আনন্দের অশ্রু

oputanvir
4.8
(56)

উর্মির বিয়ে হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে । যথারীতি এই বিয়েতে উর্মির কোন মতামত নেওয়া হয় নি । যেমন করে পুরো জীবনে ওর মতামতের দাম কখনই দেওয়া হয় নি । ওর পরিবার কেবল ওকে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে । উর্মিকে সেটা মেনে নিতে হয়েছে ।

ছোট বেলা থেকেই উর্মির ইচ্ছে ছিল চারুকলাতে পরাশোনা করবে । উর্মির ছবি আঁকার হাত অনেক ভাল । কিন্তু ইন্টারের পরে ওর এই ইচ্ছের দাম কেউ দিলোই না । এমনকি ওদের জেলার বাইরেও যেতে দেওয়া হল না । স্থানীয় মহিলা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। উর্মির বাবার মতে মেয়েদের এতো পড়াশোনা করার কোন দরকার নেই । ঘর সংসার করতে এতো পড়াশোনার প্রয়োজন পড়ে না । ইদানীং ছেলের পরিবারবা মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারটাও দেখে বিধায় ওকে অর্নাসে ভর্তি করানো হয়েছে । না হলে সেটাও করতো না ।

অর্নাস তৃতীয় বর্ষ পরীক্ষার পরে উর্মির বিয়ে হয়ে গেল । বিয়ে হয়ে সে ঢাকার সাভারে শ্বশুরবাড়িতে উঠে এল । এখানে এসে সে কেবল বুঝতে পারলো যে এক কারাগার থেকে সে অন্য কারাগারে এসে হাজির হয়েছে । উর্মির শাশুড়ি খুবই প্রতাপশালী মহিলা । বিয়ের দিনই সে উর্মিকে বাড়ির নিয়ম সব বুঝিয়ে দিয়েছে । এই বাড়ির মোট তিন ছেলে । উর্মির স্বামী সবার ছোট । আগের দুই ভাইয়ের বউরা এই বাসাতেই থাকে । তাদের স্বামীরা ঢাকাতে চাকরি করে । একই সাথে ঢাকাতে থাকে। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বাসার আসে, রবিবার যায় । উর্মির স্বামী আহসানও ঢাকাতে চাকরি করে । তবে সে তার বড় দুই ভাইয়ের সাথে থাকে না ।

এক সপ্তাহের মাঝেই উর্মির দম বন্ধ হয়ে এল এই বাসায় । উর্মিদের বাসার পেছনে বড় উঠোন ছিল । তার পেছনে বড় মাঠ । চাইলে সেখানে হেটে বেড়ানো যেত কিন্তু এখানে পুরোটাই বিল্ডিং । বাড়িতেই বন্দি থাকতে হয় । তার জা-রা সারাদিন রান্না ঘরে কাজ করে । সে নতুন বউ । তাই এখনও রান্না ঘরে যেতে হয় নি । তবে খুব জলদিই তাকেও সেখানেই যেতে হবে ।

উর্মি ছবি আকার জন্য কোন সুযোগই পাচ্ছে না । আসলে উপায়ও নেই । বাসায় একটা রঙ তুলি ছিল । ওর বাবা এসব পছন্দ করতেন না । তারপরেও লুকিয়ে সে ছবি আকতো । এখানে সেটাও সম্ভব না । পিচুকেও সে রেখে এসেছে । ও সাথে থাকলেও মন টা ভাল হত একটু ! তবে এই বাসায় পোষা প্রাণী পছন্দ করা হয় না । বিশেষ করে তারা শাশুড়ি এসব পছন্দ করেন না । তার মানে কোন দিন এই বাসায় পোষা বেড়ালটাকে নিয়ে আসতে পারবে না ।

দুইদিন পরে তার স্বামী আহসান বাসায় এল । খাবার টেবিলে সে তার মা কে বলল যে উর্মিকে সে সাথে করে নিয়ে যাবে ! এই কথা উর্মির জন্য নতুন ছিল । সে খানিকটা অবাক হয়ে একবার তার স্বামীর দিকে পরে ভয়ে ভয়ে তার শাশুড়ির দিকে তাকাল । তার শাশুড়ি গম্ভীর কন্ঠে বলল, এখনই কেন নিয়ে যেতে হবে?

আহসান বলল, এখন নিলে কী সমস্যা ?

-কেন তোমার বড় দুইভাইয়েরা বিয়ে করে নি ? তাদের তো কোন সমসয়া হচ্ছে না!

-মা তাদের সাথে তুমি আমার তুলনা কেন করছো? তারা যা করেছে আমাকে তাই কেন করতে হবে? আর কেনই বা করবো ? আর বউ যদি এখানেই রাখব তাহলে আমি বিয়ে করলাম কেন?

-কথা বার্তা এমন কেন তোমার শুনি?

-মা তুমি খুব ভাল করেই জানো আমি কেমন করে কথা বলি ! আজ থেকে তো চেনো না আমাকে !

উর্মি তখনই ব্যাপারটা বুঝতে পারল । তার স্বামী তার বড় দুই ভাইয়ের মত মোটেও মায়ের এতো বাধ্যগত নয় । আহসান বলল, উর্মি কাল আমার সাথে ঢাকা যাবে । এটাই ফাইনাল । আমি তোমাদের কাছে অনুমতি চাই নি । কেবল জানালাম । আর আমি অলরেডি নতুন বাসা উঠে পরেছি। বাড়িওয়ালাকে বলেওছি যে আমি বউ নিয়ে আসছি।

আহসান খাওয়া শেষ করে উঠে গেল । একটু পরে তার শাশুড়িও উঠে গেল । তার মুখ দেখার মত অবস্থা ছিল না । রাতের বেলা উর্মি আহসানকে বলল, আম্মার সাথে এমন কন্ঠে কথা না বললেই কি হত না ?

আহসান একটা বই পড়ছিল । ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আসলে এমনই । যা মনে আসে সরাসরি বলে দিই । আমার ইচ্ছে হয় আর যা আমার কাছে ঠিক মনে হয় তাই করি । কারো ধার ধারি না ।

-তাই বলে বড় দের সাথে বেয়াদবি করা কি ঠিক?

আহসান বইটা এক পাশে সরিয়ে রাখল। তারপর উর্মির দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে বেয়াদবি কিনা জানি না তবে আমাদের কালচারে আমাদের শেখানো হয় যে বড়দের কথা মান্য করে চলতে । তার মানে কি এটা যে বড়রা যা আমাদের উপরে চাপিয়ে দিবে তাই আমাদের করতে হবে?

উর্মি কিছু না বলে চুপ করে রইলো । আহসান বলল, তোমাকে একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই । আমি যখন ইন্টার পাশ করি তখন থেকেই আমার ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হব । অথচ আমার বাসায় আমার বাবা আর মায়ের ইচ্ছে যেন আমি ডাক্তারিতে পড়ি । আমার মোটেই ইচ্ছে ছিল না । এখন আমি তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি । কারণ জীবনটা আমার । আমি কী হতে চাই সেটাই আমাদের কাছে মূখ্য বিষয় । এখন তুমি আমাকে বল এটা কি বেয়াদবী হয়েছে? আমাদের কালচারে এটা শেখানো হয় যে বড়দের সম্মান করতে তাদের আদেশ মেনে চলতে । এই সুযোগটা বড়রাও নেয় খুব । তাদের মনে একটা ধারণা জন্মেছে যে তাদের ইচ্ছেটাই হচ্ছে প্রধান। তারা যা বলবে সেটা ছোটদের শুনতেই হবে । নয়তো সেটা বেয়াদবী হবে !

আহসান কিছ সময় চুপ থেকে বলল, আমি আসলে এমনই । এমনই বেয়াদব । সারা জীবন এটাই সহ্য করে নিতে হবে । 

পরদিন উর্মি নতুন বাসায় উঠে এল ।  এবং সেদিনই বড় রকমের একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো । ঐদিন বিকেল বেলা একজন মানুষ এসে হাজির হল ওদের নতুন বাসায় । সাথে করে পিচুকে নিয়ে এসেছে সে । আহসান ব্যবস্থা করেছে । বেড়ালটা জড়িয়ে ধরে উর্মি কিছু সময় বসে থাকল । এখানে এসে এমন কিছু যে পাবে সেটা ভাবে নি । রাতের বেলা আহসানকে খুব করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো ওর । এতো আনন্দ হচ্ছিল । তবে নিজ থেকে সেটা করতে সংকোচ বোধ করছিল ।

দুই

উর্মির নতুন বাসায় মোট দুইটা শোবার ঘর । এছাড়া একটা ছোট স্টাডি রুমের মত আছে । সেখানে একটা টেবিল আর বুকসেলফ রাখা । আহসান সিভিল ইঞ্জিনিয়ার । এখানে অনেক বই পত্র রয়েছে । টেবিলে অনেক আঁকাঝুকি জিনিসপত্র রাখা । টেবিলটা একটু গোছাতে গিয়ে উর্মি দেখল সেখানে একটা আইপ্যাড রয়েছে । অনেক দিন আগে উর্মি ওর বাবাকে এমন একটা আইপ্যাড কিনে দেওয়ার আবদার করেছিল । এমন না যে, তার উর্মির বাবা স্বচ্ছল ছিলেন না । কদিন আগেই উর্মির ছোট ভাইয়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে বাইক কিনে দিয়েছিলেন। সেই জন্য আবদারটা উর্মি করেছিল । আইপ্যাডে ছবি আঁকা যায় বেশ ভাল করে । উর্মিকে কিনে দেওয়া হয় নি । উর্মির মা পরে টাকা দিয়ে একটা কম দামী ট্যাব কিনে দিয়েছিল । সেটাতে ছবি আঁকত সে ।

আজকে আইপ্যাডটা দেখে একটু লোভ হল । স্বামীর কাজের জিনিস নিশ্চয়। একবার মনে হল যে হাত দেওয়া ঠিক হবে না । কিন্তু রান্না শেষ করে আর লোভ সামলাতে পারলো না । পুরো দুপুর আর বিকেল আইপ্যাডে ছবি আঁকা নিয়েই ব্যস্ত রইলো । তারপর তার স্বামী আসার আগে আবারও আগের স্থানে সেটা রেখে দিল ।

রাতে খাওয়ার সময় উর্মি আহসানকে বলল, আপনার আইপ্যাডটা আমি একটু ধরেছিলাম ।

-আমার ?

আহসান যেন একটু অবাক হল ।

-হ্যা । ঐ যে টেবিলের উপরে আছে !

-ও ওটা । ওটা তো আমার না ।

-তাহলে?

-ওটা তোমার জন্যই কেনা ! তোমার ইনস্টাগ্রামে দেখলাম অনেকগুলো ইলাস্ট্রেশন । তাই মনে হল আইপ্যাডে এই ছবি গুলো আরও ভাল করে আঁকা যাবে।

উর্মির মনে দুইটা ঘটনা একসাথে ধাক্কা মারল । প্রথমটা হচ্ছে তার স্বামী তার ইনস্টাগ্রাম একাউন্ট খুজে বের করেছে । সেখানে তার আকাঁ ছবি দেখেছে । এবং পরে ওর জন্য একটা আইপ্যাড কিনে নিয়ে এসেছে ।

উর্মি বলল, ওটা তো অনেক দামী !

আহসান উর্মির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও তো অনেক দামী !

উর্মি অনুভব করল ওর চোখে সিক্ত হয়ে এসেছে । জীবনে এই প্রথমবার মনে হল কেউ ওকে মূল্য দিচ্ছে । ওর মনে হল অন্য কারো কাছে ওর মূল্য আছে । উর্মি যে পরিবার থেকে উঠে এসেছে সেখানে মেয়েদের সম্মান দিতে দেখে নি কোন দিন । সেখানে মেয়েদের কেবল সংসার সামলানো আর বাচ্চা উৎপাদনের কাজ ছাড়া আর কোন কাজের যোগ্য মনে করা হয় না । কোন সিদ্ধান্ত তাদের সাথে আলো করে নেওয়া হয় না। কেবল তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় । এমন আচরণ পেয়েই সে অভ্যস্ত ছিল । ভেবেছিল তার স্বামী এবং স্বামীর বাড়িতেও এমন কিছুই হবে !

উর্মি কিছুতেই নিজের চোখের পানি আটকাতে পারল না ।

আহসান উর্মির প্রতিক্রিয়াটা লক্ষ্য করলো । তারপর একটু হেসে বলল, বোকা মেয়ে ! এতো সামান্য ব্যাপার নিয়ে চোখের পানি ফেলতে আছে ! শোন, এখন তোমার কাজ হবে আমার একটা চমৎকার ছবি একে দিবে । আমি অফিসের লোকজনদের দেখাব । সবাইকে বলব যে দেখো আমার বউ কত চমৎকার ছবি আকে ! মনে থাকবে তো !

উর্মি কেবল মাথা ঝাকাল । তখনও ওর চোখ দিয়ে পানি পরা বন্ধ হয় নি । তবে এই অশ্রু মোটেই দুঃখের নয় । আনন্দের অশ্রু ।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

সরাসরি মেসেজ পাঠাতে চিঠি.মি এপ ব্যবহার করুন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 56

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →