-নীলু কেমন আছো?
নীলার মনে হল ওর চারিপাশের সব কিছু যেন হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গেছে । কোন ক্লাস শুরুর এখনও অনেক বাকি । নীলা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো । আজকে ক্লাস করবে কি করবে না সেটা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। কয়েক জনের আজকে তারা যাবে পুরান ঢাকাতে । সেখানে গিয়ে নান্নার বিরিয়ানি খাবে । নীলার একবার মনে হচ্ছে যায় আবার মনে হচ্ছে এই দুপুর বেলা পুরান ঢাকায় যাওয়ার কোন মানে নেই । তবে পুরান ঢাকা না হয়ে বসুন্ধরার দিকে গেলে হয়তো যাওয়া যায় । আড্ডাও দেওয়া যাবে ।
নীলুর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল । বুকের ভেতরে একটা অনুভূতি সৃষ্টি হল । এই অনুভূতিটা সে ভুলে গিয়েছিলো । নীলা ভেবেছিলো সে হয়তো এই অনুভূতির কথা আর কখনও মনে করবে না । কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন করতে লাগল ।
নীলু !
কন্ঠটা আবারও বলে উঠলো ।
নীলা বলল, কী চাই?
-একটু দেখা করতে পারবে?
-কেন?
-অনেক দিন তোমার সাথে দেখা হয় না !
-হওয়ার দরকার আছে কি?
ওপাশ থেকে কন্ঠটা যেন একটু থামলো । তারপর নীলা ফোনের ভেতরেই একটু হাসির আওয়াজ শুনলো । সে বলল, বুঝতে পারছি । আমার উপর রাগ করে আছো?
-আপনার উপরে আমি রাগ করে নেই । আমি ভুল ভাবছেন ! আপনি এমন কেউ নন যে আপনার উপর রাগ করা যাবে !
আবারও হাসির শব্দ ।
-যাক, রাগ করে নেই শুনে ভাল লাগল । একটু দেখা করবে? আমি তোমার ক্যাম্পাসে !
নীলা খুব প্রবল ভাবে চাইল এই কথা বলতে যে সে দেখা করবে না । কেন জানি সেই তীব্র কন্ঠটা সে হারিয়ে ফেলল । নিজের ভেতরে রাগ কিংবা অভিমান ধরে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল । এমন কেন হচ্ছে ?
কেন ?
এই মানুষটা ওকে কী তীব্র ভাবেই না অপমান করেছিলো ! আর নীলা কিনা তার প্রতি নমনীয় হচ্ছে ? তবে নীলা নিজেকে আটকাতে পারলো না । নীলা বলল, আমার ক্লাস আছে?
-কখন শেষ হবে?
-দেরি আছে।
-কত দেরি ?
-চারটা ক্লাস পরপর !
-আচ্ছা আমি অপেক্ষা করি ।
-মানে?
-মানে । ক্লাস শেষ কর । অপেক্ষা করি।
-আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে । আপনি চলে যান । ক্লাসের পরে আমরা বন্ধুরা পুরান ঢাকাতে যাবো !
-কখন ফিরবে?
-আজিব তো ! কখন ফিরবো কিভাবে বলব ?
-আচ্ছা যাও । এই পথ দিয়েই তো ফিরবে ! আমি অপেক্ষা করে আছি । ফেরার সময়ে আমার সাথে একটু দেখা করে গেলে চলবে।
নীলা ঠিক বুঝতে পারলো না যে কী বলবে ! সেই সাথে নিজের কাছেই বুঝতে পারলো যে ওর পক্ষে তার সাথে না দেখা করে থাকা সম্ভব না । ফোন রেখে দিল । মনের ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে । বার বার কেবল মনে হচ্ছে এই এক বছর পরে সে আবার কেন এল ওর জীবনে! চলে গিয়েছিল সেটাই তো ভাল ছিল !
পাশ থেকে সাবিহা বলল, এই নীলা এতো কী ভাবছিস ? চল !
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে । ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ওরা নান্নার বিরিয়ানিই খেতে যাবে । নীলা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা যা ! আমি যাবো না ।
-সে কি ! কেন ?
-আমার একজনের সাথে দেখা করতে হবে ।
-কে ?
-সেটা তোদের শুনতে হবে না । তোরা যা !
এই বলে নীলা আর অপেক্ষা না করেই উঠে দাড়ালো । আগে ওদের ডিপার্টমেন্টের রেস্ট রুমের দিকে গিয়ে হাজির হল । ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে নিজে চুপ ঠিক করলো । নিজের আচরণ দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল । এতোদিন পরেই মানুষটার জন্য কী তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছে!
রেহান নামের ঐ মানুষটা ওদের বিল্ডিংয়েই থাকতো আগে । নীলার থেকে বয়সে ৫/৬ বছরের বড় হবে । নীলা যখন ভার্সিটিতে ঢোকে তখন সে চাকরিতে ঢুকেছিলো । বিদেশী ব্যাংকের এমটিও । অনেক টাকা বেতন । পাড়ার সব মেয়েরাও রেহানের জন্য পাগল ছিল । দেখতে শুনতে যেমন ভাল তেমনি মার্জিত ব্যবহার ! নীলা নিজেও পছন্দ করতো ওকে খুব ।
নীলার সাথে রেহানের কথা হত প্রায়ই ।
রেহান প্রায় দিনই রাতের বেলা ছাদে উঠতো । একটা সময়ে নীলাও নিয়মিত ছাদে যাওয়া শুরু হল । টুকটাক কথা হত প্রতিদিন । নীলাকে সে নীলু বলে ডাকতো । নীলার এতো ভাল লাগতো !
পাড়ার অন্য মেয়ের বাবার মতই নীলার বাবার ইচ্ছে ছিল এমন একটা ছেলের সাথেই মেয়ের বিয়ে দিক । এছাড়া মেয়ের পছন্দের ব্যাাপরেও তিনি জানতেন ! তাই যখন রেহান চাকরি পেল তখন নীলার বাবাই আগ বাড়িয়ে নীলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো ।
তবে কদিন পরেই নীলার মন ভাঙ্গলো । রেহানদের বাসা থেকে বিয়ের জন্য মানা করে দেওয়া হল । জানানো হল যে রেহান এখন বিয়ের কথা ভাবছে না মোটেও । তবে কদিন পরে নীলার কানে একটা কথা এল । নীলাকে নাকি রেহান পছন্দ করে নি । নীলা একটু মোটা ছিল শরীরে । এটাই নাকি কারণ !
এই কথা শুনে নীলা বড় অপমানিত বোধ করেছিল । তবে মনের ভেতরে একটা জেদও চেপেছিলো । নিজের ওজন সে কমাবেই । কমিয়েও ফেলেছিলো । তবে বিয়ের প্রস্তাব মানা করে দেওয়ার মাস দুয়েকের ভেতরেই রেহানরা ফ্লাট বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যায় । কোথায় চলে যায় সেটা অবশ্য নীলা আর জানে না । জেদ করেই জানার চেষ্টা করে নি । তবে নিজের ওজন ঠিকই কমিয়েছে সে ।
নীলা যখন ধীর পায়ে হেটে যাচ্ছিলো তখন অনুভব করতে পারছিল যে মনের ভেতরে একটা কাঁপন অনুভব করছে । এমন কেন হচ্ছে সেটা নীলা জানে না। এমন একটা মানুষের জন্য সে কেন এই রকম কিছু অনুভব করছে !
দুই
-আপনি কেন এসেছেন?
-তোমাকে একবার দেখতে?
-মানে? আপনি কি আমার সাথে ঠোট্টা করছেন?
-না । সত্যিই তোমাকে দেখতে খুব মন চাইছিলো ।
-কেন?
-কাল আমার ফ্লাইট !
-কোথায় যাচ্ছেন ?
নীলা নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো । তবে মনের ভেতরে একটা কৌতুহল জন্ম দিয়েছে । এতোদিন পরে সে যেখানেই যাক সেটা ওকে জানাতে কেন হবে ! আর দেখাই বা কেন করতে হবে !
নীলা এতো সময়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল । এতো সময়ে সে রেহানের দিকে ফিরে তাকাল। চোখের উপরে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো । সেই চোখের দৃষ্টি । এমন দৃষ্টি কেন !
দ্য আইস চিকো, দে নেভার লাই !
তাহলে কেন ?
রেহান তাহলে কেন ওর থেকে দুরে গিয়েছিল?
-কী হয়েছে রেহান ?
রেহান জবাব দিল না কিছু সময় । চুপ করে রইলো যেন । কিছু যেন ভাবছে সে । তারপর বলল, তোমার বাবা যেদিন আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিনই আমাদের হাতে রিপোর্টটা এসেছিলো । খেয়াল করে দেখেছিলে তার আগে কদিন আমি ছাদে আসি নি । আসলে আমার শরীর একটু খারাপ ছিল । ফার্স্ট স্টেজ ক্যান্সার ধরা পরেছিলো । আমি তোমাকে আমার জীবনের সাথে যুক্ত করতে চাই নি । ভেবেছিলাম যে যদি ঠিক হতে পারি তাহলে আবার তোমার কাছে যাব। মানে যদি ততদিন তোমার বিয়ে না হয়ে থাকে । তবে …
নীলা বলল, তবে?
-অবস্থার আসলে খুব বেশি উন্নতি হয় নি । আমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে । ভাবলাম যে যদি আর না ফিরে আসি তাহলে তোমাকে আর দেখা হবে না !
নীলা যেন বাক্যহারা হয়ে গেল । দেখা হবে না মানে কি ! এই ছেলে বলছে কী ! মুহুর্তের ভেতরেই নীলার সমস্ত রাগ দুঃখ আর কষ্ট একেবারে দুর হয়ে গেল । এতো দিন রেহানের প্রতি রাগ অভিমান যা ছিল সব টুকু যেন একেবারেই গায়ে হয়ে গেল ।
নীলা কেবল অনুভব করতে পারলো যে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে ।
একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা সেখানেই সবে থাকলো । ওরা যে খুব কথা বলল কিংবা জমে সব গল্প বলল একে অন্যকে সেটাও না । কেবল একে অন্যের পাশে বসে থাকলো চুপচাপ । একে অন্যের পাশে চুপ করে বসে রইলো কেবল ।
সন্ধ্যার সময় নীলাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে রেহান বলল, ভাল থেকো কেমন ! যদি কপাল লেখা থাকে তাহলে আবার দেখা হবে আমাদের!
নীলা রেহানের রিক্সাটা চলে যাওয়া দেখলো । যত সময় রিক্সাটা দেখা যায় তত সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো কেবল ।
তিন
সব গোছানো শেষ । ভোর চারটার সময় রেহানের ফ্লাইট । অনেকেই এসেছে শেষ বারের মত দেখা করতে । ওরা সবাই আপাতত যাবে আমেরিকাতে । ওখানে রেহানের বড় মামা থাকে । সেখান থেকেই চিকিৎসা হবে । আজকে সারা দিনই রেহান নীলার সাথে থেকে । তবুও রেহানের মনে হচ্ছে মেয়েটার সাথে আরেকটু দেখা হলে ভাল হত। আরেকটু কথা বলতে পারলে হয়তো মনে শান্তি পেত ও ।
এখন মনে হচ্ছে যে সেই সময়ে নীলার কাছ থেকে দুরে চলে যাওয়া মোটেও ঠিক হয় নি । হয়তো নীলা সাথে থাকলে এই পুরো সময়টা আরো ভাল কাটতো ওর । ওর মনে একটা শান্তির ভাব আসতো । তবে রেহান জানে যদি সেই সময়ে নীলা সব কিছু জানার পরে ওর কাছ থেকে দুরে চলে যেত তাহলে সেটা ওর পক্ষে সহ্য করা অনেক কষ্ট হয়ে যেত । এই ভয়েই সে নিজেই দুরে সরে গিয়েছিল । কিন্তু আজকে নীলার সাথে দেখা করার পরে ওর মনে হল নীলার সাথে ওভাবে যোগাযোগ বন্ধ করা মোটেও ঠিক হয় নি । মেয়েটা যেভাবে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিল রেহানের মনে হল যে নীলা ওকে ছেড়ে যেত না । ওর পাশে থাকতো সব সময় ।
রাত ঠিক দশটার সময় রেহানদের বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো । রেহানদের বাসার কাজের মেয়েটা দরজা খুলেই দেখলো আগের বাসার নীলা আফা দাড়িয়ে রয়েছে দরজার সামনে । তার পেছনে তার বাবা মা । রেহানের বাবা একটু অবাক হলেন । সব থেকে অবাক হল রেহান । নীলাকে আজই দেখতে পাবে সেটা সে ভাবে নি । অবাক হলেও মনের ভেতরে একটা তীব্র আনন্দবোধ এসে ধরে দিল । নীলা ওর কাছ থেকে এই বাসার ঠিকানা নিয়েছিল তবে নীলা যে একটু পরেই চলে আসবে সেটা সে কখনই ভাবে নি ।
তবে রেহান এবং ওর পুরো পরিবারের অবাক হওয়ার ব্যাপার তখনও বাকি ছিল । নীলার বাবা যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে নীলা এখন রেহানকে বিয়ে করতে চায় । এই বিয়েতে যদি কেউ আপত্তি করে তাহলে তার কাছে এক বোতল পটাশিয়াম সায়ানাইট রয়েছে । সেটা সবার সামনে সে খাবে। এই হুমকি দিয়েই সে তার বাবা মাকে রাজি করিয়েছে ।
সবার বিস্ময় কাটতে একটু সময় লাগলো । নীলা তখন রেহানের দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে । রেহান তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে পাগল মেয়েটা এমন একটা কাজ করতে চলে এসেছে । সবার ঘোর যখন কাটলো, বিশেষ করে পরিববারের ছেলে মেয়েরা নীলাকে ঘিরে ধরলো । বড়রা একটু বেশি সময় স্থির থাকলেও মাত্র এক ঘন্টার ভেতরে নীলাকে বউ সাজানো শেষ করে ফেলল সবাই মিলে । রেহানের মায়ের বিয়ের শাড়ি পরানো হল নীলাকে । সাথে করে তার গহনাই পরানো হল । বারোটার ভেতরে কাজি এসে বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে চলেও গেল । রেহান যখন কবুল বলে খাতায় সই করছিল তখনও ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই তার নীলার সাথে বিয়ে যাচ্ছে।
রাত দুইটার সময় যখন রেহান ইমিগ্রশনের গেট দিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে ঢুকছে, নীলা শেষ বারের মত সবার সামনেই রেহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল । রেহান একই ভাবে ওকে জড়িয়ে ধরেই বলল, আই এম গোনা কামিং ব্যাক ফর ইউ । দেখে রেখো আমি আসবোই ।
নীলা বলল, তোমাকে আসতেই হবে । অবশ্যই আসতে হবে !
ভালবাসার হাত গুলো সব সময় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে থাকে, যে কোন পরিস্থিতিতেও ছেড়ে চলে যায় না । যারা চলে যায় তারা আসলে কখনই ভালোবাসে না । গল্পের মত বাস্তবেও নীলার কাছে রেহান ফিরে আসুক ।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.