নিশির ডাক

oputanvir
4.4
(41)

অন্য সময় হলে কিংবা অন্য কারো কথাটা শুনলে নাজনীন হয়তো হেসে ফেলতো কিংবা খানিকটা বিরক্তি দেখাতো । কিন্তু সামনে যে মানুষটা বসে আছে তার মুখ থেকে এই রকম কথা শোনার পরে সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করাটা সমীচিন হবে না । হাজার হলেই এই মানুষটার সাথে তার বিয়ের কথা বার্তা চলছে । পরিবারের লোকজন খুব করে চাইছে আবিদের সাথেই ওর বিয়ে হোক । আর আবিদ এমন একজন মানুষ যে তাকে অপছন্দ করার কোন কারণই নেই । নাজনীনেরও আপত্তি নেই বিয়েছে । কিন্তু সেই মানুষের মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে নাজনীনের একটু হাসি পেল বটে । তবে সে হাসলো না ।

আবিদ আবার বলল, সত্যিই তুমি বিশ্বাস করলে না?
-আপনিই বলুন, এটা কি বিশ্বাস করার মত কোন কথা?

আবিদ চট কটে কোন জবাব দিতে পারলো না । তবে সে মনে মনে বিশ্বাস করতে চায় যে এমন কিছুই ঘটেছে । নয়তো নাজনীনকে তার এমন ভাল কেন লাগবে? এমন ভাবে তাকে মনে কেন ধরবে ?

নাজনীন এবার বলল, শুনুন আবিদ, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে । সত্যিই পছন্দ হয়েছে । কিন্তু আপনার যদি মনে হয় আপনি আমাকে কেবল এই কারণে পছন্দ করেছেন কারণ আমার প্রাক্তন স্বামীর আত্মা আপনার ভেতরে ঢুকেছে তাহলে আমি বলবো আমাদের বিয়েটা না হোক । ঠিক আছে কি !

হঠাৎ করে নাজনীন এমন কঠিন কন্ঠে কেন কথা বলল সেটা আবিদ ঠিক বুঝতে পারলো না । সে জলদি জলদি বলে উঠলো না প্লিজ, তুমি এমন কথা বলবে না । প্লিজ । আমি আর কিছুই বলছি না । কিছু বিশ্বাস করতে হবে না । তবে বিয়েতে অমত কর না কেমন !

নাজনীন আবিদের ভেতরের উতলা ভাবটা দেখে একটু অবাকই হল । তার ভাব দেখে নাজনীনের মনে হচ্ছে যে কোন উপায়ে নাজনীনকে তার বিয়ে করতেই হবে । ওকে ছাড়া সে বাঁচবে না । নাজনীনের কেন জানি ব্যাপারটা ভাল লাগলো । বলল, ওকে । দয়া এই সব কথা বলবেন না আর। আর আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি নি কেন জানেন?
-কেন?
-কারণ হচ্ছে সত্যিই যদি আমার মৃত স্বামীর আত্মা আপনার ভেতরে ঢুকতো তাহলে আপনি কোন ভাবেই আমাকে পছন্দ করতেন না ।
-মানে?
-সব মানের ব্যাখ্যা করে বলতে হয় না । কিছু কিছু বুঝে নিতে হয় !

আবিদ আসলেই বুঝলো না । তবে পরে এটা নিয়ে চিন্তা করা যাবে ভাবলো । এখন বরং মেয়েটাকে আরো ভাল করে দেখা যাক ।

নাজনীনের সাথে আবিদের বিয়ে হওয়ার কোন কথা ছিল না । এমন কি বিয়ের কথা বার্তাও হওয়ার কথা ছিল না কোন ভাবেই । তারপরেও হচ্ছে । এবং এর পেছনে একটা অদ্ভুত কারন যুক্ত । আবিদ নিজে এই ব্যাপারটা কোন ভাবেই বিশ্বাস করতো না যদি না সেটা নিজের সাথে ঘটতো । এই যুগে এসে এমন কথা বিশ্বাস করাটা সত্যিই বড় হাস্যকরই শোনাবে ।

রসুলপুর গ্রামে আবিদদের জমিদারি আছে । বিশাল জায়গা সম্পত্তির মালিক ওরা । ছোট থেকে আবিদ ওর বাবা মায়ের সাথে ঢাকাতেই মানুষ । সেখানেই পড়াশোনা শেষ করে ভাল চাকরি করে জীবন শুরু করেছিলো সে । ঠিক সেই সময়েই ঘটলো বিপত্তি । আবিদের শরীরে মরন ব্যাথি বাসা বাঁধলো । অনেক কাঠ খড় পোড়ানো হল বটে কিন্তু কাজ হল না । সব ডাক্তারেরা জবাব দিয়ে দিলেন । বললেন যে শেষ সময়টা পরিবারের সাথে যেন কাটানো হয় । সেই মোতাবেগই আবিদকে ওদের গ্রামের বাসায় নিয়ে আসা হয় দাদা-দাদীর কাছে ।

সব আশা যখন শেষ তখন একটা অদ্ভুত কাজ হল । একদিন রসুলপুরের ওদের জমিদার বাড়িতে একজন ওঝার মত লোক এসে হাজির হল । সে এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিল আবিদের দাদাকে । বলল যে সে তার নাতিকে সুস্থ করে তুলতে পারবে । তবে এর জন্য একটা মানুষ মারা পড়বে । এবং এর দায়ভার তাকে নিতে হবে ।

আবিদের দাদা নিজের নাতিকে বাঁচানোর জন্য তাতেই রাজি হলেন । খুব সাধারণ কিছু জিনিস পত্র আনতে দিল । তার দাদা সব কিছু জোগার করে দিলেন । তারপর এক আমাবস্যার রাতে ওঝা বসলো ধ্যানে । আবিদের দাদার এই কাজের কথা কেউ জানলো না । তাদের নিজ বাড়ি থেকে একটু দুরে একটা বড় বাগানে এই যজ্ঞের ব্যবস্থা করা হল ।

ওঝা পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল তার দাদাকে । খুব সহজ একটা হিসাব । একটা প্রাণের বদলে আরেকটা প্রাণ । সে ধ্যান করে নিশিকে ডেকে নিয়ে আসবে এবং নিশি মূলত তার নাতির প্রাণ নিতেই আসবে । তবে ওঝার মন্ত্রের কারণে সে ভুলে গ্রামে গিয়ে ডাক দিতে থাকে । সেই ডাক গ্রামের মানুষ শুনতে পাবে । সেই ডাক শুনে যদি কেউ বাইরে বের হয়ে আসে তাহলে তার আত্মাকে নিয়ে চলে যাবে নিশি । এবং আবিদের জীবন রক্ষা পাবে । তবে এখানে একটা রিস্ক আছে । যদি এই ডাক শুনে গ্রামের কোন মানুষ সাড়া না দেয় তাহলে আজই আবিদের মরন হবে । এই ঝুকি টুকু আবিদের দাদা নিয়েছিলেন । তবে তার মনে একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে কেউ না কেউ ঠিকই সাড়া দিবে । এভাবে তার নাতি মারা যেতে পারে না ।

যজ্ঞ শেষ হল এবং ওঝা জানালো যে নিশি তার শিকার পেয়ে গেছে । তার নাতি সুস্থ হয়ে যাবে ।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আবিদ তারপর দিন থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলো । এক মাসের ভেতরে আবারও আগের স্বাস্থ ফিরে পেতে শুরু করলো সে । আবার ডাক্তার দেখানো হল এবং সবাই অবাক হয়ে খেয়াল করলো যে তার শরীর থেকে মরন ব্যাধি দুরে হয়ে গেছে । কিভাবে গেছে সেটা কেউ জানে না তবে গেছে । এটাই সব থেকে বড় কথা ।

কেউ না জানলেও দুজন মানুষ ঠিকই জনাতো । বছর খানেক পরে মৃত্যুর সময় আবিদকে সে এই কথা বলে যান । প্রথমে অবিশ্বাস করলেও তার এভাবে সেরে ওঠাটা আবিদের কাছে রহস্যই থেকে গেছে । এবং আবিদকে তার দাদা এও জানালেন যে ঐদিন সত্যিই গ্রামে ওর বয়সী এক যুবক মারা গিয়েছিলো অদ্ভুত ভাবে ।

যুবকের নাম জাহির আহমেদ । সে গ্রামে এসেছিলো তার বউকে নিয়ে । তাদের বিয়ে হয়েছিলো দুবছর ধরে । মেয়েটা এখন ঢাকাতে থাকে তার বাবা মায়ের সাথে। চাকরি করে । আবিদের মনে একটা কৌতুহল জন্ম দিল । এবং খোজ খবর নিয়ে সে মেয়েটির কাছে চলে গেল ।

মেয়েটি একটা ব্যাংকে কাজ করে । সেই ব্যাংকের ক্লাইন্ট সেজেই প্রথমে তার সাথে দেখা করলো । দেখা করে যখন সে বাসায় আসলো তখনই আবিস্কার করলো যে নাজনীন নামের ঐ মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে । অদ্ভুত ভাবে নাজনীনকে তার ভালো লাগছে ।
পরের দিন আবিদ আসলে বুঝতে পারলো যে তার দাদা যে সংবাদটা তাকে দিয়েছে সেটার ভেতরে আসলে সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে । কারণ তার দেওয়া তথ্য মতে নাজনীন ছিল জাহিরের স্ত্রী । এবং যেহেতু জাহিরের আত্মা তার ভেতরে এসেছে তাই তাকে ভালো লাগাটা খুবই স্বাভাবিক । এই কারণেই নাজনীনকে ভাল লাগছে তার । মনে হচ্ছে ওকে ছাড়া জীবন চলবে না ।

বাসায় যদিও প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না একটা স্বামী মারা বিধবা কে ছেলের বউয়ের করার ব্যাপার তবে শেষ পর্যন্ত আবিদের জেদের কাছে সবাই হার মানলো । নাজনীনের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব গেল । সেখানেও সব রাজি ।

দেখতে দেখতে ওদের বিয়ে হয়ে গেল । বাসর রাতে নাজনীনকে মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো । নাজনীন যে দেখতে আহামরি সুন্দরী সেটাও কিন্তু না তারপরেও আবিদের চোখে সে পৃথিবীর সব থেকে বেশি সুন্দরী। নাজনীন বলল, এভাবে তাকিয়ে কেন আছেন শুনি?
-বারে ! নিজের বউকে দেখবো না?
-হ্যা দেখুন ভাল করে ! তা এখনও সেই ভুত যায় নি মাথা থেকে?
-কোন ভুত?
-ঐ যে নিশির ডাকের ভুত !

আবিদ চট করে উত্তর দিতে পারলো না । আবিদকে চুপ থাকতে থেকে নাজনীন বলল, আপনার থিউরিতে যে ভুল আছে সেটা বলবো?
-বল শুনি।
-আপনি বললেন যে নিশির আপনার বদলে জাহিরের আত্মা নিয়ে গেছে । আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে জাহিরের আত্মা চলেই গেছে । তাই না সেটা তো আপনার ভেতরে আসে নি । তাহলে আপনার তো আমাকে ভাল লাগার কোন কারণ নেই ।

আবিদ কী বলবে খুজে পেল না । নাজনীন যে কথা বলল সেটা তো যুক্তিযুক্ত মনে হল । এভাবে তো ভাবে নি সে ।
নাজনীন আবারও হাসতে হাসতে বলল, তা আমাকে যেমন পছন্দ হয়েছে জাহিরের বাবা মায়ের প্রতি আপনার কেমন মনভাব । তাদেরকে কি আপন মনে হচ্ছে খুব?

আবিদ নিজে গিয়েছিলো জাহিরের বাসায় । ওদের গ্রামেই তো বাড়ি । কিন্তু তার বাবা মায়ের প্রতি আলাদা কোন অনুভূতি কাজ করে নি । অথচ করা উচিৎ ছিল না ।
নাজনীন বলল, জাহির কিন্তু তার বাবা মায়ের খুব ভক্ত ছিল । বুঝেছেন জনাব। আমার থেকেও বেশি । যদি সত্যি আপনার দাবী সত্য হত তাহলে তাদের পছন্দ হত বেশি আমাকে নয় । আর আমাকে সে খুব বেশি পছন্দ করতো না । আপনাদের গ্রামে রুবি নামের একটা মেয়ে আছে । তাকে পছন্দ করতো !

এই বলে নাজনীন হাসতে শুরু করলো ।

তাহলে বিবাহিত জীবনে কি নাজনীন সুখী ছিল না ? এই কারণেই সেদিন বলেছিলো কথাটা?
তাহলে সবই কি ছিল বুজরুকি!
নিশির ডাক বলে আসলেই কিছু নেই?

আবিদ অবশ্য আর কিছু চিন্তা করতে চাইলো না । সে বেঁচে আছে এবং সুস্থ হয়ে বেঁচে আছে । সেই সাথে নাজনীনকে বিয়ে করে ফেলেছে । এটাই এখন সব থেকে বড় কথা ।

নাজনীন আবিদের ছেলে মানুষী দেখে হাসলো কেবল । ছেলেটা কেন যে তার প্রেমে পড়লো নাজনীন ঠিক বুঝলো না । অথচ জাহিরকে প্রেমে পড়ানোর জন্য কতই না চেষ্টা করেছে । কোন কাজ হয় নি । মন থেকে সে কোন নাজনীনকে ভালোবাসে নি । কেবল বাবা মায়ের কথা রাখতে গিয়ে ওকে বিয়ে করেছিলো । অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসতো সে । এটা কোন ভাবেই নাজনীন মেনে নিতে পারে নি । তাই তো ব্লাক ম্যাজিক করেই জাহিরকে খুন করেছিলো সে । একই ভাবে সে চেষ্টা করেছিলো জাহিরের মন পেতে কিন্তু কাজ হয় নি । অথচ ঠিকই মারা পড়লো ।

তবে নিশির ডাকের ব্যাপার সম্পর্কে নাজনীন খুব ভাল করেই জানে । নাজনীন শুনেছে আবিদের অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ ছিল এবং সে সত্যি সত্যি মিরাকেল ঘটিয়েই সুস্থ হয়েছে । তার মানে হচ্ছে ঐ দিন রাতে অন্য কেউ সাড়া দিয়েছিলো নিশির ডাকে । আর একই দিনে অন্য ভাবে জাহির মারা পড়েছে । আর আবিদ ভেবে নিয়েছে যে জাহির নিশির ডাকে মারা পড়েছে ।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মারাটা পড়লো কে?

নিশির ডাক গল্পের থিম আমরা অনেকেই পড়েছি । একজন কে সুস্থ করতে এভাবে নিশিকে ডেকে আনা হয় তারপর সে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডাক দেয় । যে ডাকে সাড়া দেয় তার জীবন নিয়ে চলে যায় অন্য দিকে আরেকজন বেঁচে ওঠে । এই গল্প সেই থিম থেকে লেখা।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.4 / 5. Vote count: 41

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →