রিমি আর আমার গল্প

oputanvir
4.6
(82)

দুপুরের কিছু আগে পিয়ন এসে জানালো যে আমার কাছে একজন গেস্ট এসেছে । আমার সাথে দেখা করতে চায় । একটু অবাক হলাম । কারণ আমার কাছে আসার আগে আমাকে সবাই ফোন করে আসে সাধারনত । কে এমন যে ফোন না করেই চলে এসেছে !
কৌতুহল নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে হাজির হয়ে দেখি রিমি বসে আছে । আমাকে ঢুকতে দেখেই ফিক করে হেসে ফেলল । আমি বললাম, আসবি আগের থেকে ফোন দিবি না ?
রিমি বলল, তোমাকে সারপ্রাইজ দিলাম ।
-কী আমার বাহারী সারপ্রাইজ ! কেন এসেছিস?
-বারে আসতে পারি না?
-আমি কাজ করছি । কাজের সময় কেন এসেছিস বল ?
-আমি তোমার সাথে লাঞ্চ করতে এসেছি ।

আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । মেয়েটা দেখলাম বেশ সেজে গুজেই এসেছে । নীল রংয়ের একটা কুর্তা পরেছে । নিচে পরেছে সাদা লেগিংস । আর কালো ওড়না । মুখে মেকাপ দিয়েছে একটু তবে ঠোঁটে একদমই লিপস্টিক দেয় নি । রিমি ঠিক জানে যে আমি কোন ধরণের পোশাক পছন্দ করি ।

আমি বললাম, আমি কাজ শেষ করি তারপর ।
-ওকে আমি অপেক্ষা করছি । তুমি কাজ শেষ করে আসো ।
আমি আমার ডেস্কে ফেরত গেলাম । হাতের কাজটা তখনও শেষ হয় নি । লাঞ্চ আওয়ার হতে এখনও কিছু সময়ব বাকি আছে । তবে কেন জানি রিমিকে একা একা বসিয়ে রাখতে ইচ্ছে হল না । কবীর ভাইকে বললাম যে একটু কাজে বের হচ্ছি লাঞ্চের পরেই বের হব। কাজটা অর্ধেক রেখেই আবার গেস্ট রুমের দিকে রওয়ানা দিলাম । আজকে একটু আগে বের হলে তেমন কিছু হবে না । আমি যখন আবার গেস্ট রুমে গিয়ে হাজির হয়েছি দেখি রিমি বের হওয়ার জন্য রেডি । যেন ও জানতোই আমি এখনই আসবো । আমার দিকে তাকিয়ে আবারও হাসলো ।

বললাম, বেশি দুরে যাবো না । ঐ যে সামনে যে রেস্টুরেন্ট টা দেখছিস । ওখানে ।
-আচ্ছা বাবা আচ্ছা । চল তো !

রিমি সম্পর্কে আমার কাজিন । ছোট চাচার বড় মেয়ে । আমার থেকে বছর পাঁচের ছোট । ছোট বেলা থেকে আমার সাথে বড় হয়েছে । ওকে ধরে কত যে মেরেছি তার কোন ঠিক নেই । তবে আমার হাতে এতো মাইর খেয়েও কোন দিন আমার পিছু ছাড়ে নি । সব সময় আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো । যখন পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকাতে চলে এলাম সব থেকে বেশি কান্না কাটি রিমিই করেছিলো ।

আমি চাকরিতে ঢুকতে না ঢুকতেই রিমি ঢাবিতে ভর্তি হয়ে গেল । তখন থেকে আবার নিয়মিত আমাদের দেখা হত বেশ । রিমিই আসতো বিশেষ করে । আমাকে নিয়ে এদিক ওদিক যেত । আমার পকেট থেকে টাকা খরচ করাতো আর কি !

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে রিমি একটানা বকবক করেই চলেছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী নিয়ে চিন্তিত শুনি?
-আর বলিস না । বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে । এখন নতুন বাসা কই পাই ।
-কেন এতো বাসা । খুজে পাচ্ছো না?
-বাসা পাবো না কেন কিন্তু ব্যাচেলরকে বাসা দিবে কে শুনি?
-বিয়ে করে ফেলো ।
-এতো ঝামেলা একবারে নিতে পারবো না ।
-তাহলে এক কাজ কর আমাকে বউ বানিয়ে নিয়ে যাও । বলবে যে নতুন বিয়ে করেছি ।

কথাটা বলেই রিমি হেসে ফেলল । কথাটা প্রথমে শুনতে হাস্যকর মনে হলেও আমার কেন জানি মনে ধরলো । বললাম, করা যায় কিন্তু !
-করবে?
-হ্যা । তোকে বউ সাজিয়ে নেওয়া যায় । আর তুই তো আসিসই । খুব একটা ঝামেলা হবে না মনে হয় ।
রিমি বলল, কিন্তু…
-কিন্তু কী?
-চাচী যদি জানে ?

আমি একটু চুপসে গেলাম । মা যদি এই ব্যাপারে জানে তাহলে অবশ্য ঝামেলা হবে । অজানা কোন কারণে আমার মা রিমিকে পছন্দ করে না । আমার তিন চাচা আর দুই ফুফুর মোট ১২ জন ছেলে মেয়ে । এদের ভেতরে আমার মা কেবল রিমিকে পছন্দ করে না । এমন কি রিমি ছোট একটা ভাই একটা বোন আছে তাদের আদর করে কিন্তু রিমিকে করে না । কেন যে করে না সেটা কেউ জানে না । তবে একটা কারণ হতে পারে যে ছোট বেলাতে একবার রিমি আমার মাথা ফাঁটিয়ে দিয়েছিলো ইট মেরে । যদিও শুরুটা আমিই করেছিলাম ।
অবশ্য রিমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারে নি যে এমন ভাবে আমার মাথা কেটে যাবে । আমার থেকে ও নিজেই বেশি ভয় পেয়েছিলো । আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো একদিন ।
আমি বললাম, মা কে না বললেই হল । তুমি মুখ না খুললেই হল !

তাই ঠিক হল । পরের শুক্রবার রিমিকে নিয়ে হাজির হলাম এক বাসায় । বাসাটা ছোট দুই রুমের । প্রথম দেখাতেই পছন্দ হল বাড়িওয়ালা বললাম যে আমরা নতুন বিয়ে করেছি । প্রথমে বাড়িওয়ালা একটু সরু চোখে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে তবে রিমি এমন আচরণ শুরু করলো যে সত্যিই ও আমার বিয়ে করা বউ । আমরা মোটামুটি সবই সত্য কথা বললাম । জানালাম যে আমি চাকর করি, ও পড়াশোনা করে । বিয়ে করেছি ছয়মাস । ও হলে থাকে আমি ব্যাচেলর মেসে থাকতাম । এখন মনে হচ্ছে দুজনের একসাথে থাকা দরকার ।
কাজ হয়ে গেল । বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিয়ে দিল ।

বাসায় উঠে পড়লাম । জিনিস পত্র খুব বেশি ছিল না । রিমি আমার সাথেই ছিল সব সময় এবং সব থেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে ও নিজে আমাকে অনেক সাহায্য করলো । এরপর আমার জীবন শেষ সহজ হয়ে গেল । সত্যি বলতে কি সব টুকুই হল রিমির কারণেই । ও প্রায় দিনই ক্লাস শেষ করে আমার বাসায় এসে হাজির হত। ঘর দোর সব নিজেই সামলাতো । দুই রুমের একটা রুম ও নিজে দখল করে নিল থাকার জন্য । যদিও প্রতিদিন থাকতো না তবে প্রায়ই আসতো ।

কিন্তু জীবনে ঝামেলা থাকবে তা তো হয় না । কিভাবে জানি আমার মা জেনে গেল এই কথা । আমাকে কিছু বলল না তবে রিমিকে কিছু নিশ্চয়ই বলল । কী বলল সেটা আমি জানি না । পরের দিন দেখি ও নিজের সব জিনিস পত্র নিয়ে চলে যেতে উদ্যোত হল । আমি ওকে থামালাম । গেট দিয়ে বের হতে যাচ্ছিলো তার আগেই ওকে ধরে ফেললাম । বললাম, কী হয়েছে?
রিমি কিছু বলল না । তবে ওর চেহারা আমি ভাল করে খেয়াল করে বুঝলাম যে রিমি কান্নাকাটি করেছে ।
বললাম, বলবি তো কী হয়েছে?
-কিছু না । তোমার এখানে আসাটা আমার উচিৎ হচ্ছে না ।
-মা ফোন দিয়েছিলো?
রিমি কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকালো । কান্না আটকানোর প্রবল চেষ্টা করছে। তখনই বুঝলাম যে মা ফোন দিয়েছিলো । আমি জোর করে ওর হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলাম । তারপর আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । তখনই অনুভব করলাম যে ও হু হু করে কেঁদে উঠলো । এতো তীব্র ভাবে কান্না করে উঠলো যে আমি নিজেই খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম । বুঝতে পারলাম যে মা খুব ভাল করেই ওকে কথা শুনিয়েছে ।

ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, মায়ের কথাই মন খারাপ করিস না ।
কান্না বিরজিত কন্ঠে রিমি কোন মতে বলল, আমি কী করেছি বল ! আমাকে চাচী কেন পছন্দ করে না ?
-আচ্ছা মন খারাপ করিস না ।

তখন হঠাৎ আমার কী মনে হল বললাম, বেড়াতে যাবি?
রিমি তখনও আমার বুকেই মাথা গুজে কান্নাকাটি করছে ।
-জানি । যেখানে ইচ্ছে । যাবি ?
-কক্সবাজার নিয়ে যাবা?

আমি একটু ইতস্তর করলাম । এখন কক্সবাজার যাওয়া বেশ ঝামেলা । কিন্তু তারপর মনে হল যে যাওয়াই যায় । কেবল অফিস থেকে একদিন ছুটি নিলেই চলবে । তখনই কী যে আমি বললাম, চল আজই চল ।
-সত্যি ?
-হ্যা । দাড়া আমি অফিসে ফোন দিয়ে ব্যবস্থা করি ।

ছুটি মেনেস করতে সময় লাগলো না । ঘন্টা দুয়েকের ভেতরেই আমরা বের হয়ে গেলাম । কক্সবাজার যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা । হোটেলে চেক ইন করলাম ।

রাতে লম্বা একটা সময় সমুদ্রে হাটাহাটি রকলাম । রিমিকে কেন জানি খুব বেশি আনন্দিত মনে হল আমার কাছে । বেশ রাত করে হোটেল রুমে ফিরলাম । ডাবল বেডের একটা রুমই নিয়েছি আমরা থাকার জন্য । রাত যখন শুয়েছি রিমি অন্য বিছানা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মা জানতে পারলে কী হবে ভেবে দেখেছো?
-নাহ। ভাবতে চাই না আপাতত । এখন ঘুমা ।

আমি আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম । তবে একটু পরে অনুভব করলাম যে রিমি নিজের বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে শুয়েছে । আমার কানে ফিসফিস করে বলল, তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরে ঘুমাই?
আমি সত্যিই অবাক হলাম । রিমির কন্ঠে আসলে অন্য কিছু ছিল। ঢাকাতে আমার ফ্লাটে ও অনেক দিন ধরেই রয়েছে । একেবারে আমরা বাসাতে যেমন করে থাকতাম ঠিক তেমন করেই । কোন দিন কিছু মনে হয় নি । কিন্তু আজকে রিমির কী হল !

আমি ওকে কোন ভাবেই মানা করতে পারলাম না । কোন ছেলের পক্ষেই এই আহবান মানা করা সম্ভব না । রাতের বেলা দুজন প্রবল আদিম খেয়াল ভেসে চললাম । আমাদের মাঝে সব কিছু বদলে গেল ।

সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন দেখলাম রিমি আগেই উঠে গেছে । এমন কি ওয়াশরুমেও নেই । বুঝলাম যে বাইরে গেছে । আমিও ওর খোজে বের হলাম । একটু যে অস্বস্থি লাগছিলো না সেটা বলবো না তবে ভালও লাগছিলো ।
রিমিকে পেলাম সৈকতেই । একটা বিচ চেয়ারে বসে আছে । আমি সামনে গিয়ে দাড়াতেই আমার দিকে তাকালো তারপর চোখ সরিয়ে নিল । আমি বললাম, কখন উঠেছিস?
-অনেক সকালে !
-আমাকে ডাকতি!
-তুমি ঘুমাচ্ছিলে । তাই আর ডাকি নি । বস ।

ওর পাশে বসলাম । কিছু বলতে চাইলাম বটে তবে বলতে পারলাম না । পুরোটা দিন আমরা এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করলাম । তবে রাতে আমাদের মাঝে যা হয়েছে সেটা নিয়ে একটা কথাও বললাম না । তবে আমাদের মাঝে যে আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে সেটা আমরা দুজনই বেশ ভাল করেই বুঝতে পারলাম ।

ঢাকায় ফিরে এসে প্রথম কয়েকদিন রিমি আমার ধারে কাছেও এল না । না ফোন না মেসেজ কিছুই না । আমি কয়েকবার নক দেওয়ার পরেও ও উত্তর দিল না । সপ্তাহ দুয়েক এই ভাবে কাটলো । তারপর এক শুক্রবারে রিমি আমার বাসায় এসে হাজির ।

আমি তখন টিভি দেখছিলাম । সামনে কফির একটা কাপ রাখা । সকালে কফি খাওয়ার অভ্যাস আমার । ওর কাছে দরজার চাবি ছিল । সেটা দিয়েই ভেতরে ঢুকলো । ছুটির দিনে আমি বেলা করে ঘুমাই এটা ভেবেছিল । আমি এতো সকালে উঠবো ভাবে নি । তবে আমার চোখের সাথে চোখ পড়াতে অপ্রস্তুত হল না । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর আমার সামনেই বসলো । আমি বললাম, ইগ্নোর কেন করছিস আমাকে শুনি?
রিমি কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, প্রথম কথা হচ্ছে এখন থেকে আমাকে তুই করে বলবে না আর ! আমার ভাল লাগে না ।
-ওকে । পরের কথাটা কী?
-ঐদিন আমাদের মাঝে যা হয়েছে ……
আমি একটু থেমে বললাম, হ্যা ঐদিন
আমিও কথা শেষ করলাম না । রিমি বলল, আমি আবারও করতে চাই !

আমি তখন সবে মাত্র কফিতে একটা চুমুক দিয়েছি রিমির কথা শুনে সেটা মুখ থেকে বের হয়ে এল । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম রিমির দিকে । ও যে এই কথা বলবে সেটা আমি বুঝতেই পারি নি । কোন মতে বললাম, কী বললি?

-এভাবে তাকিয়ে থেকো না তো। যা বলেছি বেশ করেছি ।
-তুই আসলেই দেখি বদ হয়ে গেছিস !
-ইস আমার ভদ্র ছেলেরে ! ঐ দিন কী করেছিলে মনে নেই ?
-আমি করেছি ।
-অবশ্যই তুমি করেছো !

আমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তবে কেন জানি হাসি চলে এল । তারপর বলল, এই কদিন কেন আসিস নি?
-জানি না । নিজের কাছে কেমন যেন লাগছিলো ।
রিমি একটু চুপ করে রইলো । তারপর বলল, নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো যে আমি বুঝি তোমাকে …ব্যবহার করেছি ! আমি জানি আমি যদি ঐদিন নিজ থেকে এগিয়ে না আসতাম তাহলে এই রকম কিছুই হত না । আমি …

আমি এবার উঠে গিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলাম । তারপর ওর হাত ধরে বললাম, চল বিয়ে করে ফেলি । এবার সত্যি সত্যি !
রিমি একভাবে কেবল তাকিয়ে রইলো আমার দিকে । আমি বললাম, তুমি কি ভাবিস আমি তোর মনের খবর জানি না । কেবল মায়ের কারণে তুই আমাকে কিছু বলিস না সেটাও আমি জানি ।
-চাচী কোন দিন আমাকে মেনে নেবে না ।
-সে চিন্তা তোর করতে হবে না । তুই বিয়ে করবি কিনা বল !

আমার বলে দিতে হল না । রিমির চোখ দেখেই মনে হচ্ছিলো যে ও আমার মুখ থেকে এই কথা শোনার জন্য কত অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা ছিল ।

ঐদিন বিকেলেই বিয়ে করে ফেললাম । বাসায় কিছুই জানাই নি। কিভাবে জানাবো সেটাও ভেবে দেখি নি । কোন এক সময়ে তারা জেনে যাবে এমনিতেও । তখন যা হবে ভেবে দেখা যাবে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 82

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →