হৃদয়ের পথ

oputanvir
4.7
(49)

সায়েম, এই সায়েম !

আমি গেটের দিকে হাটা দিয়েছিলাম । পেছন থেকে ডাকটা শুনে আবার ফিরে তাকালাম । নিলয় ডাকছে । আমি নিলয়ের দিকে হেটে গেলাম । নিলয় আমার কাছে এসে বলল, কী ব্যাপার কোথায় চলে যাচ্ছিল?

আমি বললাম, বাসার দিকে যাচ্ছি । আজকে তো আর ক্লাস নেই ।

নিলয়কে দেখলাম একটু বিরক্ত হতে ! আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভুলে গেলি?

আমি মনে করার চেষ্টা করলাম যে আজকে কোথাও আমাদের যাওয়ার কথা ছিল কিনা ! প্রথমে কিছু মনে না হলেও একটু পরেই আমার মনে পড়ল । আজকে আমাদের নওরিনদের বাসায় যাওয়ার কথা !

নিলয় নওরিনকে পছন্দ করত আমি জানি । যদিও সেটা অনেক দিনের আগের কথা ।

প্রায় ছয় মাস আগে নওরিন মারা গেছে ! 

আমি বললাম, আমার আসলে এমন … তুই তো জানিস !

নিলয় বলল, আরে বেটা এটা তো মৃত বাড়ি না । কুলখানিও না । আমরা যাচ্ছি ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করতে ! 

-সেটা কী দরকার আছে?

-কেন নেই বল ! মেয়েটার ভেতরে নওরিনের হার্ট রয়েছে । নওরিনের কারণেই মেয়েটা বেঁচে আছে ।

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না । একবার মনে হচ্ছে যাই আবার মনে হচ্ছে এসবে গিয়ে লাভ নেই । কিন্তু নিলয়ের জন্য আমাকে যেতে হল । বেটা আমাকে জোর করেই নিয়ে গেল !

রিক্সা করে যাওয়া সময়ে নিলয় ননস্টপ কথা বলেই চলল । আমার কানে অবশ্য সেসব কিছুই গেল না । আমার এতোদিন পরে নওরিনের কথা মনে পড়ল । ফার্স্ট ইয়ার থেকেই নওরিনকে আমরা সবাই চিনতাম । নতুন ক্লাসে এসে, কয়েকটা ক্লাস করার পরেই সবাই বুঝতে পারে যে কে ভাল ছাত্র আর কে খারাপ তেমন ভাবেই আমরা নওরিনকে চিনেছিলাম । চুপচাপ গম্ভীর । আর পড়াশোনা নিয়ে খুব সিরিয়াস । আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে নওরিন আমাদের ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হবে । প্রথম সেমিস্টারে সেটাই হল । পর পর তিন সেমিস্টারে সে সবার থেকে এগিয়ে গেল । 

তবে তার ভাগ্য অন্য কিছু লেখা ছিল ফোর্থ সেমিস্টার পরীক্ষা দেওয়ার আগে হঠাৎ শুনি নওরিনের নাকি শরীর খারাপ । মাস খানেক না যেতেই আমরা জানতে পারলাম মেয়েটার ব্রেন টিউমার । কোন ভাবেই আর বাঁচানো সম্ভব না । আমাদের মাঝে অনেকেই ওর সাথে দেখা গেলেও আমি যাই নি । ক্লাস মেট হিসাবে হয়তো যাওয়া উচিত ছিল তবুও যায় নি । আমার হাসপাতাল মৃত্যু এবস খুব ভয় লাগে । আমি এগুলো থেকে দূরে থাকি সব !

নওরিন মাস খানেক পরেই মারা গেল । তবে তখন আমরা জানতে পারলাম যে মেয়েতা নাকি মৃত্যুর আগে তার হার্ট অন্য এক মেয়েকে দিয়ে গেছে । মেয়েটাও সেই সময়ে ঐ হাসপাতে ভর্তি ছিল । এবং ট্রান্সপ্লান্ট সফল হয়েছিল । আর কিছু জানতাম না আমরা । তবে সপ্তাহ খানেক আগে নওরিনের বাবা আমাদের ক্যাম্পাসে এসেছিলেন । তিনি আমাদের সবাইকে নওরিনের জন্মদিনে যেতে বলেছেন বিশেষ ভাবে । সেখানে নাকি তাদের নতুন মেয়ের সাথে আমাদের সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিবেন ! মানে যে মেয়েটার শরীরে এখন নওরিনের হার্ট রয়েছে । 

বিকেলের মাঝেই আমরা প্রায় সবাই হাজির হয়ে গেলাম ।নানান আয়োজন ছিল । সময়টা ভাল কাটল আমাদের । এবং কিছু সময় পরেই সেই মেয়েটাকে আমরা সবাই দেখতে পেলাম । আমাদের থেকে বয়সে একটু বড়ই হবে মনে হল । মেয়েটা আমাদের সবার দিকে তাকালিয়ে ভাষণ দেওয়ার মত করে নিজের কথা শুরু করল, 

আমাদের মেডিকেল সায়েন্স বলে যে আমাদের হৃদয় বলে আসে কিছু নেই । যা আছে সবই আমাদের মস্তিস্ক । আমিও তাই এতোদিন মনে করতাম । কিন্তু নওরিনের হৃদয়টা যেদিন থেকে আমার বুকের ভেতরে এসে আসন গেড়েছে সেদিন থেকে আমি একটা পরিবর্তন আমার নিজের ভেতরে অনুভব করছি । এই যে নওরিনের বাবা মাকে আমার এখন বড় আপন মনে হয় । সত্যিই হয় । আমি এটা অনুভব করতে পারি । এই যে তোমরা ওর বন্ধু ছিলে তোমাদেরকে আমার বড় আপন মনে হচ্ছে । আমি আশা করবো আমাদের এই চেনা জানা এখানেই শেষ হয়ে যাবে না !

মেয়েটাকে আমার কেন জানি একটু পরিচিত মনে হল । কোথায় যেন দেখেছি তাকে !

মেয়েটার নেহা সাইরিন । নামটাও কেমন যেন পরিচিত মনে হল । আমাদের থেকে মেয়েটা বছর দুয়েকের বড় । আমাদের জানালো যে সে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করে । একে একে আমাদের সবার সাথে কথা বলল সে । আমার সাথেও এসে কথা বলল । 

ঘটনা মনে হল এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু এখানে শেষ হল না । 

পরের দিন আমি নেহাকে আমাদের ক্যাম্পাসে দেখতে পেলাম । আমার কেন জানি মেন হল আমার সাথে দেখা করার জন্যই সে এখানে এসেছিল । আমার দিকে এল । 

-আপনি এখানে?

নেহা হাসল একটু । তখনই আমি মেয়েটাকে ভাল করে চিনতে পারলাম । নেহা আসলে একজন মডেল । সে চাকরির পাশাপাশি মডেলিংও করে । ওর কিছু ভিডিও আর ছবি আমি দেখেছি । নেহা বলল, এখানে এসেছিলাম একটা কাজে । ভাবলাম এতো কাছে যখন এলাম তোমাদের সাথে দেখা করে যাই । কিন্তু কোথায় যাবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । 

আমার কেন জানি মনে হল নেহা মিথ্যা বলছে । ও কারো সাথে নয়, কেন জানি মনে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে । গতদিন আমার সাথে যখন ওর চোখে চোখ পড়েছিল কথা বলার সময় তখনই আমার মনে হয়েছিল যেন নেহা খুব অবাক হয়েছে । আমাকে যেন সে চিনতে পেরেছে এমন একটা ভাব !

আমি বললাম, চলুন সবার সাথে আড্ডা দেওয়া যাক । ওরা মাঠে আছে।

মুহুর্তের ভেতরেই নেহা বলল, আজকে না । আসলে চলে যাচ্ছিলাম । তুমি বাসায় যাচ্ছো ?

-হ্যা বাসায় যাবো !

-তোমার বাসা তো মোহাম্মাদপুরে তাই না । চল তোমাকে পৌছে দিই !

আমি এবার সত্যিই একটু অবাক হলাম । আমি যে মোহাম্মাদপুরে থাকি এটা যখন নেহা জানে তার মানে হচ্ছে আমার সাথেই সে দেখা করতে এসেছে । সেটার ব্যাপারে কোণ সন্দেহ নেই । আমি বললাম, ওদিকেই ।

-আমার সাথে গাড়ি আছে ! এসো !

আমি ভেবেছিলাম নেহার গাড়িতে ড্রাইভার থাকবে । তবে সেটা সত্যি হল না । নেহা নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে । আমি সামনের সিটে উঠে বসলাম । গাড়ি চলল এগিয়ে । তবে আমার বাড়ির দিকে গেল না । সেটা যে যাবে না সেটা আমি জানতাম । আমরা এলাম গুলশানের দিকে । এখানেই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা থামল । আমি গাড়ি থেকে নামলাম । দেখলাম একজন এগিয়ে এসে গাড়ি নিয়ে গেল । 

নেহা আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল । একেবারে একটা কোনার দিকে টেবিলে আমরা বসলাম ! বোঝায় যাচ্ছে নেহা এখানে প্রায়ই আসে । সবাই ওকে চেনে !

-তোমাকে এখানে নিয়ে এলাম দেখে কী অবাক হয়েছে

-একটু কৌতুহল হচ্ছে ! 

নেহা একটু সময় কী যেন ভাবল । তারপর বলল, নওরিন সম্ভবত তোমাকে পছন্দ করত । তুমি জানো এটা?

আমি একটু অবাক হলাম । আমার মুখের ভাব দেখেই নেহা বুঝে নিল যে আমি জানি না । নেহা বলল, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম নওরিনের কারো সাথে কোন প্রেম আছে কিনা সেটা খুজে বের করতে । খুব ভাল করে খোজ নিয়ে জানলাম যে এমন কিছু ছিল না । তারপরই মনে হল মনে মনে মেয়েটা কাউকে না কাউকে পছন্দ করতই ।

-কীভাবে নিশ্চিত হলেন?

-ভুলে কেন যাচ্ছো আমার বুকের ভেতরে ওর হৃদপিণ্ডটা রয়েছে । কিভাবে জানি আমি জানি না আমি কেবল জানি । 

-ওর ক্লাসমেটদের কেউ কিনা সেটা বের করার জন্যই আমাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন?

-হ্যা !

-এবং আমার দিকে তাকিয়েই আপনি বুঝতে পারছেন সেটা আমি !

নেহা আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না । কিছু সময় কেবল তাকিয়ে রইল আমার দিকে । তারপর বলল, শুনতে সীলি শোনাবে জানি ! কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর থেকে আমার কেবলই মনে হয়েছে যে আমি কিছু যেন একটা কিছু মিস করছি খুব । খুব বেশি । গত দিন তোমার সাথে দেখা হওয়ার পরে সেই অনুভূতিটা আমার চলে গেছে । তোমাকে চোখে ভরে দেখার জন্য আমার চোখ যেন তৃঞ্চিত ছিল । তোমাকে নওরিন অসম্ভব ভাল বাসত । হয়তো কোন দিন বলে নি তবে বাসত কোন সন্দেহ নেই । আর এখন আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমাকে ছাড়া আমার একটা দিনও চলবে না !

নেহা যে এভাবে সরাসরি কথাটা বলে দিবে আমি ভাবতেও পারি নি । আমার নিজের কাল লাল হয়ে গেল । নেহা বলল, তুমি অবশ্যই আমাকে রিজেক্ট করতে পার । তোমার পূর্ণ অধিকার রয়েছে তবে এতে আমার মনের অবস্থার কোণ পরিবর্তন হবে না । 

আমি সত্যিই কোন দিন বুঝতেও পারি নি যে নওরিনের মত একজন মেয়ে আমাকে মনে মনে পছন্দ করতে পারে । সে কোন আমাকে বুঝতেও দেয়নি । আমাদের মাঝে কথাও হয় নি কখনও । তারপরেও মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে গেছে । আর এখন এই সুপার মডেল নেহা ! এই মেয়েটার কী সাহসের সব কিছু বলে দিল আমাকে । কোন রাকঢাক না করেই ।   

এবং ব্যাপারটা মোটেই সে গোপন করল না । পরের মাসের ভেতরেই আমাদের ক্লাসের মানুষ তো বটেই দেশের অর্ধেক মানুষ জেনে গেল যে নেহার একজন বয়ফ্রেন্ড রয়েছে এবং সেটা আমি । আমি যদিও নেহাকে হা না কিছুই বলি নি। তবে ও যখন আমার সাথে দেখা করতে আসে কিংবা আমার সাথে ফোনে কথা বলত আমার ভালই লাগত । ওর ইনস্টাগ্রামে আমার সাথে ছবি আসা শুরু করল । আমার চেহারাও মানুষ চিনতে শুরু করল । 

তবে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় নওরিন যদি আমাকে বলত নিজের মনের কথা তাহলে আমি কী করতাম?

রাজী হতাম কি?

কী জানি ! 

তবে এভাবেই হয়তো নওরিনের হৃদয় তার নিজের পথ খুজে নিয়েছিল । যে যদি বেঁচে থাকত তাহলেও হয়তো ঠিকই আমার কাছে এসে হাজির হত !

গল্পটা মূল থিক মৌলিক না । অনেক দিন আগে একটা মুভি দেখেছিলাম, নাম ছিল ডিলনে জিসে আপনা কাহা। সালমান খান এবং ভূমিকা চাওলার মুভি । সেখানে সালমান খানের আগের স্ত্রীর হার্ট ভুমিকার ভেতরে ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় । এছাড়া সম্প্রতি এনিলেম মুভিতেও এমন একটা কাহিনী আছে । সেই থিম থেকেই এই গল্প । আরও একটা গল্প আসবে এই একই থিমে । মানে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের থিম ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 49

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “হৃদয়ের পথ”

Comments are closed.