একটু অবাকই হল। বলল, জ্বী ভাইয়া কেমন আছেন?
-তুমি কেমন আছো?
-এইতো ভাইয়া ভাল। আপনার কী খবর?
নাফিস বলল, ভাল । তা তোমাদের ভেতরে কি কোন ঝামেলা চলছে?
নীলার মনে একটু দ্বিধা জন্মালো । এখন সে কী বলবে? বলে দিবে যে তার বন্ধুর সাথে নীলার ব্রেক হয়ে গেছে । এখন কেবল নোটিশ পিরিয়ড চলছে । খুব জলদি তা কার্যকর হয়ে যাবে। তারপর মনে হল থাকুক । আবরার নিজ থেকেই বলবে । ওর কিছু বলার দরকার নেই।
-কেন বলুন তো ভাইয়া?
-না মানে আবরারকে আমি একটু অন্য রকম দেখছি। ও তো এই রকম আচরণ করে না কখন । খুবই শক্ত মনের মানুষ সে । কোন কিছুতেই বিচলিত হয় না প্লাস নিজের কাজ কর্মও বাদ দেয় না। কিন্তু গত চারদিন থেকে দেখছি আবরার অফিস যায় নি । ঠিক মত খায় নি । সারা দিন বিছানায় পড়ে পড়ে শুয়ে আছে । অন্য কোন কাজ করে নি । এমন টা ও না।
নীলা কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না । সেও আবরারকে চিনে খুব ভাল ভাবেই । তার তো এই রকম আচরণ করার কথা না । তাহলে কেন করছে?
ওর জন্য?
অবশ্যই ওর জন্য ! এটা তো বলে দিতে হয় না ।
নাফিস বলল, তোমাদের ভেতরে কী হয়েছে আমি জানি না । তবে যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে মিটমাট করে নাও । আর যদি সম্ভব হয় তাহলে আজকে বাসায় যাও । আমি ওকে কয়েকবার ফোন দিয়েছি কিন্তু সে রিসিভ করে নি । বাসায় একা আছে সে।
ফোন রাখার পরে নীলার মনভাব একেবারে বদলে গেল। বারবার মনে হল যে ওর এখনই আবরারের কাছে যেতে হবে। আর কোন কিছু ওর মনে রইলো না । কেমন মনে হল যে এখনই ওর আবরারের কাছে যেতেই হবে।
প্রায় দুই মাস পরে।
-তুমি তো আর আমাকে আগের মত প্যারা দাও না?
-তুমি চাও যে আগের মত আচরণ করি?
-না চাই না। হঠাৎ এতো ভাল কেন হয়ে গেলে?
-কারণ সেই সময়ে আমি এমন একটু অনুভূতির ভেতর দিয়ে গেছি যে আমার মনে হয়েছে যে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। বিশেষ করে পরপর দুইদিন যখন তুমি ফোন দিলে না তখনই আমার ভেতরটা কেমন যে শূণ্য হয়ে গেল । মনে হল যে আমি আমার জীবনের সব থেকে কিছু হারিয়ে ফেলেছি। চার নম্বর দিনে আমার আর কোন হুশই ছিল না । সত্যিই ছিল না । আমার মাথায় ভেতরে যে কী চলছিল আমি নিজেও না । ৫ নম্বর দিনে যদি তুমি না আসতে হয়তো আমি মারা যেতাম । সত্যিই যেতাম । মনে নেই কিভাবে দরজা খুলে তোমাকে দেখে জড়িয়ে ধরেছিলাম !
নীলার খুব ভাল করেই মনে আছে । ওকে জড়িয়ে ধরার এক পর্যায়ে নীলা আবিস্কার করেছিল আবরার কাঁদছে । একটা পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ ওকে হারিয়ে কাঁদছে এই অনুভূতিটা নীলার কাছে একেবারে অন্য রকম ছিল । সে জানতো যে আবরার ওকে ভালবাসে কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ে যাবে সেটা নীলা ভাবতেও পারে নি ।
তারপর থেকেই নীলা নিজেকে বুঝিয়েছে যে এমন মানুষ সে আর খুজে পাবে না। একটু যন্ত্রনা সে দেয় তবে দিক । সেটা সে সহ্য করে নিবে। তবে আর ওকে ছেড়ে যাবে না । ভাগ্যিস নোটিশ পিরিয়ড দিয়েছিল । তা না আবরার কী করে ফেলত কে জানে !
আমার করা একটা অনুবাদ গ্রন্থ কিনতে ক্লিক করুন
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.