নিকিতার সাথে আমার প্রেমটা চলতে থাকলো অনেকটা নাইট টেনেরর স্কুলে পড়া ছেলে মেয়েদের মত । কিশোর বয়সের প্রেমে যেমন সব সময় এই ভয়ে থাকতে হয় যদি কেউ দেখে ফেলে আমাদের অবস্থাও হয়েছে তেমন । মাসের বেশির ভাগ সময়ই নিকিতাকে নানান কাজকে ব্যস্ত থাকতে হয় । আমি ওকে দেখতে পাই না । যখন দেখা করি তবুও লুকিয়ে ঝুকিয়ে । বেশির ভাগ সময়ই ও একেবারে মুখ ওড়না পেঁচিয়ে আসে ।
আমি ওকে নিয়মিত টিভিতেই দেখতে পাই । কিন্তু ও আমাকে দেখতে পায় না । মাঝে মাঝে তাই হাজির হই ওর বলা স্থানে । কাজের কারনেই ওকে মাঝে মাঝেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় । আমাকে একটা পাস এনে দিয়েছে সে । আমি সময় পেয়ে সেই সাংবাদিক সেজে চলে যাই । ভীড়ের মাঝে ওর চোখ আমার উপরে থাকে । মুখে হাসি হাসি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয় সে । এই ভাবেই আমাদের বেশির ভাগ দেখা হয় ।
তবে এসবের মাঝেও আমার দিকে ওর সজাগ দৃষ্টি থাকে সব সময় । বিশেষ করে আমি কি করি না করি সব জানে । একদিন এই কথা জানতে চাইলে ও বলল, শুনো পৃথীবীর সব মেয়ের এই একটা ইচ্ছে যে সে তার প্রেমিক স্বামীর ব্যাপারে সব কিছু জানে । আমার কাছে ওয়ে আছে আমি কেন করবো না ?
-তাই বলে সব সময় আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রাখবে ?
নিকিতা হাসলো । তারপর বলল
-মনে করো তোমার কোন বিপদ হল । যেকোন বিপদ আর তোমার একা একা সেটা সাফার করতে হল আমি এই ব্যাপারটা কোন দিন মেনে নিতে পারবো না । তোমার সাথে যাই হোক ভাল খারাপ আমি চাইবো সবার আগে আমি জানবো আমি ষবার আগে ব্যবস্থা নিবো ! বুঝতে পেরেছো ? তুমি কি জানো আমাদের মেয়েদের হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে তারা তাদের ভালবাসার মানুষের জন্য সব কিছু করে ফেলতো সকল আঘাত আগে নিজের শরীর দিয়ে ঠেকিয়ে দিতো । কিন্তু আমাদের সব সময় তা থাকে না । কিন্তু আমার অনেকটাই আছে আমি সেটার ব্যবহার করবো না ?
আমি কোন কিছু বলতে পারলাম না । এই কথার বিপরীতে আর কিছু বলাও যায় না ।
আমাদের প্রেম চলতে থাকে । নিকিতা মাঝে মাঝে খুব গোপনে আমাদের বাসায় আসে । তারপর মায়ের সাথে কিছু সময় গল্প করে । বাবা এই সময় খুব অস্বস্থির ভেতরে থাকে । তার কাছে ব্যাপারটা এখনও ঠিক স্বাভাবিক না ।
তবে আমার মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় । আমি এতো অস্বাভাবিক জীবন চাই নি । আমি যেমন সাধারন মানুষ আমি চেয়েছিলাম আমার প্রেমিকা/বউও আমার মতই সাধারন কেউ হয় । হয়তো হাউজওয়াইফ নয়তো আমার মত জব করবে । আমরা অফিস শেষে এক সাথে ঘুরতে যাবো । রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করবো । বৃষ্টি হলে রিক্সা করে ঘুরবো । কিন্তু নিকিতার সাথে কোন দিন সেটা সম্ভব না ।
নিকিতা নিজেও এটা জানতো । আমার যে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় সেটা সেও জানে । সেদিন ছুটির দিন ছিল । প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে । আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম । এমন সময় নিকিতার ফোন এসে হাজির ।
-কি করছেন পড়ছেন প্রোফেসর সাহেব ?
-এই সময়ে আর কি করবো !
-শুনো এখনই বাইরে বের হও তো !
-মানে ?
-তোমার বাসার সামনে দেখো গাড়ি চলে গেছে । কালো রংয়ের পাঞ্জাবীটা পরে এসো ।
-কেন ? আমি তো বুঝতে পারছি না ।
-এতো কিছু বুঝতে হবে না । আসতে বলছি আসো !
আমি কথা না বাড়িয়ে পাঞ্জাবী পরে নিলাম । কয়েক দিন আগে নিকিতাই এটা আমাকে উপহার দিয়েছে । বাসার গেটের কাছে আসতেই দেখলাম কালো রংয়ের গাড়ি এসে হাজির হয়েছে বাসার সামনে । আমাকে দেখে সেটার দরজারও খুলে গেল । আমি কোন কিছু চিন্তা না করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম । গাড়ি কিছু সময় চলার পরে একটা স্থানে এসে থামলো । বেশ কিছু সময় ধরে গাড়িটা চলে থেমে গেল । আমি তাকিয়ে ঠিক রাস্তাটা চিনতে পারলাম না । রাস্তাটার দুইপাশে সারি সারি গাছ । বিশেষ করে কদম আর কৃষ্ণচুড়া গাছই বেশি দেখা যাচ্ছে । রাস্তায় গাড়ির চলাচল নেই বললেই চলে । আমি তাকিয়ে দেখি আমাদের গাড়ির ঠিক সামনে আরেকটা গাড় দাড়িয়ে রয়েছে ।
কিছু সময় পরেই গাড়িটা থেকে হাতে ছাতা নিয়ে একজন কালো রংয়ের শাড়ি পরা এক মেয়ে বের হয়ে এল । আমাদের গাড়ির দিকে হাটতে লাগলো । আরেকটু ভাল করে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটা আর কেউ নয়, নিকিতা ! আমার গাড়ির সামনে এসে বলল গাড়ির দরজা খুলতে ইশারা করলো । আমি দরজাটা খুলতেই ও ছাতা নিয়ে দরজার কাছে চলে এল ।
এক ছাতার নিচে আমরা দাড়িয়ে আছি । নিকিতা হাতের ইশারা করতেই গাড়ি দুটো চলে গেল । তাকিয়ে দেখি পুরো রাস্তা জুড়ে কেবল আমরা দুজন । একটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে না । আমি বললাম
-যদি কেউ এখানে আমাদের দেখে ফেলে ?
নিকিতা হাসলো । বলল
-দেখবে না । সেরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে !
-কি রকম ?
-এই রাস্তার দুই মাথায় ডাইব্রেশন করা হয়েছে । একটু ঘুরে যাবে । তাছাড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে । কেউ আসবে না !
এই বলে নিকিতা হাতের ছাতাটা রাস্তায় ফেলে দিলো । সাথে সাথে এক ঝাক বৃষ্টির পানি আমাদের ভিজিয়ে দিতে লাগলো । আমি অবাক নিকিতার দিকে তাকিয়ে রইলাম । এই মেয়ে আমার ইচ্ছে পুরনের জন্য পুরো রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে । খাইছে আমারে !
মুষল ধারে বৃষ্টি পড়তে থাকলো আর আমরা দুজন বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম এক সাথে । মাঝে মাঝে হাটি রাস্তার উপর বসে থাকি । জীবনে এর থেকে চমৎকার বৃষ্টিময় সময় আমি কাটিয়েছি কি না আমার জানা নেই ।
আমার মনের সেই সাধারন প্রেমিকার আফসোস টা একেবারে চলে গেল । মনে হল এর থেকে ভালা আর কিছু হতেই পারে না । আমার প্রেমিকা আমার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য পুরো একটা রাস্তা বন্ধ দিয়েছে । এটা আমি কোথায় পেতাম !
বাসায় ফেরার পরেও অনেকটা সময় এই আনন্দ নিয়েই সময় কাটাতে লাগলাম । কিন্তু সুখের পর ঝামেলা এসে হাজির । আমার বেলাতেও ঠিক তাই এসে হাজির হল । ফেসবুকে কয়েকটা ছবি মুহুর্তের ভেতরে ভাইরাল হয়ে গেল । এবং সেই ছবিটা আর কারো নয় আমার আর নিকিতার বৃষ্টিতে ভেজার ছবি । রাত দশটা বাজতে বাজতে সব গুলো নিউজ পোর্টালের লিড নিউজ হয়ে গেল সেটা । দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোন ছেলের সাথে বৃষ্টিতে ভিজছে ।
ফেসবুকে খুব ঝড় উঠলো । অনেকে এটার বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে আবার অনেকে এটার পক্ষে । কেউ বলছে এতো গুরুত্বপূর্ন পদে থেকে কেউ এমন কাজ কিভাবে করে আবার কেউ বলছে সে তার দায়িত্ব পালনে কখনও অবহেলা করে নি । তার কি ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে না । সে হোম মিনিস্টার হয়েছে বলে কি সে কাউকে ভালবাসতে পারে না । জল্পনা কল্পনা চলতে লাগলো । নিকিতার সাথের ছেলেটা আসলে কে ?
কেউ বলছে অনেক ব্যবসায়ী কেউ বলছে ফ্যামিলি ফ্রেন্ড কিংবা বাইরে থেকে ! কিন্তু আমার আসল পরিচয় কেউ তখন বের করতে পারে নি ।
আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । যে কয়টা ছবি পোস্ট হয়েছে সেখানে আমার চেহারা খুব স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না । যারা আমাকে চেনে তারা হয়তো ভাল করে তাকালে বুঝতে পারবে যে নিকিতার সাথের ছেলেটা আমি ।
সামনে কি হবে কে জানে ?
ওর ক্যারিয়ারে নিশ্চয়ই একটা বড় রকমের দাগ সৃষ্টি হয়ে গেল আমার জন্য !
ইস! যদি ওকে আমার ঐ ইচ্ছের কথা না বলতাম তাহলে হয়তো এসব কিছুই হত না !
Comments are closed.