রূপকথার গল্প

oputanvir
4.8
(103)

দুপুরের খাবার সময়টা আমি সাধারনত একা একাই খাওয়া দাওয়া করি । আমার অফিস ক্যান্টিনটা বেশ মান সম্মত । বলতে গেলে সেখানে সবাই যায় লাঞ্চ কিংবা অন্য যে কোন অযুহাতে । সেখানে একটা লম্বা সময়ও তারা থাকে । আমি কেন যেন গিয়ে বসতে পারি না খুব একটা । নিজেকে কেমন যেন অবাঞ্চিত মনে হয় । কারণটা আমার আসলে জানা নেই । আমার মনে হয় যে অন্যান্য কর্মীরা হয়তো আমাকে ঠিক মত মেনে নিতে পারে না সেখানে । এটা আমার নিজের হীনমন্নতা বলা যায় । আসলে যে মানুষ এতিম খানাতে মানুষ হয়েছে হঠাৎ করেই একটা বড় কর্পোরেট অফিসে চাকরি পেয়ে গেলে তার অবস্থা আমার মতই হওয়ার কথা । এই কারণে আমি নিজেকে খানিকটা লুকিয়ে রাখি সব সময় । সবার কাছ থেকে আড়ালে রাখি ।

আজও নিজের ডেস্কে বসেই দুপুরের খাওয়া শেষ করে মোবাইলে ফেসবুক ব্রাউজ করছিলাম তখন পিওন এসে বলল, স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে?
-এখন ?
-ক্লাইন্ট কোন?
-এক ম্যাডাম!

আমি একটু অবাক হলাম । আমার ক্লাইন্ট হলে অফিসে আসার আগে আমার সাথে যোগাযোগ করেই তারা আসে । তাহলে এখন কে এল?

আমি গেস্ট রুমে হাজির হলাম । এই সময়ে গেস্টদের কেউই বলতে গেলে থাকে না । দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম মেয়েটাকে । আমাকে ঢুকতে দেখে উঠে দাড়ালো । পোশাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হল মেয়েটি বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে । এই মেয়ে আমার কাছে কী চায়?

-আমি সুমন আহমেদ ।
মেয়েটি একটু ইতস্তর করতে করতে উঠে দাড়ালো । আমি বললাম, আরে উঠতে হবে না । বসুন ।
মেয়েটি আবার বসে পড়লো । তারপর খানিকটা দ্বিধা নিয়েই বলল, আমি নওরিন চৌধুরী । আমার বাবার নাম আকরব আহমেদ চৌধুরী !

নামটা শুনেই আমি স্থির হয়ে গেলাম। বুঝতে কষ্ট হল না যে মেয়েটা কে ? তবে এই মেয়ে ঠিক কেন এসেছে আমার কাছে সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না । হিসাব মত তো এই মেয়ের এখানে আসার কোন কারণ নেই ।

আকবর চৌধুরী জন্মদাতা পিতা । যদিও সমাজের চোখে সেটা বৈধ কিছু নয় । হ্যা এই সত্যতা আমি জানতে পেরেছি মাস খানেক আগে । আমি যে এতিম খানাতে বড় হয়েছি সেখানে আমার বাবার মায়ের ব্যাপারে কোন তথ্যই ছিল না । কেবল আমি জানতাম যে কোন এক সন্ধ্যায় একজন মহিলা আমাকে এখানে রেখে যায় । ব্যাস আর কিছু নেই আমার ব্যাপারে । এটা নিয়েই আমি বড় হয়েছি । সেই মহিলাই সম্ভবত আমার মা ছিলেন এমনটা আমি মনে করতাম ।

তবে মাস খানেক আগে এক বৃদ্ধ কোথা থেকে উদয় হলেন । একেবারে আমার বাসায় এসে হাজির হলেন । তিনি জানালেন যে আমার আগের এতিম খানা থেকে তিনি আমার বাসার ঠিকানা জোগার করেছেন । আমি এতিমখানা থেকে চলে এলেও নিয়মিত ওখানে যাতায়াত করি । সত্যি বলতে আমার পরিবার বলতে ওরাই রয়েছে । সেই মহিলাই আমাকে জানালেন যে তিনিই সেই মহিলা যিনি আমাকে ওখানে রেখে এসেছিলেন । এবং তিনি আমার মা নন।

সেদিনই আমি জানতে পারি যে আমার আসলে বেঁচে নেই । আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে সে মারা গেছে । যে ক্লিনিকে আমার মায়ের মৃত্যু হয় সেই ক্লিনিকে এই মহিলা আয়ার কাজ করতেন । তারপর তিনি যা বললেন তাতে মোটামুটি আমার পুরো পৃথিবীই খানিকটা নড়ে উঠে । ঐ মহিলার কাছ থেকেই জানতে পারি যে আমার বাবার নাম কী !

আমার বাবা এই সমাজের একজন নামীদামী ব্যবসায়ী । আমার মা কিশোরী বয়সে তাদের বাসায় কাজ করতো । তখন আকবার চৌধুরীর বয়স ছিল কম । মায়ের সাথে একটা অবৈধ সম্পর্কে তৈরি করে সে । কিন্তু যখন দুর্ঘটনা ঘটে যায় তখন আকবর চৌধুরীর বাবা ব্যাপারটা ভাল ভাবেই সামলে দিলেন । আমার মাকে ভয় ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলেন । আজ থেকে ৩০ বছর আগে তো এতো সব কিছু এমন ছিল না । এখন যেমন সব কিছু এতো সহজে ধামা চাপা দেওয়া যায় না । ফেসবুকে চাইলে ই যে কিছু বলা যায় কিন্তু তখন এসব করা যেত না ।

কয়েকটা দিন আমার বড় অশান্তিতে কাটলো । আমি এতোদিন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আসতাম যে আমার মা আমাকে দুরে ঠেলে দিয়েছে । সেই মোতাবেগই তাকে ঘৃণা করতাম কিন্তু এখন দেখি তার তো আসলে কোন দোষই নেই । তাকে খামোখা এতোদিন ঘৃণা করে এসেছি । আসল কার্লপ্রিট তো অন্য জন । কেন জানি তার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হল । সপ্তাহ খানেক আগে তাই তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম । ভেবেছিলাম তার সাথে দেখা করাটা সহজ হবে না তবে আমি কেবল আমার মায়ের নাম বলে তার কাছে খবর পাঠানোর পরেই দেখলাম ভেতরে যাওয়ার অনুমূতি মিলল । তার মানে সে আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছে !

কিছু সময় আমরা কেবল একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম । তার বয়স হবে ৫০এর মত । এখনও বেশ ইয়াংই মনে হচ্ছে দেখে । আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় তারপর বলল, কী চাও ?
আমি শান্ত মুখে বললাম, আপনার কাছে আসলে আমার কিছু চাওয়ার নেই ।
-তাহলে কেন এসেছো?
-একবার দেখা করতে এলাম কেবল । ভয় পাবেন না আমি ৩০ বছর আপনাকে ছাড়া বেঁচে আছি, জীবনের বাকি সময়েও আপনার দরকার পড়বে না । আর আমার টাকা পয়সার খুব একটা দরকারও নেই । আমি খুব ভাল একটা চাকরি করি । আপনি দয়া করে এই চিন্তা করবেন না যে আপনাকে ব্লাকমেইল করে আমি টাকা নিতে এসেছি ।

কথা গুলো বলে কিছু সময় কেবল তাকিয়ে রইলাম কেবল। দেখলাম একটু আগে যে কঠিন চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল এখন আর সেটা নেই । আমি আবার বললাম, আমি কেবল দেখতে চেয়েছিলাম যে বীর্যদাতা কাপুরুষ পিতা আসলে দেখতে কেমন ! জানেনই তো ঘৃণা করতে গেলে চেহারা যদি জানা যায় তাহলে ঘৃণার পরিমানটা বেশি ।

আমি আর কিছু না বলে উঠে চলে এলাম । আমি ভেবেছিলাম যে তার সাথে সেখানেই আমার শেষ দেখা হবে । আমি কোন দিন তার সামনে গিয়ে হাজির হব না কিংবা তার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবো না । কিন্তু এই মেয়ে যে এখানে এসে হাজির হবে সেটা তো ভাবি নি ।

নওরিন তাহলে সম্পর্কে আমার বোন হয় । যদিও এসবের কোন মানে নেই । আমি বললাম, বলুন কেন এসেছেন?
নওরিন বলল, আপনি কি আমার সাথে একটু আমাদের বাসায় আসবেন?
-কেন?
-বাবা খুব অসুস্থ হয়ে গেছেন কদিন থেকে ।
-আপনার বাবা অসুস্থ হয়েছে । এখানে আমার কী করা আছে বলুন ? আমি তো আর ডাক্তার নই । ভাল ডাক্তারের ব্যবস্থা করুন !
-বাবা আসলে আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন!
-আমি তার সাথে দেখা করতে চাই না । এটা তাকে বলে দিন । পরিস্কার ভাবেই বলে দিন । সে বাঁচুক মরুক, অসুস্থ হোক ভাল থাকুক তাতে আসলে আমার কিছুই যায় আসে না । এটাও তাকে বলে দিবেন । আপনি এখন আসুন । আমার কাজের সময় হয়ে গেছে ।

আমি নওরিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে এলাম নিজের ডেস্কে । তবে সত্যি বলতে নিজের মনে শান্তি পেলাম না । বারবার নিজেকে কেবল বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমার আসলে কিছুই যায় আসে না । তবে একটা সময় বুঝতে পারলাম যে আমার মন বলছে তার সাথে দেখা করতে ।

নওরিন পরের একটা সপ্তাহ প্রতিদিন এই অনুরোধ নিয়ে আসল । কাতর হয়ে বলতো যেন আমি একটা বার যাই তার সাথে । শেষে একটা সময় আমার মনের দেয়াল ভেঙ্গে গেল ।

সপ্তাহ দুয়েক আগে যখন আকবর চৌধুরীকে দেখেছিলাম তখন কঠিন চরিত্রের মানুষ মনে হয়েছিলো । তবে এই দুই সপ্তাহে তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল যে বড় অসহায় একজন মানুষকে দেখছি । বয়স যেন বেড়ে গেছে অনেক বেশি । ঘরের ভেতরে এক মাঝ বয়সী মহিলা বসে আছেন । আমাকে দেখে সে একভাবে তাকিয়ে রইলো । বুঝতে অসুবিধা হল না যে ইনি আকরব চৌধুরীর স্ত্রী । সে উঠে গিয়ে আমাকে বসার জন্য টুলটা ছেড়ে দিল । আমি ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম । তারপর বসলাম টুলের উপরে ।

আমি বসতেই সে আমার হাত ধরলো । আমি কেন জানি হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারলাম না । কিছুটা সময় সে আমার হাত ধরে বসে রইলো । তারপর বুঝতে পারলাম তিনি কাঁদছেন । একটা সময়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, নীলুফার আমাদের বাসায় কাজ করতো না । সে আমার দুরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল, তার কেউ ছিল না বলে আমার মা তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলো । সেই কিশোরী মেয়েটাকে আমার প্রথম দেখাতেই ভাল লাগে । আমি তাকে নিজের মত করে পেতে চেয়েছিলাম । বিয়ে করতে চেয়েছিলাম । তবে আমার বাবা তা চায় নি । আমার তখন কিছুই করার ছিল না । আমি …. আমি জানতামই না যে …।

বলতে বলতে তিনি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন । আমি বললাম, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি শান্ত হয়ে শুয়ে থাকুন ।
তিনি শান্ত হলেন না সহসাই । আরো কত কিছু বলতে লাগলাম । আমি একমনে সে সব শুনতে থাকলাম । কেন জানি এই প্রলাপ আমার শুনতে ভাল লাগছিলো ।

দেখলাম একটা সময় একজন ডাক্তার এল । তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল ইঞ্জেকশন দিয়ে । সে ঘুমিয়ে গেলে আমি উঠে পড়লাম । দরজা দিয়ে বের হয়ে যখন বসার ঘরে এসেছি তখন নওরিনের মা পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডাকলেন ।

-একটু বসবে বাবা!
আমি বসলাম । সেও বসলো আমার সামনের সোফাতে । তারপর বলল, তোমার বাবা যা বলেছে সে সব কিন্তু মিথ্যা না । বিয়ের একদম প্রথমদিনই সে তোমার মায়ের কথা আমাকে জানিয়েছিলো । তার প্রতি তোমার বাবার ভালবাসায় আমি কখনই খাদ দেখতে পাই নি । তোমার দাদা তাকে বিশ্বাস করিয়েছিলো যে বাচ্চা এভোর্ট করতে গিয়ে তুমি আর তোমার মা মারা গেছ । সেই সার্টিফিকেটও সে দেখিয়েছিলো । সে যদি জানতো তুমি বেঁচে আছো তোমাকে সে খুজে বের করতোই ।

আমি কী বলবো সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না । সে আবার বলল, তোমার রাগ জায়েজ আমি জানি । তবুও যদি সম্ভব হয় তাহলে তোমার বাবাকে মাফ করে দিও ।

আমি চলে আসার সময় দেখতে পেলাম নওরিন দাড়িয়ে রয়েছে দরজার কাছে । তার সাথে আরও একজন মেয়ে । চেহারা দেখে মনে হল এটা নওরিনের বোন । আমি তার দিকে তাকিয়ে বলল, কী নাম তোমার?
-অরিন ।
আমি আর কিছু বললাম না । নওরিন বলল, আপনি আর আসবেন না?
-জানি না ।
-আসবেন । প্লিজ আসবেন ।
আমারও কেন জানি মনে হল যে আমাকে আবারও আসতে হবে ।

পরের দিন অফিস শেষ হওয়ার কিছু আগে আমাকে অবাক করে দিয়ে অরিন আমার অফিসে এসে হাজির । আমি যখন অফিস থেকে বের হচ্ছি দেখতে পেলাম ও দাড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ওপাশে । পরনে স্কুল ড্রেস । আমি অবাক ভাবটা কাটিয়ে উঠতেই দেখলাম ও রাস্তা পার হয়ে আসতে চাচ্ছে । আমি ওকে হাতের ইশারাতে থামিয়ে দিয়ে নিজেই গিয়ে হাজির হলাম । বললাম, কী ব্যাপার তুমি এখানে?
-আমার কোচিং এই খানে । শেষ হল একটু আগে । ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই ।
তারপর ব্যাগ থেকে একটা বড় ডেইরি মিল্কের চকলেট বের করে দিল আমার দিকে । বলল, এটা তোমার জন্য ।

আমার মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করলো । এই অচেনা অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই । চকলেটটা নিতে নিতে বললাম, কিছু খাবে তুমি?
-চটপটি খেতে চাই কিন্তু আম্মু খুব বকবে ।
আমি হেসে ফেললাম । বললাম, চল আমি কিনে দিচ্ছি । আমি কিছু বললেন বলবে যে আমি খাইয়েছি । তাহলে কিছু বলবে না ।
দেখলাম অরিনের মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো ।

অরিন যখন চটপটি খাচ্ছিলো আমার মনে সেই আনন্দের অনুভূতি টুকু এসে হাজির হল । বড় ভাই তার ছোটবোনকে চটপটি খাওয়াচ্ছে, চোট বোন পটপট করে কথা বলেই যাচ্ছে । একেবারে কোন পার্ফেক্ট পরিবারের গল্প যেন । আমি কোন দিন কি ভেবেছিলাম যে আমার কপালেও এমন একটা দিন এসে হাজির হবে !
কেউ ভাবে নি । এ যেন এক রূপকথার গল্প ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 103

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “রূপকথার গল্প”

  1. অপু তানভীর মানেই অন্যরকম!
    ভালবাসা অভিরাম!♥

Comments are closed.