রোবটের ভালোবাসা

oputanvir
4.9
(52)

পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হওয়াটা একটা ভাগ্যের ব্যাপার । সেই দিক দিয়ে হিসাব করতে গেলে নওরিনের ভাগ্যটা ঠিক ওর সহায় ছিল না । ব্যাপারটা এমন না যে নওরিনের কোন ভালবাসার মানুষ ছিল । পারিবারের পছন্দ মতই সে বিয়ে করেছে । তবে অন্য সব মেয়ের মতই তার মনেও আশা ছিল যে যার সাথে তার বিয়ে হোক সেই মানুষটা যেন একটু রোমান্টিক হয় । একটু ভালবাসুক তাকে । কিন্তু নওরিনের সেই আশা পূরণ হয় নি । নওরিনের স্বামী জুবায়ের একজন রোবট টাইপের মানুষ । অফিস বাসা অফিস – এই বাইরে তার জীবনে আর কিছুই নেই । বাসায় যত সময় থাকে হয় টিভি দেখে নয়তো ল্যাপটপে কাজ করে । রাতে এক সাথে ঘুমায় আর শারীরিক ভাবে কাছে সময় মাঝে মাঝে । এই হচ্ছে জুবায়ের ।

নওরিনের বিয়ে হয়েছে বছর খানেক । এই এক বছরে জুবায়ের কেবল ওকে নিয়ে হানিমুনে গেছে বিয়ের এক সপ্তাহ পরে । অবশ্য সেই হানিমুনেই নওরিন বুঝতে পেরেছিলম যে জুবায়ের কেমন মানুষ । প্রথম প্রথম খুব কান্না আসতো নওরিনের তবে এখন সব সয়ে গেছে । বিশেষ করে জুবায়ের কখনই ওর কাজে বাঁধা দেয় না । ওকে কিছু করতে মানাও করে না । নওরিন নিশ্চিন্তে যেখানে সেখানে ঘুরতে পারে । এমন কি এর মাঝে একটা ট্যুর গ্রুপের সাথে সে রাঙ্গামাটি ঘুরেও এসেছে একা একা । জুবায়ের মানা করে নি । বরং ওকে নিজেই বাসস্টান্ড পৌছেও দিয়েছে । যদি জুবায়ের ওকে মানা করতো, যেতে না দিতো তাহলেই বরং নওরিন খুশি হত বেশি । তখন মনে হত যে জুবায়ের ওকে নিজের ভাবে বলেই জোর খাটায় । কিন্তু সেটা করে না জুবায়ের ।

নওরিন অনেকবারই আলাদা হওয়ার কথা ভেবেছে । কিন্তু বাসায় বলার সাহস পায় নি সে । নওরিনের বাবা খুবই রাগি মানুষ । মূলত তার ভয়েই কোন দিন একটা প্রেম করার সাহস পায় নি সে । বাসায় হয়তো কখনই ওর পরিস্থিতি বুঝতেই চাইবেই না । আমাদের এই সমাজে স্বামী ঠিক ঠাক মত আয় রোজগার করতে পারলেই তার আর কোন অযোগ্যতা দেখা হয় না । সেই হিসাবে জুবায়ের একজন আদর্শ স্বামীই বটে ।

তবে গত এক সপ্তাহ ধরে নওরিন জুবায়েরের আচরণের ভেতরে একটা পার্থক্য লক্ষ্য করছে । এই কদিনে জুবায়েরের আচরন সম্পর্কে ওর ভাল একটা ধারণা জন্মেছে । আসলে যে কেউই বুঝতে পারবে এটা । নওরিন সব সময় জুবায়েরকে ধীর স্থির হিসাবেই দেখে এসেছে কিন্তু এই একটা সপ্তাহ জুবায়ের যেন একটু অস্থির । সেটা নওরিনের চোখ এড়ালো না মোটেই । রাতে খাওয়ার সময়ই কথাটা তুলল সে ।

-অফিসে কি কাজের অনেক চাপ?

জুবায়ের চুপচাপ খাচ্ছিলো । নওরিনের কথা শুনে ওর দিকে ফিরে তাকালো । তারপর বলল, হ্যা কী বললে?
-বললাম অফিসে কাজের চাপ অনেক?
-চাপ তো থাকেই । নতুন আর কী !
-তাহলে কদিন থেকে তোমাকে বড় অস্থির মনে হচ্ছে । কোন সমস্যা হয়েছে ?

জুবায়ের একটু সময় তাকিয়ে রইলো নওরিনের দিকে । নওরিন তখনই মনে হল যে জুবায়েরকে বড় অচেনা মনে হচ্ছে । এই চোখের দৃষ্টি খানিকটা অচেনা ওর কাছে । এমন করে তাকায় না সে কখনই । তার মানে সত্যিই কোন ঝামেলা হয়েছে । টাকা পয়সার কোন ঝামেলা হয়েছি কি?

জুবায়ের মাথাটা আবার সরিয়ে অন্য দিকে নিল । তারপর আবার খাওয়াই মন দিল । নওরিনের মনে হল আবারও কথাটা সে জানতে চায় । যতই জুবায়ের তার মনের মত না, তার পরেও সে তার স্বামী । একটু রোবট টাইপের এটা সত্য কিন্তু সে মানুষ মানুষ এটা নওরিন জানে । আর এক সাথে থাকতে থাকতে মানুষের প্রতি মায়া জন্মে যায় আপনা আপনি । তবে জুবায়ের যদি না বলতে চায় তাহলে নওরিন জানতে পারবে না কিছুইতেই । সব সময় জুবায়ের চুপচাপই থাকে ।

নওরিন খেতে খেতে তাকিয়ে রইলো জুবায়েরের দিকে । সে চুপচাপ খেয়ে চলেছে । স্পষ্টই বলতে চায় না । না বলতে চাইলে কী আর করার ! নওরিন আর জানতে চাইলো না । কিন্তু তখনই নওরিনকে অবাক করে দিয়ে জুবায়ের কথা বলে উঠলো । এবং এমন কিছু বলল যে শোনার জন্য নওরিন মোটেই প্রস্তুত ছিল না । অন্তত এমন কথা যে জুবায়ের বলতে পারে সেটা আসলে নওরিনের ধারণার বাইরে ছিল ।

-গত সপ্তাহে আমি আসলে একটা স্বপ্ন দেখেছি । সকালে ।
-স্বপ্ন?
নওরিন ঠিক বুঝতে পারলো না । জুবায়ের বলল, হ্যা স্বপ্ন। আমার সাধারণত কোন স্বপ্নের কথাই মনে থাকে না তবে এই স্বপ্নটা আমার স্পস্ট মনে রইলো ঘুম ভাঙ্গার পরে ।
-কী স্বপ্ন?

জুবায়ের একটু দম নিল । নওরিন বুঝতে পারলো যে স্বপ্ন নিশ্চিত কোন ভয়ংকর স্বপ্ন হবে যার কথা মনে হতেই জুবায়ের মুখের ভাবটা বদলে গেছে । জুবায়ের আরো কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, স্বপ্নে দেখলাম যে তুমি আমর থেকে আলাদা হওয়ার জন্য ডিভোর্স ফাইল করেছো । আমার মত একটা আনরোমান্টিক রোবট টাইপের মানষের সাথে থাকা তোমার পখ্ষে সম্ভব না জাজকে এই কথা বলেছ এবং জাজ সেটা গ্রহন করে তোমার পক্ষে রায় দিয়েছে !

নওরিন খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো জুবায়ের দিকে । দেখতে পেল জুবায়ের চোখের পাতা কেমন তীরতীর করে কাঁপছে । জুবায়ের বলল, স্বপ্নটা দেখার পরে কেমন যে মনে হল নিজের কাছে আমি নিজেই জানি না । আমার কেবলই মনে হতে লাগলো যে সত্যিই তুমি ছেড়ে চলে যাবে । আসলে আমার ভেতরে আসলেই তো এমন কিছুই নেই । আমি … আমি …।

নওরিন তীব্র বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করলো যে জুবায়ের খানিকটা যেন অস্থির হয়ে গেল । জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । বাচ্চা ছেলেরা নিজেদের পছন্দের জিনিস হারিয়ে ফেললে যেমন করে জুবায়ের অনেকটাই তেমন করছে । নওরিন কেবল অনুভব করতে পারলো যে ওর চোখ দিয়ে আপনা আপনিই পানি বের হয়ে জুবায়ের এই অস্থিরতা দেখে । তবে এই চোখের পানি মোটেই দুঃখের নয় । তার স্বামীকে তাকে হারানোর ভয়ে অস্থির হয়ে গেছে এটার জন্য ।

নওরিন খাওয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াঅ । তারপর উঠে গিয়ে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরলো । জুবায়ের বসে রয়েছে । মুখটা নওরিনের বুকের মাঝে গুজে দিল আরও একটু ভাল ভাবে । তখনই নওরিন অনুভব করলো জুবায়ের শরীর কাঁপছে । তীব্র আবেগ সে ধরে রাখতে পারে নি । সেটা চোখের পানি দিয়ে বের হয়ে আসছে ।
মাথাটা আরো একটু শক্ত করে নিজের ভেতরে জড়িয়ে ধরে নওরিন বলল, বোকা ছেলে এমন করে হয় নাকি ! আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো কেন?
ধরা গলায় জুবায়ের বলল, জানি না । স্বপ্নটা এতো বাস্তব মনে হল যে আমি আর কিছু ভাবতেই পারি নি । আমার মাথার ভেতর থেকে সেটা কিছুতেই সরে নি । যাচ্ছে না কিছুতেই ।

কত সময় নওরিন ওকে জড়িয়ে ধরে রেখে শান্ত করলো সেটা নওরিন নিজেও জানে না । এক সময় ওকে ছেড়ে দিয়ে বসলো ওর ঠিক পাশের চেয়ারে । তারপর জুবায়ের ঠোঁটের একদম কাছে নিজের ঠোঁট নিয়ে এল । এতো কাছে যেন নিঃশ্বাস পর্যন্ত অনুভূত হচ্ছে । তারপর বলল, এভাবে আমাকে ভালোবাসো, একবার মুখ ফুটে বললে কী হয়?
-কোন দিন কাউকে বলি নি । কিভাবে বলতে হয় জানিও না ।
-আমি তোমার অফিসের বস না । তোমার বউ । আমাকে যদি বলতে না পারো তাহলে কাকে বলবে শুনি ।

তারপরই নওরিন জুবায়েরকে চুমু খেল । এভাবে ওরা আগে চুমু খায় নি । চুমু পর্ব শেষ হলে আবারো নিজের প্লেটের কাছে গেল । তারপর বাকি খাওয়া খেতে লাগলো । জুবায়ের তখন কিছুটা স্থির হয়ে গেছে । শান্ত দেখাচ্ছে ওকে । নওরিন ওকে বলল, শুনি এবার থেকে তোমার কাজ হবে যে প্রতিদিন আমাকে চিঠি লেখা ! মনে যা আসে যা বলতে চাও সব । যদি না লিখো তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি কেস ফাইল করবো বলে দিলাম !

এই বলে নওরিন হাসলো । যদিও সে জানে খুব ভাল করেই যে জুবায়েরের প্রতি যে অভিযোগ ওর ছিল তা এক মিনিষের উধাও হয়ে গেছে । ওর পক্ষে আর কখনই জুবায়েরকে ছেড়ে যাওয়া তো দুরের কথা সেই কথা চিন্তা করাও হবে না । যে ছেলে কেবল একটা স্বপ্ন দেখেই এমন অস্থির হয়ে যেতে পারে সেই ছেলেকে কি ছেড়ে যাওয়া যায় ! নওরিন সত্যিই খুব অবাক হয়েছে । জুবায়ের ভেতরে যে এমন ভাবে ভালোবাসার ক্ষমতা রয়েছে সেটা সে কোন দিন ভাবে নি । মনে মনে ঠিক করেই নিল সে এই রোবটটাকে সে ঠিক ঠিক নিজের মনের মত করে রোমান্টিক বানিয়েই ছাড়বে । একটু সময় লাগবে, তা লাগুক ! ওরা তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 52

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

4 Comments on “রোবটের ভালোবাসা”

  1. Few among my friends are such robotic/shy persons. Good story.

    1. বেশির ভাগ মানুষই নিজেদের অনুভূতি গুলো কাছের মানুষের কাছে প্রকাশ করতে পারে না । তারা কোন অনুভূতি প্রকাশ করে না এর মানে এই না যে তারা অনুভব করে না ।

      1. right. But most people misunderstand shy/externally emotionless people. Only a few genuinely attempt to know them better.

        1. এই যেমন আমার কথাই যদি আমি উদাহরন দেই । বাস্তবের আমার কাছের মানুষ যারা আমাকে চেনে তারা কোন দিন জানেই না যে আমি তাদের জন্য কেমন অনুভব করি। আমার পরিবারের মানুষ মনে করে যে তাদের প্রতি আমার কোণ ভালবাসা নেই । অথচ আমি কোণ দিন তা প্রকাশই করতে পারি না যে কেমন আমি অনুভব করি।

Comments are closed.