মোবাইল ফোন

oputanvir
4.8
(55)

লিনা খানিকটা অবাকই হয়ে গেল ইমনের প্রতিক্রিয়া দেখে । ইমন যে খুশি হবে সেটা লিনা জানতো কিন্তু ব্যাপারটা যে এমন ভাবে ওকে নাড়া দিবে সেটা লিনা সম্ভবত ভাবতে পারে নি । ইমনের হাতটা নিজের হাতের ভেতরে নিয়ে বলল, সামান্য একটা মোবাইলই তো, তাই না?
-সামান্য !
শব্দটা বলেই ইমন লিনার দিকে তাকালো । তারপর বলল, ১৮ হাজার টাকা অনেক টাকা । আয় করতে সময় লাগে কষ্ট লাগে । তোমার কতখানিক কষ্ট হয়েছে শুনি ।

লিনা হাসলো । কষ্ট একটু যে হয় নি তা নয় । কিন্তু কষ্টের পরে যে এই আনন্দটুকু পাওয়া গেল, প্রিয় মানুষটার মুখে হাসি ফোটানোর আনন্দ এটার দাম সব থেকে বেশি ।

লিনার বাসা থেকে ঢাকায় থাকা খাওয়া আর হত খরচ চালানোর মত টাকা ওর বাবা প্রতি মাসেই পাঠায় । তবে একেবারে বাবার উপর নির্ভরশীল না হয়ে লিনা নানান রকম কাজ কর্ম করে । এর একটা কাজ হচ্ছে প্রকাশনিতে কাজ করা । স্কুল কলেজের প্রশ্ন সমাধান করে দেওয়া । ম্যাথে ভাল হওয়ার কারণে এই কাজটা করতে লিনার খুব একটা কষ্ট হয় না ।

ইমনের সাথে ওর সম্পর্কে অনার্স থেকে ।অনার্সের এই সময়ে সবার মাঝেই টাকা আয়ের একটা চিন্তা কাজ করে । লিনা বেশ কিছু সময় ধরেই এই কাজ গুলো। ইমনের মোবাইলটা একদিন ভেঙ্গে গেল । তারপর থেকে ইমন বাটন ফোন ব্যবহার করতো । লিনার মনে হল যে একটা মোবাইল ওকে কিনে দিতেই পারে। তখনই এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে । প্রকাশনিতে গিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত এই কাজ গুলো করতো সে । মোটামুটি পনের দিন কাজ করে বিল আসলো ২০ হাজারের মত । সেটা দিয়েই মোবাইলটা কিনে দিলো ইমনকে । ইমন যে খুশি হবে সেটা সে আগে থেকেই জানতো কিন্তু এতো খুশি হবে সেটা ভাবতে পারে নি । ওর সব কষ্ট একেবারে ধুয়ে মুছে সেখানে কেবল আনন্দ দেখা দিল । প্রিয় মানুষটার জন্য কষ্ট করতে পারলেই আমাদের ভাল লাগে ।

এরপর থেকে ওদের সম্পর্ক যেন আরো একটু ভাল হয়ে গেল । ইমন যেন ওকে ছাড়া আর কিছু বুঝেই না । লিনা এটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারে । ওর নিজেরও ব্যাপারটা ভাল লাগে খুব । এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো । কিন্তু এরই মাঝে একটা ঝামেলা এসে হাজির হল । সেদিন ক্লাস শেষ করে ও হলের দিকে যাচ্ছে । এমন সময়ে একটা কালো রংয়ের গাড়ি ওর ঠিক সামনে এসে দাড়ালো । একটু অবাক হল ও । গাড়িওয়ালা পরিচিত মানুষ লিনার খুব একটা নেই । কাঁচটা খুলে গেল । সেখান থেকে একটা সুন্দরমত মেয়ে উকি দিল । ওর দিকে তাকিয়ে বলল, লিনা ?
লিনা আরো একটু অবাক হল । মেয়েটাকে সে কোন দিন দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না । এই মেয়ে ওকে কিভাবে চিনে?
লিনা বলল, জ্বী বলছি ।
-তোমার সাথে কয়েকটা কথা বলতে চাই ।
মেয়েটার কন্ঠে স্পষ্ট কর্তৃত্বের সুর । লিনার মেজাজটা একটু খারাপ হল বটে তবে কিছু বলল না । মেয়েটা কী বলতে চায় সেটা জানতে ইচ্ছে করছে ।
-জ্বী বলুন ।
-ভেতরে উঠে এসো ।
-জ্বী না ভেতরে যাবো না । আপনি বরং বাইরে আসুন ।

মেয়েটি কী যেন ভাবলো । তারপর নিজেই গাড়ি থেকে বের হয়ে এল । ওর ফুটপাতের এক কোনে গাছের ছায়ায় দাড়ালো ।
লিনা বলল, এবার বলুন কী বলবেন?
-তুমি ইমনকে চেনো তো !
ইমনের নামটা শুনে লিনার মনটা কেমন যেন করে উঠলো । এই মেয়েটা ইমনকে কিভাবে চেনে? মনটা মুহুর্তেই কেমন যেন কু ডেকে উঠলো ।
-হ্যা চিনি ।
-দেখো আমি জানি তোমার সাথে ওর কী সম্পর্কে । তুমি কি জানো সে কে?
-মানে ?
-মানে ইমন যা তোমাকে দেখাচ্ছে সে কিন্তু তা নয় ।
-আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না ।
-আমি সম্পর্কে ইমনের ভাবী হই । বড় ভাইয়ের বউ ।

লিনা খানিকটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । এই মেয়ের পোশাক আকাশ হাতে দামী ফোন গাড়ির সাথে ইমনকে সে ঠিক মেলাতে পারলো না ।
মেয়েটি আবার বলল, তোমার বিশ্বাস নাও হতে পারে তবে এটাই সত্যি আমাদের পরিবার এই দেশে সেরা ১০টা ধনী পরিবারের একটা । আশা করি বুঝতে পারছো যে তোমার অবস্থান আর ইমনের অবস্থান কোথায় ! দেখো আবেগ ভালোবাসা এক জিনিস আর বাস্তবা আলাদা জিনিস । প্রেম হয়তো চলবে কিন্তু ঘর সংসার অনেক বড় ব্যাপার । তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে ।

ইমনের ভাবী আর বেশি সময় থাকলো না । মোবাইল বের করে ইমনের পারিবারিক ছবি দেখালো । মেয়েটা যে মিথ্যা বলছে সেটা লিনার বুঝতে কষ্ট হল না । তাহলে ইমনে এই যে অভাবী থাকাটার ব্যাপারটা পুরোটাই অভিনয় । ওর সাথে কেবল টাইম পাস করছে ছেলেটা ! কান্না চলে এল লিনার ।

বিকেল বেলা জরূরী ভাবে ইমনকে ডেকে পাঠালো । তারপর সরাসরি সত্য জিজ্ঞেস করলো । লিনার খুব করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো যে ইমন বলে যে সব মিথ্যা । তবে ইমন সব স্বীকার করে নিল । পায়ের নিচটা যেন নড়ে উঠলো লিনার । ইমন অবশ্য ওকে বলার চেষ্টা করলো যে কেবল এই মিথ্যাটুকু সে বলেছে কিন্তু ওর প্রতি ভালোবাসা মোটেই মিথ্যা নয় কিন্তু লিনা আর কিছু শুনলো না । ওর কাছ থেকে দুরে চলে গেল ।

তারপর ইমনের সাথে একেবারে সব সম্পর্কে শেষ করে দিল সে । ইমনের কোন কথা সে শুনতে চায় না । ইমন অনেক দিন ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলো বটে কিন্তু লিনার মন গলল না কিছুতেই । তারপর একটা সময়ে ইমন হতাশ হয়ে সব বন্ধ করে দিল । অনার্স শেষ করে ইমন আর মাস্টার্স করলো না দেশে । দেশের বাইরে চলে গেল । খবরটা লিনা পেয়েছিলো । শেষবারের মত ইমন দেখা করতে এসেছিলো তবে লিনা আর দেখা করে নি ।

দুই

লিনা অফিসে এসেই বুঝলো যে কিছুটা একটা পরিবর্তন হয়েছে । সবার মাঝেই যেন একটা তাড়াহুড়ো আর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে । পাশের কলিগকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলো ব্যাপারটা । ওদের কোম্পানি নাকি বিক্রি হয়ে গেছে গতকাল । নতুন মালিক আজকে বিকেলে আসবে অফিস ভিজিটে । এই কারণেই সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা । নতুন মালিক মানেই চাকরি হারানোর একটা ভয় । ম্যানেজার সাহেবকে সব থেকে বেশি চিন্তিত দেখালো । লিনার অবশ্য খুব বেশি চিন্তা হল না । খুব বেশি দিন হয় নি সে এই অফিসে জয়েন করেছে । পড়াশোনা শেষ করে এখানে ঢুকেছে । এখানে সারা জীবন চাকরি করার ইচ্ছেও নেই ওর । এখনও বিসিএস দেওয়া বাকি ।

নতুন বস এলেন সন্ধ্যার কিছু আগ দিয়ে । সবার সাথে পরিচিত হলেন । এও জানালেন যে আগের অফিস যেমন চলছিলো তেমনই চলবে । যে যার জায়গাতে আছে সে জায়গাতেই থাকবে । কেবল একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে যে কিনা পুরো অফিসে আর তার ভেতরে যোগাযোগের মাধ্যম হবে । সে এই অফিসের ভেতর থেকেই নিয়োগ পাবে ।

এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই নতুন নিয়োগটা পেল লিনা । সবার থেকে লিনা বেশি অবাক হল । এমনটা হওয়ার কোন কথা ছিল না । লিনা যখন ধন্যবাদ দিতে নতুন বসের ঘরে ঢুকলো তখনও সে খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়েই আছে । ওকে এভাবে দ্বিধায় থাকতে দেখে নতুন বস হামিদুর রহমান বললেন, কিছু বলতে চাও লিনা?
লিনা মাথা ঝাকালো ।
হামিদুর রহমান হাসলেন । তারপর বললেন, বলে ফেলো। কো ভয় পেও না ।
লিনা একভাবে হামিদুর রহমানের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু সময় । তারপর হঠাৎ করেই লিনার মনে হল যে সে কারণটা জানে । যে প্রশ্নের উত্তর সে খুজছিলো সেটার উত্তর সে জানে ।

লিনা মাথা নিচু করে বলল, আপনি ইমনের বাবা?

হামিদুর রহমান হাসলেন । তারপর বললেন, তুমি আসলেই অনেক বুদ্ধিমতি মেয়ে ।
-আপনি কেবল আমার কারণে এই অফিস কিনেছেন!
-ঠিক তোমার কারণে নয় । ইমনের কারণে ।

ঘরে কিছু সময়ের জন্য অস্বস্তিকর নিরবতা নেমে এল । লিনা কী বলবে কিছুই খুজে পেল না । হামিদুর রহমান উঠে দাড়ালেন । জানালার কাছে গিয়ে কিছু সময় বাইরে দাড়িয়ে থাকলেন । তারপর বললেন, ইমন সব সময় চাইতো তার জীবনে এমন কেউ আসুক যে তাকে কেবল তার কারণে ভাল বাসবে । আমার টাকা পয়সার কারণে নয় । এই কারণে সে বাইরে পড়তে না গিয়ে ঢাবিতে ভর্তি হয়েছিলো । নিজের আসল পরিচয়টা লুকিয়ে । আসল পরিচয় বলতে তার বাবা যে বিরাট ধ্বনি এটা লুকিয়ে । তোমার সাথে তার পরিচয় হয় ভালোবাসা হয় ইমন তোমাকে পায় । সব কিছু ঠিক চলছিল তারপর তুমি কিভাবে জেনে গেল আমি জানি । কিন্তু ইমনকে ওভাবে ছেড়ে যাওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তোমার বল?

লিনা কিছু বলল না । এই ব্যাপারটা নিয়ে সে কত ভেবেছে । কোন উত্তর সে পায় নি । বারবার কেবল মনে হয়েছে ইমনের কথা গুলো ওর শোনা দরকার ছিল হয়তো !

হামিদুর রহমান বললেন, আমার ছেলেটা ভালো নেই লিনা । সত্যি ভাল নেই । তোমার পরে আর কাউকে সে ভালো বাসে নি । কাউকে না । আমার পুরো ব্যবসা সে এখন একা হাতে দেখে । কী অমানসিক পরিশ্রম যে সে করে যদি দেখতে । সকাল থেকে রাত । কেবল তোামকে ভোলার জন্য । এমন করে চলতে থাকলে ইমন হয়তো মারা যাবে ।

লিনা কী বলবে সেটা বুঝতে পারলো না । বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে । সেই অনুভূতিটা আবারও ফিরে আসছে । হামিদুর রহমান বললেন, আমি তোমাকে জোর করতে পারবো না । কেবল অনুরোধ করতে পারি । আর কিছুই না । তুমি ওকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিলে মনে আছে?
-জ্বী ।
-ফোনটা যে কত যত্ন করে ব্যবহার করে এখনও যদি দেখতে । একেবারে যক্ষের ধনের মত করে ।

পরিশিষ্টঃ

ইমন কোথাও নিজের ফোনটা খুজে পাচ্ছে না । একটু আগে সে ফোনটা রেখে গিয়েছিলো ওয়াশরুমে । তারপর ফিরে এসে আর পায় নি । সেক্রেটারি কামালকে ডেকে ফোন খুজতে বলল, কল দিতে বলল ।
-স্যার রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না ।
-খুজে বের করো জলদি ।
-জ্বী স্যার !

ইমনের মাথা গরম হয়ে গেল । ফোনটা কোন ভাবেই হারানো চলবে না । এতোদিনের যত্ন করে রাখা ফোন । কোন ভাবেই হারানো চলবে না ।

ইমনের মাথা গরম করে আবারও খুজতে শুরু করলো । তবে যদি মাথা ঠান্ডা করে দেখতো তাহলে দেখতে পেত একটা নতুন ফোন ঠিক ওর কোর্টের পকেটে রাখা আছে । ইমনের আগের ফোনটা যে কিনে দিয়েছিলো নিজের আয় দিয়ে, এই নতুন ফোনটাও সেই একই মানুষ কিনেছে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে । সেখানে একটা মেসেজও চলে এসেছে এরই মধ্যে । সেই মেসেজেই বলা আছে তার পুরানো ফোনটা এখন কোথায় আছে আর কার কাছে আছে ।
ইমন কখন যে মাথা ঠান্ডা করে নিজের কোর্টের পকেটে হাত দিবে সেটাই এখন দেখার বিষয় ।

গল্পের লিংক সরাসরি পেতে হোয়াটসএপ গ্রুপ কিংবা টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন করুন । লিংক পাবেন এই সাইটের নিচে । এছাড়া ইমেল সাবস্ক্রাইব করতে পারেন ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 55

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →