ঋণ শোধ

4.8
(66)

আমি জীবনে অনেক কিছু দেখেছি । তবে এতো কাছ থেকে কারো মৃত্যু এই প্রথম দেখলাম । চোখের সামনে একজন মানুষকে এভাবে মরে যেতে দেখে অদ্ভুত মনে হল । এতো সহজে মানুষ মারা যায় ! একটু আগেও মানুষটা ভাবেও নি যে সে মারা যাবে । একদিন হয়তো আমিও এমন ভাবে মারা যাবো । এভাবে অপরিচিত মানুষের মাঝে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবো । ঠিক যেমন ভাবে সেই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল ।

ছুটির দিন গুলোতে আমি প্রায়ই এদিক সেদিক হেটে বেড়াই । এই ইট পাথরের রাস্তায় পা হেটে চলে যায় সেদিক দুচোখ যায় । অনেকটা হিমুর মত হয়ে যাই । মানুষ দেখতে বের হই । তবে হ্যা অবশ্যই খালি পায়ে না ।

আমি গত পরশু দিন একই ভাবে বের হয়েছিলাম হাটতে । সময়টা দুপুরের কিছু পরে । ফার্মগেট পার হয়ে চলে এলাম বিজয় সরণী । তারপর হাটা দিলাম জাহাঙ্গির গেটের দিকে । আগে ঐদিকে একটা চমৎকার বইয়ের দোকান ছিল । আমি প্রায়ই সেখানে গিয়ে বই পড়তাম । তবে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে । ঠিক বন্ধ হয় নি । অন্য স্থানে চলে গেছে । আর যাওয়া হয় নি ওদিকে । তবে আমি এখনও হাটতে আসি এখানে ।

ছুটির দিন বলে রাস্তাটা বেশ ফাঁকাই । গাড়িঘোড়া কম । এমন সময়ই আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম লোকটা কে । সাইকেল নিয়ে হঠান রাস্তা পার হওয়ার জন্য ঘুরলেন । কেন এমন করলেন কে জানে ! পেছন থেকে আসা একটা বাস একেবারে গায়ের উপরে উঠিয়ে দিল । সত্যি বলতে এখানে বাসওয়ালার কোন দোষ নেই । এমন ভাবে বোকামী করলে দুর্ঘটনা ঘটবেই । আশে পাশে আসলে তখন কেউ ছিল না । আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে গিয়েও করতে পারলাম না । দ্রুত এগিয়ে গেলাম সেদিকে । আমিই পৌছালাম লোকটার কাছে ।

আমি সামনে বসতেই দেখতে পেলাম লোকটা তখনও জীবিত আছে । আমার দিকে চোখে পড়েছে । আমি কী করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । কী করা উচিৎ আমার !

তখনই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে একটু হাসলো । যেন তার মরার সময় চলে এসেছে সেটা সে জানতে পেরেছে । আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করলো যেন একটু । আমার মনে হল সে আমাকে সে এগিয়ে যেতে বলছে । আমি এগিয়ে গেলাম তার দিকে। কান টা নিয়ে গেলাম তার মুখের কাছে । সে ফিসফিস করে বলল, ভাই মোতালেব মিয়ার হোটেলে আমার ৯০ টাকা বাকি আছে । টাকাটা দিয়ে দিয়েন !

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে । মৃত্যুর এই সময়ে লোকটার এই কথা বলার ছিল । অন্য কিছু বলতে পারতো । বলতে পারতো তার পরিবারকে জানাতে । মাবাবা বউ কিংবা সন্তান !

একটু সময়ের ভেতরেই দেখলাম আরো মানুষ জমে গেল । যে বাস চাপা দিয়ে সে সেই বাস থেকেও অনেকে নেমে এল । আমি তাকিয়ে দেখি লোকটা স্থির হয়ে গেছে । আমার দিকে নিবদ্ধ । তবে সেই চোখে কেমন যেন একটা শান্তি দেখতে পেলাম ।

সবাই ধরাধরি করে কাছের আলরাজি হাসপাতালেই নিয়ে গেলাম আমরা । তবে আমি জানি নিয়ে গিয়ে আসলে কোন লাভ নেই । সে মারা গেছে ।

এই দুইদিন আমার কোন কাজে মন বসলো না । চোখের সামনে এমন ভাবে লোকটা মারা যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে হজম করতে একটু সময় লাগল। তবে একটা সময়ে সামলে নিতেই হত । মানুষটাকে আমি চিনিও না । কোন দিন দেখিও নি কিন্তু তার পরেও মানুষটাকে আমি সহজে ভুলতে পারলাম না । লোকটা আমাকেই তার জীবনের শেষ লাইন বলেছিলো ।
ভাই মোতালেব মিয়ার হোটেলে আমার ৯০ টাকা বাকি আছে । টাকাটা দিয়ে দিয়েন !

শেষ ঋণ শোধ করতে বলেছিলো আমাকে । ৯০ টাকার ঋণ । অথচ আমি চিনিও না মোতালেব মিয়ার হোটেল কোথায় ! এই ঢাকা শহরে কত হোটেল আছে । কত দোকান আছে । আমি কিভাবে খুজে বের করবো সেই মোতালেবকে ।
ঠিক করলাম যে ৯০ টাকা আমি মসজিদে দান করে দিবো ।

কিন্তু নিজের মনের কাছেই শান্তি পেলাম না আমি । কারণ আমি জানি যে এই ঋণ যদি না শোধ হয় তাহলে এই লোকটা কোন দিন শান্তি পাবে না । আমার উপর ভরশা করে লোকটা বলে গেছে আমি যেন টাকাটা শোধ করে দিই ।

পরদিন আলরাজি হাসপাতালে গিয়ে হাজির হলাম । একটু খোজ খবর করতেই লোকটার নাম জানতে পারলাম । সেখান থেকে আমাকে জানালো যে লোকটার নাম সবুর মিয়া । তার পকেটে থাকা মানিব্যাগ থেকে তার পরিবারের হদিস বের করা হয়েছে । গতকাল তার পরিবারের লোকজন এসে লাশ নিয়ে গেছে । তাদের অনুরোধ করতেই সেই ঠিকানা আমাকে দিয়ে দিল । মুন্সিগঞ্জে বাড়ি লোকটার ।

আমি দুদিন পরে সবুর মিয়ার বাড়িতে চলে গেলাম খোজ নিতে নিতে । বাড়িতে সবাই রয়েছে । এক ছোট ভাই আছে । বাবা মা আছে । সবুর মিয়া তখনও বিয়ে করে নি । একটা অফিসে চাকরি করতো ।

আমাকে দেখে এবং আমি সে তার শেষ সময়ে তার কাছে ছিলাম এটা জানতে পেরে আমাকে তারা বেশ আপ্যায়ন করেই বসালো । আমি তাদেরকে সবুর মিয়ার শেষ বলা কথাটা তাদের বললাম।

আমি এই জন্য এতোদুর এসেছি সেটা জেনে তারা সবাই বেশ অবাক হল । আমি বললাম, আপনাদের এই গ্রামে কি মোতালেব মিয়ার হোটেল বলে কোন হোটেল আছে?

সবুর মিয়ার বাবা মাথা নাড়ালো । এই এলাকাতে এমন কোন হোটেল নেই । আমি বললাম তাহলে সে যেখানে থাকতো সেখান থাকতে পারে । সে কোথায় থাকতো?

-মিরপুর ১২তে থাকতো ।
-আমাকে ওর বাসার ঠিকানাটা একটু লিখে দেন । সেই সাথে অফিসের ঠিকানাটাও । আমি দেখি খুজে পাই কিনা !
ঠিকানা লিখে দিলো ওরা !
আমাকে দুপুরের খাবার না খাইয়ে আসতে দিল না সবুর মিয়ার পরিবার । যখন বের হয়ে আসছি তখন সবুর মিয়ার বাবা বলল, আপনে বাবা কেন করতেছেন । আপনার তো কিছু লাগে না আমার পোলা !
-না লাগুক । সে শেষ সময়ে আমাকে বিশ্বাস করে আমার উপর ভরশা করে একটা কাজ দিয়েছেন । এই কাজটা আমি না করলে শান্তি পাবো না । আমাকে সম্ভব হলে সবুর মিয়ার একটা ছবি দেন । তাহলে এটা আমার জন্য সহজ হবে ।

আসার সময়ে সবুর মিয়ার বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন । আমার জন্য দোয়াও করলেন !

তারপর আমি প্রায় প্রতিদিন সেই মোতালেব মিয়ার হোটেল খুজতে লাগলাম। প্রথমে তার বাসার আশে পাশে সব দোকানে । সেখানে নেই । এমন কি আশের পাশের সব হোটেলে খোজ নিলাম । মোতালেব মিয়ার হোটেল পেলাম না কোথাও । পরে তার অফিসেও খোজ নিলাম । অফিসের আশে যত দুরে সম্ভব কোথাও মোতালেব মিয়ার হোটেল পাওয়া গেল না ।

দীর্ঘ দুই মাস ধরে আমি আমার খোজার পরিধি বাড়িয়েই গেলাম কেবল । তবে একটা সময়ে আমার মনে হল যে আমার পক্ষে আর এই মোতালেব মিয়ার হোটেল খুজে পাওয়া সম্ভব না ।

মাস দুয়েক পরে যখন আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি সেই সময়ে সবুর মিয়ার ছোট ভাই আমাকে ফোন দিল। ফোন দিয়ে বলল যে তার ভাই একজনকে প্রাইভেট পড়াতো ফার্মগেট এলাকাতে ।
তখনই ব্যাপারটা আমার মাথায় ধাক্কা মারলো । সবুর মিয়া ঐদিন এই রাস্তায় কী করছিল । তার বাসা কিংবা অফিসের কোনটাই এই এলাকাতে না । তাহলে ?
এখানে কেন এসেছিলো ?
এখানে প্রাইভেট পড়াতে !

আমি আবারও পুরো উদ্যোমে খুজতে শুরু করলাম । এবং এবার সেই মোতালেব হোটেলের খোজ পেয়ে গেলাম । বিজ্ঞান কলেজের পাশের একটু এগিয়ে গিয়েই হোটেলটা । হোটেলের ভেতরে গিয়ে ক্যাশে যে বসেছিল তাকে সবুর মিয়ার ছবিটা দেখিয়ে বললাম, এই মানুষটাকে চিনেন আপনি !

ছবিটার দিকে তাকিয়ে লোকটা সাথে সাথেই বলল, আরে হ চিনি তো ! ঐ যে সামনে যে বাড়ি দেখছেন ! ওখানে প্রাইভেট পড়ায় । প্রতিদিন রাতে পড়াইয়া আমার হোটেলেই ভাত খাইতো । তারপর বাড়ি যাইতো ! অনেক দিন অবশ্য আসে না আর !

আমার একটু স্বস্তি পেলাম । যাক পাওয়া গেছে অবশেষে । আমি পকেট থেকে ৯০ টাকা বের করে দিয়ে বললাম, ৯০ টাকা পাইতেন সম্ভবত তার কাছে ।
লোকটা একটু মনে করার চেষ্টা করলো । তারপর বলল, মনে হয় পাইতাম ! মনে নাই ঠিক !
-হ্যা পেতেন । এই নিন । তার ঋণ শোধ করুন ।
-সে কই?
-সে আর আসবে ।

লোকটা যেন ঠিক বুঝতে পারলো না আমার কথা । আমিও খুলে বললাম না । হোটেল থেকে বের হয়ে এলাম । তারপর সবুর মিয়ার ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম যে হোটেল খুজে পেয়েছি । তার ভাইয়ের ঋণ শোধ হয়েছে।

আজকে আমারও ঋণ শোধ হল । একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ আমার উপরে যে ভরশা করেছিলো সেই ভরশাটা আমি শেষ পর্যন্ত রাখতে পারলাম । এটা একটা বড় শান্তির ব্যাপার ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 66

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →