শশী কফির কাপটা টেবিলের উপরে এনে রাখলো । জাহিদ নিজের ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখে কাজ করছিলো । কফির কাপটা আসতেই সেটার দিকে চোখ দিল । বলল, বাহ কফি !
তারপর একটু হেসে বলল, থ্যাঙ্কিউ ।
শশী বলল, আমার জন্য এতো কাজ করছেন । একটু কফি তো খাওয়াতেই পারি ।
-আরে বার বার একই কথা কেন বলছেন । আমরা কতদিন এক সাথে কাজ করি । এই সামান্য কাজ করতে পারবো না?
-সেই সকাল থেকে কাজ করছেন । আমার জন্য আপনার ছুটিটা নষ্ট গেল ।
-এটাও তো ছুটিই । এই যে আপনি তো রান্না করে খাওয়ালেন । এটা অনেক কিছু । কতদিন বাসার রান্না করা খাবার খাই না হিসেব আছে!
শশী কিছু বলতে গিয়েও বলল না । হঠাৎ জাহিদের জন্য খুব বেশি মায়া হল ওর । মানুষটা কতদিন ধরে একা একা আছে । একজন মানুষ যখন শুরু থেকে একা থাকে তখন সেটা তার জন্য অভ্যাসের একটা ব্যাপার হয়ে যায় । কিন্তু যখন একজন পুরুষ বিয়ে করে কারো সাথে থাকতে শুরু করে, তখন তার পক্ষে একা থাকাটা বেশ কষ্টের হয়ে যায় । এই কারণে ডিভোর্সের ছেলেরা দ্রুত বিয়ে করে নেয় । অথচ আজকে প্রায় চার বছর হয়ে গেল জাহিদ তার আগের স্ত্রীর থেকে আলাদা হয়েছে । এখনও মানুষটা বিয়ে করছে না কিংবা বিয়ে করার নামই নিচ্ছে না । শশী খোজ খবর নিয়েছে । জধিদের বাবা মা বেঁচে নেই । তবে বড় ভাই আছে, বোন আছে । তারা চেষ্টা করেছে বিয়ে দেওয়ার জন্য অথচ জাহিদ কিছুতেই রাজি হয় নি । শেষে তারা ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে । মানুষটা এখন একদম একা হয়ে আছে । কেন একা হয়ে আছে সেটা শশী নিজেও জানে না ।
আজকে শশী খানিকটা ইচ্ছে করেই জাহিদকে ওর বাসায় ডেকে এনেছে । অফিসের একটা কাজ শশী খানিকটা ইচ্ছে করে দেরি করেছে । এবং শেষ মুহুর্তে জাহিদের সাহায্য চেয়েছে । ছুটির দিনে নিজের বাসায় ডেকে এনেছে কাজ করার উছিলাতে । কাজ চলছে, গল্প চলছে । দুপুরে জাহিদের পছন্দ খাবারটাই শশী রান্না করেছে । শশী নিজের মা বাবার সাথে থাকে এখানে । যদিও শশীর মা জাহিদের এমন করে বাসায় আসাটা ঠিক পছন্দ করে নি । বিশেষ করে জাহিদের আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো এটা জানার পরে শশীর মা মেয়ের সাথে তার মেলামেশা ঠিক পছন্দ করে নি। মেয়ের উপরে ঠিক তাদের পুরো নিয়ন্ত্রন তাদের নেই । তাই কিছু বলতে পারে নি । শশী যে জাহিদকে পছন্দ করে এটা মা হিসাবে ঠিকই বুঝতে পেরেছে সে ।
আজকে রান্নাটা পুরোটাই শশী নিজে করেছে । শশীর মা কেবল গোমড়া মুখে পাশে দাড়িয়ে ছিল । তবে কিছুই বলে নি । রান্না শেষ করে আবারও নিজের ঘরে এসেছে জাহিদের কাছে । তারপর দুজন মিলে বাকি কাজটা শেষ করেছে । সন্ধ্যার দিকে সব কাজ শেষ হল । জাহিদ যখন বের হতে যাবে তখন শশী বলল, আমাদের বাসার ছাদটা বেশ চমৎকার খোলা মেলা । যাবেন ?
-এখন?
-হ্যা । চলুন চলুন । বাসায় কেউ নেই তাই না?
-আসলে….
-আরে চলুন তো । ব্যাগটা শশীর ঘরে রেখে আবারও ওরা গিয়ে হাজির হল ছাদে । সন্ধ্যা পার হয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে । চাদের উপরে একটা ছাউনির মত আছে । সেখানে বসার জায়গা রয়েছে । ওরা বসলো সেখানেই ।
গল্প শশীই শুরু করলো । অফিসের গল্প থেকে শুরু করে গল্প গিয়ে থামলো পরিবারে । শশী জানতে চাইলো, আপনাদের কেন ডিভোর্স হয়েছিলো । বলা যাবে?
জাহিদ কিছু সময় তাকিয়ে রইলো শশীর দিকে । তারপর তাকালো আকাশের দিকে । তারপর বলল, আসলে কারো দোষ না । আইরিনের যে চাহিদা ছিল সেটা আমি পূরণ করতে পারি নি ।
কিছু সময় চুপ করে রইলো । শশীর মনে হল কথা গুলো বলতে যেন জাহিদের খানিকটা কষ্ট হচ্ছে । নিজেকে খানিকটা দোষারোপ করলো ব্যাপারটা জানতে চাওয়ার জন্য । জাহিদ আবারও বলল, শুরুর দিকে জানেন সব কিছু ঠিকই ছিল । সব চলছিলো বেশ চমৎকার । তারপর এক সময় আমি আবিস্কার করলাম যে আইরিনের চাহিদা বাড়ছেই । অফিস থেকে ফিরে এসেই আমাকে শুনতে হত ও সারাদিন কত কাজ করছে বাসায় । আমি চেষ্টা করতাম ওকে বাসার কাজে সাহায্য করতে । একটা সময়ে সেটাও কম পড়লো । আরো কত অভিযোগ । আমি পেরে উঠছিলাম না । একটা সময়ে আমার নিজেরই বিশ্বাস হতে শুরু হল যে আমিই আসলে যোগ্য নই । আমি হয়তো তাকে সঠিক ভাবে রাখতে পারছি না । আমিই তাল মেলাতে পারছি না ।
আইরিন চলে গেছে । তবে সেই চিন্তাটা আমার মাঝে এখনও রয়ে গেছে । আমি আসলে যোগ্য নই । হয়তো দেখা যাবে সামনে যাকে বিয়ে করছি সেও একই ভাবে অভিযোগ করছে যে আমিই ঠিক মত তার সাথে পেরে উঠছি না।
জাহিদের কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যা শশীর বুকের ভেতরে একটা ধাক্কার মত লাগলো । এমন কিছু একটা ছিল যা শশী মোটেই আশা করে নি । এমন হতাশা মিশ্রিত কন্ঠস্বর শুনে শশীর বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো । কিন্তু তারপর জাহিদ শশীকে যা বলল সেটা শোনার জন্য শশী মোটেই প্রস্তুত ছিল না । শশীর পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠলো ।
জাহিদ আকাশের দিকে তাকিয়েই বলল, শশী আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন । কেবল আমিই না ব্যাপারটা অনেকেই জানে ।
শশী বিস্মিত চোখে কেবল তাকিয়ে রইলো জাহিদের দিকে । যদিও এখন অন্ধকার চারিদিকে । ছাঁদে কোন আলো জ্বালানো নেই । পাশের বিল্ডিং থেকে আসা আলোতে যা একটু দেখা যাচ্ছে চারিদিক । জাহিদ আবার বলল, আপনার আচরণই আসলে এমন । এটা অফিসের মোটামুটি সবাই খেয়াল করেছে ।
কিছু সময় নিরবতা । শশী বলল, সবাই খুব হাসাহাসি করে !
-আরে নাহ ! হাসাহাসি কেন করবে! শফিক ভাই সেদিন এসে বললেন যে আমি যেন সিরিয়াসলি ভাবি আপনাকে নিয়ে !
-ভেবেছেন?
-হ্যা ভেবেছি । প্রতিদিনই ভাবি । শশী আপনি এমন একজন মেয়ে যাদেরকে প্রতিটি ছেলেই ভাবে । মানে তাদের স্বপ্নের নারী যেমন হয়, তেমন আপনি ।
শশীর হঠাৎ কেন জানি কান্না আসতে লাগলো । তবে এটা কষ্টের কিংবা লজ্জার নয় । আনন্দের । জাহিদ বলল, আমি অনেক বার নিজেকে আপনার সামনে এনে দাড় করাতে চেয়েছি । ভেবেছি যে আরেকটা বার সুযোগ দেওয়া যাক জীবনকে । হয়তো এবার সুখ আসবে ! যখন নিজেকে বুঝিয়ে ফেলেছি, নিজের মনকে রাজি করিয়ে ফেলেছি ঠিক তখনই সেই চিন্তাটা আবারও এসে হাজির হয় । যদি আমি না পারি ! যদি আপনার জন্যও আমি এনাফ না হয়ে থাকি ! যদি অযোগ্য হয়ে থাকি ! এই চিন্তা আমাকে সামনে এগোতে দেয় না !
শশীর মাঝে হঠাৎই যে কি হল সে অনেকটাই সাহসী হয়ে উঠলো । জাহিদের দিকে আরো একটু এগিয়ে গেল । তারপর নিজের হাতটা দিয়ে ওর ঠোঁটে শক্ত করে চুমু খেল । শশীর মনেও রইলো না যে ওদের বিল্ডিংটা সব থেকে উচু বিল্ডিং না । পাশের বাসার জানালা থেকে যে কেউ ওদের দেখতে পারে এভাবে চুম্বনরত অবস্থায় । অবশ্য শশীর এতে এখন কিছুই যায় আসে না । ও আসলে কোন কিছুতেই কেয়ার করে না ।
লম্বা চুম্বনের পরে শশী জাহিদকে বলল, ইউ আর এনাফ ফর মি ! বুঝেছো ! আমি আর কিছু শুনতে চাই না ভাবতেও চাই না । আমরা কালই বিয়ে করবো । কালই !
দুই
আইরিনের সব সময় নিজের চেহারা নিয়ে একটা গৌরব ছিল । সুন্দরী হিসাবে নিজেকে সব সময় সবার থেকে এগিয়ে রাখতো । ভাবতো ওর অন্য সবার থেকে ভাল কিছু প্রাপ্য । জাহিদের সাথে বিয়ের পরেও এমন মনে হত বারবার । কেবল মনে হত জাহিদের সৌভাগ্য যে ওর মত মেয়ে ওকে বিয়ে করেছে । জাহিদ নিজেও ব্যাপারটা মেনেই নিয়েছিলো । সব সময় চেষ্টা করতো ওকে সর্বোচ্চটা দিতে । কিন্তু আইরিনের মনে হত যে ও যেন সন্তুষ্ট নয় । এক সময় জাহিদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল সে । তারপর কয়েকজনের সাথেই আইরিন ডেট করেছে । সবাই ওকে প্রথম প্রথম খুব সমাদর করলেও কিছু দিন পরেই ওর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতো । কয়েক জনের সাথে বিছাানতেও পর্যন্ত গিয়েছে আইরিন কিন্তু কাউকেই সে ঠিক ধরে রাখতে পারে নি । বিশেষ করে আইরিনের এতো চাহিদা কেউ ঠিক পূরণ করতে পারে নি । সবাই ছেড়ে গেছে ।
কয়েকদিন আগে আইরিন জাহিদের সাথে দেখা করেছিলো । আরো ভাল করে বলল জাহিদকে ও দেখতে পেয়েছিলো । জাহিদের ব্যাপারটা ও জানতো । অনেক দিন জাহিদ একা ছিল । প্রায় চার বছরের বেশি সময় । তারপর সে বিয়ে করেছে শুনেছিলো । ভেবেছিলো কোন সাধারণ মেয়েকে হয়তো বিয়ে করেছে, হয়তো আগে বিয়েও করেছিলো । কাউকে বিয়ে করতে পারছে না বলে জাহিদের মত কাউকে বিয়ে করেছে । কিন্তু কয়েকদিন আগে জাহিদের বউকে সে দেখেছে । জাহিদের বউকে দেখার পরেই আইরিনের মনের ভেতরে একটা অশান্তি কাজ করা শুরু করেছে । বিশেষ করে মেয়েটার সম্পর্কে খোজ খবর নিয়ে জানতে পেরেছে মেয়েটার আগে কখনই বিয়ে হয় নি । জাহিদের সাথেই চাকরি করে মেয়েটা । দেখতে খুবউ সন্দর সে । চেহারাতে একটা মিষ্টি ভাব রয়েছে। ফেসবুকে খুজে বের করলো ওদের । ওদের দুজনের এক সাথে ছবি দেখে আইরিনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল । বিশেষ করে শশী নামের মেয়েটা জাহিদকে নিয়ে আর আহলাদি করতো সেটা কিছুতেই সহ্য হত না । বারবার কেবল মনে হতে লাগলো সে শশী ওর জাহিদকে ওর কাছ থেকে চুরি করেছে । ওর সব কিছু প্রাপ্য ছিল ।
অথচ আইরিনের সব কিছুই ছিল । কেবল নিজের কারণেই সব কিছু সে হারিয়ে ফেলেছে ।
আমাদের এই বর্তমান যুগে সম্পর্ক বিয়ের বেলাতে আমাদের সামনে কত অপশন আমরা দেখতে পাই । আমাদের মনে হয় আমি আরো ভাল কিছু চাই । নিজের কাছ থেকে সম্পদকে চিন্তে পারি না বাইরের চাকচিক্য দেখে । তবে মনে রাখা দরকার যেন সম্পর্কে টিকে থাকা খুবই শক্ত একটা ব্যাপার । আপনি যদি সব সময় আপনার পাটনারকে এই ব্যাপারটা দিয়ে বিচার করেন যে সে আপনার জন্য কী করছে কিংবা কী কী দিয়েছে তাহলে আপনি জীবনে কখনই সুখে থাকবেন না । বরং এটা দিয়ে বিচার করুন যে আপনার সঙ্গীটি আপনার জন্য কী কী জিনিস স্যাকরিফাইস করে দিয়েছে । জগতের সকল প্রাণী সুখে থাকুক ।