না হওয়া সেই সমুদ্র ভ্রমন

oputanvir
4.8
(60)

ফারিন যে এমন একটা কাজ করবে সেটা আমি ভাবতেও পারি নি । মিটিং রুমে আমি চোখ বড় বড় করে কেবল তার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু সময় । আমি জানি যে মিমিও ঠিক একই ভাবে ফারিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । ফারিন আমাদের চোখের দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ম্যানেজার স্যারকে বলল, স্যার মিমি আর অপুই যাক । ওদের দুজনের কম্পিনেশন সব থেকে ভাল হবে ।
ম্যানেজার স্যার আমার কাজ নিয়ে বরাবরই সন্তুষ্ট । তাই আমাকে যে কোন কাজের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায় সেটা সে জানে । তাই আপত্তি করলো না ।

আগামীকালকের কনফারেন্সে আমি আর মিমি যাবো এটাই ফাইনাল হল । মিটিং রুম থেকে সবাই বের হয়ে গেলেও আমি আর মিমি বসে রইলাম । ফারিন আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, শুনো খবরদার এটা বদলানোর চেষ্টা করবে না । সামনেই এনো্য়্যাল এপ্রাইজাল আসবে । এটার উপর তোমাদের অনেক কিছু নির্ভর করছে । বুঝেছে !
আমি এটা জানি খুব ভাল ভাবেই । এটা যদি আমার হাত ছাড়া হয়ে যায় আমি নিশ্চিত ভাবেই অন্যদের থেকে পিছিয়ে যাবো । আমাকে টপকে অন্য কেউ প্রোমোশন পেয়ে যেতে পারে !

আমি ফারিন বের হয়ে যেতেই আমি মিমির দিকে তাকালাম । মিমিও খানিকটা অস্বস্থি নিয়ে তাকালো আমার দিকে । সত্যি বলতে কী গত এক বছরে এইবারই মিমির সাথে আমি সরাসরি কাজ করতে যাচ্ছি । এর আগে ওকে সব সময় এড়িয়ে চললেও এবার আর কোন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না সেটা খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পারছি ।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার এর ভেতরে কোন হাত নেই ।
মিমি আমার কথার কোন জবাব দিল না । তবে আমার যে কোন হাত নেই সেটা সম্ভবত সে নিজেও বিশ্বাস করেছে । ওর মুখ দেখে সেটাই আমার মনে হল ।

মিমি আমাদের এই অফিসে জয়েন করেছে বছর খানেক ধরে । কাজে কর্মে সে সব কিছুই ভাল । তবে আমি সব সময়ই তার কাছ থেকে দুরে থেকেছি । এবং এই দুরে থাকার ব্যাপারটা কেবল আমিই না মিমি নিজেও চলেছে । তবে সেটা আমরা অফিসের কাউকেই ঠিক বুঝতে দিতাম না । তবে ফারিন ঠিকই টের পেয়ে গেল । অফিসে ফারিনের সাথে আমার সম্পর্কে সব থেকে ভাল । আমি আর ফারিন প্রায় একই সময়েই এই অফিসে জয়েন করেছিলাম । একদিন লাঞ্চ আওয়ারে ফারিন আমাকে বলল, মিমিকে তুমি কি চিনতে আগে থেকে?
নামটা শুনেই আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম । সত্য কথাটা বলবো কিনা ভাবছি তখনই ফারিন বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে মিমি তোমার প্রেমিকা ছিল । ঠিক না ?

ফারিন যে ব্যাপারটা এভাবে ধরে ফেলবে সেটা আমি টের পাই নি । বললাম, অফিসের কাউকে বল না প্লিজ ।
-তার মানে সত্যিই ছিল ।
-হ্যা । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় পুরোটাই আমি ওর সাথে ছিলাম ।
-তাহলে ? ব্রেক আপ কেন হল?
-ও খুব প্যারা দিতো । আমাকে নিয়ে তার শতশত অভিযোগ ! প্রথম প্রথম আমি সব মেনে নিয়েও ছিলাম । কিন্তু এক সময় তার কোন মামাতো ভাই এল জার্মানি থেকে । তখন থেকে এই অভিযোগের মাত্রাটা যেন বহুগুনে বেড়ে গেল । আর তুলনা দেওয়া শুরু হল । শোভিক ভাইয়ের মত হও । এটা কর তার মত ওটা কর তার মট ! এক সময়ে আমার আর মাথা ঠিক থাকে নি ।
-তারপর ?
-তারপর আর কি ! একদিন খুব ঝগড়া হল । ব্রেক তারপর । তারপর অনেক দিন দেখা নেই । আমি এখানে জয়েন করে কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম । ঐদিন ওকে অফিসে ঢুকতে দেখে চমকে গিয়েছিলাম ।

ফারিন অবশ্য আর কিছু জানতে চাইলো না । তবে মাঝে মাঝে ঠিকই আমাকে নিয়ে টিজ করতো । এটা অবশ্য বড় কিছু ছিল না । তবে মাস খানেক আগে ফারিন এসে হঠাৎ আমাকে বলল, তোমার এক্স মনে হয় এখনও তোমাকে ভালোবাসে ।
আমি তখন লাঞ্চ করছিলাম । আমাদের বেশির ভাগ গল্পই হত লাঞ্চ আওয়ারেই । আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, কী সব আজেবাজে কথা !
-না সত্যি !
-তুমি কিভাবে জানো শুনি?
-শুনো আমি যেহেতু একটা মেয়ে অন্য একটা মেয়ের আচরণ আমি একটা ছেলের থেকে ভাল বুঝবো !
-তা কী বুঝলে শুনি?
-মিমি এখনও তোমার থেকে মুভ অন করতে পারে নি । আর আমি যখন তোমার সাথে কথা বলি তখন সে জেলাস ফিল করে । তার আচরণেই আমি এটা বুঝেছি ।
-ঘোড়ার ডিম বুঝেছো ।
-সত্যি বলছি !

আমি অবশ্য ঠিক আর কথা বাড়ালাম না । সম্পর্কে থাকা অবস্থাতে আমি যে মিমিকে খুব বুঝতাম সেটা অবশ্য না । তবে আমি সব সময় চেষ্টা করেছি । যখন হয় নি তখন হার স্বীকার করে নিয়েছি । আমার সহ্যের শেষ সীমাতে পৌছেই আমি আলাদা হয়ে গেছি । তবে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে আরেকবার চেষ্টা করে দেখলে কি কিছু হতে পারতো ! আমি ঠিক জানি না ।

ফারিনের মনে যে এই ব্যাপারটা ছিল আমি কখনই বুঝি নি । আমি নিশ্চিত জানি আমাকে আর মিমিকে ইচ্ছে করে ফারিন কক্সবাজার পাঠাচ্ছে । না জানি কপালে কী আছে ।

পরদিন সারাটা দিন কেটে গেল আমার মিমির প্রস্তুতি নিতে । আমরা কী কী প্রেজেন্টেশন দিবো এটা নিয়ে আমাদের সারাদিন ব্রিফিং চল। আমরা রাতের বেলা রওয়ানা দিলাম । প্লেনে ওঠার সময়ে আমার মনে পড়লো যে আমাদের সম্পর্কের থাকার সময়ে আমরা কখনো একসাথে কোথাও যায় নি । এমন কি ঢাকা থেকে পানাম সিটিতেও আমাদের যাওয়া হয় নি কখনো । আমার মনটা হঠাৎ করে উদাস হয়ে গেল । আমি সব সময় একটা রোমান্টিক স্বপ্ন দেখতাম যে আমরা বাসে করে দুরে কোথাও যাচ্ছি । গল্প করছি আমাদের দুজনের হাত দুজনের হাত ধরা । এক সময়ে আমরা ঘুমিয় পড়েছি একে অন্যের কাধে মাথা রেখে ।

আগে যখন বাসায় যাওয়া আসা করতাম তখন এমন দৃশ্য আমি দেখতাম প্রায় । স্বামীর কাধে মাথা রেখে নিশ্চিত ঘুমাচ্ছে স্ত্রী । এই দৃশ্যটা কেন জানি আমার খুব ভাল লাগতো । আমিও এক সময়ে আশা করতাম যে এমন একটা ঘটনা আমার সাথেও ঘটবে কোন না কোন দিন । এবং সেটা মিমির সাথেই ঘটবে সেটাই আশা করেছিলাম ।

এই যে মিমির সাথে আমার প্রথম ট্যুর হচ্ছে অথচ আমাদের মাঝে যোজন যোজন দুরত্ব । অবশ্য আমাদএর জার্নি খুব বেশি সময়ের জন্য হল না । প্লেনে উঠলাম আর নামলাম যেন । এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া করে হোটেলে পৌছালাম । কিন্তু সেখানে পৌছেই নতুন একটা সমস্যা দেখা দিল ।

এই হোটেলেই কনফারেন্সটা হবে । এখানকার কনফারেন্স রুমেই সব আয়োজন করা হয়েছে । আমাদের মত আরও অনেক কোম্পানীই এসে হাজির হয়েছে । আমাদের জন্য দুইটা রুম রিজার্ভ রাখার কথা ছিল কিন্তু বেশি মানুষের কারণে তারা দুইটার বদলে একটা রুম রেখেছে । এর মানে হচ্ছে হয় আমাদের অন্য কোন হোটেলে গিয়ে থাকতে হবে নয়তো একই রুমে থাকতে হবে । মিমি তো প্রথমে অন্য হোটেলে যেতে চাচ্ছিলো তবে আমি বললাম এখন অন্য হোটেলে রুম পাওয়া যাবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন । অবশেষে বাধ্য হয়ে সেই রুম নিতে রাজি হয়েছে ।

আমার নিজের কাছে সব কিছু কেমন যেন মনে হচ্ছে । সেই সব কিছু আমাদের সাথে হচ্ছে যা হওয়ার কথা অথচ কয়েক বছর পরে । রুমে ঢুকে অবশ্য মনটা ভাল হয়ে গেল । অনেক বড় রুম । দুটো আলাদা বেড । এছাড়া বারান্দা রয়েছে । সাথে বাথরুম চমৎকার । আমাদের দুজনের থাকতে মোটেও কষ্ট হবে না সেটা আর বলে দিতে হল না ।

ব্যাগ রেখে ও প্রথমে ওয়াশরুমে ঢুকলো । শাওয়ার নিল বেশ লম্বা সময় ধরে । রুম থেকে ও যখন বের হল তখনও আমি নিজের বিছানায় শুয়ে । ওর দিকে তাকিয়ে একটা হার্টবিট মিস করলো আমার । চুল ভেজা । গায়ে একটা টিশার্ট নিচে একটা থ্রিকোয়াটার পরা । তবে এই সদ্য গোসল করে বের হয়ে ওর চেহারায় আলাদা একটা আভা দেখা দিয়েছে । কথা আছে গোসলের পরেই নাকি মেয়েদের সব থেকে সু্ন্দর লাগে । কথাটা যে মিথ্যা না সেটা আমি এতোদিনে প্রমান পেলাম । আমার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকাটা মিমি খেয়াল করলো । তবে বিরক্ত হল না । আমার দিকে একটু তাকিয়ে নিজের বিছানায় বসে চুল মুছতে শুরু করলো । তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল, গোসল করবে না?
-হুম ।
-গোসল সেরে এসো । তারপর খেতে চল । তারপর কালকের প্রেজেন্টেশন নিয়ে কাজ করতে হবে ।

আমার মনটা একটু খারাপ হল । আমি ভেবেছিলাম মিমি হয়তো অন্য কিছু বলবে । কাজ বাদ দিয়ে অন্য কোন কথা । কিন্তু তারপরে আমার নিজের কাছেই নিজের আচরণ দেখে অবাক লাগলো । আমি মিমির কাছ থেকে অন্য কিছু কেন আশা করছি । সম্পর্ক তো আমিই শেষ করে দিয়েছিলাম । আমিই তো ওর খবরদারী আর অভিযোগ থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম । সেটা আমি পেয়েছি । তাহলে কেন আবার অন্য কিছু আশা করছি !

খাওয়া দাওয়া শেষ করে এসে কাজ নিয়ে বসলাম। বেশ রাত পর্যন্ত কাজ শেষ করে তারপর ঘুমাতে গেলাম । আলো নিভানোর পরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল মনের ভেতরে । মিমি আমার থেকে কয়েক হাত দুরেই শুয়ে আছে । কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার । মিমির কথা ভাবতে ভাবতেই আমার ঘুম চলে এল ।

পরের দিনটা আমাদের সত্যিই খুব ব্যস্ততায় কাটলো । লাঞ্চের আগে দুইটা আরে পরে আরও দুইটা প্রেজেন্টেশন দিলাম । সত্যি বলতে কি মিমি সত্যি চমৎকার কাজ করলো । প্রেজেন্টেশন পরে প্রশ্নোত্তরের সময় আমিও ওর সাথে ছিলাম যদিও আমার সাহায্য ওর খুব একটা দরকার ছিল না । আমি ওকে সব কিছু তৈরি করে দিচ্ছিলাম । মাঝে মাঝে নিজেও কথা বলছিলাম । বিকেলের শেষ প্রেজেন্টেশন শেষ করার আগে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে আমাদের কোম্পানির মালিক এসে হাজির হয়েছেন । তিনি যে আসবেন আমাদের এটা জানা ছিল না । স্টেজ থেকে নেমে যখন তার কাছে গেলাম তখন সে আমাদের হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালো । এবং এও জানালো যে আমাদের কাজে সে অনেক খুশি ।
তারপর আমাদের অবাক করে দিয়ে স্যার বললেন যে এখান থেকে একটু পরে চেক আউট করতে । আমাদের জন্য গাড়ি রেডি থাকবে । আমাদের মারমেইড ইকো রিসোর্টে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে । আজকের রাত কাল সারা দিন ওখানে কাটিয়ে কাল ঢাকা ফিরতে হবে । এই সব কিছু অফিসই বহন করবে । এটা আমাদের কাছের পুরস্কার ।

দুই
মারমেইড ইকো রিসোর্টে পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । আমাদের জন্য আলাদা দুইটা রুমের ব্যবস্থা করা ছিল । মিমি নিজের রুমের ঢুকে গেল । আমিও নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম । তারপর বিছানাতে শরীর এলিয়ে দিলাম । আজকের সারা দিন বেশ ধকল গেছে তবে দিন ভাল গেছে । সব কাজ ভাল ভাবেই শেষ হয়েছে । আর সব থেকে বড় ব্যাপার যে মিমির সাথে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে না । এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার খুশি হওয়া উচিৎ কিন্তু কেন জানি আমার মন ভাল লাগছে না ।

ঐ হোটেলে মিমি আমার সাথে আমার রুমে ছিল । আসার দিন রাতের বেলা ও যখন গোসল শেষ করে তোয়ালে দিয়ে রুমে ঢুকলো আমি খানিকটা অবাক চোখেই ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম । ওকে এভাবে আমি কোন দিন দেখি নি । হ্যা ওর অনেক ছবিই আমার কাছে ছিল । সত্যি বলতে কি সেই ছবি আমার একটা ড্রাইভে এখনও আছে কিন্তু আমাদের কখনই এভাবে এর রুমে থাকার সুযোগ আসে নি । এমন সময়ে সেই সুযোগ এল যখন আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসি না !

নাকি বাসি?
ফারিনের কথাটা আবারও আমার মনে পড়লো । ও বলেছিলো যে মিমি এখনও আমাকে ভালোবাসে । কীসের ভিত্তিতে সে এমন কথা আমাকে বলেছিলো সেটা আমি জানি না । তবে মেয়েরা অনেক কিছুই নাকি বুঝতে পারে । আমরা সেটা বুঝটে পারবো না । আর আরেকটা ব্যাপার আমাকে একটু অবাক লাগছিলো সেটা হচ্ছে রুমের ভেতরে মিমি কিন্তু অস্বস্তিবোধ করে নি । মানে একটা ছেলের সাথে একই রুমে থাকার ব্যাপারটা এই দেশি কোন মেয়েই স্বাভাবিক ভাবে নিবে না ।

অবশ্য মিমি আমাকে খুব ভাল করেই চেনে । আমার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কেও সে জানে । আমার তো মনে হয় আমার থেকেও আমাকে ও ভাল ভাবে চিনতো । আমি কিসে রেগে যাই কিংবা কিসে আমার ভাল লাগে সেটা ও জানে খুব ভাল ভাবেই । এই জন্য সে নিশ্চিন্ত এবং নিরাপদবোধ করছিলো সেটা আমি জানি । এছাড়া আরেকটা ব্যাপার আমার মনে হয়েছে যে মিমি নিজেও মনে হল অখুশি হয় নি । যতই প্রথমে ও বিরক্তবোধ করুক না কেন কিন্তু আমার কেন জানি মনে হল যে একই রুমে থাকাতে ও মোটেই বিরক্ত হয় নি ।

এবং সত্যি বলতে কি আমার নিজেরও ব্যাপারটাতে খারাপ লাগে নি কিন্তু এখন এই রুমে একা থেকে কেন জানি আমার মন খানিকটা বিষন্ন লাগছে। নিজের মনের ভাব বুঝে নিজেই খানিকটা অবাক হলাম । মনের এমন আচরণ সত্যিই অবাক করার মতই ।

রাতে ডাইনিংয়ে হাজির হয়ে দেখলাম যে মিমি সেখানে আগে থেকেই হাজির হয়েছে । একটা সাদা টিশার্ট পরে আছে । সেই সাথে নিচে একটা থ্রিকোয়ারটার প্যান্ট । আমি ওর পাশের চেয়ারে বসলাম । চুপচাপই খাওয়া শেষ করলাম । খাওয়া শেষ করে কী করবো ভাবছি । একবার মনে হল রুমে গিয়ে শুয়ে থাকি । কাল সন্ধ্যায় আমাদের বাস । যদিও প্লেনে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু মিমি কোন কারণ ছাড়াই বাসে যেতে চাইলো । আসার সময়ে নাকি ওর প্লেনে চড়তে ভয় লেগেছিল । অবশ্য প্লেনটা খানিকটা মুড়ির টিনের মতই ছিল এটা আমি নিজেও স্বীকার করে নিব ।
মিমি আমাকে জানালো যে চাইলে আমি প্লেনে যেতে পারি । কোন চিন্তা নেই । সে বাসে চলে যাবে । একবার মনেও হল যে প্লেনে চলে যাই কিন্তু কেন জানি গেলাম না । যতই সে আমার প্রেমিকা না হোক, এক সময়ে ছিল, আর এখন এক সাথে চাকরি করি আমরা । মেয়েটাকে একা একা তো আর ছেড়ে দিতে পারি না যদিও এখন এই বাস জার্নি গুলো নিরাপদ তবুও মন সায় দিল না । বললাম যে সমস্যা নেই একসাথে বাসে করেই যাওয়া যাবে ।

আমি ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবো তখনই মিমি বলল, রুমে যাবে এখন?
-হ্যা । আর তো কোন কাজ নেই ।
-আসো একটু বিচে হাটি !

মিমির কাছ থেকে এই অনুরোধ পেয়ে একটু অবাক হলাম । তবে আমার মন আপনা আপনি খুশি হয়ে উঠলো । আমি রাজি হয়ে গেলাম । রুমে গিয়ে তো শুয়েই থাকতাম । একটু হাটাহাটি করলে কোন সমস্যা হবে না আশা করি ।

সমুদ্রের সামনে দাড়িয়ে সব সময়ই নিজেদের বড় ক্ষুদ্র লাগে । আমারও তাই মনে হয় । মন খানিকটা উদাস হয় সব সময় । আজও মিমির সাথে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আমার মন খানিকটা উদাস হয়ে গেল । তবে আমি আবিস্কার করলাম যে এই মন খারাপের কারণ মোটেই আগের কারণ গুলোর মত নয় । বরং এই মন খারাপের কারণ আমার কাছে অজানা ।

এটাই মিমির সাথে আমার প্রথম সমুদ্র দেখা । আমার মনে আছে এই সমুদ্র দেখা নিয়েই ওর সাথে একবার খুব ঝগড়া হয়েছিলো । বলা যায় এর পর থেকেই আমাদের সম্পর্কের খানিকটা অবনতি হয়েছিলো । সেবার দুজনের একসাথে সমুদ্র দেখার সব আয়োজন সম্পন্ন । আমরা ক্লাস ফাঁকি যাবো । টিকিট কাটা শেষ । হোটেল বুকিং দেওয়া শেষ । যাওয়ার ঠিক আগের দিন মিমি জানালো যে সে যেতে পারবে না । হঠাৎ করেই জানি তার কোন কাজিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । এখন সেখানে যেতে হবে । আমি বললাম যে বাসায় জানাতে পরীক্ষা পড়ে গেছে তুমি যেতে পারবে না । মিমি রাজি হল না । বলল যে তার খুব কাছের কাজিন সে । যেতেই হবে ।

আমি রাগ করে একাই গেলাম কক্সবাজার । বিয়ে থেকে ফিরে আসার পরে মিমি আমাকে অনেকবার সরি বলেছিলো তবে আমার ভেতরের রাগটা আসলে যায় নি কখনই । সেখান থেকেই মূলত আমার ব্রেকআপের কথা মাথায় এসেছিলো । আমি সেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম এই সমুদ্র পাড়ে বসে একা । আজও আমরা সেখানে চলে এসেছি । এই কয়টা বছরে মিমির থেকে দুরে আছি । ভাল আছি কি?
জানি না

-বাসা থেকে বিয়ের কথা বলে না ?

মিমির প্রথম প্রশ্ন । আমরা তখন একটা বিচচেয়ারে বসে আছি । আমি বললাম, হ্যা মা বলে তো ।
-তাহলে করছো না কেন বিয়ে?
-তুমি কেন করছো না।
চট করেই জবাব দিল না মিমি । তারপর বলল, বাসা থেকে ছেলে দেখেছে । সামনের ঈদ বিয়ে ।

আমি চুপ করে গেলাম । কেন জানি কথাটা আমার বুকে বিধলো । কেন বিধলো আমি জানি না ।
আসলেই কি জানি না নাকি জানতে চাই না ?

ঠিক সেই সময়েই আমার মোবাইলে একটা মেসেজ এল । দেখলাম ফারিন পাঠিয়েছে মেসেজটা । সেখানে একটা মাত্র লাইন লেখা ।

মিমি খুব করে তোমার সাথে সমুদ্র দেখতে চাইছিল ।

আমি মেজেসটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম অবাক হয়ে । আমার যেন সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছিলো না । মিমি আর আমি এখানে এসেছি কারণ মিমি চেয়েছে । বিয়ের আগে ও আমার সাথে শেষবারের মত সমুদ্র দেখতে চেয়েছিলো । আমাদের সেই না হওয়ার সমুদ্র দেখা !

আমি মিমির দিকে তাকিয়ে বললাম, আসো সমুদ্রে নামি !
-কী!
-বললাম চম সমুদ্রে নামি !
-আরে মাথা খারাপ এই রাতের বেলা !

আমি রিসোর্টের এক বয়কে ডাক দিলাম । আমার আর মিমির মোবাইল পার্স দিলাম তার হাতে । তারপর ওর হাত ধরে ওকে টেনে নিলাম পানির ভেতরে । আমি ভেবেছিলাম হয়তো ও যেতে চাইবে না । তবে আমাকে সে আর বাধা দিল না । আস্তে আস্তে বেশ পানিতে নেমে এলাম । মিমি আমার হাত ধরে রেখেছে ।

বুক সমান পানিতে দাড়ালাম । মিমিই প্রথমে আমার দিকে পানি ছুড়ে দিল । এরপর আমিও দিলাম । এভাবেই চলল অনেকটা সময় । তারপর যখন আমরা দুজনেই ভিজে একাকার তখন আমার মাঝে কী হল আমার জানা নেই । আমি মিমির কাছে চলে গেলাম । তারপর খুব গভীর ভাবে ওর ঠোঁটে চুমু খোলম । মিমি বাঁধা তো দিলই না বরং তাতে ঠোঁট মেলাল।
আমাদের আসলে এই একটা ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের । এই সময় সমুদ্রে নেমে একে অন্যকে চুমু খাবো ।

অবশ্য তারপর আমাদের চুমু খাওয়া থেমে থাকলো না । আমরা পরের দিনও গেলাম ফিরে ঢাকাতে । আরও একটা দিন থাকলাম কক্সবাজারে । তার পরের দিন ফিরে যাওয়ার সময় বাসে পুরোটা সময়ই মিমি আমার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলো । আমাদের সেই স্বপ্নের জার্নিটা এতোদিন পরে এসে পূর্ণতা পেল ।

পরিশিষ্টঃ

এখানে একটা ধন্যবাদ ফারিনের প্রাপ্য । ফারিন আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিল যে মিমি চেয়েছে বলেই মিমি আর আমি এই ট্রিপে আসতে পেরেছি । আর মিমিকে সে একই ধরণের মেসেজ পাঠিয়েছে যে আমি চেয়েছি । এই কারণেই মিমি আমার সাথে সমুদ্র দেখতে চেয়েছিলো ।

আমরা যখন আমার ঘরে প্রবল ভালোবাসার পরে একে অন্যের খুব কাছে শুয়ে রয়েছি তখন মিমি আমাকে বলল কথাটা । আমি অস্বীকার করে ওর কথা বললাম । দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । ফারিনের মেসেজটা দেখালাম ওকে । ও ঠিক একই মেসেজ দেখালো আমাকে । আমার তখন মনে হল যে এই বুঝি মিমি চলে যাবে ।

কিছু সময় আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম । তারপর আমিই এগিয়ে গেলাম ওর দিকে । ওর কপালে চুমু খেয়ে বললাম, তোমাকে এই যে চুমু খেতে পারলাম, এটার জন্য আমি মোটেই দুঃখিত নই ।
-পরে তো ঠিকই অভিযোগ করবে যে আমি তোমার জীবন দুর্বিষহ করে দিচ্ছি ।
-তা করবো হয়তো, তুমি হয়তো দিবেও !
-কী ! তাই না ! আমি এখনই চলে যাচ্ছি । শান্তি দিয়েই যাচ্ছি তোমাকে!

এই বলে ও উঠে চলে যেতে চাইলো বটে তবে পারলো না । আমি ওকে আবারও কাছে ডেকে নিলাম । তারপর বললাম, এবার যেতে দিবো না তোমাকে ! কোথাও না !

সত্যিই আর যেতে দেই নি । ঢাকাতে আসার কদিন পরেই মগবাজার কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি । ফারিন আমাদের বিয়ের সাক্ষি হয় । অবশ্য এখনও বাসায় জানানো হয় নি । কিভাবে জানাবো সেটাই ভাবছি ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 60

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “না হওয়া সেই সমুদ্র ভ্রমন”

  1. You try to give the protagonists of some of your stories (couples) a happy ending. it’s entertaining to read. But we readers know that ‘ those who sails away from our life, never comes back’. Anyways, Keep writing the stories as you imagine them.

    1. হ্যা এটা আমিও জানি যে যারা একবার চলে যায় তারা আর ফিরে আসে না । তবুও আমার ভাবতে ভালোলাগে যে ভালোবাসা গুলো মরে যায় না । একটু সময়ের জন্য হয়তো নির্জীব হয়ে যায় । ঠিক ঠাক যত্ন নিলে আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। আর বাস্তবতা আমরা ফেস করিই । গল্পেই না হয় একটু মিলন হোক।

Comments are closed.