বখাটের প্রেমে পড়া

4.9
(49)

নীরা আবারও বলল কথাটা । মায়ের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে রইল। তবে মায়ের মন গলল না কিছুতেই । তিনি কন্ঠে বললেন, ঢং করবি না নীরু । মানুষ বাঁচে না আর উনি আছে কুত্তা বিলাই নিয়ে। 

নীরার কেন জানি খুব কান্না এল । মাকে খুব বেশি নিষ্ঠুর মনে হল । এক দৌড়ে আবার চলে এল নিচের ঘরে । জানালা দিয়ে তাকালো বাইরে। কদিন থেকে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে । আজকে সকাল থেকে সেটা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে । ফলে ওদের এলাকাতে পানি উঠে গেছে। একেবারে কোমর পর্যন্ত পানি। সব কিছু ডুবে গেছে । মানুষ জন কোন মতে টিকে আছে। তবে এর ভেতরে সব থেকে বিপদে পড়েছে রাস্তার কুকুর আর বেড়াল । ওদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই । সব উচু স্থান ডুবে যাওয়াতে একেবারে বিপদে পড়ে গেছে ওরা । 

নীরা ওর জানালা থেকেই একটা বিড়াল আর একটা কুকুরকে দেখতে পেল । ওদের বাসার সামনেই একটা ভ্যান গাড়ির উপরে আটকে পড়েছে কুকুর আর বিড়াল দুটো । গতকাল থেকেই দেখছে । বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে মারা যাবে ওগুলো । মাকে বলেছিল ওগুলোকে বাসায় নিয়ে আসার জন্য তবে মা কঠিন কন্ঠে মানা করে দিয়েছে । এই সব ঝামেলা তার মোটেই ভাল লাগে না। নীরা প্রাণী দুটোর দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো । অন্য সময় হলে বৃষ্টি ওর ভালই লাগে । মাঝে মাঝে সে ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে । নয়তো জানালার পাশে শুয়ে শুয়ে বই পড়ে তবে আজকে এই প্রানীগুলোর অবস্থা এতো খারাপ দেখে মোটেই ভাল লাগল । বৃষ্টি বিলাশ করতে ইচ্ছে করল না। মন খারাপ তাকিয়ে রইলো প্রাণীদুটোর দিকে ।

ঠিক সেই সময় ঘটনাটা ঘটল। নীরা দেখতে পেল একটা নৌকা এসে থামল ভ্যানটার পাশে । তবে নৌকার দিকে তাকিয়ে একটা তীব্র বিস্ময় কাজ করল ওর ভেতরে । সেখানে আরও কয়েকটা কুকুর আর বেড়াল রয়েছে। একজন মানুষ নৌকা চালাচ্ছে আর অন্য জন পানিতে হাটছে । 

নীরার বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে যে মানুষটা পানিতে নেমে বেড়াল আর কুকুর গুলোকে নৌকাতে তুলছে সেই মানুষটাকে সে খুব ভাল করেই চেনে। এখানেই ওর বিস্ময়ের কারণ । মানুষটাকে সে এখানে মোটেই আশা করে নি । 

রিশাদকে পাড়ার সবাই বখাটে বলেই চেনে । সারাদিন মাস্তানি করে বেড়ায় । মানুষের সাথে ইচ্ছে করে মারামারি করে। সেই সাথে মেয়েদের ইভ টিজিং তো আছেই। পাড়ার কেউ রিশাদ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের পছন্দ করে না । তবে কেউ কিছু বলতে সাহসও পায় না । ওর বাবা এই ওয়ার্ড কমিশনার । কারো কিছু বলার সাহস নেই । সবাই তাই মুখ বুঝেই সহ্য করে। 

নীরাকেও ওরা অনেকবারই টিজ করেছে। নীরা একভাবে রিশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো । একটু যেন শীতে কাঁপছে । বৃষ্টির পানি বেশ ঠান্ডা সেটা বোঝাই যাচ্ছে । হঠাৎ নীরার রিশাদের জন্য একটা অদ্ভুৎ মায়া জন্মালো । একভাবে সে রিশাদের দিকে তাকিয়েই রইলো । 

রিশাদ হাত নেড়ে কাকে যেন জিজ্ঞেস করছে, আরও কোথায় কোন কুকুর বেড়াল আছে কিনা ! একজন কী যেন বলল। সম্ভবত অন্য কোথায় আরেকটা কুকুর রয়েছে সেটার খোজ দিল । নৌকাটা সেদিকে ঘুরে গেল । নীরা বিছানা থেকে উঠে জানালা দিয়ে রিশাদকে আরেকবার দেখার চেষ্টা করল । যতদুর চোখ যায় সেদিকে তাকিয়েই রইলো সে । 

মনটা ভাল হয়ে গেল সাথে সাথে । প্রাণী গুলোর একটা গতি হল এই জন্য ওর মন ভাল লাগছে । কিন্তু সেই সাথে আরও একটা কারণে ওর ভাল লাগছে । রিশাদ নামের ঐ ছেলেটাকে অদ্ভুত ভাবে ভাল লাগতে শুরু করল। পুরো রাতে নীরা একটা ফোটা ঘুমালো না । ঘুমাতে পারল না । ভোরের আযানের সময় উঠে তাকালো জানালা দিয়ে । তখনই সে বুঝতে পারল যে সে রিশাদ নামের ঐ বখাটের প্রেমে পড়েছে।

এক মাস পর

-রিশাদ ভাইয়া!

রিশাদ রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিল নিজের বাসার দিকে । পাছে পিন্টু রয়েছে । ওর নাম ধরে ডাক শুনেই ফিরে তাকাল । মেয়েটাকে সে চেনে । রমিজ সাহেবেদের বাসায় ভাড়া থাকে । নীরা নাম ।

নীরা আবার বলল, একটু হেল্প করবেন?

-কী হেল্প? 

একটা রিক্সা ডেকে দিন না প্লিজ। আমি কোন রিক্সা পাচ্ছি না।

রিশাদ একটু চমকালো বটে । কারণ ওকে এই কথা বলার কথা না মেয়েটার । এই মেয়েটাকে ও কয়েকবার টিজ করেছে। পাড়ার সব মেয়েই ওকে দেখলে দৌড়ে পালায় । আর এই মেয়ে কিনা ওকে রিক্সা ডাকতে বলছে।

রিশাদ পিন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, যাতো মোড়ের মাথা থেকে একটা রিক্সা ডেকে নিয়ে আয় । আমার নাম নিবি।

পিন্টু একটু অবাক হলেও কোন কথা জানতে চাইল না । দৌড় দিল মোড়ের দিকে । নীরা এসে দাড়াল রিশাদের পাশেই । তারপর ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে রিশাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনার জন্য!

ডেইরি মিল্ক চকলেটটার দিকে তাকিয়ে রিশাদ এবার সত্যিই অবাক হল। মনে মনে ভাবল এই মেয়ের সমস্যা কী ! ওর সাথে এতো ভাল ব্যবহার কেন করছে।

রিশাদ সেটা নিতে নিতে বলল, চকলেট কেন?

নীরা হাসল । তারপর বলল, আপনাকে আসলে একটা চুমু খেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনার মুখ দিয়ে সিগারেটের গন্ধ আসছে । তাই চুমু খাবো না। সেদিনে একেবারে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দিবেন সেদিন পাবেন । এর আগে নয়। এখন তাই চকলেট !

নীরা কথা বলল খুব স্বাভাবিক ভাবে । তারপর চকলেটটা রিশাদের হাতে দিয়ে ডান দিকে হাটা দিল। রিশাদের মনে হল ও সম্ভবত ভুল শুনল। এই মেয়ে অবশ্যই ওকে এই কথা বলে নি। বলতে পারে না। 

-ভাই ও ভাই !

পিন্টুর দিকে তাকিয়ে রিশাদের তন্ময় কাটল । 

-বাড়ি যাবেন না?

-মেয়েটা কোথায়?

-নীরা আপা?

-হ্যা। কোথায়?

-রিক্সা নিয়া চইল্লা গেল । ডাক দিমু?

-না থাক। 

রিশাদ নীরাকে আরও দুইদিন পরে দেখতে পেল । মোড়ের মাথায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল । তখন নীরা দেখতে পেল পিন্টুর সাথে কী নিয়ে যেন কথা বলছে। এক পর্যায়ে সে নিজের বাসার দিকে চলে গেল আর পিন্টু এগিয়ে এল ওর দিকে । তারপর তার দিকে একটা চকলেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ভাই এটা আপনার জন্য।

-নীরা দিল?

-জ্বী বই। বলল যে এটাই কেবল আপনার প্রাপ্য ! এখন অন্য জিনিসটা পাবেন না।

রিশাদ একটু যেন ফ্রিজ হয়ে গেল । মেয়েটা কি পিন্টুকেও এই কথা জানিয়েছে। পিন্টু বলল, ভাই অন্য জিনিস মানে কোনটা? আর কী পাইবেন 

যাক বলে নি তাহলে !

রিশাদ বলল, কিছু না । তারপর চকলেটটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল দোকান থেকে । মাথার ভেতরে অদ্ভুত সব সব চিন্তা খেলা করছে। মেয়েটা হঠাৎ এমন আচরণ কেন করছে! রিশাদ সত্যিই কিছু বুঝতে পারছে না। তবে রিশাদের কেন জানি খুব একটা খারাপও লাগছে না।।

আরও এক মাস পর

নীরা কলেজ থেকে বাসার দিকে যাচ্ছিল। প্রায় দিনই সে হেটেই বাসায় যায়। ওর কলেজটা বাসা থেকে খুব একটা দুরেও না। আগে রিক্সা করে যেত কারণ পাড়ার মোড়ে বখাটে গুলো ওকে টিজ করত তবে এখন সেই টিজ করাটা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই সম্ভবত বুঝে গেছে যে রিশাদের সাথে নীরার কিছু চলছে। যদিও রিশাদ কিংবা নীরা কেউই সুস্পষ্ট ভাবে কিছু বলে নি। তবে নীরা প্রায় দিনই রিশাদকে একটা করে চকলেট দেয় । বেশির ভাগ দিনে নিজের হাতে দিলেও মাঝে মাঝে পিন্টুর হাত দিয়েই দেয় যাতে মানুষ জন এটা দেখতে পায়। 

আজকেও নীরা আস্তে আস্তে হাটছে। কলেজ থেকে সোজা প্রধান রাস্তা দিয়ে না গিয়ে মাঝের একটা গলি রয়েছে। এখানে আগে কয়েকটা ফ্যাক্টরি ছিল। এখন সেগুলো বন্ধ হয়ে আছে। তাই জায়গাটা বেশ নির্জন থাকে। আগে এই দিক দিয়ে যেতে ভয় লাগলেও এখন কেন জানি লাগে না। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে এখানে প্রায়ই রিশাদকে দেখা যায় আড্ডা দিচ্ছে। আজকেও হয়তো পাওয়া যাবে।

আরও কয়েক কদম যেতেই একটা ফ্যাক্টরির দেয়াল রয়েছে । সেটা পার হতেই নীরা রিশাদকে দেখতে পেল । তবে যেভাবে দেখতে পাবে সেভাবে ন। কয়েকটা মুহুর্ত সময় লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। রিশাদকে ঘিরে রয়েছে মোট তিনজন । ওকে অবশ্য সময় লোকজন ঘিরেই থাকে তবে আজকের ব্যাপারটা যে অন্য রকম সেটা বুঝতে ওর কয়েক মুহুর্ত সময় লাগল। এই তিনজন মানুষ মোটেও রিশাদের কাছের কেউ না। একজনের হাতে বড় ছুরি দেখেই নীরা যেন ভয়ে জমে গেল। রিশাদের সাথে কী হতে চলেছে সেটা নীরার বুঝতে খুব বেশি সময় লাগল না। রিশাদকে এখানে একা পেয়ে এরা ওর উপরে হামলা করছে। এতো সাহস এদের কিভাবে হল?

অবশ্য এর রকম চোরাগুপ্তা হামলা যে কেউ করতে পারে। অন্য সময় হলে হয়তো নীরা নিজে ভয়ে পালিয়ে যেত কিন্তু এখন নীরার মাঝে যে কী হল যেটা নীরা নিজেও বলতে পারবে না। সে একটা চিৎকার দিল তারপর এক দৌড়ে রিশাদের কাছে চলে গেল। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। 

এমন যে কিছু হতে পারে সম্ভত রিশাদ বুঝতে পারে নি। এমন কি তার হামলাকারীরাও বুঝতে পারে নি। তারা কিছু সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তবে নীরা কিন্তু ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে। সেই সাথে রিশাদকে আড়াল করার চেষ্টা করে চলেছে। কোন ভাবেই যে রিশাদের শরীরে কোন আঘাত পেতে দিবে না।

তখনই নীরার কানে একটা পরিচিত ডাক এল । কুকুরের ডাক। বেশ কয়েকটা কুকুরের আওয়াজ ওর কানে এল। নীরার কেন জানি মনে হল আর ভয় নেই। রিশাদকে ওরা কিছু করতে পারবে না আর।

এতো উত্তেজনা নীরার আর সহ্য হল না। যখনই ও একটু নিশ্চিত হল নিজের কাছে যে রিশাদের আর কোন ক্ষতি হবে না তখন ওর দেহটা ছেড়ে দিল। আর তখনই জ্ঞান হারালো সে।

সেদিন সন্ধ্যা 

নীরা যখন চোখ মেলে তাকাল তখন দেখল ও নিজের ঘরে শুয়ে আছে। চোখে মেলেই সে তার মাকে দেখতে পেল। ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। 

-কেমন লাগছে এখন?

নীরা মৃদু স্বরে বলল, ভাল।

-তুই আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। ওভাবে তুই কেন গিয়েছিলি? তোকে না বলেছি রিক্সায় আসতে! 

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নীরা তার আগেই একজনকে ঘরে ঢুকতে দেখল। মানুষটাকে নীরা নিজেও চেনে। রিশাদের বাবা । নীরার মায়ের কাছে এসে বলল, ভাবী প্লিজ নীরাকে কিছু বলবেন না । আজকে ও না থাকলে রিশাদের যে কী হত সেটা আমি ভাবতেই পারছি না।

নীরা দেখল ওর মা ওকে আর কিছু বলল না । তবে সে যে এই ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করে নি সেটা খুব ভাল ভাবেই বোঝা গেল তার মুখ দিয়ে। নীরার অবশ্য এতো কিছু মনে হল না। রিশাদের বাবার মুখ থেকেই শুনতে পেল রিশাদ ঠিক আছে। এটাই ওর জন্য অনেক কিছু।

রাতে নীরা অনেকটা সময় ভাবল । ওর এতো সাহস কিভাবে হল সেটা ও নিজেই জানে না। যদি সত্যিই ওরা ওর শরীরে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিত তখন কী হত?

পরিশিষ্ট

নীরা আবারও সেই নির্জন কারখানার পাশে এসেছে। একা আসে নি । পিন্টু ওকে ডেকে নিয়ে এসেছে। ওকে সেই দিন সেখানেই রেখে পিন্টু চলে গেল। নীরা দেখতে পেল রিশাদ সেখানেই বসে রয়েছে। ওর পাশে বেশ কয়েকটা কুকুর বসে রয়েছে অলস ভাবে। রিশাদের মাথা এখনও একটা পট্টি দেখা যাচ্ছে। 

নীরা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। রিশাদ বলল, আজকের চকলেট কই?

-নেই?

-কেন?

-এমনি !

-আজকে অবশ্য আমার চকলেট দেওয়ার কথা তোমাকে!

-দিন তাহলে!

-সাথে আনি নি। তবে একটা কথা বলার আছে!

-কী কথা ?

-আমি আর সিগারেট খাই নি।  আর কখনও খাবো না।

-কেন খাবেন না কেন?

-কারণ একজন আমাকে কথা দিয়েছে সিগারেট না খেলে আমাকে খুব মিষ্টি কিছু খেতে দিবে!

নীরা এক ভাবে তাকিয়ে রইলো রিশাদের দিকে। মুখে কেবল দুষ্টু একটা হাসি দেখা দিয়েছে ওর !

আমার করা অনুবাদ গ্রন্থ পাওয়া যাচ্ছে মেলাতে। স্টল নম্বর ১০০। এছাড়া অনলাইন থেকে কিনতে ক্লিক করুন

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 49

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →