আরে ওখানে কী হচ্ছে ?
আমি নীলার সাথে হাটছিলাম । আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পাশেই একটা বড় মাঠ রয়েছে । তার পাশে গাছগাছালি ভর্তি বড় একটা বাগান। আমাদের ক্যাম্পাসের অনেকেই সেখানে গিয়ে বসে গল্পটল্প করে । আমিও যাই । আজকে নীলা বলল ওর ক্লাস করতে ভালো লাগছে না । আমি যেন ওর পাশে মাঠে হাটতে যাই । আমারও ঠিক ক্লাস করতে ভাল লাগছিলো না । টুপ করে আমরা দুজন বের হয়ে গেলাম । এমন সময়েই ভীড়টা দেখতে পেলাম । সেই সাথে কয়েকটা গাড়িও দেখতে পেলাম ।
বললাম, কোন স্যুটিং হচ্ছে মনে হয় !
নীলা বলল, তাই নাকি? চল তো দেখি কে ?
-আরে ওখানে দেখার কী দরকার ।
-আরে চল না দেখি ।
আমি অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও হাটতে লাগলাম নীলার পেছন পেছন । ভীড় ঠেলে একটু সামনে এগোতেই দেখতে পেলাম তাদের । বর্তমান সময়ের সব থেকে জনপ্রিয় নাকিয়াদের একজন । নাজিয়া রহমান ।
আমি খানিকটা সময় থমকে গেলাম । নাজিয়াকে এখানে দেখতে পাবো আমি ভাবি নি । আমার তখনই মনে হল যে এখান থেকে এখনই চলে যাওয় উচিৎ । আমি চলে যেতে উদ্দত হলাম আর ঠিক তখনই নাজিয়া ভীড়ের দিকে ঘুরে তাকালো । আর আমার কী কপাল যে একেবারে চোখটা আমার চোখের উপরেই পড়লো ।
আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য কেমন যে ফ্রিজ হয়ে গেলাম । দেখলাম নাজিয়াও আমার দিকে তাকিয়ে ফ্রিজ হয়ে দাড়িয়ে রইলো । সম্ভবত
কোন ডায়ালগ দেওয়ার কথা ছিল । সেটা দিতে পারলো না ।
কাট
শুনতে পেলাম ।
দেখলাম একজন লোক এগিয়ে গেল নাজিয়ার দিকে । ওকে কিছু যেন বলছে । পরিপেক্ষিতে নাজিয়াও কিছু বলল । তারপরই দেখলাম নাজিয়া সেট ছেড়ে চলে গেল একটা ভ্যানের দিকে । আমি নীলার দিকে তাকিয়ে দেখি ও তখনই স্পটের দিকে তাকিয়ে । আমি বললাম, চল এখন থেকে ।
নীলার অবশ্য আরও কিছু সময় থাকার ইচ্ছে ছিল তবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আর থাকলো না । আমি ভীড় ছেড়ে বের হয়ে গেলাম ।
কিন্তু বেশি দুর যেতে পারলাম না । মিনিট খানেক হেটেছি এমন সময় দেখি একজন কম বয়সী ছেলে আমাদের দিকে দৌড়ে এল আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে । ছেলেটি এসে বলল, ম্যাডাম আপনাদের ডাকছে।
আমার বলার আগেই নীলা বলল, ম্যাডাম ? কোন ম্যাডাম?
-নাজিয়া ম্যাডাম !
নীলা প্রথমে কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে । তার মাথায় সম্ভবত এটা আসছে না যে নাজিয়া কেন আমাদের ডাকবে । তাপর নীলা আমার দিকে ফিরে তাকালো । বোঝার চেষ্টা করলো যে আমি কোন ভাবে নাজিয়ার পূর্ব পরিচিত কিনা !
আমার চেহারা দেখেই ও বুঝতে পারলো যে ওর ধারণা সঠিক । বলল, তুই চিনিস ওকে?
-হ্যা ।
-কোন দিন বলিস নি তো !
-এটা বলার কী আছে !
-চল চল দেখা করে আসি !
আমরা আবার ঘুরে হাটতে লাগলাম নাজিয়ার ভ্যানের দিকে ।
দুই
নাজিয়ার সাথে আমার আবার দেখা হবে, আরো ভাল করে বললে নাজিয়া আসলে আমার সাথে আবার দেখা করতে চাইবে সেটা আমি কখনই ভাবি নি । নাজিয়া এক সময়ে আমার প্রেমিকা ছিল । এই কথা বললে হয়তো কেউ কোন দিন বিশ্বাসই করবে না তবে সত্যিই ছিল সে আমার প্রেমিকা । এবং প্রেমটা হয়েছিলো অনেকটা ওর নিজের ইচ্ছেতেই। আমি জানি এখন যদি আমি এই কথা বলি মানুষজন আমাকে মারতে তেড়ে আসবে ।
নাজিয়ার সাথে আমার প্রেম শুরু হয়েছিলো আমার এসএসসি পরীক্ষার আগে । আমার সাথে আমাদের স্কুলেই পড়াশুনা করতো । পড়াশোনাতেও বেশ ভাল ছিল । এমন একটা দিন ভাগ্যক্রমে আমাদের টেস্ট পরীক্ষার দিন আমি ওর রুমে গিয়ে হাজির হই পরীক্ষা দিতে । পুরো রুমে আমরা মাত্র কয়েকজন ছেলে ছিলাম । আমি বসেছিলাম একেবারে নাজিয়ার পাশেই । পরীক্ষা হলেও ওকে বেশ কয়েকবার সাহায্য করলাম । এই ছিল আমার সাথে ওর যোগাযোগ ।
পরে যখন নতুন কলেজে উঠলাম তখন নাজিয়ার সাথে পরিচয় হল বেশ ভাল করেই । এবং কয়েকমাস ঘুরতেই বুঝতে পারলাম যে আমাদের ভেতরে কিছু হতে যাচ্ছে । নাজিয়া আমাকে ছয় মাসের মাথায় প্রথম মনের কথা বলেছিলো । তারপরই আমাদের প্রেম শুরু হয় ।
নাজিয়ার প্রায় সব ব্যাপারই আমার পছন্দ ছিল কেবল একটা ব্যাপার বাদ দিয়ে । ও তখন টিকটক ভিডিও বানানো । সোস্যাল মিডিয়াতে খুব বেশি একটিভ থাকতো । যদিও আমাদের প্রেম তখনও গোপন ছিল । চমৎকার নাঁচতে পারতো । ওর অনেক নাচের ভিডিও টিকটকে ঘুরে বেড়াতো । আমার একটু খারাপ লাগতো এই ভেবে যে আমার প্রেমিকাকে সবাই কেমন চোখে দেখছে । তবে আমি এটা মেনেই নিয়েছিলাম ।
তারপরই একদিন ঘটলো আসল ঘটনা । ওর কয়েকটা ভিডিও এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠলো যে ওকে একটা বিজ্ঞাপনের জন্য ডাকা হল । সেটাতে ও বেশ চমৎকার কাজ করলো । এরপর একের পর এক কাজ আসতে শুরু করলো । ও অনেক বেশি ব্যস্ত থাকা শুরু করলো । আমাদের মাঝে আস্তে আস্তে দুরত্ব বাড়া শুরু করলো । প্রথমে কয়েকদিন একটু অভিযোগ করতাম তবে একটা সময়ে বুঝতে পারলাম যে আমি ওকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি । ওকেও দোষ দিয়ে আসলে লাভ নেই । ও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। আমরা যখন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলাম তখন আমরা খেয়াল করলাম যে আমরা একে অন্যের থেকে অনেক দুরে চলে এসেছি ।
আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম । নাজিয়া একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালে ভর্তি হল । নাজিয়া তখন একটা মুভিতে অভিনয় শুরু করেছে । এক বছরের মাধায় এমন হল যে আমাদের মাঝে একবারও কথা হল না । আমি নাজিয়ার জীবন থেকে একেবারে হারিয়ে গেলাম।
তিন
নাজিয়া আমার সামনে বসে আছে । আমার পাশে নীলা। ও যেন এখনও ঠিক মত বিশ্বাস করতে পারছে না যে বিখ্যাত নায়িকা আমাদের সামনে বসে আছে । আমি যদিও ওর ছবি সোস্যাল মিডিয়াতে পত্রিকাতে দেখেছি তবে এভাবে সামনা সামনি অনেক দিন পরে দেখলাম । প্রায় চার বছরের বেশি সময় হবে ।
-কেমন আছো?
আমি হাসলাম । বললাম, ভাল ।
-তোমার কী খবর?
-দেখতেই পাচ্ছো !
-হুম !
নীলাকে দেখলাম অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে । নাজিয়া আস্তে আস্তে সব জবাব দিল । কিভাবে পরিচয় কিভাবে বন্ধুত্ব এইসব । দেখলাম ও আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল । আমিও তাই কিছু বললাম না । প্রায় ঘন্টা খানেক গল্প হওয়ার পরে যখন বের হতে যাবো নাজিয়া নিজ থেকে আমার ফোনে ওর নাম্বার সেফ করে দিল । আমারটাও নিল ।
আমি ভেবেছিলাম হয়তো আর আমাদের তেমন কথা হবে না । ক্ষণিকের দেখা ক্ষণিকের আবেগ এসব চলে যাবে । ও আবার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে । তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল রাতের বেলা। রাত একটার দিকে নাজিয়ার ফোন এসে হাজির ।
কথা শুরু হল ঘুমিয়ে পড়েছি কিনা । বললাম, নাহ এখনও ঘুমাই নি । বই পড়ছি ।
-রাত জেগে বই পড়ার অভ্যাস যায় নি এখন?
-মনে আছে এখন এসব?
-হ্যা । সবই মনে আছে ।
-আর কী মনে আছে?
-আমাদের প্রথম চুমু খাওয়ার দিন । প্রথম হাত ধরা সব !
আমি কী বলবো খুজে পেলাম না । নাজিয়া বলল, ঐ মেয়েটা নীলা তোমার প্রেমিকা?
-নাহ । ক্লাস মেট বন্ধু ।
-সত্যি?
-হ্যা । মিথ্যা কেন বলব?
-নতুন কাউকে ভালোবাসো নি?
-এখনও মনের মত পাই নি । পেলে হয়তো !
-মনের মত বলতে ? …. আমার মত?
আমি চট করে জবাব দিলাম না । দিতে পারলাম না ।
নাজিয়া বলল, আজকে তোমাকে হঠাৎ করে দেখে কী যে মনে হল আমি বুঝতেই পারলাম না । তারপর ঐ মেয়েটার সাথে দেখে তীব=র একটা কষ্ট এসে জড় হল মনে । কেন হল সেটা আমি বোঝার চেষ্টা করলাম । কিন্তু পারলাম না । পরে উপলব্ধি করতে পারলাম যে আসলে আমি….।
আমি জানি নাজিয়া কী বলতে যাচ্ছে কিন্তু এসব কথার কী কোন মানে আছে? ওর জীবন আলাদা আমার জীবন আলাদা । আমরা আবার কখনো এক হতে পারবো না ।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই অবাক হওয়ার মত একটা ঘটনা ঘটলো। আমাদের বাসাটা যদিও প্রধান রাস্তার পাশে না । একটু ভেতরে হাউজিংয়ের মধ্যে । তারপরেও মাঝে মাঝে এখান দিয়ে গাড়ি যায় । একটা ট্রাক যাওয়ার আওয়াজ এল জানলা দিয়ে । সেটার হর্নের আওয়াজও শুনলাম এবং অবাক হওয়ার মত ব্যাাপর হচ্ছে ফোনের ভেতরেও সেই আওয়াজ শুনতে পেলাম ।
আমার ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো । আমি দ্রুত উঠে বারান্দায় চলে গেলাম । আমি একটা কালো রংয়ের গাড়ি দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম একটু দুরে । নাজিয়াকে বললাম, তুমি আমার বাসার সামনে এসেছো?
নাজিয়া কোন জবাব দিল না । তবে একটু পরেও গাড়ির দরজা খুলে ওকে বের হয়ে আসতে দেখলাম । তারপর আমার দিকে ফিরে তাকালো ।
পরিশিষ্টঃ
আমাদের পুরো রাতটা কেটে গেল ফুটপাথের উপরে বসে । পুরোটা সময় নাজিয়া আমার হাত ধরে ছিল । কত কথা আমরা বলল । এই চার বছরে ও কত কিছু করেছে, কত মানুষের সাথে মিশেছে, সব কথা যেন আমাকে ওর বলতেই হবে এমন ভাবে আমাকে বলতে শুরু করলো ।
যখন ভোর হতে শুরু করলো তখন ও আমার কাছ থেকে বিদায় নিল । তবে যাওয়ার আগে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো লম্বা একটা সময় । আর বলে গেল যে আগের বারের মত কোন ভাবেই এবার সে আমার থেকে দুরে যাবে না । আমারও কেন জানি মনে হল এবার এবার ও আমার থেকে দুরে চলে যাবে না আগের মত ।