তুমি কি ফিরে এসেছিলে?

oputanvir
4.8
(41)

আমাদের জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যা আমাদেরকে একেবারে বদলে দেয় । আমরা একেবারে নতুন মানুষ হয়ে যাই । আমাদেরকে তখন কেউ আর সেই আগের মানুষ বলে চেনা যায় না । আমরা নিজেরাই নিজেদেরকেই নিজেরা চিনতে পারি না । নওরিনের জীবনটাও ঠিক একই ভাবে বদলে গিয়েছিল । সেদিনের সে ঘটনার পরে নওরিন নিজের ভেতরের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হয়েছিল। বারবার সে নিজেকে ফিরে পেতে চেয়েছিল কিন্তু আর সে নিজেকে ফিরে পায় নি । নিজের জীবনের সাথেই সমঝোতা করে নিয়েছিল বটে তবে সে আবারও একই ভাবে একই গর্তে ধাক্কা খাবে সেটা সে কোন দিনই ভাবতে পারে নি । অন্তত এই দুর দেশে এভাবে আবিরের সাথে দেখা হবে সেটা সে কখনই ভাবে নি ।

নওরিন এয়ারপোর্টের কাঁচে ঘেরা দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো কিছু , পুরো এলাকাটা যেনে একেবারে সাদা হয়ে আছে । যতদুর চোখ যায় সাদা বরফ ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ছে না । মাফলারটা আরেকটু জড়িয়ে নিল ।। যদিও ভেতরটা এখনও বেশ উষ্ণ তার পরেও মনের ভেতরেই শীত শীত অনুভুত হচ্ছে ওর । এই আবহাওয়াতে বাইরে বের হওয়ার কোন উপায় নেই । এখানে নেমেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে ও যোগাযোগ করেছিল । ওরা বার কয়েক ক্ষমা চেয়ে ওকে বলেছে যে প্রচন্ড তুষারপাত শুরু হয়েছে হঠাৎ করেই । তাই লোকাল কন্ট্যাক্ট কোন ভাবেই এই রাতের বেলা এয়ারপোর্টে এসে হাজির হতে পারছে না। ওকে একটু কষ্ট করে এয়ারপোর্টের আশে পাশে কোন মোটেলে আজকে রাতটা কাটানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছে । সকল খরচ ওরা বহন করবে জানিয়েছে। নওরিন হেসে সম্মতি জানিয়েছে । এছাড়া আর কিছু করাও নেই । আবহাওয়া খারাপ হলে আসলে কারোই কিছু করার থাকে না । তারপরেও আরও দুয়েকবার ফোন করলো ওরা । আশে পাশের কয়েকটা মোটেলের ঠিকানা দিয়ে দিল ।

নওরিন কিছু সময় তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে । একবার মনে হল রাতটা এখানে কাটিয়ে দেয়। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সময়টা । এগারটা পঁচিশ বাজে । ছয় সাতটা ঘন্টা । এয়ারপোর্টের চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। সাথে করে একটা গল্পের বই এনেছে ও । অর্ধেকটা পড়া হয়েছে । বাকিটা পড়ে শেষ করতে পারবে এখানে বসেই ।

নওরিন যখন বই বের করে সেটা পড়তে শুরু করবে তখনই ফোনটা বেজে উঠল । নম্বরটা অপরিচিত । একটু আগে ক্যাম্পাস থেকে যে নম্বরে ওর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল এটা সেই নম্বর নয় । হোয়াটসএপেই এসেছে ফোনটা । তাই কোন র‍্যান্ডম কলও হতে পারে না । হতে পারে ক্যাম্পাসের অন্য কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। নওরিন ফোনটা রিসিভ করল।

সম্পূর্ণ বাংলাতে একজন বলল,

-নওরিন?

-হ্যা ।

-দুই নম্বর গেটের দিকে আসো একটু।

নওরিন কিছু বলতে পারবে না তবে মনের ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল । এখানে প্রচুর বাংলাদেশী এবং কলকাতার ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে তবে এতো জলদি এদের কারো সাথে যোগাযোগ হবে নওরিন ভাবতে পারে নি ।

ব্যাগ গুলো সাথে নিয়ে দুই নম্বর গেটের দিকে হাটা দিল । এই তুষার ঝড়ের ভেতরে কেউ ওর সাথে দেখা করতে এসেছে ব্যাপারটা ওর কাছে কেমন অদ্ভুত ঠেকছে। কিন্তু নওরিনের জন্য হয়তো আরও বিস্ময়ের ঘটনা অপেক্ষা করছিল। দরজার সামনে আসতেই দেখতে পেল তাকে ।

থমকে দাড়ালো ।

এই দুর দেশে তাকে আবারও দেখতে পাবে নওরিন ভাবতেই পারে নি। সেই লম্বা চুল আর গভীর চোখ নিয়ে সে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকেই । কোন সন্দেহ নেই ওর জন্যই সে এখানে এসেছে । একটু আগে সেই ওকে ফোন করেছিল।

কত বছর হল?

দশ বছর ?

নাকি একটু কম ?

আবির খুব স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে এল । তারপর খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, আজকের আবহাওয়া যে এমন ভাবে খারাপ হবে সেটা বুঝতে পারি নি । নয়তো আরও আগে চলে আসতাম । একবার তো ভেবেছিলাম আসতেই পারব না।

নওরিনের মাথায় কিছু ঢুকছে না । আবির জানতো ও আসবে ।

কিভাবে জানত?

ওর কি জানার কথা ?

মানুষটার দিকে চোখ ভরে তাকিয়ে রইলো কেবল। এতো গুলো বছর পার হয়ে গেছে অথচ সেই অনুভূতিটা এখনও কত তাজা রয়েছে। এই মানুষটার জন্য ওর পুরো জীবনটাই বদলে গিয়েছিল । একেবারে নতুন মানুষে পরিণত হয়েছিল নওরিন । আজকে আবারও সেই মানুষটাই ওর সামনে । এতো গুলো বছর পরে আবারও ওর চোখের সামনে এসে হাজির হয়েছে সে ।

যখন ওকে নিয়ে গাড়িটা চলতে শুরু করল তখন আবির নিজ থেকেই বলল, অবাক হচ্ছ এখানে আমাকে দেখে?

-হুম।

-আসলে তুমি যে প্রোফেসরের সাথে যোগাযোগ করেছ উনি আমার ইমিডিয়েট প্রফেসর । আমি ওনার আন্ডারেই রয়েছি এখানে। ওনার হয়ে আমিই ফরেন স্টুডেন্টদের যাচাইবাছাইয়ের কাজ করি । বলতে পারো সেদিন ভাগ্যক্রমে তোমার এপ্লিকেশন আমার হাতে এসে পড়েছিল । আমি প্রথমে ঠিক চিনতে না পাড়লেও পরে যখন ভাল করে তোমার ছবি দেখলাম তারপর আরও তথ্য যাচাই করলাম তখন্ বুঝতে পারলাম যে তুমিই !

নওরিনের কাছে হঠাৎ কিছু ব্যাপার ক্লিয়ার হয়ে গেল । ওর ফুলফান্ড স্কলারশীপ নিয়ে এখানে আসার কথা ছিল না । যখন ও আবেদন করেছিল তখন ধরেই নিয়েছিল যে এখান থেকে ডাক আসবে না যদি আসেও তবে ফুল ফান্ডিং আসবে না । কিন্তু যখন অফার লেটার এল তখন বিস্মিত হয়েছিল । যদিও বাসা থেকে মোটেই রাজি ছিল না । তাদের একটাই কথা যে একা একা তাদের মেয়েকে তারা এতো দূরে পাঠাবেন না ।

তবে শেষ পর্যন্ত তারা অদ্ভুত এক শর্ত জুড়ে দিলেন । যেতে হলে আগে বিয়ে করে তারপর যেতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা অবশ্য নওরিনকে করতে হয় নি । কেবল এঙ্গেইজেন্ট করে এসেছে বাবার পছন্দের ছেলের সাথে । কদিন পরে ছেলেও নাকি আসবে । তখনই বিয়েটা হবে।

আবির খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিল । এখনও বেশ ভাল পরিমানেই তুষার পরছে তবে আগের থেকে কম এখন । সম্ভবত একটু আগে রাস্তা থেকে তুষার সরানো হয়েছে । নওরিন এখনও যেন ঠিক মত কিছু বিশ্বাস করতে পারছে না। আবিরের সাথে এই ভাবে দেখা হয়ে যাবে সেটা সে ভাবতেও পারে নি । এভাবে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সাথে কি দেখা হয়ে যায়? নওরিন যখন ঢাকাতে পড়তে গেল তখন কতবার এই আশায় বুক বেঁধেছিল যে পথে চলতে ফিরতে কোন না কোন দিন তার সাথে আবিরের ঠিকই দেখা হয়ে যাবে । কিন্তু কোন দিন দেখা হয় নি । আর আজকে এই ভাবে এই দুর দেশে ওর চোখের সামনে এসে হাজির ছেলেটা !

আচ্ছা আবির বিয়ে করেছে?

বিয়ে না করলেও একটা প্রেমিকা তো আছেই ওর ! এতো গুলো দিন পার হয়ে গেছে একা একা তো আর থাকবে না। এটার কোন মানে নেই।

-তুমি চাইলে একটু ঘুমিয়ে নাও। ঘন্টা দুয়েক লাগবে যেতে !

-কোথায় যাচ্ছি ?

-আমার আসায়?

-বাসায়?

-হ্যা ! এতো রাতে কোন মোটেলে যেতে হবে না । আমার বাসা থেকে ইউনিভারসিটি কাছে ।

-বাসায় আর কে আছে?

-আর কে থাকবে?

-তোমার বউ?

খুব যেন মজার কোন কথা বলেছে নওরিন । আবির খুব জোড়ে হেসে উঠল । তারপর বলল, হ্যা আছে একটা বউ । এতো চিন্তা করতে হবে না । আর এটা বাংলাদেশ নয় যে বাসায় হাজির হলেই মানুষজন লংকা কাণ্ড বাধিয়ে দিবে।

নওরিন কেমন যেন একটু সংকুচিত বোধ করল । আবির এই কথাটা কেন সেটা সে খুব ভাল করেই জানে । সেদিনের সেই ঘটনা নওরিনের খুব ভাল করেই মনে আছে ।

নওরিনের শরীরটা সত্যিই ক্লান্ত হয়ে আছে । এতোটা সময় নিজের শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার কোন উপায় ছিল না । কিন্তু এখন নওরিন জানে যে পাশে একজন রয়েছে যে কিনা ওকে ঠিকই দেখে শুনে রাখবে। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায় ।

আমাদের সবার বেলাতেই এমন ঘটনা ঘটে । আমরা যখন দেখি আমাদেরকে দেখে শুনে রাখার কেউ নেই তখন সর্বদা আমরা সচেতন থাকি নিজের সব কিছু নিজেরাই দেখে শুনে রাখি কিন্তু যখনই কেউ একজন আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, এমন একজন যার উপরে আমরা পূর্ন ভাবে ভরশা করতে পারি তখন আমরা সব কিছু তার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যাই । এই যে পাশে গাড়ি চালাচ্ছে যে মানুষটা, সেই মানুষটার সাথে প্রায় দশ বছর পরে দেখা হয়েছে নওরিনের । অথচ সে এই মানুষটার উপর নিশ্চিন্তেই ভরশা করতে পারছে। সে জানে মানুষটা তাকে দেখে শুনে রাখবে।

কেন এমন একটা অনুভূতি ওর মনে এসে হাজির হল সেটা নওরিন জানে না । কোন ব্যাখ্যা নেই, নেই কোন কারণ। অবশ্য এই যে এই তুষার ঝড়ের ভেতরেও এই মানুষটা দুই ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে ওকে নিতে এসেছে, এটা একটা কারণ হতে পারে ।

নওরিন চোখ বন্ধ করল । একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক ।   

চলবে…..

আমার অনুবাদ করা একটা বই বের হচ্ছে । বইটির প্রি অর্ডার শুরু হয়েছে । এখানে থেকে প্রি-অর্ডার করতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 41

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “তুমি কি ফিরে এসেছিলে?”

  1. ভাই আপনার গল্পগুলো এককথায় অসাধারণ। অবসর সময়ে পড়ার জন্য একদম পারফেক্ট

Comments are closed.