রাজা নার্সিসাসের কথা অনেকেই জানেন । গ্রিক মিথোলজির গল্প । নার্সিয়াস নিজের প্রেমে এতোটাই মগ্ন থাকতো যে একজবার সে নদীর পানিতে নিজের প্রতিচ্ছি দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গেল যে সে পানিতে কখন যে ডুবে মরলো সেটা সে নিজেই জানে না। নার্সিস্টিক পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার রোগটির নাম এই গ্রীক মিথোলজির চরিত্র থেকেই এসেছে।
আমাদের সবারই এমন পরিচিত কোন খালু মামু কিংবা ফুফা থাকে যে সব সময় এমন একটা ভাব ধরে থাকে যে তার সব কিছুর উপর খুব বেশি জ্ঞান আছে । কিংবা নিদেনপক্ষে পাড়ার কোন বয়স্ক চাচার সাথে তো পরিচয় আছেই যে কিনা নিজেকে সব থেকে জ্ঞানী ভাবে । তার কথা বার্তা শুনলে মনে হয় সেই হচ্ছে দেশ তথা এই পৃথিবীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও যোগ্য ব্যক্তি । পাড়াতেও যদি এমন না থাকে ফেসবুক কিংবা ব্লগে তো পাবেনই এমন কাউকে না কাউকে যে সব সময়ই নিজেকে সেরা মনে করে এসেছে । কথায় আছে, [sb]আপনাকে যে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই হয় ।[/sb] কিন্তু এই খালু মামু চাচাদের কাছে এই প্রবাদ বাক্যটা ঠিক উল্টো । তাদের বেলা খাটে, [sb]আপনাকে যে বড় বলে বড় সেই হয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সে নয় । [/sb] এই যে নিজেকে সব থেকে বড় মনে করা, নিজেকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান নিজেকের যোগ্যতাকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করার ব্যাপার একটি জটিল মানসিক রোগকে নির্দেশ করে । এই রোগের নাম হচ্ছে [sb]নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার[/sb] । সংক্ষেপে [sb]এনপিডি[/sb] । ইউকিপিডিয়া এই রোগের বাংলা করেছে [sb]আত্মরতিমূলক ব্যক্তিত্ব ব্যাধি[/sb] । তবে আমার কাছে ইংরেজি নামটাই যুতসই মনে হচ্ছে ।
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সব সময় নিজেকে সবার থেকে সেরা মনে করে । নিজের সম্পর্কে একটা কাল্পনিক উচ্চ ধারণা তার মনে পাকাপোক্ত ভাবে বসে যায় । সে সব সময় ভাবে, সে-ই এই জগতের সব থেকে যোগ্য এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ন । এই কারণে তার অন্য সবার থেকে আলাদা সম্মান প্রাপ্য । এই কারণে তারা সব সময় চায় আশে পাসেই সবাই তাদের প্রশংসা করুক, তোষামদী করুক আরো ভাল বাংলায় বললে তারা চায় সবাই যেন তাদের চামচামি করুক ।
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগের লক্ষণঃ
১. এনপিডি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অস্বাভাবিক ভাবে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে । এমন কি কার্যত কোন কাজ না করে থাকলেও সে সব সময় এটা মনে করে যে, সে না থাকলে সমাজ তথা দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে । তার মত গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি আর দ্বিতীয়টি নেই।
২. এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে । এছাড়া তারা অধিক মাত্রায় অনুগত্য পছন্দ করে । তাদের সব সময় মনে হয় যেহেতু সে সবার থেকে সেরা তাই সবাই তার অনুগত হয়েই থাকবে – এটাই স্বাভাবিক । এছাড়া সে প্রশংসা পেতে খুব পছন্দ করে । যদি কেউ তাদের প্রসংশা না করে তাহলে তাদের প্রতি বিরূপ আচরণ করে থাকে ।
৩. এরা সব ব্যাপারেই বিশেষজ্ঞ ভাব ধরে থাকে । সব সময় এমন ভাবে আচরণ করা যাতে সে সব কিছুই জানে এবং সবার থেকে বেশি জানে । যে বিষয়ে অজ্ঞ সেই বিষয়েও আন্ডাজে কথা বলা । বাস্তবিক হচ্ছে হল এই ধরণের মানুষেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোন বিষয়েই জ্ঞান রাখে না । তারপরেও তারা এমন একটা ভাব ধরে থাকে যেন সেই বিষয়ে তাদের জ্ঞান রয়েছে প্রচুর ।
৪. এরা অন্যের মতভাব, মতামতের ব্যাপার সহানুভূতিশীল নয় । অন্যের মতামতকে তারা গুরুত্ব দিতে চায় না । আরো ভাল করে বললে অন্য অনুভূতি মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য যে মানসিক অবস্থার দকার সেটা এদের ভেতরে থাকে না । অন্যের মনভাব বুঝতে এরা অক্ষম । এছাড়া, যারা তাদের তোষামোদী না করে, সমাচোলনা করে তাদের প্রতি সব সময় প্রতিহিংসামূলক আচরণ প্রদর্শন করে থাকে । এছাড়া প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে এরা চিন্তা করতে পারে না । নিজেদের চিন্তার বাইরে গিয়ে চিন্তা করার মানসিক সক্ষমতা এদের থাকে না ।
৫. নিজের সাফল্যকে সব সময় বাড়িয়ে বলে থাকে । আবার মিথ্যা ভাবে সেটা অন্যের সামনে তুলে ধরে নিজের মূল্য বাড়াতে সচেষ্ঠ থাকে সব সময় ।
৬. নিজের সুবিধা লাভের জন্য সব সময় অন্যকে ব্যবহার করে থাকে । সেই যদি কোন কাজে ব্যর্থ হয় তাহলে সেই ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের উপরে দিয়ে দিয়ে থাকে ।
৭. সবাই তাকে ঈর্ষা করে এমন মনভাব পেষণ করা । তার কাছে মনে কেউ তাকে তার প্রাপ্ত অধিক সম্মান না দেওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে তারা তাকে ঈর্ষা করছে ।
৮. কাউকে সফল হতে দেখলে তার সেই সাফল্যকে ছোট করার একটা প্রবণতা দেখা যায় ।
৯.সব সময় কুটিল, অহংকারী, তাচ্ছল্যপূর্ণ এবং উদ্ধত আচরণ বা মনোভাব দেখানো । এছাড়া এরা সব নিয়মনীতি মানতে পারে না ।
১০. অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো এদের পছন্দের কাজ এবং সব অন্যের নামে বদনাম করা এদের স্বাভাবিক একটি স্বভাব ।
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের কারণ
বিশেষজ্ঞরা এখনও নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগের সঠিক কারণ নির্ণয় করতে পারে নি তবে বেশ কিছু এনপিডিতে আক্রান্ত রোগীদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে তারা কিছু সম্ভাব্য কারণ তারা নির্ণয় করেছেন ।
জেনেটিক কারণঃ গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক কিংবা শারীরিক কোন পরিবর্তনের ফলে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন । আবার পারিবারের কারো এই রোগ থাকলে সেই ক্ষেত্রেই এই রোগটি দেখা দিতে পারে ।
পারিবারিক ও সামাজিক কারণঃ বিশেষজ্ঞরা জেনেটিক কারণ থেকেও পারিবারিক ও সামাজিক কারণকে বড় করে দেখছেন এই রোগটির পেছনে । পরিবারের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্তি আদর পাওয়া ছেলে মেয়েদের ছোট বেলা থেকে এমন মনভাব গড়ে উঠতে পারে । এছাড়া আমাদের ভেতরে এমন অনেক বাবা মাই আছেন যারা নিজেদের সন্তানদের ব্যাপারে অন্ধ থাকেন, তাদের কোন দোষ দেখেও দেখেন না । এমন ভাবে বড় হওয়ার ছেলে মেয়েদের মাঝে এই রোগটি দেখা দিতে পারে । এছাড়া শিশু বয়স থেকে কেউ যখন অন্যায় অবিচারের শিকার হতেই থাকে, অবস্থার পরিবর্তন হলে তাদের মাঝেও এই রোগ দেখা দিতে পারে ।
কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ ?
এনপিডিতে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি কখনই নিজের এই রোগটিকে রোগ হিসাবে দেখেন না । তাই তাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াটা একটা কষ্টকর ব্যাপার । ক্ষেত্র বিশেষে এটা অসম্ভবও বটে । এই ক্ষেত্রে গু্রুপ থেরাপি অনেক কার্যকর হতে পারে । এছাড়া এই রোগটি সাধারণ কিশোর বয়স থেকেই দেখা দেয় । পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যদি শুরু থেকেই সচেতন হয়ে থাকে তাহলে শুরু থেকেই এই রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব ।
এনপিডি রোগে আক্রান্ত রোগীরা সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে অন্যান্য সদদ্যদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে সক্ষম নয় । তাদের আচরণের কারণে প্রায়ই তাদের সাথে অন্যান্য মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয় । ফলে দেখা যায় যে একটা সময়ের পরে তারা ব্যক্তি জীবনে একা হয়ে পড়ে । একাকীত্ব তাদের এই রোগটাকে আরো বাড়ি দেয় বহুগুণে । তাই পারিবার বন্ধুবান্ধবদের এই ব্যাপারে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিৎ ।