ছোট ভাইয় নয়নের মলিন চেহারার দিকে নাইলার সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়লো আদিবের উপর । নাইলার মা নয়নকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে তবে সে মুখ গোমড়া করে বসে রয়েছে । বসার ঘরে টিভি চলছে তবে নয়ন টিভি দেখছে না ।
নাইলার মনে হল এখনই সে হোটেলের সামনে গিয়ে হাজির হয় । চিৎকার করে বলে একবার তার ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা করলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত ! অসুস্থ একটা ছেলে হুইল চেয়ারে করে মাঠে গিয়েছিলো কেবল মাত্র তার সাথে একটু দেখা করতে । একবার যদি মাথায় একটু হাত রেখে একটু আদর করে দিতো তাহলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত !
নাইলা জানে আসলে ওর কিছুই করার নেই । যে হোটেলে খেলোয়ার আদিব রয়েছে সেখানে হয়তো ওকে ঢুকতেও দেওয়া হবে না । গেটের কাছ থেকেই বের করে দেওয়া হবে । তারপরেও নাইলার খুব করে ইচ্ছে হল রাস্তার সামনে গিয়ে চিৎকার করে কথা গুলো বলতে ।
নাইলার ছোট ভাই নয়ন একজন লিউকোমিয়ার পেসেন্ট । প্রতিমাসের অনেকটা সময় ওকে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় । যে টুকু সময় সে ভাল থাকে সে পড়ে থাকে তার ভিডিও গেম আর ফুটবল খেলা দেখা নিয়ে । আর এই ফটবলের জন্য আদিবকে সে পছন্দ করে । আদিব একটি ইউরোপিয়ান দলে খেলে । দেশ জোড়া তার খ্যাতি । কদিন আগে সে দেশে এসেছে । একটা প্রীতি ম্যাচ ছিল তাদের জেলার স্টেডিয়ামে । সখন থেকে নয়ন শুনেছে আদিব আসবে ওদের জেলাতে তখন থেকে বায়না ধরেছে আদিবের সাথে একবার দেখা করবে । একবার তার সাথে একটা ছবি তুলবে ।
কিন্তু চাইলেই তো এটা সম্ভব না । নাইলা তবুও অনেক চেষ্টা করেছিলো । আদিবের ম্যানেজারকে জানিয়েছিল যে একটু যেন দেখা করে । তবে দেখা করানো সম্ভব হয় নি । সবাই আদিবের সাথে দেখা করতে চায় সবাই ছবি তুলতে চায় । সেই সবার চাওয়ার নয়ন পিছিয়ে পড়েছে । পারে নি দেখা করতে ! শেষে বাধ্য হয়ে চলে আসতে হয়েছে ওদের । তারপর থেকেই নয়ন মন খারাপ করে আছে । নাইলা জানে এই মন খারাপের ব্যাপারটা ওর শরীরের উপর একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। কিন্তু নাইলার কিছুই করার নেই আসলে এখানে । নাইলার এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন না থাকার ব্যাপারটা কখনই ভাল লাগে না ।
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো । নাইলা ঘড়ির দিকে তাকালো । রাত প্রায় এগারোটা বাজে । ওর বাবা অফিসের কাজে গিয়েছে ঢাকাতে । আগামীকাল আসবে । তাহলে এতো রাতে আবার কে এল?
নাইলা একটু বিরক্ত হয়েই দরজা খুলতে গেল । দরজা খুলেই দেখতে পেল তাকে । প্রথমে নাইলার মনে হল যেন সে ভুল দেখছে । কয়েক পলক দাড়িয়ে রইলো সেখানেই । নিজের চোখকে ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছে না । কারণ এটা সম্ভব না কোন ভাবেই । নাইলা ভাবলো ও বসে থাকা অবস্থায় হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলো । সেখান থেকেই সে স্বপ্ন দেখছে । নয়তো ফুটবলার আদিব কিভাবে আসবে তার বাসায় !
আদিব বলল, হ্যালো । আমি কি নয়নদের বাসায় এসেছি?
নাইলা তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । আদিব একটা ফুটবল নিয়ে এসেছে হাতে করে । নাইলা বলল, জ্বী !
-আমি কি ভেতরে আসতে পারি ?
-হ্যা হ্যা অবশ্যই ! আসলে আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে আপনি এসেছেন?
-আসলে আমার ম্যানেজার আমাকে বলেই নি নয়নের কথা । বললে আমি ওকে নিয়ে যেতাম আমাদের ড্রেসিং রুমেই । একটু আগে সে জানালো । ছোট শহর । ঠিকানা বের করতে তাই খুব একটা কষ্ট হয় নি । আপনাকে চিনতো স্টেডিয়ামের একজন কর্মী । সেই সাহায্য করলো । নয়ন কোথায়?
নাইলা কেবল নিজের ভাইয়ের আনন্দময় মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল । কতদিন সে নয়নকে এভাবে খুশি হতে দেখেছে সেটা মনেও নেই । চোখ পানি চলে এল আনন্দে ।
আদিব প্রায় ঘন্টা খানেক থাকলো । নয়নের সাথে ওর ঘরে গেল । আদিবের পোস্টার দেখলো দেওয়ালে । আদিব একটা ফুটবল নিয়ে এসেছিলো সাথে করে সেটাতে সাইন করে দিল । দেওয়ালের পোস্টারেও সাইণ করলো । অনেক গুলো ছবি তুলল ।
গেট দিয়ের বের হয়েও নাইলা রাস্তা পর্যন্ত এল আদিবের সাথে । ছোট শহরে রাত নামে বড় জলদি । এখানে রাত বারোটা মানে অনেক রাত । নির্জন রাস্তা নাইলা কিছু সময় দাড়িয়ে রইলো । আদিবের গাড়ি এখনও এসে পৌছায় নি । নাইলা হঠাৎ আদিবকে জড়িয়ে ধরলো । খানিকটা আকস্মিক ভাবেই আদিবকে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছু সম । তারপর ছেড়ে দিলো একটু পরেও । চোখে তত সময় পানি চলে এসেছে ওর । সেটা আটকানোর চেষ্টা না করেই নাইলা বলল, আমার ভাইটা আর বেশি দিন বাঁচবে না । আপনি যখন আসলেন কী যে খুশি হয়েছে ও ! এমন আনন্দ ওকে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের ছিল না । আপনাকে কী যে ধন্যবাদ দিবো আমি বুঝতে পারছি না ।
আদিব একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও সামলে নিল । বিশেষ করে নাইলা যখন জড়িয়ে ধরেছিলো তখন । বলল, আরে কী যে বলেন । এটা আর এমন কি! নয়নের মত ফ্যানরা আছে বলেই তো আমরা আছি । ওদের ছাড়া আমরা কিছুই না ।
আদিব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই আদিবের গাড়ি চলে এল । আদিব নিজের একটা কার্ড নাইলার হাতে দিয়ে বলল, এখানে আমার ব্যক্তিগত নম্বর রয়েছে । কোন দরকারে অবশ্যই আমাকে ফোন দিবেন ।
নাইলা আদিবের চলে যাওয়া দেখলো । আজকে অনেকটা দিন পরে নাইলার মনটাও অনেক বেশি ভাল হয়ে আছে ।