মানুষ যখন কোন কথা দেয় কাউকে তখন সে একটা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় । আমার কথাই যদি ধরেন একেবারে যখন স্কুলে পড়তাম, তখন আমার একটা প্রেমিকা ছিল । মফস্বল শহরের প্রেম । লুকিয়ে চুকিয়ে প্রেম করতে হত ! কত স্বপ্ন এসে জড় হত মনে । আমাদের তখন অনেক কিছুই করা সম্ভব ছিল না । আমাদের দুই জনেরই তখন অনেক সীমাবদ্ধতা তবে স্বপ্ন তো আর সীমাবদ্ধতা দেখে না । সে কেবল পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় । আমাদের দুইজনের তখন সমুদ্র দেখার খুব শখ । দুইজন দেখবো সমুদ্র । তখন প্রেমে ছিলাম, বোকা ছিলাম । তাই একদিন আবেগের বসে তাকে প্রতিজ্ঞা করে বসলাম যে জীবনে তাকে ছাড়া সমুদ্র দেখবো না ।
তখন আসলে এই স্বপ্ন ছিল জীবনে তাকেই বিয়ে করবো, তার হাত ধরেই সমুদ্র দেখবো । এসব ছাড়া অন্য কোন চিন্তা তখন মাথায় ছিল না ।
কিন্তু বছর না ঘুরতেই প্রেম ভেঙ্গে গেল । এসএসসি পরীক্ষার পরে আমরা অন্য শহরে চলে গেলাম । আমাদের মাঝে যে আবেগ ছিল তা একেবারে কেটে গেল । কিন্তু তাকে দেওয়া কথাটা গলাতে আটকে রইলো আমার । কলেজে থাকা কালীন সময়ে কলেজ থেকে স্টাডি ট্যুরে আমাদের কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার প্লান হল । ক্লাসের প্রায় সবাই সেখানে গেল । আমি গেলাম না । যেতে পারলাম না । আমার মনের ভেতরে কেবল সেই কথাই কাজ করছিলো যে তাকে কথা দিয়েছিলাম । আমার দেওয়া সেই কথা আমার গলাতে আটকে রইলো । এমন কি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখনও আমি যেতে পারি নি সমুদ্র দেখতে । আমাদের মাঝে কিছু ছিল না, কোন আবেগ কোন ভালোবাসা ছিল না অথচ আমি সেই কথা দেওয়া থেকে মুক্ত করতে পারছিলাম না নিজেকে ।
তাকে ছাড়া সমুদ্র দেখবো না !
এই কারণে আবেগের বসে কখনই কাউকে কোন কথা দিতে নেই । জ্ঞানী গুণীরা বলেন যখন আপনি খুব আনন্দিত থাকবেন তখন কাউকে কোন কথা দিবেন না । পরে এর ফল বিপরীত হতে পারে । এই কারণে কথা দিতে হয় ভেবে চিন্তে । নাজিয়া কি আমাকে ভেবেচিন্তে কথা দিয়েছিল ?
আমার তা মনে হয় না । সে আমাকে কথা ছিল নিজের আবেগের কারণে । সেই আবেগ এতো দিনে জীবিত থাকার কথা না । ধুয়ে মুছে চলে যাওয়ার কথা । আমিও তো কথা দিয়েছিলাম যে আমি আসবো । সেই জন্যই তো এসেছি । যদিও নাজিয়া স্পষ্ট করেই বলেছিল যে এই সময়ের মাঝে আমি চাইলে বিয়ে শাদী করে একেবারে ঘরসংসারি হয়ে যেতে পারি । কেবল আমি যেন আসি, এই অনুরোধ করেছিলো ।
আচ্ছা চাইলেই তো বিয়ে করে ফেলতে পারতাম !
নিজেকে আমি অনেক বারই এই প্রশ্ন করেছি । বাসা থেকে কতবার যে চাপ দেওয়া হয়েছে বিয়ের জন্য কিন্তু আমি করি নি । আমি আসলে করতে পারি নি । যদিও আমার মনে একটা ধারণা ছিল যে নাজিয়ার আবেগ থাকবে না । তারপরেও মনের সুক্ষ একটা ইচ্ছে বারবার কেবল এই মনে হয়েছে যদি থাকে ! যদি মেয়েটা সত্যি সত্যি অপেক্ষা করে থাকে ! এবং ফিরে এসে যদি দেখে আমি বিয়ে করে ফেলেছি তখন তার মনের ভাবটা কেমন হবে !
এটা আমি ভাবতেই পারি নি । এমন একটা দৃশ্য আমি নিতে পারি নি । নাজিয়ার সেই গোলগাল মুখে আমাকে না পাওয়ার কষ্টের ভাবটা কেমন হবে সেটা আমি কল্পনা করতেও সাহস করি নি । অথবা আমার মনের ভেতরেও একটা চাওয়া ছিল যে মেয়েটা আমার জন্য অপেক্ষা করুক । আমাকে পাগলের মত ভালবাসুক !
এই ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খা মানুষের চিরোজীবনের । মানুষ আসলে যতই নিজেকে রাফ এন্ড টাফ দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন এমনি সত্যি সত্যি যে যদি নির্দয়ই হয় তারপরেও তার মনের কোন কোন অংশ এই নিখাত ভালোবাসার জন্য একটা আকাঙ্খা থাকে । এটা সবার মাঝেই থাকে । আমি যদি বলি যে আমার মাঝে এটা নেই তাহলে সেটা মিথ্যা বলা হবে কোন সন্দেহ নেই ।
টুং আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো । মেসেজ এসেছে ।
মোবাইলটা বের করলাম । রাহা মেসেজ দিয়েছে । ”কী জনাব, তোমার নায়িকা এসেছে?”’
আমি একটু অবাক হলাম মেসেজটা দেখে ! রাহা নিজেও যে এই দিনটার কথা মনে রাখবে সেটা ভাবি নি ।
আমার বিয়ে না করার কারণটা বাসা কিংবা বন্ধুবান্দবদের সবাই ঠিক না জানলেও রাহা জানে । মেয়েটার সাথে আমার মাঝে বেশ কিছু দিন কথা হত নিয়মিত । মেয়েটার আগ্রহ থেকেই । রাহা তখন আমাদের অফিসে চাকরি করতো । দরকারে অদরকারে মেয়েটা নিজ থেকে এসে কথা বলতো । আমার সাথে ওর ভাব হওয়ার একটা কারণ ছিল যে ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমি কখনই ওকে জাজ করি নি, যা অফিসের অনেকেই করতো । রাহার আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো । তবে সেটা টেকে নি । আমাদের সমাজে ডিভোর্সী একটা মেয়েকে সবাই এমনিতেই বাঁকা চোখে দেখে । কিন্তু আমার আচরণে সেটা আমি কোন দিন প্রকাশ করি নি । এটাতে আমার কিছু যায় আসে না যে কে বিয়ে করেছে কার ডিভোর্স হয়েছে ! এই কারণেই সম্ভবত রাহা আমাকে আরো বেশি পছন্দ করতো ।
আমাদের চেনা জানা কেবল অফিস নয়, অফিসের বাইরেও বাড়তে লাগলো । টুকটাক গল্প থেকে ডিনার কিংবা মুভি দেখা চলতে লাগলো । বছর খানেকের মাথায় রাহা নিজ থেকেই আমাকে নিজের মনের কথা বলল যা আমি সবিনয়েই প্রত্যাখান করলাম । কারণ জানতে চাইলে ওকে পুরো গল্পটাই বলে দিলাম ! সব শুনে আমার দিকে কিছু সময় অবাক হয়ে থেকে বলল, নাজিয়া আসবে বলে তোমার মনে হয় ?
-সম্ভবনা বেশি যে আসবে না । আবেগ চলে যাবে!
-তারপরেও অপেক্ষা করবে?
-কথা দিয়েছি যে !
-মাঝে মাঝে এই সব দেখলে মনের ভেতরে অনুভূতি হয় । এমন মানুষও থাকে জগতে !
তারপরেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল । তবে আমি বুঝতে পারতাম যে রাহা খানিকটা যেন চুপছে গেছে । তার মাস ছয়েক পরে সে অন্য কোম্পানিতে চলে যায় চাকরি নিয়ে । যোগাযোগও কমে যায় আস্তে আস্তে । তবে সেটা একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি । আজকে রাহার মেসেজ পেয়ে অবাক হলাম তাই । ফিরতি মেসেজে লিখলাম, না আসে নি ।
-কত সময় ধরে বসে আছো?
-এই ঘন্টা খানেক !
-কত সময় থাকবে!
-দেখি কত সময় থাকা যায় !
-আচ্চা আামকে জানিও কেমন! আমি খুব করে চাই নাজিয়া যেন আসুক । তবে যদি না আসে তবুও কিন্তু আমি খুশিই হব !
রাহা কেন কথাটা বলল আমি জানি । আমি আর কথা বাড়ালাম না । মোবাইলটা রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম !
সামনের বাড়িটাতে নাজিয়ের সেই এক্স থাকে । মানে তখন থাকতো । এখনও থাকে কিনা কে জানে । সরকারি কোয়াটার এটা । হয়তো ওর বাবা বদলি হয়ে গেছে । সেই ছেলেও চলে গেছে । আজকে আমি এখানে বসে আছি এটার পেছনে ঐ ছেলের একটা বড় হাত রয়েছে ।যদি সে নাজিয়ার সাথে প্রতারণা না করতো তাহলে সেদিন নাজিয়া কখনই আমার সাথে কথা বলতো না কিংবা আমাকে তার বয়ফ্রেন্ড হতেও বলতো না । আমাদের মাঝে কোন পরিচয়ও হত না । বেটা ধরে একটা মাইর দিতে পারলে ভাল হত !
আমি বসে বসে আরো কত কিছু ভাবতে লাগলাম । আমার মস্তিস্ক বারবার বলছে নাজিয়া আসবে না আসলে । তার এখন এখানে আসার কোন মানে নেই, কিন্তু একই সাথে আমার মন চাচ্ছে যেন নাজিয়া অবশ্যই আসুক । তবে একটা সময়ে আমি বুঝতে পারলাম যে নাজিয়া আর আসবে না । ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা বাজে । আমাদের আসার কথা ছিল সন্ধ্যার সময়ে । আমি বিকেল থেকে এখানে অপেক্ষা করছিলাম । আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম যে রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে । এই রাস্তায় অনেক খাবারের দোকান বসে । অনেকেই এখানে খেতে আসে । সন্ধ্যার দিকে তাই এই রাস্তা বেশ জমজমাট থাকে । কিন্তু এখন একেবারে নির্জন হয়ে গেছে । শেষ কার্ট দোকানটা তাদের কার্ট বন্ধ করে দিয়েছে ।
আমি আরো কিছু সময় অপেক্ষা করে রইলাম । এখন ছেড়ে চলে যেতে আমার ইচ্ছে করছিলো না কিছুতেই । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো যে আমি চলে যাবো আর ঠিক সেই সময়েই নাজিয়া আসবে । আমাকে না পেয়ে মেয়েটা মন খারাপ করবে !
কী অদ্ভুত একটা মনভাব । নাজিয়া যে আসে নি কিংবা আসবে না এটা কিন্তু আমি জানতাম অনেক আগে থেকেই কিন্তু নিজের মনের কাছেই আমি এই সত্যটা মেনে নিতে প্রস্তুত নই । তাই বারবার কেবল অপেক্ষা করেই রয়েছে !
তবে একটা সময়ে আমি বাধ্য হলাম উঠে পড়তে । রাত বারোটা বেজে গেছে । আর এখানে বসে থাকা যাবে না । মোাবাইলে রাহাকে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠালাম ।
সে আসে নি ।
মেসেজটা সীন হল কিন্তু রিপ্লাই এলো না । আমিও আর সেটার জন্য অপেক্ষা না করে মোবাইলটা পকেটে ভরলাম । তারপর উঠে দাড়ালাম । সাইকেল নিয়ে এসেছিলাম মনে করে । বাসায় যাওয়ার জন্য তাই অন্য যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না ।
আমি সাইকেল নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম ।
কিন্তু অদ্ভুত একটা কাজ করলাম একটু পরেই । রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে আবারও সাইকেলটা ঘোরালাম । মনে হল শেষ বারের মত দেখে যাই যে নাজিয়া এসেছে কিনা যদিও জানি যে সে আসবে না !
কিন্তু যখন আমি আবার আগের জায়গাতে এলাম তখন তীব্র একটা বিস্ময় নিয়ে দেখলাম যে সেখানে সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন বসে আছে । আমি কেবল অনুভব করতে পারছিলাম যে আমার বুকের ভেতরটা তীব্র ভাবে কাঁপতে শুরু করেছে ।
আমি কি স্বপ্ন দেখছি ?
নাকি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে !
আমি যখন নাজিয়ার সামনে গিয়ে দাড়ালাম নাজিয়া আমার দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, একটু সময় হবে আপনার?
-কত সময়?
-এই ধরুন সারা জীবন ! হবে?
পরিশিষ্টঃ
আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে নাজিয়াদের বাসা আসলে এখানেই । নাজিয়া চলে এসেছিল অনেক আগেই । আমাকে সে অপেক্ষা করতে দেখেছিলো । আমি যখন জানতে চাইলাম যে আমাকে এতো সময়ে বসিয়ে কেন রাখলে শুনি?
নাজিয়া হেসে বলল, আপনি আমাকে চার বছর অপেক্ষা করালেন আমি সামান্য এই টুকু অপেক্ষা করাতে পারবো না?
কেন জানি আমার রাগ হল না । মনে হল যে ঠিকই তো আছে ওর যুক্তি । আমি সাইকেলটা রেখে ওর পাশে বসলাম । তারপর বললাম, আমি যখন সাইকেল নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম তখনও আসতে পারতে !
নাজিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানতাম যে আরেকবার ফিরে আসবেনই ! আমার মন বলছিলো । তাই ডাকি নি ।
-যদি না আসতাম তাহলে?
-ফোন করতাম । ফোন করে বলতাম ফিরে আসতে !
-আমার নম্বর তোমার কাছে আছে?
-জনাব, কেবল আপনার নম্বরই না, আপনার ১৪ গোষ্ঠীর সব নাড়ি নক্ষত্র আমি জানি । বুঝেছেন, এমন কি ঐ বদ মেয়েটার সাথে ঘোরাঘুরি করেছেন সেটাও আমি জানি !
আমি খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম নাজিয়ার দিকে । নাজিয়া বলল, এবার কি বিশ্বাস হয়েছে যে আমার ভালোবাসা কেবল ছেলেমানষী আবেগ নয় ! নাকি আরো কোন পরীক্ষা দিতে হবে!
-বিশ্বাস হয়েছে ।
-গুড । এখন কালকেই আমাদের বিয়ে হবে ।
-কালকেই?
-হ্যা । আমার মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হবে এই মাসের দশ তারিখে । আমি ফ্লাইট পরশুদিন। কাল বিয়ে । কোন কথা শুনবো না । অনেক কষ্ট দিয়েছেন । আর না ।
মেয়েটা সব কিছু ফেলে কেবল আমার জন্য দেশে এসেছে । আমি আর কোন কথা কোন অযুহাত দেওয়া ঠিক হবে না মোটেও ।
গল্পের লিংক সরাসরি পেতে হোয়াটসএপ গ্রুপ কিংবা টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন করুন । লিংক পাবেন এই সাইটের একেবারে নিচে।
Thanks for concluding the story.
আসলে আপনার মন্তব্যের কারণেই এই পর্ব আমি লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলাম । নয়তো লিখতাম না ।
এই সব মিথ্যে গল্প
অবশ্যই এই সব মিথ্যা গল্প । এখানকার সব গল্পই মিথ্যা ।