মিমি নিজেও জানে না সে কী দেখবে কফিনটার ভেতরে । এতো দিন ধরে যে ডাকটা সে শুনে এসেছে সেই ডাকটার মালিককে সে দেখে নি । কেবল অনুভব করেছে কেবল !
কিন্তু আজকে সে তাকে দেখতে চলেছে।
কফিনটা বের হয়ে এল । এদিকে দরজাটা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে । তবে দরজাটা পুরোপুরি খোলার আগেই ওরা কফিনটা খুলে ফেলবে । এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
আচ্ছা ভেতরে যে আছে সে কেমন?
আরিয়ানা বলল, মিমি ! এই কাজটা কর না ! সব কিছু ওলট পালট হয়ে যাবে । এমন টা কর না । এখনও কিছুই নষ্ট হয় নি ।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই দরজাটা তীব্র বিস্ফোরণে ভেঙ্গে পড়ল । সেই সাথে কফিনটাও এক দিকে ছিটকে পড়ল । ভেতরে ঢুকে পড়েছে ওরা । কয়েক রাউন্ড গুলো করল । মিমিকে লক্ষ্য করেই গুলি চালালো ওরা !
ওদের সবার সামনেই দেখা গেল জ্যাকোব কে। তবে গুলিটা মিমির শরীরের লাগল না । ফরহাদ এগিয়ে এসে সেই গুলিটা হজম করে নিল । তবে মিমি ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। আক্রমণটা সামনের দিকে করতে যাবো কিন্তু ফরহাদ ওকে মানা করল । এর থেকেও জরুরী কাজ রয়েছে । চোখের ইশারায় দেখালো ডান দিকে ।
সেদিকে চোখ যেতেই দেখতে পেল তাকে ।
ঘুমন্ত রায়ানকে !
ওদের ফ্লিপিং কিং !
ফরহার তখনই চিৎকার করে বলল, শিল্ড !
শিল্ড শব্দটা বলার সাথে সাথে সব গুলো ভ্যাম্পায়ার একেবারে এক সাথে এসে হাজির হল । ঠিক কফিনের সামনে হিউম্যান শিল্ড তৈরি করল । এটা ভেদ করে কোন গুলি ওদের সামনে আসবে না ।
মিমি এক ভাবে কিছু সময় রায়ানের চেহারার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । মনে হচ্ছে যেন ঘুমিয়ে রয়েছে সে । এতো গুলো বছর ধরে সে এই মাটির নিচে আটকে রয়েছে । সাধারণ মানুষের শরীর হলে কবেই না পচে গলে যেত । কিন্তু এই শরীরটা একদম তাজা রয়েছে !
কিভাবে রয়েছে সেটা মিমি জানে না । কেবল চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে যে রয়েছে ।
আরিয়ানার চিৎকার আবারও কানে এল ওর ।
না মিমি ! না ! এমন টা কর না !
তবে মিমির সেদিকে খেয়াল নেই ।
সে নিজের হাতের কাছটা কামড়ে ধরল । দাত দিয়েই ছিড়ে ফেলল সেটা । রক্ত বের হল বেশ খানিকটা । সেই রক্ত সে মুখে নিল । তবে সেটা গিলে ফেলল না । মুখের ভেতরে নিয়েই রায়ানের একবারে কাছে গিয়ে হাজির হল । ঠোট দিয়ে গভীর চুমু খেলে রাখানের ঠোটে । এবং নিজের মুখে নেওয়া নিজের রক্ত রায়ানের মুখের ভেতরে চালান করে দিল ।
প্রথমে যেন কিছুই হল না ।
মিমি কিছু বুঝল না । ঘরের ভেরতে সবাই যেন একেবারে থেমে গেছে । চার্চের লোকজনও গুলি করা বন্ধ করে করে দিয়েছে । ওরাও দেখার জন্য অপেক্ষা করছে যে কী হয় !
কিন্তু কিছুই হল না । রাজার ঘুম তো ভাঙ্গল না ।
রাজা তো জেগে উঠলো না । স্লিপিং কিং তো ঘুমিয়েই রইলো!
তাহলে ওকে যে ডাকল?
প্রতিটা রাতে যে কেউ ওকে ডাকত, ওকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করতো সেই ডাকটা কোথা থেকে এল?
নাকি সে ঠিক মত তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে নি ?
কোন ভুল হল কী?
মিমি চেহারাটার দিকে কেবল তাকিয়ে রইলো একভাবে?
এই প্রথম সে চেহারাটাকে দেখলো অথচ ওর কাছে মনে হল যে কত দিনেরই না চেন যেন এই মানুষটা ! এখনও মনে হচ্ছে যে ঘুমিয়ে রয়েছে সে । এখনই জেগে উঠবে !
পুরো বেজমেন্টের সব কিছু যেন থেমে গেছে । সবাই কেবল তাকিয়ে রয়েছে কফিন থেকে পরে যাওয়া রায়ানের দেহটার দিকে । এভাবে কত সময় পার হয়ে গেল কেউ বলতে পারবে না । তবে এক সময়ে সবার স্তব্ধতা ভাবটা কেটে গেল । এদের ভেতরে সবার আগে এগিয়ে এল জ্যাকোব । সে পিস্তলটা ঠেকালো মিমির মাথার উপরে। তারপর বলল, তোমাদের রাজা দেখি আসলো না তোমাদের বাঁচাতে? আই গেস সে তোমাদের ত্যাগ করেছে।
মিমি উঠে দাড়ালো । অন্য সবার দিকে তাকাল। গুলির আঘাতে প্রায় সবাই আহত । ওরা মরবে না সেটা মিমি জানে । হয়তো বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সময় লাগবে । তাহলেই সুস্থ হয়ে উঠবে।
ভ্যাম্পায়ারদের মারার জন্য বিশেষ পদ্ধতি আছে । তাদের ভেতরে একটা হচ্ছে ওদের মাথা কেটে ফেলা । অন্যটা ঘুমন্ত অবস্থায় বুকে বড় গজাল বিধিয়ে দেওয়া।
জ্যাকোব আবার বলল, এবার বিদায় দেওয়ার পালা । যদিও তোমার ভেতরে রাজাকে জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই দেখা যাচ্ছে তারপরেও তুমি আমাদের জন্য বিপদজনক !
এবং বলতে বলতেই সে ট্রিগার চেপে দিল ।
মিমি নিজের মস্তিস্কের ভেতরে সেই তীব্র উত্তেজনা অনুভব করতে পারল । রিভালবারের ট্রিগার চাপার সময় থেকে একেবারে গুলি বের হওয়ার প্রতিটা মুহুর্ত যখন সে অনুভব করতে পারছে । এই তো দেখা যাচ্ছে গুলিটা নল থেকে বের হয়ে আসছে । সোজা ওর কপাল বরাবর আসছে সেটা । এখনই সোটা ওর কপালে গিয়ে লাগবে । তারপর সেখানেই মৃত্যু হবে । সব কিছু যেন থেমে গেছে।
গুলিটা ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখছে সে !
তাহলে এটা তার জীবনের এটাই শেষ । এখানেই সমাপ্তি?
মিমি কেন জানি পালাতে চেষ্টা করল না । এমন কি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টাও করলো না । সেই স্থানেই স্থির হয়ে বসে রইলো ।
মনের ভেতরে একটা তীব্র অনুভূতি জাগ্রত হল । মনে হল যেন এই মৃত্যুর ভেতরে সে রায়ানের সাথে মিলিত হতে পারবে । এক সাথে থাকতে পারবে। ওর প্রতি হঠাৎ এই ভালবাসা কিভাবে আর কোথা থেকে এল সেটা মিমি জানে না ।
ফরহান নামের সেই ভ্যাম্পায়ার মিমিকে বলেছিল যে মিমির উচিৎ ছিল নাকি রায়ানের জন্য পাগল হয়ে যাওয়া । এমনটাই নাকি হওয়ার কথা । রায়ান যাকে নির্বাচন করবে জেগে ওঠার জন্য সে নাকি রায়ানের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে । কিন্তু মিমি সেই অনুভূতিকে ওভাকাম করেছিল । পাগল সে হয় নি ।
এটা দেখে ফরহান কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিল । সে বলেছিল যে তাহলে রায়ান মিমিকে আর নিয়ন্ত্রিত করতে নাও পারতে । বরং রাজা নিজেই শুনবে রানীর কথা ! কিন্তু তারপরেও মিমি একটা টান ঠিকই অনুভব করতে শুরু করেছিল । চাইলে সে এটা উপেক্ষা করতে পারতো ঠিকই তবে সে করে নি । রায়ানকে জাগিয়ে তোলার জন্য এগিয়ে এসেছে।
কিন্তু যখন ওকে আর জাগিয়ে তোলা যায় নি তখন মিমির কাছে সব কিছু কেমন যে অর্থহীন মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে ওর আর এই পৃথিবীতে কিছুই নেই । কেউ নেই । এখানে থাকার কোন মানে নেই ।
মিমি চোখ বন্ধ করল । স্থির হয়ে সেখানেই বসে রইলো । গুলির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল ।
কিন্তু কিছু একটা স্থির রইলো না । গুলিটা যখন মিমির কপালে গিয়ে ঠেকবে ঠিক তখনই তাদের মাঝে এসে দাড়াল ।
একটা হাত !
####
আরিয়ানা তাকে দেখল । উঠে বসেছে । এবং হাতটা এগিয়ে দিয়ে সে গুলিটা ঠেকিয়ে দিয়ে ।
তার হাত দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করল বটে সেটার দিকে সে বিন্দু মাত্র খেয়াল দিল না । এতো দ্রুত সে চলাচল করল সে চোখের পলকে জ্যাকোবের কাছে পৌছে গেল । একটা কেবল চড় মারল জ্যাকোবকে । একেবারে উলটে গিয়ে পাশের দেয়ালের সাথে গিয়ে বাড়ি খেল সে ।
এরপর অন্য সবাইকে কাবু করতে তার সময় লাগল না খুব একটা ।
যখন আরিয়ানার একেবারে মুখোমুখো এল সে আরিয়ানার মনের ভেতরে একটা তীব্র ভয় এসে দাড়াল । রক্তাক্ত লাল চোখ । এতো ভয়ংকর চোখে সে জীবনেও দেখেনি । জীবনে এতো ভয় সে পায় নি ।
তবে তখনই আরেকটা ঘটনা ঘটল । মিমি একেবারে ওদের কাছে এসে হাজির হল । তারপর রায়ানের হাত টা চেয়ে ধরলো ।
রায়ান যেন আরও রেগে গেল ! এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিতে চাইলো তবে সে পারল না ।
এটা ওকে বেশ অবাকই করল। তবে মনে পড়লো এতো দীর্ঘ সময় সে ঘুমিয়ে ছিল । পূর্ণ মাত্রায় শক্তি সে অর্জন এখনও করতে পারে নি । আর যে ওকে আটকেছে ওর শরীরেও একই শক্তি রয়েছে ।
-তোমার সাহস তো কম না আমাকে বাঁধা দিচ্ছ ? তুমি জানো না তুমি কে? তোমার অবস্থান কোথায়?
মিমি তখন রায়ানকে তীব্র অবাক করে দিয়ে ওর গালে কষে একটা চড় মারল ।
রায়ান তো বটেই ঘরে থাকা প্রতিটি মানুষ এবং ভ্যাম্পায়ার তীব্র বিস্ময় নিয়ে সেই ঘটনা দেখতে পেল । রায়ান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল কেবল ! গত হাজার বছরে কেউ তাকে এভাবে চড় মেরেছে বলে তার মনে পড়ে নি । আর এই মেয়ে যে কিনা তার রানী হওয়ার কথা, আজ্ঞাবহ দাসী হওয়ার কথা সেই তাকে এভাব চড় মারল !
রায়ান এবার মিমির চোখের দিকে তাকালো । যে কোন মানুষকে মুহুর্তের ভেতরে কাবু করাটা তার জন্য কোন ব্যাপার না ।
সে তাকাল তবে কোন কিছুই হল না ।
মিমি বলল, এসব কিছু চলবে না । কোন মানুষ কে মারা চলবে না । কথা পরিস্কার হয়েছে?
-কী আমাকে হুকুম !
-আমার চড় খাবে বলে দিলাম । বলেছি না কিছু চলবে না ।
রায়ান তখন অবাক হয়ে খেয়াল করল যে একটু আগে ওর ভেতরে সে আক্রোস ছিল, সব মানুষকে মেরে ফেলার যে তীব্র আকাঙ্কা ছিল সেটা একেবারে নেই হয়ে গেছে ।
-চল এখান থেকে!
মিমি কথাটা হুকুমের মতই শোনাল। রায়ান কিছুতেই সেই হুকুমটা অমান্য করতে পারছে না । বারবার মনে হচ্ছে ওর এখন এখান থেকে চলেই যেতে হবে।
মিমি এবার আরিয়ানার দিকে তাকাল । তারপর বলল, আমি আগেই বলেছি আমি কোণ ভায়োলেন্স চাই না । আমি এটা নিশ্চিত করব যে রায়ান যেন কোন মানুষকে হত্যা না করে । আর তুমি এটা নিশ্চিত করবে যেন কোন ভ্যাম্পার হান্ট যেন না বের হয় । আমি ভায়োলেন্স চাই না তার মানে নেই না যে আঘাত এলে সেটা সহ্য করে নিব। কথাটা মনে রেখ।
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, চল এখান থেকে । সকালের আলো ফুটবে একটু পরে । আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে !
রায়ানের দিকে তারপর তাকিয়ে বলল, আর তুমি ! সেই রাজা বাদসার দিন এখন আর নেই । এসব ভং বাদ দাও । আমার উপর তোমার নিয়ন্ত্রন থাকার কথা যদিও মনে হচ্ছে সেটা কাজ হচ্ছে না । বরং উল্টোটা হচ্ছে । তোমাকে এখন থেকে আমার কথা শুনতে হবে।
পরিশিষ্ট
ফরহাদের বিশাল বড় একটা বাড়িতে রায়ান গত একসপ্তাহ ধরে রয়েছে । এই এক সপ্তাহে কত ভ্যাম্পায়ার যে ওর সাথে দেখা করতে এসেছে তার কোন ঠিক নেই । তাদের রাজা ফিরে এসেছে । সব কিছু এখন বদলে যাবে এখন ।
রায়ান কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না যে ও কেন মিমি নামের মেয়েটাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না । বরং উল্টোটা হচ্ছে । মিমির কথা সে কোন ভাবেই উপেক্ষা করতে পারছে না । এই যেমন মিমি ওকে কঠিন কন্ঠে বলে গেছে যে কোণ ভাবেই রক্তের জন্য মানুষ মারা চলবে না । এখন ব্লাড ব্যাংক আছে। সেখান থেকে রক্ষ কিনতে হবে । এর অন্যথায় হবে কিছুতেই ।
রায়ান এও ভেবেছিল যে কলারটার জন্যই বুঝি ওকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে । কিন্তু সেটাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে । মিমি কলারটা সেদিনের পরে আর পরে নি । কিন্তু তারপরেও সব কিছু একই রয়েছে । এবং সব থেকে বড় ব্যাপার রায়ান মেয়েটার প্রতি তীব্র একটা আকর্ষণ অনুভব করছে । মনে হচ্ছে মেয়েটার সাথে তার দেখা করতেই হবে ।
আজকে সে তাই মিমির বাসার সামনে এসে হাজির হয়েছে। ওর হাতে ছোট একটা যন্ত্র । এটার নাম নাকি স্মার্ট ফোন । এটা দিয়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ করা যায়। ওর সময়ে এসবের কিছুই ছিল না । রায়ান এই কদিনে কিছু বুঝতে পেরেছে এর ব্যবহার !
সে রাস্তায় দাড়িয়েই ফোন দিল মিমিকে ।
-তোমার বাসার সামনে । নিচে নেমে এসো।
-তোমাকে না বলেছি হুকুম দেবে না । রাজা বাদশার ঢং এখানে চলবে না !
রায়ানের মেজাজটা বিগড়ে গেল । তবে সে জানে তার আসলে কিছুই করার নেই। এই মেয়ে তার রাগের মোটেও ধার ধারে না । একটু শান্ত গলায় বলল, নিচে নেমে এসো ।
-আসব না ।
রায়ান খানিকটা অসহায় বোধ করল । একবার মনে হল ফোন কেটে দেয় । কিন্তু পরক্ষণেই মনের ভেতরে মিমির সাথে দেখার করার তীব্র আকাঙ্খাটা আরও তীব্র হয়ে উঠল ।
-প্লিজ । নেমে এসো !
-হুম ! দ্যাস বেটার।
তবে কন্ঠটা ফোন থেকে নয়, পেছন থেকে শোনা গেল ! মিমি নেমে এসেছে । ওকে দেখেও যেন রায়ানের চোখে শান্তি লাগল ।
মিমি এগিয়ে এসে বলল, চলেন মহারাজ ! আজকে আপনাকে একটা জিনিস খাওয়াবো । মানুষের রক্ত তো অনেক খেলেন এবার মানুষের খাবার খেয়ে একটু দেখেন কেমন লাগে !
-আমি এসব খাই না ।
-খাই না বললে চলবে না । খেতে হবে । ফুচকা খেয়ে দেখুন কতই না মজা লাগে!
রায়ানের মনে হল ও ঘুমিয়ে ছিল সেটাই ভাল ছিল । এখন জেগে উঠে বড় বিপদে পড়েছে ।