আজকের বিকেল যেন একটু বেশি সবুজ । টিএসসির মোড়ে বসে চা খেতে খেতে মিতু আকাশের দিকে তাকালো । কোন কারণ ছাড়াই আজকে মিতুর মনটা ভাল । এমন প্রায়ই মিতুর সাথে হয় । সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হয় আজকে ও মনটা ভাল খুব । আবার এমন দিনও যায় যখন কোন কারণ ছাড়াই মন খারাপ লাগে ।
আজকে মন ভাল হওয়ার কারণে ঠিক করেছিল যে শিমুলের সাথে দেখা করবে । কয়েক দিন ধরে শিমুনের মন মেজাজ বেশ খারাপ । বিশেষ করে ওর বন্ধু জাহিদের হঠাৎ করে চাকরি হওয়ার পর থেকেই ও যেন নিজেকে আরো একটু যেন গুটিয়ে নিয়েছে সে । ওর কাছে কেবলই মনে হচ্ছে যে ও আসলে কোন কাজের নয় । মিতু ওকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু শিমুল বুঝতে চায় না । মন খারাপ করে ।
আজকেও শিমুল দেখা করতে চাইছিল না । তবে রাজি করানো গেছে ওকে । শেষ পর্যন্ত এসে হাজির হয়েছে টিএসসিতে । মিতুর পাশে বসে আছে বিরস মুখে । কাপে চুমুক দিচ্ছে একটু পর পর ।
মিতু শিমুলের কাধে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল, কী ভাবছিস এতো?
শিমুল কিছুই ভাবছিলো না । তবে এই ভাবে এখানে মিতুর পাশে বসে থাকতে ওর কেন জানি ভাল লাগছিলো না । সকালে মায়ের সাথে একটা কথা কাটাকাটি হয়েছে । ওর চাকরি না পাওয়া নিয়ে বাসার সবাই খুব বিরক্ত । যদিও শিমুল মোটেই বাসায় একেবারে বসে থাকে না । শিক্ষা জীবন থেকেই টিউশনি করে সে । এখন যদিও সেটা কমিয়ে দিয়েছে । লেখালেখির হাত ছিল । অনলাইনে বিভিন্ন পত্রিকাতে লিখেও টুকটাক আয় করে । সেটা বাইরে বলার মত কিছু না । তবে হাত খরচের জন্য বাসায় হাত পাততে হয় না । কিন্তু ওর মায়ের এমন আচরণ যেন দুনিয়ার তার মন অকাজের আর কেউ নেই । অবশ্য শিমুলের এখন নিজেরও এমন মনে হতে শুরু করেছে ।
পড়াশোনা শেষ হয়েছে বছর খানেক হতে চলল । এখনও ভাল কোন চাকরি জোগার করতে পারে নি সে । চারিদিকে যারাই আসছে সবার আগে এই প্রশ্ন !
শিমুল কী করে !
কেন কিছু করছে না !
আশে পাশের সবাই চাকরি পেয়ে যাচ্ছে শিমুলের কেন কিছু হচ্ছে না !
কবে কিছু হবে !
সবার কথা শুনে শিমুলের কেবল মনে হচ্ছে যে দুনিয়াতে ওর চাকরি পাওয়া ছাড়া আর কাজ কারো নেই । সবাই ওর জন্য কতই না চিন্তিত অথচ সে খুব ভাল করেই জানে এই চিন্তা আসলে লোক দেখানো । ওরা সবাই ওকে টিটকারি মারছে ! সবার মধ্যে কেবল মিতুর কথা শুনলে মনে হয় ওর চাকরি পাওয়া না পাওয়া কোন চিন্তা নেই ।
-কী ব্যাপার কী ভাবছিস এতো?
প্রশ্নটা আবার করলো মিতু । শিমুল বলল, কিছু ভাবছি না ।
-এতো কেন চিন্তা করিস বস তো?
-তো কী করবো?
-শোন জীবনের জন্য জীবিকা, জীবিকার জন্য জীবন নয়! কিন্তু আমরা সবাই কেমন চাকরি টাকা আয়ের জন্য বেঁচে থাকছি ।
শিমুল তাকালো মিতুর দিকে । মিতুর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে শিমুলের হাতটা ধরলো । তারপর বলল, এতো চিন্তা করিস না । কিছু একটা হবে । আজ কাল হোক । সবার আগে হচ্ছে তোর না হয় পরে হবে একটু !
-যদি না হয় !
-না হলে আর কি ! রান্না করতে তো পারিস ! আমি চাকরি তুই আমার জন্য রান্না করবি । পারবি না ?
-তবুও আমাকেই বিয়ে করবি?
-হুম ! অন্য কাউকে দিয়ে চলবে না আমার ! বুঝেছিস? পাগল কোথাকার !
শিমুলের জানি মনটা একেবারে ভাল হয়ে গেল । মিতুর সাথে প্রতিবার দেখা হওয়ার পরেই এমনটা হয় । তবে শিমুলের ভয় করে যে হয়তো কোন একদিন এমনও আসবে তখন অন্য সবার মত মিতুই বদলে যাবে । এমন কোন দিন যদি আসলে তখন শিমুলের পক্ষে সেটা সহ্য করা মুস্কিল হয়ে যাবে ।
শিমুল বলল, তখন কিন্তু প্যান প্যান করতে পারবি না । মনে থাকে যেন !
-আচ্ছা বাবা করবো না । তবে রান্না ভাল না হলে কিন্তু খবর আছে বললাম !
শিমুল কিছু না বলে হেসে ফেলল । হাসলো মিতুও । দুজন হাসতে লাগলো ।
অবশ্য ওদের দুজনের কেউ খেয়াল করলো না যে ওদের কে দুজনকে একজন লক্ষ্য করছে । ওদের কথা বার্তা শুনছে মন দিয়ে । ওদের হাসি দেখে তার নিজের ঠোঁটেও একটা হাসি দেখা দিয়েছে ।
দুই
শিমুলের হাতে যখন এপোয়েন্টমেন্ট লেটার দেওয়া হল তখনও শিমুলের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না । অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । বারবার মনে করার চেষ্টা করছে এই কোম্পানিতে সিভি দিয়েছিলো কিনা । কিন্তু মনে করতে পারলো না । অসভ্য বিডিজবস থেকে অনেক জায়গাতেই সিভি দিয়েছে গত এক বছরে । এতো কোম্পানির নাম কী তার মনে আছে !
গত পরশু দিন হঠাৎ করে শিমুলের ফোনে একটা ফোন এসে হাজির হল । শিমুলকে বলা হল যে তাকে এই কোম্পানির ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়েছে । যে যেন আজকে এসে হাজির হয় । একটু অবাক হয়েই হাজির হয়েছিলো সে । সকাল এগারোটায় তার ইন্টারিভিউ নেওয়া হল । তারপর তাকে বলা হল যে একটু অপেক্ষা করতে । এক ঘন্টা পরেই এপোয়েন্টমেন্ট লেটার হাত দিয়ে দেওয়া হল । বেতনের পরিমান দেখে চোখ কপালে উঠলো । শুরুতেই দেবে ৫০ হাজার । চাকরি স্থায়ী হলে বেতন হবে ৭০ হাজার । এতো ভাল চাকরি সে কিভাবে পেয়ে গেল সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না । এতো ভাল ভাগ্য তার ভাল !
অফিস বিল্ডিং নিচের ফ্লোরে একটা ক্যাফে এসে থামলো শিমুল । মিতুকে খুজতে লাগলো । অফিসের সময়ে আগে সে মিতুকে এখানেই রেখে গিয়েছিলো । দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে মিতুকে খুজতে লাগলো । পেয়ে গেল একটু পরেই । মিতুও ওকে দেখতে পেল । উঠে দাড়িয়েছে সে । চোখে চোখেই কথা হল ওদের । মিতুর বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে চাকরিটা শিমুল পেয়ে গেছে ।
তখনই শিমুল অবাক হয়ে খেয়াল করলো মিতুর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে । শিমুলের কেবল মনে হল মিতুকে এতো সুন্দর আর কোন দিন মনে হয় নি ওকে । জীবনের সব থেকে সুন্দর দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে !
তবে ওদের দুজনের কেউ খেয়াল করলো না টিএসসির সেই মানুষটাও ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । তার মনে আশ্চর্য আনন্দ এসে ভর করেছে । এই দৃশ্যটা দেখার জন্য সে শিমুলের খোজ করেছিলো টিএসসি দেখা হওয়ার পরেই । ফোন নম্বর খুজে বের করতে খুব একটা কষ্ট হয় নি । তারপর নিজের কোম্পানিতে চাকরি অফার লেটার সে নিজেই পাঠিয়েছে । যদিও মিতুকে যে নিয়ে আসবে সেটা সে ভাবে নি । প্রথমে ভেবেছিলো ইন্টারভিউটা সে নিজেই নিবে কিন্তু নিলো না । ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে । ম্যানেজার সাহেব একটু অবাকই হয়েছিলেন তবে কোন কথা বলেন নি । বসের উপরে কথা চলে না ।
এই পুরোটা সময় সে মিতুকে খেয়াল করছিলো । মিতুর চোখে মুখে একটা অস্থিরা দেখতে পাচ্ছিলো সে । প্রিয় মানুষটার জন্য চিন্তা । তারপর যখন শিমুল ক্যাফেতে ঢুকল, একে অন্যের দিকে তাকালো তখন মিতুর চোখ দিয়ে পানি বের হতে দেখলো তার নিজের কাছেই এটো ভাল লাগলো সেটা নিজেও বলতে পারবে না । আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে যেন ফিরে গেল সে । তার নিজে স্ত্রীর মাঝে সে খুজে পেল মিতুকে আর শিমুলের মাঝে খুজে পেল নিজেকে ।
তিনি দেখতে পেলেন মিতুর নিজের চোখ মুছে এগিয়ে গেল শিমুলের দিকে । বলল, এখন আমার জন্য রান্না করবে কে শুনি?
শিমুল হেসে ফেলল । বলল, চিন্তা নেই । আমিই রান্না করবো !
-তাই না ।
লোকটা মনে মনে হাসলো আবার । ঠিক করলো যে ওদের বিয়ের পরে মিতুকেও সে এই কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে দিবে । এই দুজনকে সে সব সময় নিজের চোখের সামনে রাখবে । মিতু আর শিমুল খেয়াল করলো না একজন ক্যাফে থেকে বের হয়ে গেল । এই মানুষটাই তাদের আজকের আনন্দের জন্য দায়ী সেটা ওরা জানতেও পারলো না ।
মিতু… নামটার সাথে একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে…
এইসব মিথ্যে গল্প গুলো সত্য হয়ে উঠুক; এমন সব ভালোবাসা গুলো জীবনের যুদ্ধে এই গল্পের মতই জয় লাভ করুক প্রতিবার।
গল্পে ভালোলাগা।