হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা

oputanvir
4.7
(66)

আরে ওখানে কী হচ্ছে ?

আমি নীলার সাথে হাটছিলাম । আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পাশেই একটা বড় মাঠ রয়েছে । তার পাশে গাছগাছালি ভর্তি বড় একটা বাগান। আমাদের ক্যাম্পাসের অনেকেই সেখানে গিয়ে বসে গল্পটল্প করে । আমিও যাই । আজকে নীলা বলল ওর ক্লাস করতে ভালো লাগছে না । আমি যেন ওর পাশে মাঠে হাটতে যাই । আমারও ঠিক ক্লাস করতে ভাল লাগছিলো না । টুপ করে আমরা দুজন বের হয়ে গেলাম । এমন সময়েই ভীড়টা দেখতে পেলাম । সেই সাথে কয়েকটা গাড়িও দেখতে পেলাম ।

বললাম, কোন স্যুটিং হচ্ছে মনে হয় !
নীলা বলল, তাই নাকি? চল তো দেখি কে ?
-আরে ওখানে দেখার কী দরকার ।
-আরে চল না দেখি ।

আমি অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও হাটতে লাগলাম নীলার পেছন পেছন । ভীড় ঠেলে একটু সামনে এগোতেই দেখতে পেলাম তাদের । বর্তমান সময়ের সব থেকে জনপ্রিয় নাকিয়াদের একজন । নাজিয়া রহমান ।

আমি খানিকটা সময় থমকে গেলাম । নাজিয়াকে এখানে দেখতে পাবো আমি ভাবি নি । আমার তখনই মনে হল যে এখান থেকে এখনই চলে যাওয় উচিৎ । আমি চলে যেতে উদ্দত হলাম আর ঠিক তখনই নাজিয়া ভীড়ের দিকে ঘুরে তাকালো । আর আমার কী কপাল যে একেবারে চোখটা আমার চোখের উপরেই পড়লো ।

আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য কেমন যে ফ্রিজ হয়ে গেলাম । দেখলাম নাজিয়াও আমার দিকে তাকিয়ে ফ্রিজ হয়ে দাড়িয়ে রইলো । সম্ভবত
কোন ডায়ালগ দেওয়ার কথা ছিল । সেটা দিতে পারলো না ।

কাট

শুনতে পেলাম ।

দেখলাম একজন লোক এগিয়ে গেল নাজিয়ার দিকে । ওকে কিছু যেন বলছে । পরিপেক্ষিতে নাজিয়াও কিছু বলল । তারপরই দেখলাম নাজিয়া সেট ছেড়ে চলে গেল একটা ভ্যানের দিকে । আমি নীলার দিকে তাকিয়ে দেখি ও তখনই স্পটের দিকে তাকিয়ে । আমি বললাম, চল এখন থেকে ।

নীলার অবশ্য আরও কিছু সময় থাকার ইচ্ছে ছিল তবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আর থাকলো না । আমি ভীড় ছেড়ে বের হয়ে গেলাম ।

কিন্তু বেশি দুর যেতে পারলাম না । মিনিট খানেক হেটেছি এমন সময় দেখি একজন কম বয়সী ছেলে আমাদের দিকে দৌড়ে এল আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে । ছেলেটি এসে বলল, ম্যাডাম আপনাদের ডাকছে।
আমার বলার আগেই নীলা বলল, ম্যাডাম ? কোন ম্যাডাম?
-নাজিয়া ম্যাডাম !

নীলা প্রথমে কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে । তার মাথায় সম্ভবত এটা আসছে না যে নাজিয়া কেন আমাদের ডাকবে । তাপর নীলা আমার দিকে ফিরে তাকালো । বোঝার চেষ্টা করলো যে আমি কোন ভাবে নাজিয়ার পূর্ব পরিচিত কিনা !

আমার চেহারা দেখেই ও বুঝতে পারলো যে ওর ধারণা সঠিক । বলল, তুই চিনিস ওকে?
-হ্যা ।
-কোন দিন বলিস নি তো !
-এটা বলার কী আছে !
-চল চল দেখা করে আসি !

আমরা আবার ঘুরে হাটতে লাগলাম নাজিয়ার ভ্যানের দিকে ।

দুই
নাজিয়ার সাথে আমার আবার দেখা হবে, আরো ভাল করে বললে নাজিয়া আসলে আমার সাথে আবার দেখা করতে চাইবে সেটা আমি কখনই ভাবি নি । নাজিয়া এক সময়ে আমার প্রেমিকা ছিল । এই কথা বললে হয়তো কেউ কোন দিন বিশ্বাসই করবে না তবে সত্যিই ছিল সে আমার প্রেমিকা । এবং প্রেমটা হয়েছিলো অনেকটা ওর নিজের ইচ্ছেতেই। আমি জানি এখন যদি আমি এই কথা বলি মানুষজন আমাকে মারতে তেড়ে আসবে ।

নাজিয়ার সাথে আমার প্রেম শুরু হয়েছিলো আমার এসএসসি পরীক্ষার আগে । আমার সাথে আমাদের স্কুলেই পড়াশুনা করতো । পড়াশোনাতেও বেশ ভাল ছিল । এমন একটা দিন ভাগ্যক্রমে আমাদের টেস্ট পরীক্ষার দিন আমি ওর রুমে গিয়ে হাজির হই পরীক্ষা দিতে । পুরো রুমে আমরা মাত্র কয়েকজন ছেলে ছিলাম । আমি বসেছিলাম একেবারে নাজিয়ার পাশেই । পরীক্ষা হলেও ওকে বেশ কয়েকবার সাহায্য করলাম । এই ছিল আমার সাথে ওর যোগাযোগ ।
পরে যখন নতুন কলেজে উঠলাম তখন নাজিয়ার সাথে পরিচয় হল বেশ ভাল করেই । এবং কয়েকমাস ঘুরতেই বুঝতে পারলাম যে আমাদের ভেতরে কিছু হতে যাচ্ছে । নাজিয়া আমাকে ছয় মাসের মাথায় প্রথম মনের কথা বলেছিলো । তারপরই আমাদের প্রেম শুরু হয় ।

নাজিয়ার প্রায় সব ব্যাপারই আমার পছন্দ ছিল কেবল একটা ব্যাপার বাদ দিয়ে । ও তখন টিকটক ভিডিও বানানো । সোস্যাল মিডিয়াতে খুব বেশি একটিভ থাকতো । যদিও আমাদের প্রেম তখনও গোপন ছিল । চমৎকার নাঁচতে পারতো । ওর অনেক নাচের ভিডিও টিকটকে ঘুরে বেড়াতো । আমার একটু খারাপ লাগতো এই ভেবে যে আমার প্রেমিকাকে সবাই কেমন চোখে দেখছে । তবে আমি এটা মেনেই নিয়েছিলাম ।

তারপরই একদিন ঘটলো আসল ঘটনা । ওর কয়েকটা ভিডিও এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠলো যে ওকে একটা বিজ্ঞাপনের জন্য ডাকা হল । সেটাতে ও বেশ চমৎকার কাজ করলো । এরপর একের পর এক কাজ আসতে শুরু করলো । ও অনেক বেশি ব্যস্ত থাকা শুরু করলো । আমাদের মাঝে আস্তে আস্তে দুরত্ব বাড়া শুরু করলো । প্রথমে কয়েকদিন একটু অভিযোগ করতাম তবে একটা সময়ে বুঝতে পারলাম যে আমি ওকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি । ওকেও দোষ দিয়ে আসলে লাভ নেই । ও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। আমরা যখন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলাম তখন আমরা খেয়াল করলাম যে আমরা একে অন্যের থেকে অনেক দুরে চলে এসেছি ।

আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম । নাজিয়া একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালে ভর্তি হল । নাজিয়া তখন একটা মুভিতে অভিনয় শুরু করেছে । এক বছরের মাধায় এমন হল যে আমাদের মাঝে একবারও কথা হল না । আমি নাজিয়ার জীবন থেকে একেবারে হারিয়ে গেলাম।

তিন
নাজিয়া আমার সামনে বসে আছে । আমার পাশে নীলা। ও যেন এখনও ঠিক মত বিশ্বাস করতে পারছে না যে বিখ্যাত নায়িকা আমাদের সামনে বসে আছে । আমি যদিও ওর ছবি সোস্যাল মিডিয়াতে পত্রিকাতে দেখেছি তবে এভাবে সামনা সামনি অনেক দিন পরে দেখলাম । প্রায় চার বছরের বেশি সময় হবে ।
-কেমন আছো?
আমি হাসলাম । বললাম, ভাল ।
-তোমার কী খবর?
-দেখতেই পাচ্ছো !
-হুম !

নীলাকে দেখলাম অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে । নাজিয়া আস্তে আস্তে সব জবাব দিল । কিভাবে পরিচয় কিভাবে বন্ধুত্ব এইসব । দেখলাম ও আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল । আমিও তাই কিছু বললাম না । প্রায় ঘন্টা খানেক গল্প হওয়ার পরে যখন বের হতে যাবো নাজিয়া নিজ থেকে আমার ফোনে ওর নাম্বার সেফ করে দিল । আমারটাও নিল ।

আমি ভেবেছিলাম হয়তো আর আমাদের তেমন কথা হবে না । ক্ষণিকের দেখা ক্ষণিকের আবেগ এসব চলে যাবে । ও আবার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে । তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল রাতের বেলা। রাত একটার দিকে নাজিয়ার ফোন এসে হাজির ।

কথা শুরু হল ঘুমিয়ে পড়েছি কিনা । বললাম, নাহ এখনও ঘুমাই নি । বই পড়ছি ।
-রাত জেগে বই পড়ার অভ্যাস যায় নি এখন?
-মনে আছে এখন এসব?
-হ্যা । সবই মনে আছে ।
-আর কী মনে আছে?
-আমাদের প্রথম চুমু খাওয়ার দিন । প্রথম হাত ধরা সব !

আমি কী বলবো খুজে পেলাম না । নাজিয়া বলল, ঐ মেয়েটা নীলা তোমার প্রেমিকা?
-নাহ । ক্লাস মেট বন্ধু ।
-সত্যি?
-হ্যা । মিথ্যা কেন বলব?
-নতুন কাউকে ভালোবাসো নি?
-এখনও মনের মত পাই নি । পেলে হয়তো !
-মনের মত বলতে ? …. আমার মত?

আমি চট করে জবাব দিলাম না । দিতে পারলাম না ।
নাজিয়া বলল, আজকে তোমাকে হঠাৎ করে দেখে কী যে মনে হল আমি বুঝতেই পারলাম না । তারপর ঐ মেয়েটার সাথে দেখে তীব=র একটা কষ্ট এসে জড় হল মনে । কেন হল সেটা আমি বোঝার চেষ্টা করলাম । কিন্তু পারলাম না । পরে উপলব্ধি করতে পারলাম যে আসলে আমি….।

আমি জানি নাজিয়া কী বলতে যাচ্ছে কিন্তু এসব কথার কী কোন মানে আছে? ওর জীবন আলাদা আমার জীবন আলাদা । আমরা আবার কখনো এক হতে পারবো না ।

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই অবাক হওয়ার মত একটা ঘটনা ঘটলো। আমাদের বাসাটা যদিও প্রধান রাস্তার পাশে না । একটু ভেতরে হাউজিংয়ের মধ্যে । তারপরেও মাঝে মাঝে এখান দিয়ে গাড়ি যায় । একটা ট্রাক যাওয়ার আওয়াজ এল জানলা দিয়ে । সেটার হর্নের আওয়াজও শুনলাম এবং অবাক হওয়ার মত ব্যাাপর হচ্ছে ফোনের ভেতরেও সেই আওয়াজ শুনতে পেলাম ।

আমার ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো । আমি দ্রুত উঠে বারান্দায় চলে গেলাম । আমি একটা কালো রংয়ের গাড়ি দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম একটু দুরে । নাজিয়াকে বললাম, তুমি আমার বাসার সামনে এসেছো?
নাজিয়া কোন জবাব দিল না । তবে একটু পরেও গাড়ির দরজা খুলে ওকে বের হয়ে আসতে দেখলাম । তারপর আমার দিকে ফিরে তাকালো ।

পরিশিষ্টঃ
আমাদের পুরো রাতটা কেটে গেল ফুটপাথের উপরে বসে । পুরোটা সময় নাজিয়া আমার হাত ধরে ছিল । কত কথা আমরা বলল । এই চার বছরে ও কত কিছু করেছে, কত মানুষের সাথে মিশেছে, সব কথা যেন আমাকে ওর বলতেই হবে এমন ভাবে আমাকে বলতে শুরু করলো ।

যখন ভোর হতে শুরু করলো তখন ও আমার কাছ থেকে বিদায় নিল । তবে যাওয়ার আগে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো লম্বা একটা সময় । আর বলে গেল যে আগের বারের মত কোন ভাবেই এবার সে আমার থেকে দুরে যাবে না । আমারও কেন জানি মনে হল এবার এবার ও আমার থেকে দুরে চলে যাবে না আগের মত ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 66

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →