দুপুরের খাবার সময়টা আমি সাধারনত একা একাই খাওয়া দাওয়া করি । আমার অফিস ক্যান্টিনটা বেশ মান সম্মত । বলতে গেলে সেখানে সবাই যায় লাঞ্চ কিংবা অন্য যে কোন অযুহাতে । সেখানে একটা লম্বা সময়ও তারা থাকে । আমি কেন যেন গিয়ে বসতে পারি না খুব একটা । নিজেকে কেমন যেন অবাঞ্চিত মনে হয় । কারণটা আমার আসলে জানা নেই । আমার মনে হয় যে অন্যান্য কর্মীরা হয়তো আমাকে ঠিক মত মেনে নিতে পারে না সেখানে । এটা আমার নিজের হীনমন্নতা বলা যায় । আসলে যে মানুষ এতিম খানাতে মানুষ হয়েছে হঠাৎ করেই একটা বড় কর্পোরেট অফিসে চাকরি পেয়ে গেলে তার অবস্থা আমার মতই হওয়ার কথা । এই কারণে আমি নিজেকে খানিকটা লুকিয়ে রাখি সব সময় । সবার কাছ থেকে আড়ালে রাখি ।
আজও নিজের ডেস্কে বসেই দুপুরের খাওয়া শেষ করে মোবাইলে ফেসবুক ব্রাউজ করছিলাম তখন পিওন এসে বলল, স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে?
-এখন ?
-ক্লাইন্ট কোন?
-এক ম্যাডাম!
আমি একটু অবাক হলাম । আমার ক্লাইন্ট হলে অফিসে আসার আগে আমার সাথে যোগাযোগ করেই তারা আসে । তাহলে এখন কে এল?
আমি গেস্ট রুমে হাজির হলাম । এই সময়ে গেস্টদের কেউই বলতে গেলে থাকে না । দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম মেয়েটাকে । আমাকে ঢুকতে দেখে উঠে দাড়ালো । পোশাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হল মেয়েটি বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে । এই মেয়ে আমার কাছে কী চায়?
-আমি সুমন আহমেদ ।
মেয়েটি একটু ইতস্তর করতে করতে উঠে দাড়ালো । আমি বললাম, আরে উঠতে হবে না । বসুন ।
মেয়েটি আবার বসে পড়লো । তারপর খানিকটা দ্বিধা নিয়েই বলল, আমি নওরিন চৌধুরী । আমার বাবার নাম আকরব আহমেদ চৌধুরী !
নামটা শুনেই আমি স্থির হয়ে গেলাম। বুঝতে কষ্ট হল না যে মেয়েটা কে ? তবে এই মেয়ে ঠিক কেন এসেছে আমার কাছে সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না । হিসাব মত তো এই মেয়ের এখানে আসার কোন কারণ নেই ।
আকবর চৌধুরী জন্মদাতা পিতা । যদিও সমাজের চোখে সেটা বৈধ কিছু নয় । হ্যা এই সত্যতা আমি জানতে পেরেছি মাস খানেক আগে । আমি যে এতিম খানাতে বড় হয়েছি সেখানে আমার বাবার মায়ের ব্যাপারে কোন তথ্যই ছিল না । কেবল আমি জানতাম যে কোন এক সন্ধ্যায় একজন মহিলা আমাকে এখানে রেখে যায় । ব্যাস আর কিছু নেই আমার ব্যাপারে । এটা নিয়েই আমি বড় হয়েছি । সেই মহিলাই সম্ভবত আমার মা ছিলেন এমনটা আমি মনে করতাম ।
তবে মাস খানেক আগে এক বৃদ্ধ কোথা থেকে উদয় হলেন । একেবারে আমার বাসায় এসে হাজির হলেন । তিনি জানালেন যে আমার আগের এতিম খানা থেকে তিনি আমার বাসার ঠিকানা জোগার করেছেন । আমি এতিমখানা থেকে চলে এলেও নিয়মিত ওখানে যাতায়াত করি । সত্যি বলতে আমার পরিবার বলতে ওরাই রয়েছে । সেই মহিলাই আমাকে জানালেন যে তিনিই সেই মহিলা যিনি আমাকে ওখানে রেখে এসেছিলেন । এবং তিনি আমার মা নন।
সেদিনই আমি জানতে পারি যে আমার আসলে বেঁচে নেই । আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে সে মারা গেছে । যে ক্লিনিকে আমার মায়ের মৃত্যু হয় সেই ক্লিনিকে এই মহিলা আয়ার কাজ করতেন । তারপর তিনি যা বললেন তাতে মোটামুটি আমার পুরো পৃথিবীই খানিকটা নড়ে উঠে । ঐ মহিলার কাছ থেকেই জানতে পারি যে আমার বাবার নাম কী !
আমার বাবা এই সমাজের একজন নামীদামী ব্যবসায়ী । আমার মা কিশোরী বয়সে তাদের বাসায় কাজ করতো । তখন আকবার চৌধুরীর বয়স ছিল কম । মায়ের সাথে একটা অবৈধ সম্পর্কে তৈরি করে সে । কিন্তু যখন দুর্ঘটনা ঘটে যায় তখন আকবর চৌধুরীর বাবা ব্যাপারটা ভাল ভাবেই সামলে দিলেন । আমার মাকে ভয় ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলেন । আজ থেকে ৩০ বছর আগে তো এতো সব কিছু এমন ছিল না । এখন যেমন সব কিছু এতো সহজে ধামা চাপা দেওয়া যায় না । ফেসবুকে চাইলে ই যে কিছু বলা যায় কিন্তু তখন এসব করা যেত না ।
কয়েকটা দিন আমার বড় অশান্তিতে কাটলো । আমি এতোদিন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আসতাম যে আমার মা আমাকে দুরে ঠেলে দিয়েছে । সেই মোতাবেগই তাকে ঘৃণা করতাম কিন্তু এখন দেখি তার তো আসলে কোন দোষই নেই । তাকে খামোখা এতোদিন ঘৃণা করে এসেছি । আসল কার্লপ্রিট তো অন্য জন । কেন জানি তার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হল । সপ্তাহ খানেক আগে তাই তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম । ভেবেছিলাম তার সাথে দেখা করাটা সহজ হবে না তবে আমি কেবল আমার মায়ের নাম বলে তার কাছে খবর পাঠানোর পরেই দেখলাম ভেতরে যাওয়ার অনুমূতি মিলল । তার মানে সে আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছে !
কিছু সময় আমরা কেবল একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম । তার বয়স হবে ৫০এর মত । এখনও বেশ ইয়াংই মনে হচ্ছে দেখে । আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় তারপর বলল, কী চাও ?
আমি শান্ত মুখে বললাম, আপনার কাছে আসলে আমার কিছু চাওয়ার নেই ।
-তাহলে কেন এসেছো?
-একবার দেখা করতে এলাম কেবল । ভয় পাবেন না আমি ৩০ বছর আপনাকে ছাড়া বেঁচে আছি, জীবনের বাকি সময়েও আপনার দরকার পড়বে না । আর আমার টাকা পয়সার খুব একটা দরকারও নেই । আমি খুব ভাল একটা চাকরি করি । আপনি দয়া করে এই চিন্তা করবেন না যে আপনাকে ব্লাকমেইল করে আমি টাকা নিতে এসেছি ।
কথা গুলো বলে কিছু সময় কেবল তাকিয়ে রইলাম কেবল। দেখলাম একটু আগে যে কঠিন চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল এখন আর সেটা নেই । আমি আবার বললাম, আমি কেবল দেখতে চেয়েছিলাম যে বীর্যদাতা কাপুরুষ পিতা আসলে দেখতে কেমন ! জানেনই তো ঘৃণা করতে গেলে চেহারা যদি জানা যায় তাহলে ঘৃণার পরিমানটা বেশি ।
আমি আর কিছু না বলে উঠে চলে এলাম । আমি ভেবেছিলাম যে তার সাথে সেখানেই আমার শেষ দেখা হবে । আমি কোন দিন তার সামনে গিয়ে হাজির হব না কিংবা তার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবো না । কিন্তু এই মেয়ে যে এখানে এসে হাজির হবে সেটা তো ভাবি নি ।
নওরিন তাহলে সম্পর্কে আমার বোন হয় । যদিও এসবের কোন মানে নেই । আমি বললাম, বলুন কেন এসেছেন?
নওরিন বলল, আপনি কি আমার সাথে একটু আমাদের বাসায় আসবেন?
-কেন?
-বাবা খুব অসুস্থ হয়ে গেছেন কদিন থেকে ।
-আপনার বাবা অসুস্থ হয়েছে । এখানে আমার কী করা আছে বলুন ? আমি তো আর ডাক্তার নই । ভাল ডাক্তারের ব্যবস্থা করুন !
-বাবা আসলে আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন!
-আমি তার সাথে দেখা করতে চাই না । এটা তাকে বলে দিন । পরিস্কার ভাবেই বলে দিন । সে বাঁচুক মরুক, অসুস্থ হোক ভাল থাকুক তাতে আসলে আমার কিছুই যায় আসে না । এটাও তাকে বলে দিবেন । আপনি এখন আসুন । আমার কাজের সময় হয়ে গেছে ।
আমি নওরিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে এলাম নিজের ডেস্কে । তবে সত্যি বলতে নিজের মনে শান্তি পেলাম না । বারবার নিজেকে কেবল বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমার আসলে কিছুই যায় আসে না । তবে একটা সময় বুঝতে পারলাম যে আমার মন বলছে তার সাথে দেখা করতে ।
নওরিন পরের একটা সপ্তাহ প্রতিদিন এই অনুরোধ নিয়ে আসল । কাতর হয়ে বলতো যেন আমি একটা বার যাই তার সাথে । শেষে একটা সময় আমার মনের দেয়াল ভেঙ্গে গেল ।
সপ্তাহ দুয়েক আগে যখন আকবর চৌধুরীকে দেখেছিলাম তখন কঠিন চরিত্রের মানুষ মনে হয়েছিলো । তবে এই দুই সপ্তাহে তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল যে বড় অসহায় একজন মানুষকে দেখছি । বয়স যেন বেড়ে গেছে অনেক বেশি । ঘরের ভেতরে এক মাঝ বয়সী মহিলা বসে আছেন । আমাকে দেখে সে একভাবে তাকিয়ে রইলো । বুঝতে অসুবিধা হল না যে ইনি আকরব চৌধুরীর স্ত্রী । সে উঠে গিয়ে আমাকে বসার জন্য টুলটা ছেড়ে দিল । আমি ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম । তারপর বসলাম টুলের উপরে ।
আমি বসতেই সে আমার হাত ধরলো । আমি কেন জানি হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারলাম না । কিছুটা সময় সে আমার হাত ধরে বসে রইলো । তারপর বুঝতে পারলাম তিনি কাঁদছেন । একটা সময়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, নীলুফার আমাদের বাসায় কাজ করতো না । সে আমার দুরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল, তার কেউ ছিল না বলে আমার মা তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলো । সেই কিশোরী মেয়েটাকে আমার প্রথম দেখাতেই ভাল লাগে । আমি তাকে নিজের মত করে পেতে চেয়েছিলাম । বিয়ে করতে চেয়েছিলাম । তবে আমার বাবা তা চায় নি । আমার তখন কিছুই করার ছিল না । আমি …. আমি জানতামই না যে …।
বলতে বলতে তিনি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন । আমি বললাম, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি শান্ত হয়ে শুয়ে থাকুন ।
তিনি শান্ত হলেন না সহসাই । আরো কত কিছু বলতে লাগলাম । আমি একমনে সে সব শুনতে থাকলাম । কেন জানি এই প্রলাপ আমার শুনতে ভাল লাগছিলো ।
দেখলাম একটা সময় একজন ডাক্তার এল । তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল ইঞ্জেকশন দিয়ে । সে ঘুমিয়ে গেলে আমি উঠে পড়লাম । দরজা দিয়ে বের হয়ে যখন বসার ঘরে এসেছি তখন নওরিনের মা পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডাকলেন ।
-একটু বসবে বাবা!
আমি বসলাম । সেও বসলো আমার সামনের সোফাতে । তারপর বলল, তোমার বাবা যা বলেছে সে সব কিন্তু মিথ্যা না । বিয়ের একদম প্রথমদিনই সে তোমার মায়ের কথা আমাকে জানিয়েছিলো । তার প্রতি তোমার বাবার ভালবাসায় আমি কখনই খাদ দেখতে পাই নি । তোমার দাদা তাকে বিশ্বাস করিয়েছিলো যে বাচ্চা এভোর্ট করতে গিয়ে তুমি আর তোমার মা মারা গেছ । সেই সার্টিফিকেটও সে দেখিয়েছিলো । সে যদি জানতো তুমি বেঁচে আছো তোমাকে সে খুজে বের করতোই ।
আমি কী বলবো সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না । সে আবার বলল, তোমার রাগ জায়েজ আমি জানি । তবুও যদি সম্ভব হয় তাহলে তোমার বাবাকে মাফ করে দিও ।
আমি চলে আসার সময় দেখতে পেলাম নওরিন দাড়িয়ে রয়েছে দরজার কাছে । তার সাথে আরও একজন মেয়ে । চেহারা দেখে মনে হল এটা নওরিনের বোন । আমি তার দিকে তাকিয়ে বলল, কী নাম তোমার?
-অরিন ।
আমি আর কিছু বললাম না । নওরিন বলল, আপনি আর আসবেন না?
-জানি না ।
-আসবেন । প্লিজ আসবেন ।
আমারও কেন জানি মনে হল যে আমাকে আবারও আসতে হবে ।
পরের দিন অফিস শেষ হওয়ার কিছু আগে আমাকে অবাক করে দিয়ে অরিন আমার অফিসে এসে হাজির । আমি যখন অফিস থেকে বের হচ্ছি দেখতে পেলাম ও দাড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ওপাশে । পরনে স্কুল ড্রেস । আমি অবাক ভাবটা কাটিয়ে উঠতেই দেখলাম ও রাস্তা পার হয়ে আসতে চাচ্ছে । আমি ওকে হাতের ইশারাতে থামিয়ে দিয়ে নিজেই গিয়ে হাজির হলাম । বললাম, কী ব্যাপার তুমি এখানে?
-আমার কোচিং এই খানে । শেষ হল একটু আগে । ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই ।
তারপর ব্যাগ থেকে একটা বড় ডেইরি মিল্কের চকলেট বের করে দিল আমার দিকে । বলল, এটা তোমার জন্য ।
আমার মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করলো । এই অচেনা অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই । চকলেটটা নিতে নিতে বললাম, কিছু খাবে তুমি?
-চটপটি খেতে চাই কিন্তু আম্মু খুব বকবে ।
আমি হেসে ফেললাম । বললাম, চল আমি কিনে দিচ্ছি । আমি কিছু বললেন বলবে যে আমি খাইয়েছি । তাহলে কিছু বলবে না ।
দেখলাম অরিনের মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো ।
অরিন যখন চটপটি খাচ্ছিলো আমার মনে সেই আনন্দের অনুভূতি টুকু এসে হাজির হল । বড় ভাই তার ছোটবোনকে চটপটি খাওয়াচ্ছে, চোট বোন পটপট করে কথা বলেই যাচ্ছে । একেবারে কোন পার্ফেক্ট পরিবারের গল্প যেন । আমি কোন দিন কি ভেবেছিলাম যে আমার কপালেও এমন একটা দিন এসে হাজির হবে !
কেউ ভাবে নি । এ যেন এক রূপকথার গল্প ।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
অপু তানভীর মানেই অন্যরকম!
ভালবাসা অভিরাম!♥