স্বপ্নের মত দিন

oputanvir
4.6
(63)

আমি ভেবেছিলাম অন্য স্বাভাবিক মেয়েদের মত করে নাওরিন আমাকে এক সময়ে ছেড়ে যাবে । আমাকে ছেরে কোন ভাল ছেলেকে দেখে বিয়ে করে সংসারি হবে । ভাল ছেলে দেখে বিয়ে বলতে আবার এই না যে আমি আবার খুব খারাপ ছেলে । আসলে আমিও ভাল ছেলে । মানে যে গুণ থাকলে একটা ছেলেকে খারাপ বলা যায় আমার ভেতরে সেসবের কিছুই নেই । আমি কোন নেশা করি না, বাজে সঙ্গ নেই এমন কি নওরিন ছাড়া অন্য কোন প্রেমও জীবনে আমি করি নি । সেই হিসাবে মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলা প্লেবয়ও আমি নই । তাহলে আমাকে বিয়ে করতে নওরিনের সমস্যা কোথায়?
সমস্যা হচ্ছে আমি খানিটা ভ্যাগাবন্ড টাই ছেলে । মানে জীবন নিয়ে আমি খুব একটা সিরিয়াস কোন কালেই ছিলাম না, এখনও নই । আমি ভাল ছেলে বলতে যে ছেলে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে যথেষ্ঠ সচেতন এমন ছেলেকে বুঝিয়েছিলাম । আপনি আসলে কত ভাল সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না যদি না আপনি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা না করেন ।

নওরিন এক সময়ে আমাকে বারবার বলতো এই কথা । সারাটা সময়ে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতো । তবে সে চাকরি পাওয়ার পরপরই সেই ঘ্যান ঘ্যান বন্ধ হয়েছে । আমি ভেবেছিলাম যে ও হয়তো এবার আমাকে ছেড়েই দিবে । তবে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে ওর চাকরি পাওয়ার প্রায় দুই বছর হয়ে গেলেও নওরিন আমাকে ছেড়ে যায় নি । আমি কৌতুহল নিয়ে নওরিনকে জিজ্ঞেক করলাম । বললাম আগে তো আমার চাকরি বাকরি নিয়ে খুব কথা বলতে । এখন বল না যে?

দিনটা শুক্রবার । আমি আর নওরিন রমনা পার্কের ঘাসের উপর বসে আছি । নওরিন তখন বাদাম খাচ্ছে । আমার প্রশ্ন শুনে নওরিন বলল, কেন তুমি চাও আবারও শুরু করি ?
-না সেটা না ।
-তাহলে?
-না মানে কারণটা জানতে চাচ্ছি কেবল । বিরক্ত হয়ে?
একটা বাদাম মুখে দিতে দিতে নওরিন বলল, না ঠিক বিরক্ত হয়ে না । আসলে যখন চাকরি করতাম না তখন বাসা থেকে খুব চাপ দিতো বিয়ের জন্য । এই জন্য তোমাকে বলতাম বারবার । এখন চাকরি পাওয়ার পরে বাসা থেকে চাপ দিতে পারে না । হ্যা তারা বলে ঠিকই তবে আমি পাত্টা দেই না এখন । আর তোমাকেও প্যারা দেই না ।
-এভাবেই থাকবে?
-দেখা যাক কত দিন থাকা যায় । যদি তোমার থেকে ভাল কাউকে পাই চলে যাবো সেদিন !

আমার থেকে অনেক ভাল ছেলের সাথে নওরিনের বিয়ের কথা বার্তা হচ্ছিলো । এর ভেতরে একজন ছিল বিসিএস ক্যাডার । বিয়ে প্রায় হয়েই যাচ্ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত নওরিনের জেদের কাছে সবাই পরাজয় মানে । বিয়ে থেকে যায় । আমি সেবার সত্যিই অবাক হয়েছিলাম ।

আমার মনে হল নওরিনকে বিয়ের কথা বলাই যায় কিন্তু পরপরই আমি ভয় পাই । কিভাবে ওর দায়িত্ব নেব আমি । সবাই সব কিছুর জন্য তৈরি হয় না । আমিও এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তৈরি হয় নি । আমার মনে সাহস হয় না । কিন্তু সেই সাথে এও জানি যেদিন নওরিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, যেদিন ওর অন্য কারো সাথে বিয়ে হবে সেদিন হয়তো আমার আর বেঁচে থাকতে পারবো না ।

-বিয়ে করবে আমাকে ?

নওরিন এবার একটু অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে । আমি কখনই ওকে বিয়ের কথা বলি না । আজকে এই কথা বলতে দেখে নওরিন বলল, আর ইউ আস্কিং অর জাস্ট টাইম পাস?
-জিজ্ঞেস করছি। করবে?
-বউকে কী খাওয়াবে শুনি?
-বউ তো নিজেই অনেক টাকা আয় করে । আমার খাওয়ানো লাগবে না ।
নওরিন বলল, সেটা না হয় খেলো কিন্তু মানুষের কথা সহ্য হবে তো! বউয়ের কোন সমস্যা নেই । পুরুষের আবার সুপিওরিটি কম্প্লেক্স থাকে । মেল ইগোতে যদি আঘাত লাগে ! তখন?

আমি কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলাম । নওরিন আবারও বাদাম খাওয়ায় মন দিল । ও প্রথমে একটু কৌতুহলি হয়ে উঠেছিলাম আবার ধরে নিয়েছে আমি আগের অবস্থায় ফিরে যাবো । আমি বলল, আমাদের গ্রামে কিছু জায়গা সম্পত্তি আছে । বাবাকে বলেছি যে তার কিচু অংশ বিক্রি করতে । বাবাও আমার উপর বেশ বিরক্ত । বললাম যে টাকা দিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট করতে চাই । প্রথমে ভেবেছিলাম সে কিছুই করবে না । তবে গতকাল রাতে খাবার সময় বলল যে তার পরিচিত একজন একটা রেস্টুরেস্ট ছেড়ে দিচ্ছে । লোকেশন টা ভাল । ঐ বেইলি রোডে স্খুলের কাছে , সে কথা বলেছে ।

এবার দেখলা নওরিন একটু গম্ভীর ভাবে আমার দিকে তাকালো । আমি বললাম, গ্রাম থেকে জমি বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা পাও্য়া যাবে । রেস্টুরেস্টটা আগে দিই । তুমি এখনই চাকরি ছেড়ো না । যদি দাড়িয়ে যায় তখন দুজন মিলে এক সাথে রেস্টুরেন্ট চালানো যাবে। কী বল?

আমি তখনই দেখতে পেলাম নওরিনের চোখে পানি জমতে শুরু করেছে । ও আসলে ভাবতেই পারে নি যে আমি সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাইবো । এই আনন্দের কারণের ওর চোখে পানি চলে এসেছে । অন্য দিকে তাকিয়ে সে পান আটকানোর চেষ্টা করলো । আমি ওর মুখোমুখি বসে ছিলাম । উঠে গিয়ে একেবারে ওর শরীর ঘেষে বসলাম । তারপর হাত ধরে বললাম, প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে বটে তবে রেস্টুরেন্টটা দাড়িয়ে গেলে দুজন সব সময় এক সাথে কাজ করতে পারবো ।

আমাদের বিয়ে হয়ে গেল পরের মাসেই । নওরিনের বাবা যদিও খানিকটা অখুশি ছিলেন তবে রাজি হলেন শেষ পর্যন্ত । বাবা নিজে গিয়ে তাকে বোঝালো । পরিকল্পনার কথা বলল।
বিয়ের পরে নওরিন আমাদের বাসায় উঠে এল । মানিয়ে নিল খুব জলদি । আসলে সেই ক্যাম্পাস জীবন থেকেই নওরিন আমাদের বাসায় আসে । প্রথম যখন বন্ধু ছিলাম তখন থেকেই। তারপর প্রেমিকা হওয়ার পর থেকে অনেকবারই এসেছে । মায়ের সাথেও ওর ভাব ছিল অনেক বেশি । তাই মানিয়ে নিতেও কষ্ট হল না ।
বিয়ের মাস খানেক পরে আমি নওরিনকে বললাম, চল গ্রামে ঘুরে আসি । জমিজমা বিক্রির আগে কটা দিন ওখানে কাটিয়ে আসি । কী বল !
নওরিন মানা করলো না । বিয়ের পরে আমাদের কোথাও যাওয়া হয় নি তখনও । নওরিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিল সপ্তাহ খানেকের জন্য । আমি রওয়ানা দিলাম আমাদের গ্রামের দিকে ।

দুই
-এ সব তোমাদের জমি ?
-হ্যা ।
নওরিন এবার আমার দিকে তাকালো অবাক হয়ে । বলল, তোমরা দেখি বিশাল বড়লোক !
-বড়লোক না ছাই । এসব জমির দাম নেই খুব একটা । খুব বেশি টাকা পাওয়া যাবে না ।

গতকালই আমরা এসেছি আমাদের গ্রামে । আমাদের দাদার বাবা সত্যি সত্যিই জমিদার ছিলেন । নিজেদের থাকার জন্য বিশাল বাড়ি বাড়ি বানিয়েছিলেন যার অনেকটাই এখন ভেঙ্গে চুরে গেছে । সেই বাড়িটার এক অংশ এখন আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা । অনেক ঘরই ব্যবহারের যোগ্য না । কয়েকটা ঘর পরিস্কার করে সংস্কারে বাড়ির কাজের লোকজন থাকে আর আর বাড়ি জমিজমা দেখা শোনা করে । বাবা মাঝে মাঝে আসেন জমিজমার জন্য । তখন সে এখানে থাকেন ।

কয়েকটা দিন কেটে গেল খুব চমৎকার ভাবে । নওরিন গ্রামে ঘুরে বেড়ায় । পুকুর পাড়ে বসে । গাছ থেকে পেয়ারা পড়ে খায় । ওর জন্য একটা সাইকেল আনা হয়েছে, সেটা চালায় । সব মিলিয়ে সাতটা দিন কিভাবে যে পার হয়ে গেল সেটা আমরা কেউই বুঝতে পারলাম না । তারপর ঢাকাতে ফিরে গেলাম আবার । কিন্তু আমি তখনও বুঝি নি যে নওরিনের মনে কী রেয়েছে ।

পরের দিন খাওয়ার টেবিলেই নওরিন কথাটা বলল বাবাকে উদ্দেশ্য করে ।
-আব্বু জমি কি বিক্রির কথা বার্তা হয়ে গেছে ?

আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো এটা বিক্রির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী । বাবা বলল, কথা বার্তা চলছে । অনেক পরিমান জমি তো । বায়ার খুজতে সময় লাগছে ।
-আব্বু বিক্রি করতে হবে না জমি !

আমি খানিকটা অবাক হলাম নওরিনের কথা শুনে । দেখলাম বাবাও কৌতুহল নিয়ে তাকালো নওরিনের দিকে ।
নওরিন বলল, জমি গুলো থাকুক । যেমন আছে । ঢাকা থেকে তো খুব বেশি দুরে না । যেতে সময় লাগে না খুব একটা । আমি আর জাহিদ যদি গ্রামে গিয়ে থাকি, জমি জমা দেখা শুনা করি তারপর যে জমি গুলো লিজ দেওয়া আছে সেগুলোতে নিজেরাই চাষবাষ করি আপনার কি আপত্তি আছে?

আমি তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম নওরিনের দিকে । দেখলাম বাবা মা দুজনেই দেখলাম বেশ অবাক হয়েছেন । বাবা বলল, তুমি সত্যিই গ্রামে গিয়ে থাকতে চাও মা?
-জ্বী । ঢাকা শহর আমার কোন কালেই পছন্দ ছিল না । এখনও নেই । পড়াশোনার পরে আমি চাকরি নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে চেয়েছিলাম । আপনার ছেলের কারণে ঢাকা ছাড়তে পারি নি । এখন এতো বড় একটা সুযোগ এসেছে । সেটা ছাড়তে চাই না ।
-কিন্তু ঢাকার বাইরে গিয়ে কি থাকতে পারবে ? এখন হয়তো কয়েকটা দিন সেখানে কাটিয়ে এসে ভাল লাগছে কিন্তু যখন পার্মানেন্টলি থাকবে সেখানে তখন কিন্তু ভাল লাগবে না ।
-আব্বু যদি ভাল না লাগে তখন তো উপায় আছে । তখন বিক্রি করা যাবে । তাই না ? ধরেন এক বছরের একটা প্রজেক্ট নিলাম হাতে । দেখলাম যে ওখানে আসলেই টিকে থাকতে পারি কিনা আমরা ! যদি না পারি তাহলে ফিরে এলাম । জমি তখন বিক্রি করলাম । কী বলেন ! কিন্তু একবার জমি গুলো হাত ছাড়া হয়ে গেলে আর ফেরৎ আসবে না ।

দেখলাম বাবা হাসল। সে যে মনে মনে খুশি হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না । বিশেষ করে নিজের বাবা দাদার জমিজমা বিক্রি করতে কেউই পছন্দ করে না । বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর কী মত ?
-আমার কোন মত নেই । ও যদি খুশি হয় তাহলে সেটাতে আমিও খুশি
নওরিন মাস খানেকের ভেতরে নিজের চাকরি ছেড়ে দিল । তারপর আমি আর নওরিন তলপি তপলা নিয়ে আমাদের গ্রামে গিয়ে হাজির হলাম । আসার আগে বাড়িটা আরও ভাল করে সারিয়ে নিলাম । একটা অংশের ছাদ ভাল ভাবে ঠিক করা হল । সেখানে যথা সম্ভব সব আধুনিক জীবন যাপনের সব যন্ত্রপাতিও রাখা হল ।
দিন গুলো কেমন স্বপ্নের মত কেটে যেতে লাগলো । নিজেদের জমিজমা দেখা শুনা করতে শুরু করলা আমি নওরিন । জমির ফসল লাগানো থেকে শুরু করে সার দেওয়া পানি দেওয়া সব কাজেই নওরিনের আগ্রহ আমার থেকে বেশি । দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে গেল । একটা ফসল উঠে এল আমাদের ঘরে । সেই সময় ঘরে তোলা মাড়াই করা সব কিছুতেই নওরিন আছে । মাঝে মাঝে সে নিজেও কাজ করতে লাগলো লোকজনের সাথে । এরপর আমরা ঠিক করলাম যে পুকুরে মাছ চাষ করবো ।

নওরিন এসবের ছবি আর ভিডিও করে রাখতো । সেসব আপলোড দিতো ফেসবুক আর ইউটিউবে। এবং আমরা দুজনেই অবাক হয়ে দেখতাম যে সেসব দারুন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করলো ।

রাতে খোলা বারান্দায় বসে আমরা প্রায়ই গল্প করতাম । নওরিন মাঝে মাঝে বলতো, তোমাকে এই গ্রামে নিয়ে এলাম । রাগ করো নি তো ! চাইলেই কিন্তু চলে যাওয়া যায় শহরে !
আমি ওর চুলে বিলি কাটতে বললাম, তুমি যতদিন আছো ততদিন আমিও আছি । চিন্তা নেই । তোমার সাথে এন্টার্কটিকায় গিয়েও থাকতে পারবো !

আমি জানি একটা সময় আমাদের হয়তো চলে যেতে হবে । বিশেষ করে যখন আমাদের বেবি আসবে তখন তার পড়ালেখার জন্য তাকে ঢাকায় তো থাকতেই হবে । তবে সেটা আপাতত পরের চিন্তা । আগে কয়েকটা দিন শান্তিমত থাকি এখানে । কয়েকটা বছর কেটে যাক । পরেরটা পরে । এই স্বপ্নের মত দিন গুলো আর ফিরে পাওয়া যাবে না ।

গল্পটা একটা শুরু বলা যেতে পারে । যদিও গল্পটা এখানেই শেষ তবে এই গল্পের পরের অংশ একটা ভৌতিক গল্প লেখার ইচ্ছে আছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 63

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “স্বপ্নের মত দিন”

  1. A happy conclusion. readers need some satisfaction over the happy ending of protagonists in stories. You write such stories so well. been reading your stories since 2017/18. I found your stories for the first time in samu blog. thanks for continuously writing.

Comments are closed.