সে এখন অন্য কেউ

oputanvir
4.8
(50)

আমি ঠিকই জানতাম যে নেহা আমাদের বাসায় আসবে । কদিনের আমার অস্বাভাবিক আচরণ ওর ঠিকই নজরে এসেছে । আসাটা স্বাভাবিক । ওর সাথে আমার পরিচয় অনেক দিনেরই । কলেজের কোচিং থেকে শুরু হয়েছে । এখন ক্যাম্পাসেও একই সাথে আমাদের পড়াশোনা । আমাদের বাসাতেও আসে নিয়মিত । সেই আমি যদি হঠাৎ করে ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই কিংবা এড়িয়ে চলি তাহলে সেটা যে ওর চোখে বাঁধবে সেটা খুবই স্বাভাবিক।

আমি ওর গলার আওয়াজ পেলাম রুম থেকেই । মায়ের সাথে কথা বলছে । আমি কোথায় লুকিয়ে আছি সেটা জানতে চাইছে । এছাড়া আমি জানি কদিন থেকে ওকে একেবারেই এড়িয়ে চলছি সেটাও অভিযোগ করছে । মাও বলছে যে আমি নাকি কদিন থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ করছি । ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করি না, কোথাও যাই না এইসব ।

আমি টিশার্টটা পরে নিলাম । হাফ প্যান্ট বদলে একবার ফুল প্যান্ট পরার পরিকল্পনা করলাম বটে তবে সেটা বাদ দিলাম । তারপর নিজের বিছানার উপরেই শুয়ে থাকলাম যেমন ছিলাম । হাতে ফোন নিয়ে টিপছি একভাবে যদিও আমার মনযোগ দরজার দিকে । আমি জানি নেহা একটু পরেই দরজা দিয়ে ঢুকবে । আমার দিকে কিছু একটা ছুড়ে মারবে । অবস্য প্রতিবার আমাদের বাসায় আসার সময় সে আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসে । দামী কোন চকলেট না অবশ্য । আমাদের বাসার সামনে একটা কনফেকশনারির দোকান আছে । সেখান থেকে এক টাকা করে হাত মুঠো ভর্তি চকলেট নিয়ে আসে । মূলত সেগুলোই আমাদের দিকে ছুড়ে ঘরে ঢুকেই ।

আজও তাই হল । দরজাটা খোলার আওয়াজ পেলাম । আমি যদিও তাকাই নি ওর দিকে তারপরেও অনুভব করলাম যে ও ঘরের ভেতরে ঢুকলো । ঠিক তার পরপরই আমার শরীরের উপরে চকলেট গুলো পড়লাম । আমি উঠে বসলাম । তাকালাম নেহার দিকে । আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিছুটা গোমরা মুখে । আমি ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল করে দেখলাম একবার ।

নেহা বেশির ভাগ সময়েই সেলোহার কামিজ পরে আমাদের এখানে আসার সময় । তবে আজকে সে একটা কালো টিশার্ট আর জিন্স পরে এসেছে । হলার একটা বড় ওড়না জড়ানো । এখানে আসার জন্যই হয়তো ওড়ণাটা পরেছে । নয়তো ওটা পরতো না । নেহা যখন যা পরে তা পুরোপুরি পরে । ওয়েস্টার্ন পরলে পুরোপুরি ওয়েস্টার্ন আবার দেশী পরলে পুরোটুকুই দেশি ।

আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর কী হয়েছে শুনি?
আমি যথা সম্ভব নিজের কন্ঠস্বর শান্ত করে বললাম, কী হবে?
-তাহলে এমন ঢং করছিস কেন শুনি কদিন থেকে ? কতবার ফোন দিয়েছি ! বলিস না যে দেখি নি । আমি জানি তোর হাতে সব সময় ফোন থাকে । তুই ফোন ধরিস নি কারণ তুই ধরতে চাস নি । কেন?

আমি যুতসই কোন উত্তর দিতে পারলাম না । নেহা আমার স্বভাব খুব ভাল করেই জানে । কোন কাজে আমি কেমন আচরণ করি সেটাও ও খুব ভাল করেই জানে । তাই ওকে ঠিক ভূগোল বোঝানো সম্ভব না । আমি তাই সেদিকে গেলাম না । বললাম, কই না তো এমন কিছু না ।

নেহা এবার ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এল । বিছানার এককোনে বসে বলল, কী হয়েছে ?
-কিছু হয় নি।
-সৌরভ আমি কদিন থেকে বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে । আমি তোর আচরণ ঠিক ঠিক বুঝি । কী হয়েছে খুলে বল । ট্যুরের পর থেকেই দেখছি ব্যাপারটা !

ট্যুরের কথা মনে হতেই সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে চলে এল । আমি সাথে সাথে ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম । জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম একভাবে । যতই আমি চোখের সামনে থেকে দৃশ্যটা সরিয়ে দিতে চাইলাম ততই সেটা আমার চোখের সামনে চলে এল । এই কদিনে এই দৃশ্যটা আমাকে শান্তি দেয় নি একবারও । বারবার নিজেকে কেবল ছোট মনে হয়েছে । বারবার মনে হয়েছে যে আমি কিভাবে এমন কিছু ভাবতেও পারলাম ! নেহা আমার এতো কাছের একজন বন্ধু তারপরেও ওর দিকে আমি এভাবে কিভাবে তাকাতে পারলাম !

আমি তখনই অনুভব করলাম যে নেহা উঠে এসে আমার পাশে বসলাম । একদম আমার পাশে । তারপর আমার হাত টা ধরলো । নেহা এর আগেও আমার হাত ধরেছে । আমার তখন কিছুই মনে হয় নি কিন্তু আজকে কেমন যেন একটা অচেনা অনুভূতি হল । এই অনুভূতি হল আমার ভেতরে । আমি চাইলাম নেহার হাত থেকে হাতটা সরিয়ে নিতে কিন্তু পারলাম না । নেহা বেশ শক্ত করেই ধরেছে হাতটা । আমি যদি হাত ছাড়ানোর জন্য শক্তি প্রয়োগ করি তাহলে নেহাকে ব্যাথা দিতে হবে ।
নেহা বলল, কী হয়েছে বলবি আমাকে?
-আই এম সরি !
-সরি ? তুই কী এমন করলি !

আমি কিছুটা সময় কেবল চুপ করে রইলাম । তারপর বলল, ট্যুরের কথা মনে আছে?
-হুম ।
-তুই আদিবার সাথে বসেছিলি প্রথমে তারপর আমার পাশে এলি ।
-হ্যা ।
-তারপর এক সময়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি । সবাই আমরা ঘুমিয়েছিলাম ।
-হ্যা ।
-আমি ঘুমিয়েই ছিলাম । কুমিল্লার কিছু আগে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । তখনই খেয়াল করি যে তুমি আমার হাত ধরে ঘুমিয়ে আছিস । তোর দেহটা আমার উপরেই খানিকটা ঝুকে এসেছে । শরীরের সাথে শরীর লেগেছে । আমি এর আগে কখনোই তোর এতো কাছে আসি নেহা । এতো কাছে ……!!

আমি কী যে বলবো খুজে পেলাম না । আবারও সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে এল । নেহার শরীরটা আমার শরীরের উপরেই চলে এসেছে অনেকটা । বাসের ঝাকুনিতে সেটা নড়ছে ।

নেহা আমার পাশে বসে আছে । আমি জানি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমি ওর দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছি না । আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি ঐদিন কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করেছি সেটা আমি নিজে জানি । কিন্তু সেই সাথে আমি বুঝতে পেরেছি যে তোর প্রতি আমার অনুভূতি একেবারে বদলে গেছে নেহা । একেবারে । তোমাকে আমি আগে যেভাবে দেখতাম এখন চাইলেও সেভাবে দেখতে পারছি না । চোখের সামনে কত খেয়াল চলে আসছে বারবার । এরপরে আবারও যদি ঐ রকম পরিস্থিতি আসে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবো না নেহা । খারাপ কিছু হয়ে যাবে । তাই এর থেকে দুরে এসে এসেছি । আমাকে প্লিজ মাফ করে দিস তুই ।

নেহা আর কথা বলল না । সম্ভবত আমার কাছ থেকে এমন কথা সে আশা করে নি । দেখলাম হাত ছেড়ে দিল । তারপর একটু পরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । আমি যখন ঘুরে তাকালাম তখন নেহা দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছে ।

আমি আর কিছু ভাবতে চাইলাম না । মনের ভেতরে একটা কষ্ট হচ্ছে কেন জানি । নেহা আমার খুব কাছের মানুষ ছিল । এখনও আছে কিন্তু ছেলে মেয়ের এই দেয়ালের কাছে আমি না চাইলেও একটা ভাবনা চলে আসছে বারবার । এই আকর্ষণ আমি কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছি না । আর এই কারণেই আমাদের মাঝে একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে আপনা আপনি । নেহাকে আমি কোন ভাবেই কষ্ট দিতে চাই না । আমি কখনই চাই না আমি এমন কোন আচরণ করি যাতে নেহা কষ্ট পাক কিংবা আমার কোন খারাপ আচরণ আমাকে নেহার সামনে একটা পার্ভাট হিসাবে উপস্থান করুক । তাই নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারানোর আগেই ওর কাছে থেকে আমার দুরে সরে আসা উচিৎ । সেই কাজই আমি করলাম । জানি না নেহা আমাকে কী মনে করলো ।

আমি জানি আমার মত সেও কষ্ট পাবে । পাক একটু । অন্য কিছু যদি হয় তাহলে সে কষ্ট তো পাবেই, আমাকে সে ঘৃণাও করবে । এটা চাই না মোটেও আমি । আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুরু করলাম । কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি সেটা নিজেও জানি না । ঘুম ভেঙ্গে দেখি দুপুর হয়ে গেছে । ঘড়িতে আড়াইটার বেশি বাজে । একটু ক্ষুধা অনুভব করলাম ।

দরজা খুলে যখন ডাইনিং এ এলাম তখন অবাক হয়ে দেখতে পেলাম নেহা ডাইনিংয়ে খাবার সাজাচ্ছে । ওকে এখানে আমি দেখবো ভাবি নি । ভেবেছিলাম ও চলে গেছে । আমাকে দেখে নেহা আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলল, আন্টি আপনার গুনধর ছেলে উঠেছে । দিনের বেলা এতো ঘুম কেউ দেয় আমার জানা ছিল না । বাসার একটা কাজ করিস না । সারা দিন করিস কী তুই !
আম্মু রান্নাঘর থেকে বলল, তোমার আঙ্কেলও ঠিক একই স্বভাবের । এক গ্লাস পানি পর্যন্ত ঢেলে খায় না ।
-আমি হলে এদের ছেড়ে কবেই চলে যেতাম । আপনি বলে আছেন ।

আমি আসলে একটু অবাকই হয়েছি নেহার আচরণে । নেহা এর আগেও আমাদের বাসায় এসেছে । আম্মুর সাথে রান্না করেছে । দুপুরে খাওয়া দাওয়াও করেছে একসাথে । এটা একটা স্বাভাবিক আচরণ ওর জন্য কিন্তু আমার কাছ থেকে সব শোনার পরেও ও এমন স্বাভাবিক আচরন করবে সেটা আমি ভাবি নি ।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতেই সাড়ে তিনটা বেজে গেল । আম্মু খাওয়ার পরে একটু বিশ্রামের জন্য নিজের ঘরে গেলেন । নেহা আবারও আমার ঘরে এল । আমি আসলে কী বলব খুজে পেলাম না । ওর আচরণ আমাকে একটু দ্বিধান্বিত করে দিয়েছে ।

নেহা বলল, বস আমার সামনে ।
আমি কোন কথা না বলে বসলাম ওর সামনে । নেহা বলল, আমি বুঝতে পারছি তোর মনের অবস্থা । আমি সব সময় তোর কাছে সেইফ ফিল করেছি । শারীরিক এবং মানসিক দুই দিক থেকেই । আমার সব সময়ই মনে হয়েছে তোর কাছে কিছু বললে কিংবা তোর কাছাকাছি থাকলে আমি নিরাপদই থাকবো । অনেক ছেলেই এই বিশ্বাসটা ধরে রাখতে পারে না । কয়েক বছর আমাদের ক্যাম্পাসেই এমন ঘটনা ঘটেছিল । মনে আছে তোর?

আমার ঘটনাটা মনে আছে । আমি কেবল মাথা ঝাকালাম । নেহা বলল, তুইও কিন্তু ঐ রকম কিছু করতে পারতি । পারতি না? কিন্তু করিস নি । এই যে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নিয়েছিস তারপর সামনে এই রকম কিছু যাতে না হয় সেই জন্য দুরে চলে যেতে চাচ্ছিস, এমন মানুষ খুজে পাওয়া যায় না । আমি জানি আমার প্রতি তোর অনুভূতি একেবারে বাদলে গেছে । আমাকে তুই আর কেবল বন্ধুর চোখে দেখতে পারবি না কোন দিন । তাই না?
-হুম ।

নেহা একটু থামলো । তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তো বয়ফ্রেন্ড হবি আমার?

আমি একটা ধাক্কার মত খেলাম নেহার কথা শুনে । নেহা যে এমন কিচু বলতে পারে সেটা আমি ভাবতে পারি নি । আমি খানিকটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে । নেহা যেন আমার তাকিয়ে থাকা দেখে একটু মজাই পেল । আমার আরো একটু কাছে এসে বসলো । তারপর আমার হাত ধরে বলল, আমাদের মেয়েরা জানিস কোন জিনিসটা সবাই ফেস করি খুব বেশি !
-কোনটা?
-এই যে আমাদের বডি, দেহটা এটা ! সুযোগ পেলেই সবাই এর প্রতি অন্যায় করে । ভিড়ের ভেতরে দেখবি সুযোগ পেলেই মেয়েদের শরীরে হাত দেয় । খুব কম মানুষ রয়েছে এটা করে না । তুই যদি ঐদিন এই সুযোগটা নিতিস, সত্যি আমার কষ্ট লাগতো অনেক । এই যে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করেছিস, এটাতে তোর প্রতি আমার আকর্ষণ আরো বেজে গেছে অনেক অনেক বেশি । এখন আমার মনে হয়েছে যে নাহ, এই ছেলেকে কোন ভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না
তারপর নেহা আমার আর একটু কাছে এল । আমার ডান হাতটা নিজের দুই হাত দিয়ে ধরে কিছু সময় নাড়ানাড়ি করলো । তারপর সেটা নিজের ঠোঁটের কাছে নিয়ে মৃদু স্বরে চুমু খেল একটা । তাপর বলল, যে কোন কিছুর আগে অবশ্যই অনুমতি নিবি । ঠিক আছে ?
-চুমু খাওয়ার ক্ষেত্রেও!
নেহা আমার দিকে বলল, এখন প্রেমিক হতে পারিস নি এখন থেকে ডিমান্ড শুরু করা শুরু করে দিয়েছিস!
-সরি !
-হয়েছে তোর সরি । হ্যা সব ক্ষেত্রেই অনুমতি । মনে থাকে যেন । আর আাপতত কাউকেই জানানোর দরকার নেই । সময় মত আমিই জানাবো । ওকে !
-আচ্ছা ।
-আর এখন থেকে ভাববি যে আগের মত তোকে ছাড় দেব আমি ।

আমি সেটা জানি । এখন নেহা আর আমার কেবল বন্ধু নেই । সে আমার প্রেমিকা হয়ে গেছে । এখন তো অনেক কিছুই সে নিয়ন্ত্রন করবে । এটাই তো স্বাভাবিক ।

আমাদের গল্প নতুন করে শুরু হল, এখান থেকেই ।

একটা মানুষ এবং একটা পশুর ভেতরে পার্থক্য হচ্ছে যে কোন অবৈধ জিনিসের বেলায় মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে আর পশু পারে না । এই যে উপরের গল্প পড়লেন, প্রায় সব ক্ষেত্রেই এসব হয় না । এমন ভাবে গল্পের শেষ হয় না । গল্পের শেষ হয় বড় কুৎশিত ভাবে । বেশির ভাগ মানুষ তার ভেতরের পশুত্ব বিষর্জন দিতে পারে না । সময়ে সময়ে তা বের হয়ে আসে । এই জন্য এই ব্যাপারে সাবধান হওয়া ছাড়া আসলে আর কোন উপায় নেই ।

গল্পের লিংক সরাসরি পেতে হোয়াটসএপ গ্রুপ কিংবা টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন করুন । লিংক পাবেন এই ওয়েব সাইটের একদম নিচে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 50

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “সে এখন অন্য কেউ”

  1. Slight touch of eroticism. A light beginning of romance. Overall well written.

Comments are closed.