নিরব ঘাতক

oputanvir
4.8
(20)

স্বাধীনতার পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের খাবার পানির প্রধান উৎস ছিল পুকুর খাল বিল নদী ইত্যাদি । খাবার পানির উৎস হিসাবে এগুলো যে মোটেই ভাল কিছু নয় সেটা তো এখন আমাদের বলে দিতে হয় না । তবে সেই সময়ে এটা মানুষকে বোঝানো সহজ ছিল না । ফলে দেশে পানি বাহিত রোগ গুলো প্রায়ই দেখা দিত প্রবল ভাবে । এই পরিস্থিতির হাত রক্ষা পেতে ইউনিসেফ এবং ওয়াল্ডব্যাংক নলকূপ দিতে পুরো দেশটাকে ভরে ফেলে । তাদের লক্ষ্য ছিল দেশের প্রতিটি মানুষ পুকুর খাল বিল থেকে নয় বরং পানি খাবে বাড়ির নলকূপ থেকে ।

তবে গ্রামের কুসংস্কারাছন্ন মানুষ প্রথমে কিন্তু এই পানিকে গ্রহন করতে চায় নি । তাদের কাছে এই পানি ছিল শয়তানের পানি । যদিও তারা এই কথাটা বলেছি অন্য কোন কারণে তবে এই নিরাপদ পানিই যে এক সময়ে তাদের মরণের আরেকটা কারণ হয়ে দাড়াবে সেই কথাটা সেই সময়ে কেউ ভাবতেও পারে নি । এই ঘাতকের নাম আর্সেনিক।

আমরা সবাই চেরনোবিল দুর্ঘটনার কথা জানি । সেই দুর্ঘটনা ঘটেছিলো সেখানে তেজস্ক্রিয়তার ফলে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে অথচ আমাদের দেশে আর্সেনিক দূষণে প্রতি বছর তখন মারা যেত প্রায় ৪৩ হাজার মানুষ । বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একজন রিপোর্টার এটাকে বিশ্বের সর্ব বৃহৎ ম্যাস পয়জনিং অব পপুলেশন বলে উল্লেখ করেছেন ।

আর্সেনিকস সমস্যার সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এটার বিষক্রিয়া সাথে সাথেই বোঝা যায় না । কিন্তু যখন বোঝা যায় তখন অনেক কিছুই হাত থেকে ছুটে চলে যায় । অনেকের বেলাতে কিছুই করার থাকে না । বাংলাদেশে প্রথম আর্সেনিক রোগী সনাক্ত ১৯৯৩ সালে । বছরের পর বছর ধরে মানুষ আর্সেনিক যুক্ট পানি খেয়ে চামড়া ফুসফুস যকৃতের ক্যান্সালে আক্রান্ত হতে শুরু করে । এমন কি যদি গর্ভা অবস্থায় মায়ের থেকে সন্তানের শরীরেও যেতে পারে আর্সেনিক ।

তখনকার পরিস্থিতি একবার কল্পনা করে দেখুন । নলকূপের পানি খেলে আর্সেনিক হবে আর খাল বিলের পানি খেলে হবে পানিবাহিত রোগ । মানুষ তাহলে খাবে কি ! দুই হাজার দিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংখ্যা তার রিপোর্টে বলে যে আমাদের দেশের তিন থেকে সাত কোটি মানুষ আর্সেনিক পানি খাচ্ছে প্রতিদিন । সেই সময়ে পুরো দেশে প্রায় এককোটির উপরে নলকূপ ছিল। এই বিপুল সংখ্যাক নলকূপের সব গুলো পরীক্ষা করা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার ছিল । তারপরেও এই কাজটা করতে হয়েছিলো । পুরো দেশেকে আগে ৬৪টা জেলায় ভাগের পর জেলার আন্ডারে আরও ছোট ছোট সাব সেক্টরে ভাগ করা হয় । এরপর হিসাব করা হয় যে প্রতিটা সাব সেক্টরের কতগুলো বাড়ির নলকূপ পরীক্ষা করে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাবে যে কোন কোন এলাকাতে আর্সেনিক বিদ্যমান ।

মোটামুটি ১২ শতাংশ একালাতে আর্সেনিকের উপস্থিতির পরিমান ছিল বিপদজনক । এটা কিন্তু বড় একটা পরিমান । এই সমস্যার একটা সহজ সমাধান ছিল গভীর নলকূপ । আর্সেনিক মাটির যেই স্তরে থাকে গভীর নলকূপের পানি তারও নিচের স্তর থেকে আনা হয় । সেই হিসাবে এই নলকূপের পানি পান করা নিরাপদ । সেই সময় অগভীর নলকূপের পানি ব্যবহারের ব্যাপারে অনুৎসাহিত করতে ব্যাপক প্রচার চালানো হয় । মানুষ ধীরে ধীরে আবার গভীর নলকূপের পানি খেতে শুরু করে ।

২০০৩ সালে শেষবার যখন পরীক্ষা করা হয়েছিলো তখন জানা যায় দেশের মোট ২১ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক আছে । অন্য দিকে ২০১৯ সালে এক প্রকল্পে জানা যায় যে দেশের ১০টি পার্বত্য জেলা বাদদিয়ে বাকি ৫৪টি জেলাতেই কমবেশি আর্সেনিক বিদ্যমান । ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত যত নলকূপ পরীক্ষা করা তার ভেতরে ১৩.৯১ শতাংশ । সব থেকে বেশি গোপাগঞ্জে প্রায় ৫২ শতাংশ ।চাঁদপুরে ৫১, কুমিল্লায় ৪৪ শতাংশ ।

আপাতদৃষ্টিতে সমস্যার সমাধান হয়েছে মনে করলেও দেখা দেয় নতুন সমস্যা । কিছু সময়ে খেয়াল করে দেখা যায় যে যারা গভীর নলকূপের পানি পান করতে তারা অগভীর নলকূপের পানি পান কারীদের থেকে বেশি রোগাক্রান্ত হচ্ছে !
কিন্তু হিসাব মত এমন তো হওয়ার কথা না । নলকূপ যত গভীর পানিও তো তত বিশুদ্ধ হওয়ার কথা । তাহলে এমনটা কেন হচ্ছে ?

একদল বিজ্ঞানী এই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মজার এক তথ্য বের করেন । তথ্যটা হচ্ছে গভীর নলকূপ স্থাপনের খরচ তুলনা মুলক ভাবে অনেক বেশি । তাই দেখা যেত যে এই নলকূপের পরিমান খুব বেশি ছিল । গ্রামে একটা কী দুইটা ছিল । মানুষ একবারে বেশি পরিমান পানি বাসায় এনে রাখতো । এটাই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার । পানির উৎস যদি আপনার বাড়ি থেকে দুরে হয় তাহলে আপনি চাইবেন যে বেশি করে পানি এনে রাখতে । এই বেশি পানি যত সময় ধরে পাত্রে থাকতো পানি দূষণের পরিমান তত বৃদ্ধি পেত ।

আর্সেনিক সমস্যা কিন্তু আমাদের ভেতর থেকে চলে যায় নি । এটা এখনও আমাদের মাঝেই রয়ে গেছে । তবে আগের মত সচেতনা আমাদের মাঝে নেই । এই নিরব ঘাতের হাতে প্রতিবছর হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে ।

তথ্য সুত্রঃ

প্রথম আলো পত্রিকা। হাসান উজ জামান শ্যামল এর বই এটাই সায়েন্স

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 20

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →