ভালোবাসা ফিরে আসে

oputanvir
4.8
(74)

-তাহলে বিয়ের বাজারে আপনার দাম তাহলে অনেক বেশি !

তন্বী ভেবেছিলো এই টিটকারি মূলক কথা শুনে সামনে বসা ভদ্রলোক সম্ভবত রেগে যাবে । এমন করেই কথাটা বলেছি তন্বী । তার লক্ষ্য আসলে লোকটাকে খানিকটা রাগিয়ে দেওয়া যাতে নিজ থেকেই সে বিয়ের ব্যাপারে মানা করে দেয় । তাহলে ঝামেলা শেষ হয় ।

পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বাসার লোকজন তার জন্য পাত্র দেখা শুরু করে দিয়েছে । আজকেও সেইটার অংশ হিসাবে এই বিসিএস ক্যাডারের সাথে আজকে দেখা করতে এসেছে । ছেলেটার বয়স ৩৪ । একটু বেশি সময় তবে দেখতে শুনতে খারাপ না । আর সাথে যখন বিসিএস ক্যাডার যুক্ত তখন পাত্র হিসাবে সেই ছেলে খারাপ হতেই পারে না । এমনটা সব মেয়েদের বাবা মায়ের ধারণা । তন্বীর বাবা মায়েরও সেই একই ধারণা ।

তন্বীকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই আকাশ হেসে উঠলো বেশ শব্দ করে । হাসতে হাসতেই বলল, ঠিকই বলেছেন। একেবারে জিনিসের দাম যেমন চড়া আমার মূল্যও তেমন চড়া ।

তারপর আবারও হাসতে লাগলো । সামনে কফির কাপটা ঠান্ডা হচ্ছে। তন্বী অন্য কিছু নিতে চেয়েছিলো তবে যখন ক্যাডার সাহেব দুটো কফির অর্ডার দিয়েই ফেলল তখন আর আলাদা ভাবে কিছু বলল না ।
তন্বী বলল, তা এতো দিন কেন বিয়ে করেন নি জানতে পারি?
-চাকরিই বছর খানেক ধরে । বয়স যখন শেষ তখন আসলে শেষবার চেষ্টা করেছিলাম । তখন ভাগ্য সহায় হল বলতে পারেন ।
-তাও বছর তিনেক আগের কথা । তাই না ?
-হ্যা সেটা বলতে পারেন ।
-তাহলে বিয়ে করেন নি কেন শুনি? মনের মত পাত্রী পাচ্ছেন না? নাকি যোগ্যপাত্রী মিলছে না !
এই প্রশ্নটার জবাব সাথে সাথেই দিল আকাশ । তন্বী খেয়াল করলো যে হাস্যজ্বল চেহারাটা যেন একটু মহিল হয়ে গেল । তবে সেটা কাটিয়ে উঠলো সাথে সাথেই । বলল, আমার আসলে কোন ডিমান্ড নেই । তবে আমার মায়ের চাহিদার কোন শেষ নেই । হাজার হোক তার ছেলে ক্যাডার । তার চাহিদা অনেক ।

তন্বীর কেন জানি মনে হল ছেলেটা মিথ্যা বলল । তন্বীর মনে একটা দ্বিধা কাজ করতে শুরু করলো তখনই । এই বেশি বয়সের ছেলেকে বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ছিল না । কিভাবে বিয়েটা না করা যায় সেটায় ভাবছিল সে । তবে আকাশের সাথে কথা বলে তন্বীর মনে হল যে এই ছেলেটাও আসলে বিয়ে করতে চায় না । যতই বাছাবাছি করুক না কেন এই দেশে বিসিএস ক্যাডারদের বিয়ে হতে সময় লাগে না । তাহলে এই ছেলে কেন বিয়ে করে নি !

তন্বী বলল, আমি আমাকে সত্যি কথাটা বলতে পারেন । আপনার মত আমিও আসলে বিয়ে করতে চাই না এখন !

আকাশ চট করে তাকালো তন্বীর দিকে । পাত্রী দেখতে এসেছে এমন কথা আকাশ শোনেনি একবারও । এর আগে যে মেয়েদের সে বাতিল করেছে তাদের বসাই বিয়েতে একেবারে এক পায়ে খাড়া ছিল । একটা মেয়ে সবে মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো সেও রাজি ছিল এক পায়ে । এই মেয়েটা অন্য রকম । এই মেয়েটাকে বলবে কিনা কথাটা ! বলাই যায় অবশ্য ! আজকের পরে আরতো দেখা হবে না এর সাথে । একটু জানলেই বা কি !

আকাশ বলল, আসলে আপনি ঠিকই ধরেছেন । একটু আগে বললেন না যে মনের মত পাত্রী পাচ্ছি না । আমি আসলেই মনের মত পাত্রী পাচ্ছি না । আরো ভাল করে বললে কোন পাবোও না ।
খানিকটা কৌতুহলী হয়ে তন্বী বলল, কোনদিন পাবেন না, এতো নিশ্চিত হয়ে কেন বলছেন?
একটু কষ্টের হাসি হেসে আকাশ বলল, নিশ্চিত করে বলছি কারণ আমার মনের মত মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে । সে আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই ।

তন্বীর হঠাৎ কেমন যেন একটা ধাক্কার মত লাগলো । বিশেষ এই লাইনটা বলতে গিয়ে আকাশের কন্ঠটা কেমন কেঁপে উঠলো । এই কাঁপনে যে বিষাদ ছিল সেটা তন্বীকে স্পর্শ করলো । আকাশ বলল, নিশি জানেন আমার সাথে পালিয়ে পর্যন্ত বিয়ে করতে চেয়েছিলো । বলেছিলো ওকে কিছু দিতে হবে না । আমি যা খাবো সেও তাই খাবে । দরকার হলে না খেয়ে থাকবে । আমার তখন কোন উপায় ছিল না । কত জনের হাতে পায়ে ধরেছি, কিছুই হয় নি । বাসায় মা বাবাকে কত রাজি করাতে চেয়েছি ! হয় নি কিছুই । তারপরেও সাহস করে বিয়ের দিন আমরা পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম । তবে বাসায় ধরা পরে যায় ও । বিয়ে হয়ে যায় ওর !

এই টুকু বলেই আকাশ থামলো । সম্ভবত নিজেকে খানিকটা সামলে নিচ্ছে সে । তন্বী একেবারে বাক্য হারা হয়ে গেছে । বিশেষ করে এভাবে অকপটে ওর কাছে আকাশ সাহেব সব কিছু স্বীকার করে নিবে সেটা সে ভাবে নি । আকাশ কিছুটা বিরতির পরে বলল, এরপরে আসলে আমি আর কোন মেয়েকেই মনে জায়গা দিতে পারি নি । চেষ্টা করেও পারি নি । ভেবেছিলাম পুরুষ মানুষের মন, নতুন কাউকে কাছে নিয়ে এলে আগের জনকে ভুলে যাবো । এই ভেবে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম । একজনের সাথে প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিলো বিয়ে । বিয়ের দিন সাতেক আগে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পাত্রীপক্ষে মানা করে দিলাম । বাসায় বাবা মা খুব চেঁচামেচি করলো । জানেন সেদিন ভয়ংকর ভাবে আমি আমার বাবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম । আমার বেকার থাকা অবস্থায় তাদের দেওয়া প্রতিটা খোটা তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলাম । তারপর থেকে তারা অবশ্য আর উচ্চবাচ্চ করে না । আমি যদি বিয়ের জন্য মানা করে দিই বলি যে পছন্দ হয় নি তারপর আর কোন কথা বলে না । নতুন কাউকে নিয়ে আসে !

হঠাৎ করেই যেন কথা ফুরিয়ে গেল দুজনের । কেউ কোন কথা বলল না কিছু সময় । তন্বী ঠান্ডা কফিতেই চুমুক দিলো কয়েকটা । তারপর বলল, এভাবেই চলবে?
-জানি না আসলে !
-একলা জীবন কি চলে বলুন?
-চলে যাবে আশা করি ।

তারপর একটু হেসে বলল, আপনি কেন বিয়ে করতে চাননা শুনি । পড়াশোনা শেষ । এখন তো বিয়ের বয়স !
-আমি আসলে নিজের পায়ে না দাড়িয়ে কিছু করতে চাই না । বরের কথায় ওঠা বসা আমার পক্ষে সম্ভব না ।

যাওয়ার সময় হল । যাওয়ার সময় আকাশ বলল, আই উইস ইউ বেস্ট অব লাক মিস তন্বী । আশা করি আমার মত জীবন যাতে আপনার না হয় !

তন্বী বসে রইলো । আকাশকে চলে যেতে দেখলো । আরেকটা কফির অর্ডার দিল সে । কফি যদিও তার পছন্দ না তারপরেও সেখানেই বসে কফিটা শেষ করলো তন্বী । ওর মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে । না চেনা সেই নিশিকে কেন জানি তন্বীর বড় ঈর্ষা হল । তন্বীর মনে একটা আফসোস জন্ম নিল যে, ইস! এমন ভাবে কেউ যদি তাকে ভালোবাসতো !

কফি শেষ করেও কিছু সময় ঘোরাঘুরি করলো ওর । বাসায় যখন ফিরলো তখন বেশ রাত হয়ে গেছে । বাসায় মায়ের চেহারা দেখেই বুঝতে পারলো যে আকাশদের বাসা থেকে খবর চলে এসেছে । সে কিছুই বলল না । ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল । কেন জানি ওর মন খারাপ হল । অথচ সে মনে প্রাণে চেয়েছিল যাতে বিয়েটা না হোক । এখন সেই বিয়ে না হওয়াতেই তার মন খারাপ হচ্ছে ! বারবার মনে হতে লাগলো যে এমন একজনের সাথে বিয়ে হলে খুব কি খারাপ হত !
তবে প্রথম কয়েকদিন মন খারাপ রইলো বটে । এক সময়ে আকাশ নামের মানুষটা তন্বীর জীবন থেকে হারিয়ে গেল ।

তিন বছর তন্বী সেই সরকারি বিসিএস পাশ করে প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকলো । প্রথম পোস্টিং সুখন পুরে । সেখানেই জয়েন করলো সে । সরকারি কোয়াটার দেওয়া হল । ওর কোয়াটারের ঠিক পাশেই টিএনওর বাসা । সেদিন বিকেলে নিজ থেকেই টিউএনওর বাসায় গিয়ে হাজির হল সে ।

জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই আকাশ নামের মানুষটার সাথে আবারও দেখা হয়ে সেখানে । আকাশ প্রথমে তাকে ঠিক চিনতে পারে নি । তবে কিছু সময় পরেই চিনতে পারলো । এবং তন্বী তখনই আবিস্কার করলো আকাশ তখনও বিয়ে করে নি । এই বাসায় সে তার বাবা মায়ের সাথে থাকে ।

-আপনি এখনও বিয়ে করেন নি?
আকাশ হেসে বলল এমনই তো হওয়ার কথা ছিল তাই না !

তন্বীর মনে সেই আফসোস টা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো । বারবার কেবল মনে হতে লাগলো যে ইস এমন করে কেউ যদি তাকে ভালোবাসতো ! একই জেলায় কর্মস্থল থাকার কারণে তন্বীর সাথে আকাশের দেখা হত প্রায়ই । কাছাকাছি বাসা হওয়ার জন্য আকাশের বাসায় যাওয়া হত । বিশেষ করে তন্বীর মা যখন তার কাছে থাকতে এল তখন আকাশের মায়ের সাথে তার বেশ ভাব জমে গেল। এবং তারা আবারও উদ্যোগী হল । এবং এইবার স্বয়ং তন্বীর নিজেরও ইচ্ছে রয়েছে সেখানে ।

তন্বীর মনের ভাব বুঝতে কারোই কষ্ট হল না । আকাশও বুঝতে পারলো । তখন জানতে চাইলো, আপনি কেন এমন টা চাচ্ছেন ? বিশেষ করে এমন একজন মানুষকে বিয়ে করতে চাইছেন যে কিনা কোন দিন আপনাকে ভালোবাসবে না । এটা জেনেও রাজি কেন হচ্ছেন?

তন্বী কী উত্তর দিবে সেটা নিজেই বুঝলো না । কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, ইটস ওকে !
-কী ইটস ওকে !
-ওকে যে আপনি ভালোবাসবেন না । কেবল আমাকে তো ভালোবাসতে দিন ! আপনার সাথে যখন আপার প্রথম দেখা হয় তখন আমার মনে হয়েছিলো যে এই ছেলেকে আমি কোন ভাবেই বিয়ে করবো না ।
-এটাই স্বাভাবিক ছিল ।
-কিন্তু আমি নিজের ভেতরে আবিস্কার করি যে আপনার প্রেমে পড়েছি আমি । তবুও আমি মেনেই নিয়েছিলাম । নিজের মনের সাথে সমঝতা করে নিয়েছিলাম । ঠিক যেমন করে আপনি নিজের জীবনের সাথে মানিয়ে নিয়েছেন তেমন করে । কিন্তু দেখুন দেখুন ৬৪টা জেলা রয়েছে আর আপনার এখানেই আমার পোস্টিং হতে হল ! আই ওয়ান্ট টু গিভ আস এ চান্স ! আমার কোন অভিযোগ থাকবে না যদি আপনি আমাকে ভালো না বাসেন । কিন্তু আমার মন বলছে যদি বিয়ে হয় তাহলে আমরা অখুশী হব না । ট্রাই করবেন প্লিজ?

আকাশ তন্বীর কন্ঠের আকুলতা টের পেল খুব ভাল ভাবেই । নিশি ঠিক একই ভাবেই ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো । দেখবে কি একবার চেষ্টা করে? নতুন করে কাউকে ভালোবাসা কি সম্ভব হবে !!

পরিশিষ্টঃ

আকাশ যখন বাসর ঘরে ঢুকলো তখন চারিদিকের কোলাহল থেকে গেছে । কোন আয়জন করবে করবে না করেও অনেক কিছু করা হয়েছে । টিএনওর বিয়ে হয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে । একাবারে সরকারি বিয়ে যাকে বলে । জেলার ডিসি খবরটা শুনে তো খুবই খুশি । সে নিজেই সকল ব্যবস্থা করলো ।

বাসর ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল তন্বী খাটের উপর বসে রয়েছে । তবে মাথায় ঘোমটা নেই । মোবাইল টিপছে । ওকে ঢুকতে দেখেই মোবাইলটা একপাশে সরিয়ে রাখলো । আকাশ কী যে বলবে খুজে পেল । এমন দিন সে আসবে তার জীবনে সে কোন দিন ভাবে নি । অথচ এসেছে । অন্য একটা মেয়ের সাথে যে কিনা তাকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ছিল ।
এখনও তন্বীর চোখে তার জন্য ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে আকাশ । এই ভালোবাসা সে চিনতে পারে ! কিন্তু সে কি পারবে একই ভাবে ভালোবাসতে ! নয়তো মেয়েটার সাথে তো প্রতারণা করা হবে !

আকাশ খাটের উপর বসলো । তারপর বলল, খুব ধকল গেল সারা দিনে !

তন্বী হেসে ফেলল । তারপর বলল বউকে অন্য কথা বল । বল যে তোমাকে দেখতে আজকে সুন্দর লাগছে ।
আকাশ হাসলো । বলল, তুমি দেখতে এমনই সুন্দর । প্রতিদিনই সুন্দর লাগে !
-যাক এটা শুনে তো ভাল লাগলো !

এরপর তন্বী নিজ থেকেই আকাশের কাছে এল । তারপর ওর হাত ধরে বলল, লেটস ট্রাই ইট ! কেমন !
-ওকে !

তন্বী আর আকাশের জীবনের চলার পথটা আবারও এক সাথে এসে মিশে গেছে । একসাথে তাদের পথ চলা হবে আরও অনেকটা দুরে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 74

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →