”তো বলুন মিস্টার সুমন, আপনার কী সমস্যা ? আমাকে খুলে বলুন ? অফিসে স্ট্রেস কি খুব বেশি?”
তমা খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে আমার দিকে তাকালো । আমি এখন তমার কেবিনে এসে বসেছি । অফিস আওয়ার পার হয়েছে কিছু সময় আগে । তমা লাঞ্চ আওয়ারের আগে ফোন করে জানিয়েছে যে আমার পারফরমেন্স নিয়ে সে মোটেই সন্তুষ্ট নয় । কয়েক দিন যাবত আমার কাজ কর্মে অনেক ভুল হচ্ছে । আমি নাকি ঠিক মত কাজে কর্মে মন দিচ্ছি না । সে আমার নামে ফাইনাল অভিযোগ করার আগে আমার সাথে কথা বলতে চায় যে কোন সমস্যার ভেতর দিয়ে আমি যাচ্ছি কিনা ! এই কারণেই আজকের এই মিটিং !
তমার কেবিনটা বেশি বড় না । তবে সুন্দর করে সাজানো গোছানো । সে আমাদের ডিভিশনের হেড । আমাদের সব ভাল মন্দ দেখার দায়িত্ব তার । এবং সত্যি বলতে কি বয়সে কম হলেও মেয়েটা যে সেই কাজ বেশ ভাল ভাবেই করছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে । এই যেমন তমা বাদ দিয়ে যদি আমাদের আগের বস থাকতো তাহলে সে সরাসরি আমার নামে রিপোর্ট করতো ম্যানেজারের কাছে । কিন্তু তমা আগে আমার সমস্যাটা শুনতে চাচ্ছে । আমি কোন সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি কিনা কেন এমন হচ্ছে এটা তার জানার একটা বিষয় ।
আমি টেবিলের উপরে রাখা কফির কাপের দিকে তাকালাম । আমি যে চা খাই না, কফি খাই সেটা তমা জানে । এই রকম ছোট খাটো সব ব্যাপারেই তমার খেয়াল আছে । এই ব্যাপারটা আমাদের সবাই জানে । এই কারণে তাকে সবাই পছন্দ করে । আমিও করি । এবং আমার এই পছন্দ অন্য সবার থেকে একটু আলাদা । এবং আরো ভাল করে বললে আমার কাজে কর্মে মন না বসার কারণও খানিকটা এটাই ।
তমা যখন আমাদের অফিসে ইনচার্য হিসাবে যোগ দিলো তখন অনেকেই তাকে পছন্দ করে নি । বিশেষ করে একজন মেয়ে বস হিসাবে আসবে এটা আমাদের সমাজের অনেক ছেলেই ঠিক মেনে নিতে পারে না । এমন কি স্বয়ং মেয়েরাও এই ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারে না । তবে ধীরে ধীরে সবাই তমার কাজে কর্মে খুশিই হল এবং সবার মাঝেই সে খানিকটা গ্রহনযোগ্যতা পেতে শুরু করলো । তবে শুরু থেকেই তমাকে পছন্দ করতাম । বিশেষ করে ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমার পছন্দ ছিল । আরেকটা ব্যাপার ভাল লাগতো তা হল সে যে আমাদের বস এটা সে কখনই ফলাতে চাইতো না । সে আমাদের সহকর্মী হিসাবেই নিজেকে প্রকাশ করতো ।
আমার মনে আছে একবারের ঘটনা । মাস ছয়েক হয়েছে তখন তমা কাজে জয়েন করেছে । তখন কাজের চাপ প্রচুর । একটা টেন্ডার জমা দিতে হবে অথচ কাজ শেষ হয় নি । আমাদের চারজনের উপর দায়িত্ব ছিল । আমরা তখন সব কাজ কুলিয়ে উঠটে পারি নি । একদিন আগে আমি সকাল থেকে খেটে যাচ্ছি । যা অবস্থা তাতে রাত বারোটা বাজবে । আমার দায়িত্ব ছিল সব থেকে বেশি । দেখলাম একে সবাই চলে গেল । কেবল আমি রয়ে গেলাম । কারণ শেষ কাজ আমাকে শেষ করতে হবে । ঘড়িতে তখন নয়টা বাজে । পুরো অফিসে আমি একা বসে কাজ করছি । বাইরে কেবল দারোয়ান রয়েছে । আর কেউ নেই ।
তখনই আমি আবিস্কার করলাম যে তমা তখনও রয়ে গেছে । নিজেই আমার জন্য কফি নিয়ে এল । তারপর আমার কাজে সাহায্য করতে লাগলো । তার সাহায্য করার কথা ছিল না । কাজটা আমার ছিল কিন্তু তারপরেও সে করলো সাহায্য । রাত এগারোটার সময় কাজ শেষ হল । আমার সাথেই বের হল । উবার ডাকতে যাচ্ছিলো সে তবে আমি জোর করে নিজের বাইকে তুলে নিলাম ওকে । বাইকে যেতে যেতে তমা টুকটাক গল্প করছিলো । মূলত সেদিন থেকেই আমার ওর প্রতি ভাল লাগাটা ভালোবাসার দিকে পরিনত হতে শুরু করলো । ততদিনে আমি জেনেছি যে তমা তখনও বিয়ে করে নি কিংবা ওর কোন ভালোবাসার মানুষও নেই ।
আমি কফির কাপে চুমুক দিলাম । তমাও কফি কম খায় আমি জানি । ওর পছন্দ গ্রিন টি । টংয়ের দোকানের চা ওর খুব পছন্দ । প্রায়ই দেখি রাস্তার পাশে দাড়িয়ে বন্ধুদের সাথে চা খাওয়ার ছবি ও ফেসবুকে আপোলোড দিচ্ছে । তবে আজকে দেখলাম আমার সাথে কফি খাচ্ছে সে ।
-কফিতে চিনি ঠিক আছে?
-জ্বী ঠিক আছে ।
-গুড । এবার বলুন কী সমস্যা ? আপনার কাজে কর্মে মন নেই কেন? স্ট্রেস কি বেশি যাচ্ছে ?
আমি কী বলবো ঠিক খুজে পেলাম না । কিংবা কথাটা কিভাবে বলবো সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না ।
-দেখুন আমি আপনাকে কাজ করতে দেখেছি । আপনি এমন মানুষ নন । কাজ কর্ম ভাল করেছেন সব সময় । তাহলে কদিন থেকে কী এমন হল যে আপনার কাজ কর্ম ঠিক মত হচ্ছে না ? কোন একটা ঘটনা তো ঘটেছে । ফ্যামিলি প্রবলেম ? যতদুর জানি যে প্রেমিকা নেই আপনার । সেদিকের প্যারাও নেই ।
আমি এবার তমার দিকে তাকালাম । তারপর শান্ত কন্ঠে বললাম, আমার স্ট্রেসের কারণ আসলে আপনি !
কথা বলেই মনে হল যে ঠিক হল কি?
সরাসরি বসকে যদি বলি আমার কাজ কর্মে মন না বসার কারণ হচ্ছে আপনি নিজে কিংবা আপনার কারণে আমি কাজ করতে পারছি না তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাড়ায় !
আমি তমার চোখে একটা বিস্ময় দেখতে পেলাম । তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সে বলল, আমি?
-হ্যা আপনি!
-আমি আপনাকে খুব বেশি স্ট্রেস দিয়েছি?
স্ট্রেস সে দেয় নি । এই কথা কেউ বলতে পারবে না । তবে আমার স্ট্রেসের কারণের সাথে সে খুব ভাল ভাবেই জড়িতো । তমা আবার বলল, প্লিজ সুমন সাহেব আমি জানতে চাই যে আমি কী করলাম যেটা আপনার কাছে স্ট্রেস মনে হল ?
আমি কফিতে কাপে লম্বা একটা চুমুক দিলাম । তারপর সেটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে বললাম, আমার স্ট্রেসের কারণ হচ্ছে আপনি বিয়ে করে ফেলছেন । বিয়ের জন্য একটা ছেলের সাথে মিশছেন । আমি জানি এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার । গত মাসের ২৬ তারিখে সেই ছেলেটা আমাদের অফিসে এসেছিলো । পরে তার সাথে আপনি বাইরে বের হন । এই ঘটনার পর থেকে আমার মনে শান্তি নেই । আমি আসলে কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছি না । চাইলেও পারছি । আমার পক্ষে আর এখানে চাকরি করা সম্ভব হবে না মনে হচ্ছে ।
এক বারে কথা গুলো বলে বড় করে একটা দম নিলাম । তারপর তমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলাম । তমা পেছন থেকে আমাকে ডাকলো না । যদিও ডাকলেও আমি দাড়াতাম না । এমন কথা বলে দাড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভবও না ।
পরের একটা সপ্তাহ তমার সাথে আমার একটা কথাও হল না । যদিও কয়েকবার দেখা হল । তবে তমা এমন একটা ভাব করলো যেন আমাদের মাঝে সেদিন কোন কথাই হয় নি । আমিও এমন ভাব করলাম যে ঐদিন আমি কিছুই বলি নি । তবে আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি যে এখানে আর চাকরি করবো না । এখানে চাকরি করা সম্ভব হবে না আর । মনে মনে নতুন চাকরি খোজ করা শুরু করে দিলাম । কয়েক স্থানে সিভিও ড্রপ করলাম । মাস খানের ভেতরে নতুন চাকরিটা জুটেও গেল । অফার লেটার হাতে চলে এল । যদিও আমি কাউকেই বলি নি আমার নতুন চাকরির কথা তবে তমা কিভাবে যেন জেনে গেল ! আমি নিজেও জানি না যে ও কিভাবে জানলো !
লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে বসে আছে । কফি শেষ করে উঠবো এমন সময় তমাকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম ।
-সুমন সাহেব । আমার সাথে একটু ছাদে আসুন ।
তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে ছাদের দিকে হাটা দিল । আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ আমাদের খেয়াল করলো কিনা । দেখলাম সবাই নিজের খাওয়া আর গল্পে ব্যস্ত । আমি বিল দিয়ে ছাদের দিকে হেটে গেলাম । গিয়ে দেখলাম তমা এক পাশে দাড়িয়ে রয়েছে । ওর মুখ খানিকটা গম্ভীর হয়ে আছে । আমি ওর সামনে গিয়ে দাড়াম । তমা বলল, আপনি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন?
আমি একটু চমকে গেলাম । আমি নতুন চাকরি পেয়েছি এটা আমি এখনও কাউকে বলি নি । তাহলে তমা কিভাবে জানলো ! তারপর মনে হল সেদিন বলেছিলাম যে আমি চাকরি করবো না এখানে । সেখান থেকে কি বলছে?
-হ্যা ।
-কেন?
-আপনি জানেন কারণ টা । আর এখানে আমি ঠিক মত কাজ করতে পারছি না ।
-তাই বলে আমাকে না বলে নতুন চাকরি জয়েন করবেন?
আমি একটু অবাক হলাম এবার । বললাম, আপনি কিভাবে জানেন যে আমি নতুন চাকরিতে জয়েন করছি?
তমা বলল, সেটা আমি জেনেছি । সত্যি কিনা বলুন ?
-হ্যা সত্য !
-ঐ কোম্পানি ভাল না । আমাদের এখান থেকে তো ভাল না মোটেও । ওখানকার গ্রোথ ভাল না ।
-আমি জানি ।
-তারপরেও কেন যাবেন ?
-আমি কেন এতো চিন্তা করছেন?
-বাহ রে আমি চিন্তা করবো না ! আমাদের আন্ডারে চাকরি করা সকলের ভাল মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার ।
-তখন তো আমি আর আপনার আন্ডারে থাকবো না।
-কে বলেছে থাকবেন না । আপনার জন্য আমি আমি সজিবকে না করে দিলাম । এখন বলছেন চলে যাবে একটা খারাপ কোম্পানিতে । তা হবে না !
আমার মনে হল আমি যেন ভুল শুনলাম । বললাম, কী বললেন আপনি ?
-শুনেন নি কী বলেছি?
আমি কিছু সময় কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলা তমার দিকে । আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার ভেতরে কেমন যেন একটা কাঁপন শুরু হয়েছে । তমা বলল, নতুন চকারি খুজবেন ভাল কথা কিন্তু সেটা এখানকারটার থেকে ভাল হতে হবে । এটা মনে রাখবেন । নয়তো এখান থেকে কোথাও যাওয়া চলবে না ।
তমা আমাকে সেখানে রেখে চলে গেল । আমি কিছু সময় সেখানেই ঠাই দাড়িয়ে রইলাম । মনের ভেতরে কেমন যে অনুভূতি হচ্ছে সেটা ভাষার প্রকাশ করার মত নয় !
লাঞ্চ শেষে নিজের ডেস্কে বসলাম বটে তবে কোন কিছুতেই মন বসলো না । ঘুরে ফিরে কেবল তমার কথাই মনে হতে লাগলো ।
মেয়েটা ঐ ছেলেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে ?
আমার জন্য বাদ দিয়েছে ?
অবশ্যই আমার জন্যই বাদ দিয়েছে । নয়তো কেন দিবে !
অফিস শেষ করে আমি এদিক ওদিক কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম । তমা আসে কিনা সেটা দেখার জন্য । তবে তমা এল না । শেষে ওর কেবিনের কাছে গিয়ে দেখলাম যে ও কেবিনে নেই । সম্ভবত বের হয়ে গেছে । মনটা একটু খারাপ হল ।
তবে বাইক নিয়ে যখন গেটের কাছে এলাম তখন তমাকে দেখতে পেলাম । আমাদের কয়েকজন কলিগদের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে । এবং সব থেকে অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে আমাকে দেখেই ও কলিগদের কী যেন বলল তারপর আমার দিকেই এগিয়ে গেল । আমি আপনা আপনিই বাইক দাড় করলাম । ওর চোখের দৃষ্টি দেখেই আমি থেমে গেলাম। তমা সবার সামনেই খুব স্বাভাবিক ভাবে আমার বাইকের পেছনে উঠে বসলো । আমি কলিগদের দিকে তাকিয়ে দেখি ওদের ভেতরে কয়েকজন দুষ্টামির হাসি হাসছে ।
বাইক যখন চলতে শুরু করলো আমি বললাম, ওরা কী ভাবলো?
-ওরা কী ভাবলো সেটা আমাদের ভাবার কি দরকার আছে?
-নেই?
-না । অন্য স্ট্রেস আপনাকে নিতে হবে না । এখন থেকে আপনার প্রধান চিন্তা হবে যে আমি কী ভাবলাম সেটা ! অফিসে যেমন আমি আপনাকে স্ট্রেস দেই এখন থেকে অফিসের বাইরে বাসায় ঘরে সব স্থানে আমার এই স্ট্রেস নিয়েই আপনাকে থাকতে হবে । কোন অভিযোগ চলবে না । বুঝেছেন?
আমি কেবল বললাম, বুঝেছি ।
-গুড ! এখন ঐ চাপের দোকানের সামনে দাড়ান দেখি । আগে চা খাওয়া যাক । আর আজ থেকে কফি না চা খাওয়ার অভ্যাস করুন । আমি কিন্তু কফিটফি বানাতে পারবো না আগে থেকেই বলে দিলাম ।
আমি বাইকটা থামালাম টংয়ের দোকানের সামনে । আমি জানি এখন থেকে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যাবে । তবে সেই পরিবর্তনে আমার খুব একটা আপত্তি থাকবে না । এই স্ট্রেস আমি ইচ্ছে করেই নিবো মাথায়।
গল্পের লিংক সরাসরি পেতে হোয়াটসএপ গ্রুপ অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন করুন। সকল গল্পের সূচিপত্র।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
আপনার গল্প গুলোর মতন যদি জীবনের গল্প গুলোতেও এমন হ্যাপি এন্ডিং এ মোড় নিতো…. আফসোস!!
যদিও প্রিডিক্টেবল, তবুও বরাবরের মতোই গল্প ভালো ছিল। ⭐⭐⭐⭐/৫