সী-অফ

oputanvir
4.6
(51)

নোভার কথা শুনে আমি একটু অবাকই হলাম বলা চলে। নোভা আমাকে সী-অফের কথা সেটা আমি ভাবতেও পারি নি । অফিসে এক সাথে কাজ করার সুবাদে ওর সাথে আমার কথা বার্তা হয় । কিন্তু সেটা এই পর্যন্তই। এর বেশি আমাদের ভেতরে কোন সম্পর্কে ছিল না । তাই যখন নোভা আমাকে আলাদা ভাবে ওকে এয়ারপোর্টে সীঅফের কথা বলল তখন আমি একটু অবাকই হলাম । তবে কেন জানি ব্যাপারটা আমার ভালও লাগলো । বললাম, অবশ্যই । কোন সমস্যা নেই ।

অফিস থেকে নোভা এক বছরের ছুটি নিয়েছে । পড়াশোনা করার জন্য সে ইউরোপে যাচ্ছে । চাকরিটা সে ইচ্ছে করেই ছাড়ে নি । ছুটি নিয়েছে নন পেইড ছুটি । যেমন পড়াশোনা শেষ করে যখন আবার দেশে আসবে তখন যে অফিসে জয়েন করতে পারে ।

নির্ধারিত দিনে আমি নোভার বাসার সামনে গিয়ে হাজির হলাম। ফোন করতেই দেখলাম নোভা নিজেই ব্যাগ পত্র নিয়ে বের হয়ে এল । নোভা এখানে ছোট একটা বাসা ভাড়া করে থাকতো আরো দুটো মেয়ের সাথে । সেখানকার সব জিনিস পত্র সে গ্রামের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে । বাকি কয়েকদিন সে ছিল ওর এক মামার বাসাতে । সেই বাসার সামনেই আমি এসে হাজির হলাম । দেখলাম আর কেউ আমাদের সাথে এল না ।

উবার যখন চলতে শুরু করলো তখন নোভা বলল, আপনি অবাক হলেন না যে কেউ আমার সাথে আসতে চাইলো না ?
আমি সত্যিই এই কথাই ভাবছিলাম । বললাম, আসলে ….
নোভা হাসলো । তারপর বলল, এমন ভাবনা আসাটা স্বাভাবিক । আসলে আমার মামী ঠিক আমাদের কেউ পরিবারকে পছন্দ করেন না । আমার এক মামাতো ভাই আছে । সে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল । আমার তাকে পছন্দ ছিল না বলে না করে দিয়েছিলাম । তারপর থেকেই এমন । তবে মামার আদরই করতেন । ঢাকাতে আমি অনেক দিন থাকেলও মামার বাড়িতে যেতামই না একদম । মাঝে মাঝে মামার সাথে দেখা করতে তার অফিসে যেতাম । এইবার বাবা একবার জোর করেই নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে । বললেন যে যাওয়ার আগে তার সাথে দেখা করে যাই ।

এই বলে নোভা চুপ থাকলো । আমি আর কোন প্রশ্ন করলাম না । আমি জানি নোভার মা মারা গেছে অনেক আগেই । বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে । তবে কেন জানি সেই মাকে ঠিক পছন্দ করে নি । স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সে ঢাকায় চলে আসে । তারপর হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করেছে।

-আপনার বাবা জানে আপনি বাইরে যাচ্ছেন?
-কাল বলেছি ফোন করে !
-সবে কাল ?
-আরও আগে বলা দরকার ছিল আমি জানি । তবে কেন জানি আর বলতে ইচ্ছে করে নি । সে তার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত আছে ।
-আপনিও তো তার মেয়ে !

নোভা কী যেন বলতে গিয়েও বলল না । গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো ।

তবে এয়ারপোর্টে নেমে আমি সত্যিই একটু অবাক হলাম । কেন হলাম আমি জানি না । চারিদিকে এতো এতো মানুষ । দেখলাম সবাই বাইরে যাচ্ছে । তাদের সাথে কত মানুষ এসেছে । এক মহিলাকে দেখলাম ফ্লোরে বসে চিৎকারে কান্না করছে । তার মেয়ে বাইরে যাচ্ছে । মেয়ে কান্না চোখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে !

নোভা সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । আমার কেন জানি চট করেই মনে হল যে নোভা কী ভাবছে । আজকে ওর মা যদি থাকতো সেও সম্ভবত এমন ভাবে কাঁদতো । নোভা খুব শক্ত মেয়ে আমি জানি । তবে এখন ওকে কেমন যেন অচেনা মনে হল আমার কাছে ।

এক সময়ে নোভার ভেতরে যাওয়ার সময় হল । আমার কাছ থেকে বিদায় নিল । হাসি মুখেই বিদায় নিল। আমার কাছে কেন যেন ওর হাসিতে বিষাদ দেখতে পেলাম !
এই বিষাদ কার জন্য ?
আমার জন্য কি?
বিষাদ খুব খারাপ জিনিস । এটা মানুষ থেকে মানুষের ভেতরে খুব সহজেই সঞ্চালিত হয় । আমার মনটা হঠাৎ খারাপ হল না । আমার মনে হল এতো দিন ধরে আমরা এক সাথে চাকরি করছি আমাদের ভেতরে সম্পর্কটা আরো ভাল হতে পারতো। কয়েক দিন অফিস শেস করে কফি খাওয়া যেত !

ও যখন ভেতরে ঢুকে চোখের আড়ালে চলে গেল আমার মনে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা এসে ভর করলো । আমার কেন জানি মনে হল ওকে আরেকবার আমাকে দেখতে হবে ।

আমি দ্রুত ফোন দিলাম । দেখলাম সাথে সাথেই রিভিস করল ।
-কী হল ?
-আপনি কি একবার গেটের কাছে আসবেন ?
-কেন?
-আসুন প্লিজ । প্লিজ আসুন !

নোভা আর কোন কথা জিজ্ঞেস করলো না । দেখলাম কিছু সময় পরেই ও গেটের কাছ এসে দাড়ালো । আমার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ালো । আমি যখন ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লাম তখন আমি অনুভব করতে পারলাম আমার চোখ পানি চলে এসেছে ।
কী অদ্ভুত ভাবে পানি এল সেটা আমি নিজেও জানি না । আমার কেবল মনে হল আমার কাছের কেউ হয়তো আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে !

আমি এতো দুর থেকেও নোভার চোখে পানি দেখতে পেলাম । একটু আগে মেয়েটি যেমন ভাবে প্রিয় জনের কাছ থেকে দুরে গিয়ে কাঁদছিল সেই রকম কান্না !
চোখের আড়াল চলে গিয়ে নোভা আমাকে ফোন দিল ! কিছু সময় কেউ কোন কথা বললাম না আমার । তারপর নোভা বলল, এমন অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ কেন করলেন অপু সাহেব ?
-জানি না । কেন জানি মনে প্রিয় কেউ দুরে চলে যাচ্ছে !
ওপাশ থেকে কোন জবাব এল না ।
-আপনি কি আর আসবেন না ? অফিসের সবাই বলাবলি করছিলো আপনি আর আসবেন না ?
-আমি আসবো !
-সত্যিই আসবেন?
-হ্যা । কথা দিলাম !
-আচ্ছা ।
-আপনি এখন বাসায় যান । আমি বোডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাড়ালো ।
-একটু অপেক্ষা করি ! ইমিগ্রেশন হলে তারপর যাই ।
-এতো সময় বসে থাকবেন ?
-একটু না হয় থাকি !

ইমিগ্রেশন শেষ করে নোভা ফোন দিল আমাকে । ফ্লাইটের তখন আরও ঘন্টা খানেক বাকি । আমাকে বলল, এবার বাসায় যান ।
-এই তো যাচ্ছি । ওখানে পৌছে জানাবেন !
-জানাবো !

প্লেনে উঠে নোভা আমাকে আরেকবার ফোন দিল ।
-বাসায় চলে গেছেন?
-হ্যা ।
-আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি এখনও এখানেই আছেন!
-কিভাবে এই কথা বলছেন?
-কারণ আমি আমি এটা বুঝতে পারি । আপনি যখনই অফিসে আসতেন আমি আগে থেকেই সব সময় টের পেয়ে যেতাম । কিভাবে পেতাম সেটা জানি না তবে পেতাম । এই যে মনে হচ্ছে আপনি আছেন আশে পাশেই ।

আমি কোন কথা বললাম না । কারণ সত্যিই আমি তখনও এয়ারপোর্ট এলাকা ছেড়ে চলে যাই নি ।

অন্য সবার মত আমিও বিশ্বাস করেছিলাম যে নোভা আর দেশে আসবে না । মাস খানেক পরেই বসের কাছে শুনতে পেলাম খবর টা । নোভা ছুটি নিয়েও পরে নাকি তাকে মেইল করে রিজাইন করেছে । মনটা আমার বেশ খারাপ হয়ে গেল । নোভা তাহলে সত্যিই আসবে না । অবশ্য ওর এখানে কে ই বা আছে আর কার জন্যই বা আসবে !
আমার জন্য আসবে?

কিন্তু আমাদের সবার ধারণা ভুল করে দিয়ে নোভা ঠিক এক বছরের মাথায় ফিরে এল । আমাকে না জানিয়েই আমাদের অফিসে এসে হাজির হল । তবে একটা ব্যাপার আমি নিজেও টের পেলাম । নোভা বলেছিলো আমি অফিসে আসার আগেই নোভা কিভাবে জানি বুঝে যেত আমি আসছি । আমিও ঠিক বুঝতে পারলাম কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার । আমার মন কেমন যেন চঞ্চল করে উঠলো । এবং এই অনুভূতিটা এলো হঠাৎ । এবং ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো । তারপর যখন তীব্র হয়ে উঠলো তখনই দেখতে পেলাম নোভাকে, অফিসের দরজা দিয়ে ঢুকছে।

সেদিন সবাই খুব হইচই করলো । বস আমাদের লাঞ্চ করালো নোভার আগমন উপলক্ষে । তবে আমার মন খারাপ হয়ে রইলো । কারণ নোভা জানালো যে ও মাস্টার্সের পরে পিএইচডির অফার পেয়েছে । সামনের মাসেই ওর ক্লাস শুরু হবে । কটা দিন দেশে থাকতে এসেছে । তারপর মানে সত্যিই নোভা আর ফিরবে না !

নোভাকে ওর মামার বাসায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমিই নিলাম। কেন জানি ওর কাছে একা কয়েকটা মুহুর্ত কাটাতে ইচ্ছে করছিলো । সিএনজির ভেতরে এই সময়টুকুই সই ।

-তাহলে আর ফিরলেনই না ?

নোভা হাসলো । তারপর বলল, এই এলাম । কথা দিয়েছিলাম না?
-আবার তো চলে যাবেন।
নোভা হাসলো । তারপর নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলল, সেদিন যদি আপনি ওভাবে পাগলামো না করতেন তাহলে আমি হয়তো আজকে আসতাম না । সত্যিই জানেন আমি আমার মায়ের মৃত্যুর পরে অন্য কাউকে কখনও আমার জন্য চোখের জল ফেলতে দেখি নি । কখনো না । আপনাকে সেদিন ওভাবে দেখে আমার খুব ইচ্ছে করছিলো সব কিছু ফেলে ফিরে চলে আসতে ! জাহান্নামে যাক সব পড়াশোনা !
-আসলেন না কেন?
-আমি দেখতে চেয়েছিলাম এটা ক্ষণিকের এই আবেগ নাকি তার থেকেও বেশি কিছু ! আমার নিজের জন্য যেমন আপনার জন্যও ?
-কি বুঝলেন?

নোভা আমার দিকে তাকালো গভীর চোখে । আমার মনে হল যেন সব কিছু হঠাৎ থেমে গেছে । আমরা অনন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ।
নোভা চোখ সরিয়ে নিল । তারপর বলল, বুঝলাম যে আমাদের এখন খুব জলদি বিয়ে করতে হবে । আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। বিয়ে করতে হবে তারপর অনেক কাগজপত্র গোছাতে হবে। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাকে স্পাউস ভিসাতে নিয়ে যাবো আমার সাথে তবে সেটা তোমার জন্য খুব একটা ভাল হবে না । তাই তুমি আজ থেকেই আইএলসের জন্য প্রিপারেশন নাও। আমার প্রোফেসরের সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি তোমার যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন কথা দিয়েছেন !

নোভা এরপর কত কথা বলে গেল । আমি কেবল অবাক হয়েই ওর দিকেই তাকিয়ে রইলাম ।

মাস খানেক পরে আমরা আবারও এয়ারপোর্টে এসে হাজির হলাম । তবে এবার নোভা আর আমার সাথে রয়েছে আমার বাবা মা । আমরা তারপর দিনই বিয়ে করে ফেলি । মা বাবাকে নিয়েই । তারা নোভার ব্যাপারে কোন আপত্তি করেন নি। এই কদিনেই মায়ের সাথে নোভার অদ্ভুত একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । মনে হচ্ছে যেন নোভা সত্যিই তার মেয়ে !

নোভা যখন ঢুকতে গেল গেট দিয়ে মা সত্যিই কেমন করে কেঁদে উঠল । সেদিনেই মহিলার মত করে । দেখলাম নোভাও কান্না ভরা চোখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে । বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে । হাত নাড়ছে । সেদিনের সী-অফের মতই আজও নোভা যাচ্ছে দেশ ছেড়ে তবে সেদিন আর আজকের ভেতরেই কতই না পার্থক্য !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 51

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →