এই সব মিথ্যে গল্প (২.৮)

oputanvir
4.8
(64)

আজকের বিকেল যেন একটু বেশি সবুজ । টিএসসির মোড়ে বসে চা খেতে খেতে মিতু আকাশের দিকে তাকালো । কোন কারণ ছাড়াই আজকে মিতুর মনটা ভাল । এমন প্রায়ই মিতুর সাথে হয় । সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হয় আজকে ও মনটা ভাল খুব । আবার এমন দিনও যায় যখন কোন কারণ ছাড়াই মন খারাপ লাগে ।

আজকে মন ভাল হওয়ার কারণে ঠিক করেছিল যে শিমুলের সাথে দেখা করবে । কয়েক দিন ধরে শিমুনের মন মেজাজ বেশ খারাপ । বিশেষ করে ওর বন্ধু জাহিদের হঠাৎ করে চাকরি হওয়ার পর থেকেই ও যেন নিজেকে আরো একটু যেন গুটিয়ে নিয়েছে সে । ওর কাছে কেবলই মনে হচ্ছে যে ও আসলে কোন কাজের নয় । মিতু ওকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু শিমুল বুঝতে চায় না । মন খারাপ করে ।
আজকেও শিমুল দেখা করতে চাইছিল না । তবে রাজি করানো গেছে ওকে । শেষ পর্যন্ত এসে হাজির হয়েছে টিএসসিতে । মিতুর পাশে বসে আছে বিরস মুখে । কাপে চুমুক দিচ্ছে একটু পর পর ।
মিতু শিমুলের কাধে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল, কী ভাবছিস এতো?
শিমুল কিছুই ভাবছিলো না । তবে এই ভাবে এখানে মিতুর পাশে বসে থাকতে ওর কেন জানি ভাল লাগছিলো না । সকালে মায়ের সাথে একটা কথা কাটাকাটি হয়েছে । ওর চাকরি না পাওয়া নিয়ে বাসার সবাই খুব বিরক্ত । যদিও শিমুল মোটেই বাসায় একেবারে বসে থাকে না । শিক্ষা জীবন থেকেই টিউশনি করে সে । এখন যদিও সেটা কমিয়ে দিয়েছে । লেখালেখির হাত ছিল । অনলাইনে বিভিন্ন পত্রিকাতে লিখেও টুকটাক আয় করে । সেটা বাইরে বলার মত কিছু না । তবে হাত খরচের জন্য বাসায় হাত পাততে হয় না । কিন্তু ওর মায়ের এমন আচরণ যেন দুনিয়ার তার মন অকাজের আর কেউ নেই । অবশ্য শিমুলের এখন নিজেরও এমন মনে হতে শুরু করেছে ।
পড়াশোনা শেষ হয়েছে বছর খানেক হতে চলল । এখনও ভাল কোন চাকরি জোগার করতে পারে নি সে । চারিদিকে যারাই আসছে সবার আগে এই প্রশ্ন !
শিমুল কী করে !
কেন কিছু করছে না !
আশে পাশের সবাই চাকরি পেয়ে যাচ্ছে শিমুলের কেন কিছু হচ্ছে না !
কবে কিছু হবে !

সবার কথা শুনে শিমুলের কেবল মনে হচ্ছে যে দুনিয়াতে ওর চাকরি পাওয়া ছাড়া আর কাজ কারো নেই । সবাই ওর জন্য কতই না চিন্তিত অথচ সে খুব ভাল করেই জানে এই চিন্তা আসলে লোক দেখানো । ওরা সবাই ওকে টিটকারি মারছে ! সবার মধ্যে কেবল মিতুর কথা শুনলে মনে হয় ওর চাকরি পাওয়া না পাওয়া কোন চিন্তা নেই ।

-কী ব্যাপার কী ভাবছিস এতো?

প্রশ্নটা আবার করলো মিতু । শিমুল বলল, কিছু ভাবছি না ।
-এতো কেন চিন্তা করিস বস তো?
-তো কী করবো?
-শোন জীবনের জন্য জীবিকা, জীবিকার জন্য জীবন নয়! কিন্তু আমরা সবাই কেমন চাকরি টাকা আয়ের জন্য বেঁচে থাকছি ।

শিমুল তাকালো মিতুর দিকে । মিতুর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে শিমুলের হাতটা ধরলো । তারপর বলল, এতো চিন্তা করিস না । কিছু একটা হবে । আজ কাল হোক । সবার আগে হচ্ছে তোর না হয় পরে হবে একটু !
-যদি না হয় !
-না হলে আর কি ! রান্না করতে তো পারিস ! আমি চাকরি তুই আমার জন্য রান্না করবি । পারবি না ?
-তবুও আমাকেই বিয়ে করবি?
-হুম ! অন্য কাউকে দিয়ে চলবে না আমার ! বুঝেছিস? পাগল কোথাকার !

শিমুলের জানি মনটা একেবারে ভাল হয়ে গেল । মিতুর সাথে প্রতিবার দেখা হওয়ার পরেই এমনটা হয় । তবে শিমুলের ভয় করে যে হয়তো কোন একদিন এমনও আসবে তখন অন্য সবার মত মিতুই বদলে যাবে । এমন কোন দিন যদি আসলে তখন শিমুলের পক্ষে সেটা সহ্য করা মুস্কিল হয়ে যাবে ।

শিমুল বলল, তখন কিন্তু প্যান প্যান করতে পারবি না । মনে থাকে যেন !
-আচ্ছা বাবা করবো না । তবে রান্না ভাল না হলে কিন্তু খবর আছে বললাম !

শিমুল কিছু না বলে হেসে ফেলল । হাসলো মিতুও । দুজন হাসতে লাগলো ।

অবশ্য ওদের দুজনের কেউ খেয়াল করলো না যে ওদের কে দুজনকে একজন লক্ষ্য করছে । ওদের কথা বার্তা শুনছে মন দিয়ে । ওদের হাসি দেখে তার নিজের ঠোঁটেও একটা হাসি দেখা দিয়েছে ।

দুই
শিমুলের হাতে যখন এপোয়েন্টমেন্ট লেটার দেওয়া হল তখনও শিমুলের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না । অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । বারবার মনে করার চেষ্টা করছে এই কোম্পানিতে সিভি দিয়েছিলো কিনা । কিন্তু মনে করতে পারলো না । অসভ্য বিডিজবস থেকে অনেক জায়গাতেই সিভি দিয়েছে গত এক বছরে । এতো কোম্পানির নাম কী তার মনে আছে !

গত পরশু দিন হঠাৎ করে শিমুলের ফোনে একটা ফোন এসে হাজির হল । শিমুলকে বলা হল যে তাকে এই কোম্পানির ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়েছে । যে যেন আজকে এসে হাজির হয় । একটু অবাক হয়েই হাজির হয়েছিলো সে । সকাল এগারোটায় তার ইন্টারিভিউ নেওয়া হল । তারপর তাকে বলা হল যে একটু অপেক্ষা করতে । এক ঘন্টা পরেই এপোয়েন্টমেন্ট লেটার হাত দিয়ে দেওয়া হল । বেতনের পরিমান দেখে চোখ কপালে উঠলো । শুরুতেই দেবে ৫০ হাজার । চাকরি স্থায়ী হলে বেতন হবে ৭০ হাজার । এতো ভাল চাকরি সে কিভাবে পেয়ে গেল সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না । এতো ভাল ভাগ্য তার ভাল !

অফিস বিল্ডিং নিচের ফ্লোরে একটা ক্যাফে এসে থামলো শিমুল । মিতুকে খুজতে লাগলো । অফিসের সময়ে আগে সে মিতুকে এখানেই রেখে গিয়েছিলো । দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে মিতুকে খুজতে লাগলো । পেয়ে গেল একটু পরেই । মিতুও ওকে দেখতে পেল । উঠে দাড়িয়েছে সে । চোখে চোখেই কথা হল ওদের । মিতুর বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে চাকরিটা শিমুল পেয়ে গেছে ।
তখনই শিমুল অবাক হয়ে খেয়াল করলো মিতুর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে । শিমুলের কেবল মনে হল মিতুকে এতো সুন্দর আর কোন দিন মনে হয় নি ওকে । জীবনের সব থেকে সুন্দর দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে !

তবে ওদের দুজনের কেউ খেয়াল করলো না টিএসসির সেই মানুষটাও ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । তার মনে আশ্চর্য আনন্দ এসে ভর করেছে । এই দৃশ্যটা দেখার জন্য সে শিমুলের খোজ করেছিলো টিএসসি দেখা হওয়ার পরেই । ফোন নম্বর খুজে বের করতে খুব একটা কষ্ট হয় নি । তারপর নিজের কোম্পানিতে চাকরি অফার লেটার সে নিজেই পাঠিয়েছে । যদিও মিতুকে যে নিয়ে আসবে সেটা সে ভাবে নি । প্রথমে ভেবেছিলো ইন্টারভিউটা সে নিজেই নিবে কিন্তু নিলো না । ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে । ম্যানেজার সাহেব একটু অবাকই হয়েছিলেন তবে কোন কথা বলেন নি । বসের উপরে কথা চলে না ।

এই পুরোটা সময় সে মিতুকে খেয়াল করছিলো । মিতুর চোখে মুখে একটা অস্থিরা দেখতে পাচ্ছিলো সে । প্রিয় মানুষটার জন্য চিন্তা । তারপর যখন শিমুল ক্যাফেতে ঢুকল, একে অন্যের দিকে তাকালো তখন মিতুর চোখ দিয়ে পানি বের হতে দেখলো তার নিজের কাছেই এটো ভাল লাগলো সেটা নিজেও বলতে পারবে না । আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে যেন ফিরে গেল সে । তার নিজে স্ত্রীর মাঝে সে খুজে পেল মিতুকে আর শিমুলের মাঝে খুজে পেল নিজেকে ।

তিনি দেখতে পেলেন মিতুর নিজের চোখ মুছে এগিয়ে গেল শিমুলের দিকে । বলল, এখন আমার জন্য রান্না করবে কে শুনি?
শিমুল হেসে ফেলল । বলল, চিন্তা নেই । আমিই রান্না করবো !
-তাই না ।

লোকটা মনে মনে হাসলো আবার । ঠিক করলো যে ওদের বিয়ের পরে মিতুকেও সে এই কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে দিবে । এই দুজনকে সে সব সময় নিজের চোখের সামনে রাখবে । মিতু আর শিমুল খেয়াল করলো না একজন ক্যাফে থেকে বের হয়ে গেল । এই মানুষটাই তাদের আজকের আনন্দের জন্য দায়ী সেটা ওরা জানতেও পারলো না ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 64

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “এই সব মিথ্যে গল্প (২.৮)”

  1. মিতু… নামটার সাথে একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে…

  2. এইসব মিথ্যে গল্প গুলো সত্য হয়ে উঠুক; এমন সব ভালোবাসা গুলো জীবনের যুদ্ধে এই গল্পের মতই জয় লাভ করুক প্রতিবার।

    গল্পে ভালোলাগা।

Comments are closed.